৮!!
সায়ানকে সবাই শনপাপড়ি বলে ডাকে৷ সেয়ানা মাল বলেও ডাকা হয়৷ এই নামের উৎপত্তির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যে মেয়েটির সে হচ্ছে অবনী। এখন সবাই মিলে সেই অবনীর বিয়েতেই যাচ্ছে৷ বন্ধুরা যখন এসব নিয়ে হাসাহাসি করছিলো সায়ান তখন মনেমনে ভাবছে মেঘালয় ও মিশুর কথা। সেই যে ওরা চলে গেলো, আর আসার নাম গন্ধই নেই। মেঘালয় কখনো কোনো মেয়েকে এতটা পাত্তা দিয়েছে বলে সায়ানের মনে পড়ছে না।
ও ঝাপ দিয়ে সিট থেকে নেমে পড়লো। কেবিন থেকে বেড়িয়ে এসে কল দিলো মেঘালয়ের নাম্বারে। মেঘালয় রিসিভ করতেই সায়ান বললো, 'গরীবের বাহুবলি, ভাই কই আপনি?'
- 'ট্রাকের উপরে আছি৷'
- 'রাজকন্যাকে কি আপনার ট্রাক মনেহচ্ছে ভাই?'
- 'অশ্লীল কথাবার্তা কবে বাদ দিবি শনপাপড়ি?'
- 'দুইটা বাচ্চার বাপ হলে। তুই কই আছিস মেঘুশালা?'
- 'বললাম তো ট্রাকের উপর।'
- 'রেলগাড়িতে ট্রাক কই পাইলি তুই? গাড়িটাকে কি তোর ট্রাক মনেহচ্ছে?'
মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, 'ইয়ার্কি না দোস্ত। একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।'
- 'মানে!'
- 'মানেটা পড়ে বুঝাই? ফোনে এতকিছু বলা সম্ভব না। কালকে শুনিস।'
মেঘালয় কল কেটে দিলে সায়ান বাথরুমের দিকে চলে গেলো। বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগাতে যাবে এমন সময় দেখলো সেখানে একটি মেয়ে। মেয়েটি ভয়েই চিৎকার দিতে যাবে এমন সময় সায়ান এক হাতে ওর মুখ চেপে ধরলো। চোখ পিটপিট করে ভয়েই কাঁপছে মেয়েটি।
সায়ান হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, 'চেঁচাবেন না প্লিজ। নয়ত আমাকে গণধোলাই দেবে পাবলিক।'
- 'আপনি এখানে কেন? বলা নেই, কওয়া নেই সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলেন একেবারে?'
- 'হুস। এটা কি আমার শ্বশুরের বেডরুম যে বলে কয়ে ঢুকতে হবে?'
মেয়েটি রেগে বলল, 'আপনার বোঝা উচিৎ ছিলো ভেতরে কেউ আছে৷ এ রকম হুট করেই ঢুকে পড়লেন কেন?'
- 'আপনি কোন আক্কেলে দরজা খোলা রেখে বাথরুমে ঢুকে পড়েছেন?'
মেয়েটি আরো রেগে বলল, 'আমার আক্কেল নিয়ে কথা বলার আগে নিজের আক্কেল চেক করেন। এই দেখেন দরজা লাগালেও খুলে যায় আপনা আপনি। আমি তো সেটা জানতাম না।'
সায়ান হেসে বলল,'এটা আপনার বোঝা উচিৎ ছিলো। তারপর টয়লেটে বসে একহাতে দরজা টেনে ধরে কাজ সারতেন।'
মেয়েটি ভয়ংকর রেগে বলল, 'ছিহ কি বাজে কথা বলেন আপনি?'
- 'সত্য কথা শুনতে বাজেই মনেহবে।'
- 'আমি কিন্তু চিৎকার করে লোকজন জড়ো করতে পারি, তখন বিপদে পড়বেন আপনি৷'
সায়ান বললো,'বাহ! লোকজন ডেকে কি বলবেন শুনি? আমি আপনাকে জোর করে বাথরুমে নিয়ে এসেছি? আসার সময় চেঁচালেন না,আবার বাথরুমে ঢুকে চেঁচাবেন? পাবলিক দেখলেই বুঝবে আমি কত ইনোসেন্ট একটা ছেলে।'
মেয়েটি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,'ইনোসেন্ট অন মাই ফুট। ভিলেনমার্কা চেহারা। দেখলেই বোঝা যায়৷ সরে দাঁড়ান,আমি বের হবো '
সায়ান একটু সরে দাঁড়ালো। মেয়েটি জামা ঠিক করে বের হতে যাচ্ছিলো এমন সময় সায়ান বললো, 'ছিইহ কি গন্ধ আপনার শরীরে৷'
মেয়েটি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো সায়ানের দিকে। সায়ান ফিক করে হেসে বললো, 'সরি।'
মেয়েটি রাগে ফুসতে ফুসতে বের হয়ে এলো বাথরুম থেকে। সায়ান হেসে ফেললো। কাউকে জব্দ করতে ওর দারুণ মজা লাগে৷ মেয়েটিকে জব্দ করে ভালো মজা পাওয়া যাবে৷
ও বের হয়ে মেয়েটির পিছুপিছু যেতে লাগলো। মেয়েটা সোজা গিয়ে একটা কেবিনে ঢুকে পড়লো। সেটা দেখে ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো মেঘালয়ের৷ কেবিনের ভেতর গিয়ে তো আর জব্দ করা যাবেনা। বড্ড ইচ্ছে করছিলো মেয়েটাকে জব্দ করতে সেটা আর হলোনা।
হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলো এমন সময় দেখলো মেয়েটি কেবিনের দরজা খুলে বের হয়ে এলো। হাতে একটা বড় ব্যাগ। ব্যাগটা টেনে নিয়ে যেতেই পারছে না সে। সায়ান এগিয়ে গিয়ে বলল, 'হেল্প লাগবে?'
