'
বেশ অনেকটা দূর থেকে চোখে পড়া সত্ত্বেও নীরাকে চিনতে খুব একটা কষ্ট হলো না। ঠিক কত বছর পর দেখছি তা ভাবতে গেলে হিসেব কষতে হবে। হিসেব নিকেশে আমার আবার আজন্মই আলস্য আর অনীহা ।
নীরা এই মুহুর্তে আমার বরাবর ঠিক রাস্তার ওপর প্রান্তে দাড়িয়ে। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমিই অবশ্য উল্টো পথে এতদূর হেটে এসেছি। শুধু একটু কাছ থেকে দেখবো বলে। এত বছরেও ওর মধ্যে খুব একটা পরিবর্তন এসেছে বলে ধরতে পারছি না৷ কোকড়াচুল গুলো আগের মতোই বিনুনি করা কাধের একপাশ জুড়ে। হালকা রঙের মলিন সুতি শাড়ি। আর সাথে সেই তীক্ষ্ণ চোখ আর চাহুনি৷ এই চাহুনিতেই তো ম'রে ছিলাম সহস্র কোটি বার। আচ্ছা আজ কি আবার মর'ছি? তাছাড়া এই ব্যাস্ত নগরীর ব্যাস্ত পথে কেন আমি থমকে আছি, কেন আমার সময় থমকে আছে! বুকের ভেতর অসম্ভব স্থিরতা৷ সব কিছু কি থেমে গেছে?
নীরার তীক্ষ্ণ চাহুনি খুব সম্ভবত এখনো আমার ওপর পড়ে নি। কিংবা কে জানে সে হয়ত আমায় চিনতে পারে নি৷ নীরা আগের মতো থাকলেও আমার শরীরে মধ্য বয়সের ছাপ পড়েছে , চোখে মোটা লেন্সের চশমা যোগ হয়েছে, স্কুল ইউনিফর্মের বদলে স্যুট টাই হয়েছে, কাধে বইয়ের ব্যাগের বদলে অফিসের ল্যাপটপ ব্যাগ৷
নীরার চোখ তখনও অন্য কিছুতে ব্যস্ত। খুব সম্ভবত কাউকে খুজতে ব্যাস্ত৷
ইচ্ছে হল একবার অন্তত একটা বার ডাকি,
" নীরা!"
" নীরা তুমি কেমন আছো?!"
" এখনো কি কবিতার বইগুলো জমিয়ে রেখেছ?"
" আমার দেয়া শেষ কবিতার বইটার ৩৭ নম্বর পাতাটা খুলে দেখেছিলে কি কখনো? "
'
এর মাঝে নীরা নিজেই হঠাৎ আমার ভাবনার অবসান ঘটালো। রাস্তার ওপার থেকেই হাত নাড়িয়ে উচ্চারণ করল,
" রাফাত না?"
" এই রাফাত!"
'
নীরার মুখে এই বছর পর নিজের নাম শুনে হঠাৎ করে থমকে যাওয়া শরীরে তীব্র গতি ফিরে পেলাম৷ ওর ডাক উপেক্ষা করেই সোজা আবার হাটতে শুরু করলাম৷
'
" এই রাফাত শোনো তো৷ "
এবার ডাকটা খুব কাছ থেকে শুনতে পেলাম৷ নীরা এতক্ষণে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে আমার ঠিক পেছনে এসে দাড়িয়েছে৷ আমি তবুও না শোনার ভান করে হাটছি।
'
এবার নীরা একেবারে হাত হাত ধরে ফেলেছে৷ হাত ঝাকিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিরক্তি নিয়ে কতগুলো কথা এক নাগাড়ে বলে গেল,
" কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাও না? চোখে এত মোটা চশমা লাগিয়েছো দেখছি, তাও দেখতে পাও না? আমি নীরা আমায় চিনতে পেরেছো?"
'
আমি মিথ্যা হাসির চেষ্টা করলাম৷ বললাম,
" খেয়ালই করি নি। এত ব্যাস্ত থাকি আজকাল! তারপর বলো কেমন আছো? "
নীরা আগের মতোই প্রানোচ্ছলতা নিয়ে হাসলো।
" খুব ভালো আছি। "
" তা, থাকো কোথায় এখন? "
নীরা সহজ ভাবে বলল, " এইত সামনেই তিনটা বাড়ি পরে। ছয়তলা ফ্ল্যাটটা চার তলায় থাকি৷ একদিন এসো, চা খেয়ে যাবে।"
আমি বললাম, " আচ্ছা যাব। "
আমি লক্ষ্য করলাম নীরা আমার সাথে কথা বলছে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে, কাউকে খুজছে খুব সম্ভবত। ও সরাসরি আমার দিকে চোখ রাখছে না।
'
নীরাকে ব্যাস্ত দেখে আমিই উদ্যোত হয়ে বললাম, " নীরা, চলি তাহলে৷ "
ও আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, " আরে দাঁড়াও। সন্ধ্যা বেলা নিশ্চয়ই অফিসের তাড়া নেই।"
'
এবার আর আমি ওকে উপেক্ষা করতে পারলাম না।
নীরা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, " তুমি কি এখনো সিগারেট খাও?"