- 'গায়ে পড়ে কথা বলতে আসবেন না।'
- কখন গায়ের উপর পড়লাম? মাত্রই তো পরিচয় এত তারাতারি ওসব কি আর করা যায়?'
বলেই চোখ টিপ মারলো। মেয়েটা রেগে বলল, 'চরম খারাপ লোক তো আপনি। আপনার মত বাজে লোক এ জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। যত্তসব। সরে দাড়ান।'
- 'আরে, একটু হেল্প করতে চাইছি।'
- 'নো নিড। বেশি ডিস্টার্ব করলে পুলিশে ইনফর্ম করবো।'
- 'শিওর। বাংলাদেশ পুলিশ আমার বাপের মত।'
মেয়েটা আর কিছু বললো না। রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ব্যাগটা টানতে টানতে এগোতে লাগলো। সায়ান এগিয়ে এসে আবারও দুষ্টুমি করে বললো, 'মেয়েরা আমার জন্য পাগল। আমার চেহারা দেখলেই তারা ফিদা হয়ে যায়। বেল যেমন ন্যাড়া মাথা দেখলেই টুপ করে পড়তে চায়৷ তেমনি মেয়েরাও আমাকে দেখলে কাছে না এসে পারে না। তার উপর আমি ক্লোজ আপ টুথপেস্ট ইউজ করি '
মেয়েটি বললো, 'এত লুইচ্চা কেন আপনি?'
- 'পাওয়ার। আমার হর্স পাওয়ার আছে বুঝলেন। বাংলাদেশ পুলিশ আমার বাপের মতন।'
- 'আপনি কতটা বেয়াদব আপনি জানেন? দেখতে তো একেবারে ভদ্রলোকের মতন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে চরম ইতর টাইপের।'
সায়ান হেসে বললো, 'নিজেও স্বীকার করছেন আমি দেখতে একেবারে জেন্টলম্যান? আর ভেতরটা কিভাবে দেখলেন আপনি? একগাদা জামাকাপড় পড়েছি তারপরও ভেতর দেখতে পাচ্ছেন? আপনার চোখের পাওয়ার এত বেশি?'
মেয়েটি এক হাতে সায়ানের কলার টেনে ধরে বললো, 'ইতরামির একটা সীমা থাকে। ডোন্ট ক্রোস ইউর লিমিট ওকে?'
এমন সময় একটা লোক এসে বলল,'কি হচ্ছে এখানে?'
মেয়েটি কিছু বলার আগেই সায়ান বলল,'আমার স্ত্রী রেগে গেলে আগুন হয়ে যায়৷ তখন ফায়ার সার্ভিস ও ওকে শীতল করতে পারেনা।'
মেয়েটি মুখ খুলতে যাবে তখন সায়ান ওর মুখ চেপে ধরে বললো, 'বাবু প্লিজ মুখ খারাপ করোনা।'
লোকটি মুখ বাঁকা করে চলে গেলে সায়ান হাতটা ছেড়ে দিলো। মেয়েটা রেগে বললো,'ইউ...'
- 'বিডি পুলিশের ছেলে।'
- 'রাবিশ৷ যান তো এখান থেকে৷ বিরক্ত লাগছে আমার।'
সায়ান একটু এগিয়ে এসে কি যেন ভেবে আবারও পিছিয়ে এলো। বললো, 'আমরা বাংলা সিনেমার মত রোমান্টিক কাজ কাম সেরে ফেললাম না?'
- 'হোয়াট? রোমান্টিক কাজ কাম মানে?'
- 'এইযে খুনসুটি। হয় হয়, সিনেমায় এমন ই হয়। আমি শাকিব খান আর আপনি বুবলি।'
মেয়েটি এবার এমনভাবে তাকালো যে সায়ান আর এক মুহুর্ত ও দাঁড়ালো না। এক ছুটে নিজের কেবিনের ভেতরে চলে গেলো। গিয়েই দরজা লাগিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো।
সবাই জিজ্ঞেস করলো এভাবে হাসির কারণ কি? সায়ান পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতেই সবাই হেসে উঠলো। হাসি থামতেই চাইছিলো না, সেই মুহুর্তে দরজায় কে যেন নক করলো। পূর্ব উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
দরজায় ওপাশে কার সাথে যেন কথা বললো পূর্ব। সবাই দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। পূর্ব সরে যেতেই একটা মেয়ের মাথা দেখা গেলো। মেয়েটি বললো, 'আমার ব্যাগটা কি আপনাদের কেবিনে রাখতে পারি? আসলে আমি না আজকে সিট পাইনি। সেজন্যই ব্যাগটা কারো কেবিনে সেফলি রাখতে চাচ্ছিলাম।'
সবাই উৎসুক চোখে তাকালো। সায়ানের মুখে মিটিমিটি হাসি৷ কারণ এই মেয়েটিকেই একটু আগে জব্দ করে এসেছে সে। সবাই আন্দাজ করে নিলো এটিই সেই মেয়ে। এটুকু বুঝতে কারো অসুবিধা হলোনা। মৌনি বললো, 'আপনি নিজেও আমাদের সাথে যেতে পারেন আপু। আমরা পুরো কেবিনটাই বুক করে নিয়েছি৷ যদি আপনার আপত্তি না থাকে।'
মেয়েটি একবার চোখ বুলিয়ে নিলো মৌনি, রোদ ও দুপুরের প্রতি। তারপর ভিতরে প্রবেশ করলো। সে এখনও সায়ানকে দেখতে পায়নি। পূর্ব ব্যাগটা ভেতরে টেনে নিতে সাহায্য করলো। মেয়েটি সিটে বসে সামনের দিকে তাকাতেই সায়ানের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো।
৯!!
মেঘালয় বললো, 'পৃথিবীতে অনেক রকমের ছেলে আছে জানো?'
মিশু মাথা নেড়ে 'না' বললো।
মেঘালয় বললো, 'তুমি খুব সরল একটা মেয়ে। সেজন্যই এত বড় ধোকা খেয়েছো। আশাকরি এরপর থেকে আর এরকম ভূল কখনো করবে না। সবকিছুর আগে নিজেকে ভালোবাসো,নিজেকে সম্মান করো বুঝেছো?'
মিশু মাথা দোলালো। তারপর বললো, 'আমি তন্ময়কে অনেক বিশ্বাস করতাম। ওর কোনো কথাই কখনও অবিশ্বাস্য ছিলোনা। সে আমাকে সবসময় সাপোর্ট দিতো।'
- 'সাপোর্ট দিলেই ছেলেটা ভালো হয়ে যায়না। আর যেহেতু তোমাদের প্রেমটা ভার্চুয়ালে। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসেনা।'
মিশু নিরবে শুনে গেলো কথাগুলি। মেঘালয়ের কণ্ঠস্বর আর উচ্চারিত প্রত্যেকটা বাক্যই ওকে মুগ্ধ করে দিচ্ছে। মানুষটা সত্যিই অনেক ভালো একজন মানুষ। এমনকি ওর বন্ধুগুলোও সবাই একদম আলাদা।
মিশু জিজ্ঞেস করলো, 'আপনারা বিয়ে বাড়িতে কতদিন থাকবেন?'
- 'সপ্তাহ খানেক তো থাকবো ই।'
- 'আমাদের বাসায় আসবেন অবশ্যই। যারা আমার এতটা উপকার করেছে তাদেরকে অবশ্যই বাসায় নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।'
- 'সেটা দেখা যাক। তোমাদের এলাকায় একবার গিয়েছিলাম আমি। সেবার কি হয়েছিলো জানো?'
মিশু চাদরের ভেতরেই একটু নড়েচড়ে বসলো। তারপর জানতে চাইলো কি হয়েছিলো?
মেঘালয় বলতে আরম্ভ করলো, 'সেবার বেড়াতে গিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে আমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো।'
মিশু ফিক করে হেসে বললো, 'তারপর?'
- 'মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়তো। সেকি পাগলামি যে করতো। ওর পাগলামির সীমা দেখে মেয়েটির বাবা নিজেই আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলো বিয়ে করার জন্য।'
হেসে ফেললো মিশু৷ অতটুকু বাচ্চা মেয়েকে তো আর বিয়ে করা সম্ভব নয়। মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে গভীরভাবে কি যে ভাবছে। জিজ্ঞেস করলো, 'কি ভাবছেন?'