আমি রাস্তার গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বললাম," হ্যা আগের চেয়ে একটু বেশি।"
" ভালোই উন্নতি হয়েছে দেখছি৷ "
এবার আমি বললাম, " তুমি কিন্তু আগের মতোই আছো। "
নীরা অবাক হল। বলল, " আমি আগের মতো নেই। খুব সম্ভবত তোমার চোখ আগের মতোই আছে তাই আমাকে আগের মতোই দেখতে পাচ্ছ।"
" না সত্যিই আগের মতো আছো।"
" একটা বাচ্চার মা হয়েছি, আরেকটা পেটে নিয়ে ঘুরছি তবুও বলছো আগের মতো আছি? "
নীরার এই কথার ধাক্কা সামলাতে আমার বেশ কয়েক মুহুর্ত লেগে গেল৷ আশ্চর্য নীরা অন্য কারোর সন্তানের মা হচ্ছে শুনে আমার ভেতরটা এত দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে কেন! তবে কি আমার অবচেতন মন ভেবেছিলো নীরা এখনো আমার জন্য, আমার প্রতীক্ষায় রয়েছে! কি আকাশ কুসুম চিন্তা ভাবনা আমার! জীবন তো আর লেখকের কালি কলমের আবেগী উপন্যাসের মতো নয়।
নীরা নিজের মতো বলের গেল, " "বাবুকে ওর বাবা এতক্ষণেও কোচিং থেকে নিয়ে ফিরছে না তাই এদিকে এগিয়ে এলাম৷ অন্যদিন এতক্ষণে চলে আসে। "
ও নিজেই আবার জিজ্ঞেস করল ,"তারপর বিয়ে শাদি করেছ? "
" হ্যা, জীবনের প্রয়োজনে।"
নীরা হাসলো, "তা তোমার ক'টা বাচ্চা?"
আমি নিজের হাতে থাকা রায়ানের জন্য কেনা চিপসের প্যাকেটের দিকে তাকালাম৷ হেসে উত্তর দিলাম,
" আমার একটাই৷ তবে দুষ্টুমিতে দশজনের সমান। "
নীরা হো হো করে হেসে বলল, " বাবার মান রাখতে হবে তো।"
নীরা আবার বলল, " আমার কাছে তোমার একটা জিনিস আছে। আমার বিয়ের আগের দিন থেকে তুমি লাপাত্তা হয়ে গেলে তাই আর ফেরত দিতে পারি নি৷ অনেক খোজ করেছি তোমার বন্ধুদের কাছে। পরে জানতে পারলাম তুমি খালার বাড়ি চলে গেছো। ওখানকার স্কুল থেকে মেট্রিক দিচ্ছো। "
" তাছাড়া আর কি করতাম? দাড়িয়ে দাড়িয়ে অন্যকারোর সাথে তোমার বিয়ে দেখতাম? "
" এখন তো দিব্যি দেখছো অন্য কারো স্ত্রী হিসেবে। "
আমি ওর কথার কোন উত্তর দিলাম না। ও নিজেই আবার পার্স খুলে একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল,
" এটার আর দরকার নেই। বিয়ের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারপর মুহুর্ত থেকে কাগজের ঠোঙার মতোই মূল্যহীন। তোমার সঙ্গে যদি কোনদিন দেখা হয় ফেরত দিয়ে দেবো বলেই এত বছর সঙ্গে রেখেছি। "
কাগজটা খুলে দেখলাম সেই ৩৭ নম্বর পাতা৷ কবিতার বইয়ের ছেড়া পাতা।
নীরাকে লিখেছিলাম... থাক! সেসব মনে করে আর কোন লাভ নেই।
'
পাশে থাকা কাগজ কুড়ানো টোকাই শিশুটির দিকে এগিয়ে দিলাম নীরার কাছে মূল্যহীন সেই কাগজ৷ অন্তত কারো জীবিকার কাজে লাগুক।
'
ততক্ষণে নীরা আবার রাস্তার ও পাড়ে চলে গেছে। একটা ছোট্ট ছেলে এতক্ষণে তার এক হাত ধরেছে৷ পাশে থাকা মধ্যবয়সী তার অন্য হাতটাও আগলে রেখেছে৷ রাস্তার ওপাশে থাকা নীরা আর আমার মাঝে বহু আগেই কয়েক আলোকবর্ষ দুরত্ব'র শুরু হয়েছে তা আজ এত বছর পর কি করে কয়েক মুহুর্তের জন্য ভুলে গেলাম! কি আশ্চর্য বাড়িতে রায়ান আর দিতি অপেক্ষা করছে, আর আমি কি না!....
এই অতীতগুলোও না! মাঝে মধ্যে বড্ড পোড়ায়।
'