চমকে উঠলো মেঘালয়। তারপর কথাগুলো মনে করে করে মিশুকে খুলে বলতে লাগলো।
সময়টা ছিলো গ্রীষ্মকাল। কাঠফাটা রোদ চারিদিকে। তার উপর রংপুর জেলা খরার জন্য বিখ্যাত৷ এই খরায় মেজাজ ও খরখরে হয়ে উঠেছে। মেঘ, সায়ান ও পূর্ব বেড়াতে এসেছে এক আন্টির বাসায়।
বাসা থেকে বের হয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে করতে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। হঠাৎ গাছের উপর থেকে টুপ করে কি যেন পড়লো মাথার উপর। মেঘালয় মাথায় হাত দিয়ে দেখলো গরম গরম একটা বস্তু। হাতটা সামনে নিয়ে দেখে পাখির গু। মেজাজ এমনিতেই খরখরে হয়ে আছে, এখন আরো রাগ হচ্ছে। মেঘ রেগে বললো 'পাখি কি এই গরমে হাগার জায়গা পায়না?'
কথাটা বলা শেষ হতেই একটা উচ্ছল কিশোরীর প্রাণোচ্ছল হাসির শব্দ কানে আসলো। হাসির শব্দে সবাই ফিরে তাকালো মেয়েটির দিকে। মেয়েটি খিলখিল করে হেসে যেতেই লাগলো। সেই হাসির শব্দ ঝুনঝুনির মত বাজতে থাকলো সবার কানে।
মেঘালয় সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। তখন প্রচন্ড রাগ ছিলো ওর৷ রেগে বললো, 'এই পুচকে মেয়ে হাসো কেন?'
মেয়েটি আরো জোরে হেসে উঠলো। তারপর ওদের তিনজনকে অবাক করে দিয়ে কাছে এসে নিজের ওড়না দিয়ে মেঘালয়ের মাথা থেকে পাখির পায়খানা পরিষ্কার করে দিয়েছিলো। সেই হয়েছিলো শুরু। এরপর থেকে মেঘালয়ের পিছনে আঠার মত লেগে থাকতো মেয়েটি৷ মেঘ যেখানে যেতো, সেখানেই ছুটে চলে যেতো। এমনকি মায়ের কাছে জোর করে পিঠা বানিয়ে নিয়ে মেঘালয়ের জন্য নিয়ে যেতো। এতটাই পাগল ছিলো সে। পাগলামি সহ্য করতে করতে দিন কয়েক পরে মেঘালয় ঢাকায় ফিরে এলো। মেয়েটি তখন মেঘের জন্য হাত কেঁটে পাগলামি শুরু করেছিলো। বাধ্য হয়েই মেয়েটির বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো মেঘালয়ের বাসায়।
কথাগুলো শুনে হো হো করে হেসে উঠলো মিশু। হাসি থামার পর বললো, 'কি পাগল ছিলো মেয়েটা। আপনি বিয়ে করেন নি কেন?'
- 'পাগল? তখন আমার মাত্র ইন্টারমিডিয়েট শেষ হয়েছে। পুরো জীবনটাই সামনে পড়ে আছে৷ আর তাছাড়া রিলেশন চালানোর মত ইচ্ছে ছিলোনা কারণ মেয়েটি অনেক ছোট ছিলো।'
মিশু হেসে বললো, 'তাতে কি? ক্লাস নাইনের মেয়ে হলে কি হবে? ভালোবাসায় তো পি.এইচ.ডি সেরে ফেলেছে।'
- 'ওটাকে ভালোবাসা বলেনা। ওটাকে বলে আবেগ।'
- 'ভালোবাসা তো আবেগ দিয়েই তৈরী তাইনা?'
- 'না। ভালোবাসায় আবেগের বাইরেও অনেক কিছুই থাকে। ওই পাগলীকে তখন মাথায় তুললে আজকে এই জায়গায় আমি পৌছাতে পারতাম না।'
মিশু আর কিছু বললো না। এখনও ওর হাসি পাচ্ছে। মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'আমার ভালোবাসা টাকে আপনি কি বলবেন? আমি তন্ময়ের জন্য সবকিছু ছেড়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম।'
মেঘালয় মুচকি হেসে বললো, 'এটা বোকামি।'
অবাক হয়ে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো মিশু। লোকটার কথাগুলো একটু নিষ্ঠুর ধাচের হলেও এটাই সত্য, কঠিন সত্য!
—————
১০!!
- 'আচ্ছা, গাইয়া হওয়াটা কি কোনো বড় খুঁত?'
প্রশ্ন শুনে চমকালো মেঘালয়। মিশু উন্মুখ হয়ে মেঘালয়ের দিকে চেয়ে আছে আর করুণ গলায় প্রশ্ন করছে ওকে। মেঘালয় ভ্রু কুঁচকালে মিশু আবারও বললো, 'একটা মেয়ে গ্রামে জন্মেছে সেটা কি কখনো অপরাধ হতে পারে? সাধারণভাবেই গ্রামে জন্মানো মেয়েরা একটু কম স্টাইলিশ হয়ে থাকে৷ শহরের মেয়েরা তুলনামূলক বেশি স্টাইলিশ। এর জন্য কোনো মেয়েকে কেন অপমানিত হতে হবে? মেয়েটির কি নিজের জন্মের পেছনে কোনো হাত ছিলো?'
মেঘালয় একটু মাথাটা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো, 'ঠিক কি হয়েছিলো বলোতো? কিরকম অপমান?'
মিশু বলতে শুরু করলো,
তন্ময়ের সাথে পরিচয়টা হয়েছিলো ফেসবুকেই। এরপর ধীরেধীরে সম্পর্কের দিকে গড়াতে থাকে। একসময় সম্পর্ক হয়েও যায়। ফোনে সবসময় কথা চলতো আর সারাক্ষণ চ্যাটিং হতো। মিশু ধীরেধীরে দূর্বল হতে থাকে তন্ময়ের প্রতি৷ তন্ময় ছোটবেলা থেকেই শহরে বড় হয়েছে। টাকাওয়ালা বাপের একমাত্র ছেলে হওয়ায় যার চলার ধরণটাই ছিলো অন্যরকম। মিশুকে বারবার দেখা করার জন্য চাপ দিলেও মিশু দেখা করতে রাজি হতোনা। দূরত্বের ব্যবধান আর গ্রামে বড় হওয়ায় মিশুর মাঝে ভয়টা কাজ করতো বেশি৷ তবুও প্রেমের টানে বাবা মাকে মিথ্যে বলে ঢাকায় ছুটে এসেছিলো তন্ময়ের ডাকে৷ কিন্তু দেখা হওয়ার পর এত বড় ধাক্কা খেতে হবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি সে।
প্রথম দেখেই মুখটা বিকৃত করে চোখ কপালে তুলে ফেলেছিলো তন্ময়। আংশিক ভ্রু কুঁচকে যখন মিশুর দিকে তাকালো, মিশু খেয়াল করে দেখলো তন্ময়ের চোখেমুখে মুগ্ধতার পরিবর্তে বিতৃঞ্চা। তখনই ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠেছিলো মিশুর৷ কিন্তু মুখে কোনো প্রশ্ন করতে পারেনি।
সারাদিন একসাথে ঘোরাফেরা করে, সন্ধ্যার দিকে তন্ময় মিশুকে বাস স্ট্যান্ডে নিয়ে এসে বাসে তুলে দিয়ে বলেছিলো, "সাবধানে যেও। এটাই হয়ত আমাদের শেষ দেখা।'
মিশু অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে তন্ময় কিছু বলেনি। কিন্তু বাসায় গিয়ে ফোন দিয়ে বলেছে, 'আমার একটা স্ট্যাটাস আছে। আমার ইগো আছে, পারসোনালিটি আছে৷ তোমার মত একেবারে ক্ষ্যাত টাইপের মেয়ের সাথে রিলেশান রাখা আমার পক্ষে পসিবল না৷'
আকাশ থেকে পড়েছিলো মিশু। সারাদিন ভদ্র প্রেমিকের মত আচরণ করে এখন এ কেমন আচরণ? ও বারবার তন্ময়কে কল দিতেই থাকে কিন্তু তন্ময় বলে, 'তোমাকে স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছি তুমি আমার জন্য পারফেক্ট না। হুদাই কল দিয়ে ডিস্টার্ব কইরো না। আমার পাশে তোমার মত ক্ষ্যাত মার্কা মেয়েকে নিয়ে দাঁড়ানোও সম্ভব না।' কথাটা বলেই কল কেটে দেয়। মিশু দ্বিতীয়বার কল দিয়ে দেখলো নাম্বার ব্লাকলিস্টে রাখা হয়েছে। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিয়েছিলো ও। বাসের লোকজন হা করে তাকিয়েছিলো ওর দিকে। মিশু কোনো উপায় না পেয়ে নেমে পড়ে বাস থেকে।
কথাগুলো বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মিশু। মেঘালয় অবাক হয়ে শুনছিলো ওর কথা। একই চাদরে থাকায় একজন আরেকজনের শরীরের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করছে। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, 'তারপর কি হলো?'
মিশু চোখ মুছে বললো, 'এরপর আমার জন্য কত বড় বিপদ অপেক্ষা করছিলো বলে বোঝাতে পারবো না। আমি বাস থেকে নেমে সোজা তন্ময়ের বাসায় চলে যাই। ওর বাসার এড্রেস আগে থেকেই জানতাম। যখন ওর বাসায় পৌছাই তখন রাত নেমেছে। গিয়ে জানতে পারি তন্ময় বাসায় নেই। সেটা যে ব্যাচেলর বাসা তা আমার জানা ছিলো না। আমি খুঁটির মত দাঁড়িয়েছিলাম ওর বাসার নিচে। তন্ময়ের একজন বন্ধু এসে আমাকে বললো তন্ময় রুমেই আছে। তোমাকে যেতে বললো। এভাবে আমাকে বলে রুমে নিয়ে গিয়ে.....'
ডুকরে কেঁদে উঠলো মিশু। বাচ্চা মেয়েটার ভয়াবহ বিপদের কথা টের পেয়ে ভেতরটা কেমন যেন করে উঠছে মেঘালয়ের। জিজ্ঞেস করলো, 'রুমে নিয়ে গিয়ে?'
মিশু বললো, 'একজন লোকের রুমে ঢুকিয়ে দেয় আমাকে। আমার এখনও খুব ভয় হচ্ছে জানেন। ভেবেছিলাম আমি বোধহয় মরেই যাবো।'
মিশুর অসহায় অবস্থার কথা শুনে স্বান্তনা দেয়ার জন্য মেঘালয় মিশুর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, 'আর কেঁদোনা। শক্ত হও। আমার কথা শোনো৷ আশা করি আর কান্না পাবেনা।'
মিশু চোখ দুটো মুছে বললো, 'আপনাকে আমার ফেরেশতা মনে হয়েছিলো। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে আপনি মানুষ। আমার মনেহচ্ছে আপনি একজন ফেরেশতা। এত ভালো কোনো মানুষ হয়?'
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, 'চোখ বন্ধ করে কোনো পুরুষ কেই বিশ্বাস করবে না। সে যেই হোকনা কেন। সবসময় শুধুমাত্র নিজেকে আর নিজেকেই বিশ্বাস করবা। তোমার বাইরে আর কাউকেই এতটা বিশ্বাস করোনা যতটা করলে সে সুযোগ নেবে৷'
মিশু আর্দ্র কণ্ঠে বললো, 'আমার কষ্টটা কোথায় জানেন? আমি গ্রামের মেয়ে, আমি ক্ষ্যাত,আমি বোকা, আমার স্ট্যাটাস নেই এসব জেনেও সে আমাকে ভালোবেসেছে। আজকে কেন এরকম করলো? আর যদি আমাকে ভালো নাই লাগবে তাহলে প্রথম দেখেই কথাটা বলে বাসায় পাঠিয়ে দিতো৷ সে আমাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরেছে আর.... '
চুপ করে গেলো মিশু।
মেঘালয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো, 'বুঝেছি। আর বলতে হবেনা। কোনো মেয়েকে কাছে পেলে তন্ময়ের মত ছেলেদের হুশ থাকার কথা না। এটা নিয়ে মন খারাপ না করে এর যোগ্য জবাব দেয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো।'
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, 'হুম। এর জবাব তো আমি দেবোই। আপনি আমাকে একটু বলবেন কি করলে ওকে ভূলে যেতে পারবো সহজে?'
মেঘালয় মাথাটা ঝাঁকালো। চাঁদের আলোয় ওর মুখটা দেখে প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো মিশুর ভেতরটা। মেঘালয় বললো, 'এখন কিছু বললেও তোমার মগজে ঢুকবে না। ধীরেধীরে কিছু টার্ম দেবো, সেসব কমপ্লিট করতে হবে। পারবা?'
- 'কিসের টার্ম?'
- 'বলতে পারো তোমার একটা ভালো ক্যারিয়ারের ভিত্তি। নিজেকে বদলানো ব্যতীত কারো উন্নতির উপায় নেই। আর যাদের মাঝে পরিবর্তনের ইচ্ছা থাকে, তাদের দ্বারাই সম্ভব জগতের সমস্ত সাফল্য। মাথায় ঢুকলো?'
মিশু উত্তেজিত হয়ে বললো, "আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন৷ আচ্ছা, আপনি কি করেন?'
- 'সেটা আস্তে আস্তে জানতে পারবে। তবে তোমার চেয়েও বয়সে বড় বড় মেয়েরা আমার স্টুডেন্টস।'
- 'সেকি! আর আমিতো নিতান্তই বাচ্চাদের মত আচরণ করছি আপনার সাথে। সরি।'
মেঘালয় হেসে বললো, 'পাগলী। এটা তোমার স্বকীয়তা। জোর করে নিজেকে বদলাবে না। শুধু ব্যক্তিত্বকে মজবুত করবে। আমার নাম্বারটা রেখো, ফোনে সব বলে দিবো।'
মিশুর মনটা ভালো হতে শুরু করেছে এখন। আর আগের মত কষ্ট হচ্ছেনা৷ মেঘালয়ের কথায় উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে ওর। সত্যিই যদি এমন হয়,তাহলে খুব ভালো হয়। তন্ময়কে একটা মোক্ষম জবাব দিতে হবে তো। এরজন্য এখন থেকেই মানসিক প্রস্তুতি দরকার।
মিশু বললো, 'আপনি তাহলে আমার স্যার?'
- 'হা হা হা৷ না থাক, আমাকে স্যার বলতে হবেনা।'
- 'ভাইয়া ডাকবো?'
মেঘালয় একটু থমকে বললো, 'হ্যা সেটা ডাকতে পারো। কিন্তু স্যার আর ভাইয়া শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। নতুন কিছু ট্রাই করা যায় না?'
মিশু হেসে বললো, 'মিস্টার গুরুজি বলে ডাকবো।'
- 'হা হা হা।'
মেঘালয়ের হাসির দিকে তাকিয়ে মনের সমস্ত মেঘ কেটে যেতে আরম্ভ করেছে। আর কোনো মন খারাপ লাগছে না। মিশু কাছ থেকে মেঘালয়ের দিকে চেয়ে থেকে আপন মনেই বললো, 'স্যার আমাকে মানুষ বানাবেন? আমার বড্ড মানুষ হওয়ার ইচ্ছা।'
মেঘালয় হেসে বললো, 'হুম বানাবো। তুমি আমাকে স্যার বলোনা তো। আমাকে নিজের বন্ধু মনে করবা।'
- 'কিহ! এত বড় মানুষটা বুঝি আমার মত বাচ্চাদের বন্ধু হতে পারে?'
- 'তোমার বাবা মা কি তোমার বন্ধুদের মতন নয়?'
- 'হুম এটা ঠিক। আচ্ছা এখন থেকে আপনি আমার গুরু বন্ধু।'
আবারও শব্দ করে হেসে উঠলো মেঘালয়।
১১!!
সায়ানের শয়তানি হাসি দেখে মুখ কুঁচকে মেয়েটি অন্যদিকে তাকালো। সায়ান তখনও মিটিমিটি হাসছিলো। টুকটাক কথা বলার পর জানা গেলো মেয়েটিও অবনীর বিয়েতেই যাচ্ছে। সে অবনীর খালাতো বোন। ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করে। বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্যই বেড়িয়েছে কিন্তু ভূল করে সকালের ট্রেনের সময়টাকে রাতের ট্রেন ভেবে রাত্রিবেলা স্টেশনে আসে৷ এসে দেখলো তার ট্রেন সকালে চলে গেছে। বাধ্য হয়েই রাতের ট্রেনের টিকেট করতে হলো কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কোনো আসন পায়নি। তাই কেবিনে ঘুরাঘুরি করছিলো।
ঘটনা শুনে সবার আগে সায়ান বললো,'বান্ধবীর খালাতো বোন মানে আমাদের ও খালাতো বোন। এতগুলা খালাতো ভাই থাকতে দুশ্চিন্তা করতে হবেনা বোন। তো খালাতো বোনের চোখেমুখে এত রাগ কেন?'
মেয়েটিও কম না। সে ঝটপট জবাব দিলো, 'খালাতো ভাইদের পিছনে যদি একটা করে লেজ থাকে তাহলে রাগ না হয়ে উপায় আছে?'
- 'সেকি! আমার পিছনে লেজ গজিয়েছে? আমিতো জানতাম না। এনিওয়ে তুমি লেজ কিভাবে দেখলে? কারো প্যান্টের পিছনে ছেড়া নাকি?'
সবাই হেসে ফেললো ওর ফাজলামির ধরণ শুনে। মেয়েটিও না হেসে পারলো না। সায়ান আর ওর বন্ধুদের সবার সাথে গল্প করতে করতে রাগগুলো ধীরেধীরে কমে যাচ্ছে। এখন আর আগের মত সায়ানকে খারাপ মনে হচ্ছেনা। তবুও অন্যরকম একটা খুনসুটি ময় ঝগড়া লেগেই থাকলো ওদের মধ্যে।
১২!!
ট্রাক থেকে নেমে রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকলো মেঘালয় ও মিশু। মিশুর শরীরের অবস্থা ভালো নয়। মেঘালয় ওকে যথেষ্ট সাপোর্ট দিচ্ছে সবকিছুর ব্যাপারে৷ হাত ধরে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া, গ্লাসে পানি ঢেলে দেয়া, বের হওয়ার পর হাত ধরে অটোতে তোলা সবকিছুতেই সহযোগিতা করলো। মিশু যখন ওকে গুরুজি বলে ডাকে তখনই ফিক করে হেসে ফেলে মেঘালয়।
মেঘালয় রংপুরে পৌছে মিশুকে নিয়ে সোজা কাউনিয়ায় এক বন্ধুর বাসায় চলে এলো। বাড়িতে ছেলেটা একাই থাকে। লাঞ্চের পর মিশু ও মেঘালয়কে বাসায় রেখে ডিউটিতে চলে গেলো সে।
মেঘালয় বললো, 'এখন শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দাও। রাতে তো জোৎস্না বিলাসে যাবো'
- 'আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না।'
- 'না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে। তুমি এ রুমে ঘুমাও, আমি পাশের রুমে ঘুমাচ্ছি। ভয় পেওনা, কিছু প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমাকে ডেকো।'
মেঘালয় দরজাটা টেনে দিয়ে বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকেও মিশুর ঘুম এলোনা। অচেনা জায়গায় এলে একদম ই ঘুম হয়না ওর৷ তাছাড়া ভোরের দিকে ট্রাকে বস্তার উপরে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম থেকে উঠলে দেখে মেঘালয়ের কোলের উপরে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। অথচ ছেলেটা একটুও নড়াচড়া না করে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে মিশুর মাথাটা কোলের উপর নিয়ে৷ মিশুর গায়ে চাদর টেনে দিয়ে নিজে থ মেরে বসে ছিলো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আরো উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে৷ কিছুতেই ঘুম আসছে না।
কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে এলো বিছানা ছেড়ে। পাশের রুমের দরজায় নক করে দেখলো দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো মিশু। মেঘালয় ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মিশু বিছানার কাছে এসে বললো, 'ঘুমাচ্ছেন?'
একবার কথাটা বলতেই মেঘালয় চমকে উঠে পাশ ফিরলো। মিশু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'ঘুমান নি?'
মেঘালয় বিছানার উপর উঠে বসতে বসতে বললো, "ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তোমার ডাকে ঘুম ভাংলো। আমার ঘুম অনেক হালকা।'
- 'তাই বলে একবার ডাকতেই ঘুম ভাংলো? আচ্ছা,আপনি ঘুমান।'
- 'কিছু বলবে?'
- 'আমার না একদম ই ঘুম আসছিলো না। সেজন্যই... '
- 'তাহলে বসো৷ গল্প করি।'
- 'আপনার বোধহয় ঘুম পেয়েছে৷ অযথা ডিস্টার্ব করবো?'
মেঘালয় মুচকি হেসে বললো, 'ঘুম পালিয়েছে৷ তুমি কি বাসায় যেতে চাও এখনি?'
- 'না৷ কালকে সকালে বাসায় যাবো। আজকের প্লানটা কিছুতেই যেন বাদ না যায়। সবকিছু রেডি হয়ে গেছে?'
- 'আমার ফ্রেন্ডকে বলেছি, ও নৌকার ব্যবস্থা করে রাখবে। আমরা বিকেলে বের হবো। তুমি চাইলে এতক্ষণ ঘুমাতে পারো'
- 'আচ্ছা, তাহলে ঘুমাই গিয়ে।'
মিশু দরজার দিকে গিয়ে আবারো পিছন ফিরে তাকালো। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, 'কিছু বলবে?'
মিশু আমতা আমতা করে বললো,'না মানে আমার একটা জিনিস লাগতো।'
মেঘালয় উৎসুক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'বলো। কি দরকার?'
মিশু লজ্জায় বলতে পারলো না কিছু। মাথা নামিয়ে নিলো লজ্জা পেয়ে। মেঘালয় কোনো রকম সংকোচ না করেই বললো, 'ন্যাপকিন আনতে হবে?'
মিশুর মুখটা লজ্জায় গাঢ় নীল হয়ে উঠলো। মাথাটা নিচু করে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার মত ইচ্ছে হলো ওর। অন্যদিকে মেঘালয়ের নিঃসংকোচ প্রশ্ন শুনে অবাক ও লাগছে৷ গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু করেই বললো,'হুম।'
মেঘালয় আর কিছু না বলে বিছানা ছেড়ে নেমে এলো। দরজার কাছে গিয়ে বললো, ' দরজা লক করে শুয়ে থাকো। আমি এক্ষুনি আসছি।'
মেঘালয় বেড়িয়ে গেলে মিশু দরজা লাগাতে গিয়ে অনেক্ষণ থমকে চেয়ে রইলো মেঘের পথের দিকে। একটা মানুষ অনেক সময় ফেরেশতার মতন পাশে এসে দাঁড়ায়, তখন ইচ্ছে মানুষটার জন্য যদি কিছু করতে পারতাম! অনেক করলেও বোধহয় কিছু ঋণ কখনো শোধ হবার নয়।
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো মিশু। মেঘালয়ের ডাকে ঘুম ভাংলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বিকেল গড়িয়ে এসেছে। ও চোখ কচলে জিজ্ঞেস করলো, 'কখন এসেছেন?'
- 'দশ মিনিট পরেই। তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে ডাকিনি। এখন আমরা বের হবো, উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও।'
মিশু আরো দুবার চোখ কচলে আড়মোড়া ভাঙার চেষ্টা করলো। ওর চোখেমুখে এখনও ঘুম লেগে আছে। ঘুম থেকে ওঠার পর কাউকে এতটা মায়াবী লাগে সেটা প্রথম খেয়াল করলো মেঘালয়।
মিশু বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। বাথরুমে ঢুকতে যাবে এমন সময় মেঘালয় পিছন দিক থেকে ডাক দিয়ে একটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। মিশু ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো দরজায় হেলান দিয়ে৷ দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল আসছে। ভেতর থেকে ঠেলে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইছে। মনটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। কিন্তু এই কান্না যে কিসের সেটা জানেনা ও। তবুও পাগলের মত কাঁদতেই থাকলো।