আবরিশাম গাড়ির দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেয় এবার। প্রিয়ন্তি জানালা দিয়ে বাইরের গাছপালা, মানুষজন, দোকানগুলো দেখছে।
অর্পা বাড়ি থেকে চলে যেতেই রেজওয়ান আগের চেয়ে সুস্থ বোধ করছে। অর্পা যে তার উপর এতটা অতিষ্ঠ হয়ে গেছে ভাবতেই অনুশোচনার অনলে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছে রেজওয়ান। যে মানুষটাকে এতো ভালোবাসতো আজ সেই মানুষটাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিতে পর্যন্ত ভাবেনি দুবার। অবশ্য এর পিছনে রেজওয়ানের ঘৃণ্য বর্বরোচিত আচরণ যথেষ্ট। তিয়াসের সাথে কথা হয়েছিল গতকাল। ওর থেকেই প্রিয়ন্তির ফিরে আসার খবর জানতে পেরেছে রেজওয়ান। দীর্ঘ নয় মাস পর মেয়েটাকে দেখবে ভাবতেই মনটা খুশি হয়ে গেছে। কতটা বাবা পাগল ছিলো মেয়েটা! আজ এতদিন হলো সেই বাবার সাথে একবার ফোনেও কথা বলেনি। এসব ভাবতেই বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো রেজওয়ানের। বাসায় রান্না হয় না কতদিন। হোটেল থেকে খেয়ে নেয় তিনবেলা।
বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে রেজওয়ান। প্রিয়ন্তির পৌঁছানোর সময় হয়ে গেছে প্রায়। গাড়ি আসলে এই রাস্তা দিয়েই এলাকায় ঢুকতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো রঙের একটা চার চাকার গাড়ি ঢুকলো বড়ো রাস্তায়। জানালার পাশে প্রিয়ন্তিকে দেখে চিনতে অসুবিধা হলোনা রেজওয়ানের। গাড়ি থেমেছে। রেজওয়ান অপেক্ষা করছে।
" এসে গেছো! ভালো থেকো মিনি প্যাকেট। রুমমেট হিসেবে হলেও একটু মিস করবো।"
প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে হেসে বললো আবরিশাম। এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আবরিশামের প্রতি কোনো রাগ করলো না প্রিয়ন্তি।
" আপনিও ভালো থাকবেন। পারলে এক নারীকে ভালোবেসে জীবন সাজিয়ে নিবেন। হাজার নারীর মধ্যে কখনো মানসিক শান্তি মিলে না,সেটা কেবল এক মায়াবতীতেই মিলে।"
আবরিশাম গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে। প্রিয়ন্তি গাড়ি থেকে নেমে ব্যাগ নামানোর চেষ্টা করছে। আবরিশাম নিজেই ব্যাগ নামিয়ে দিলো। রেজওয়ান মেয়েকে দেখে এবার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।
" ধন্যবাদ আপু, আবার আসবেন। আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামতের জন্য অন্নেক ধন্যবাদ। "
আবরিশামের দাঁত কেলানো কথায় প্রিয়ন্তির গা জ্বলে যাচ্ছে। লোকটা আসলেই অসহ্য! যাকগে এখুনি তো চলে যাবে। এ জীবনে আর মুখ দেখতে হবে না। এসব ভেবে আবরিশামের দিকে তাকিয়ে মেকি হাসলো প্রিয়ন্তি।
" কেমন আছিস মা?"
হঠাৎ বাবার কন্ঠে চমকায় প্রিয়ন্তি।
" আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন? "
আবরিশাম হেসে শুধায়। প্রিয়ন্তি চোখ রাঙ্গিয়ে তাকায় আবরিশামের দিকে। প্রাক্তন স্ত্রী'র বাবার সাথে এতো খাতিরের কী আছে?
" আছি মোটামুটি। তোমাদের কথা তো জানি নতুন করে আর কী জিজ্ঞেস করবো! আমার ভুলের জন্য তোমাদের দুজনের জীবন থেকে কিছু সময় নষ্ট হয়ে গেলো। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও।"
আচমকাই বাবার চেহারার দিকে খেয়াল করলো প্রিয়ন্তি। কেমন রোগা হয়ে গেছে মানুষটা। চোখের নিচে কালো দাগ,চোখগুলো কেমন পিটপিট করছে। মনে হয় রাতে ঘুম হয় না। হওয়ার তো কথাও না। মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজে ঘুমানো যায় না রিভেঞ্জ অব ন্যাচার বলতে একটা কথা আছে না? প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয় না। সঠিক সময় নিজ কর্মের ফল সবাই ভোগ করে।
" ইট’স ওকে আঙ্কেল। যা হওয়ার হয়ে গেছে। প্রিয়ন্তির পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে দিয়ে এবার ওকে সুখী করুন। যাইহোক, আমি আসছি এখন। অনেকটা পথ ড্রাইভ করে এসেছি। আবার যেতেও হবে। ভালো থেকো প্রিয়ন্তি।"
আবরিশাম গাড়িতে উঠে বসলো। প্রিয়ন্তি তাকিয়ে আছে সেদিকে। রেজওয়ান বুঝতে পারছে তার প্রতি মেয়ের একটুও ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। নইলে একবার কথা পর্যন্ত বললো না কেনো? গাড়ি চলে গেছে দৃষ্টি সীমানার বাইরে। কেমন লাগছে যেনো প্রিয়ন্তির। একইসাথে তো ছিলো এতো মাস। হয়তো সেইজন্যই একটা মায়া অনুভব হলো!
" তুমি কেনো এসেছো? আমি তোমার বাসায় যাবো না। "
" এভাবে বলিস না মা। তোর মা-ও চলে গেছে। আমি কতবার তিয়াসদের বাসায় গেছি তাকে ফেরাতে কিন্তু সে আসেনি।"
" না আসার কারণ তুমি ভালো করেই জানো। যে নারী তোমার জন্য আজীবন প্রাণপাত করে গেছে আজ সে কেনো তোমাকে দু'চক্ষে দেখতে পারে না? "
রেজওয়ান কাঁদছে। আজকের মতো অসহায় জীবনে কখনো অনুভব হয়নি তার। সন্তানের থেকে প্রত্যাখ্যান কোনো বাবা সহ্য করতে পারে না। বাবার চোখের অশ্রু প্রিয়ন্তির ভেতরটায় নাড়া দিচ্ছে। শত হলেও তো বাবা! মেয়েদের বাবার প্রতি আলাদা টান থাকে। বাবার নীরবতা দেখে প্রিয়ন্তি ফের বলে,
" কান্না বন্ধ করো। আমি থাকবো তোমার সাথে কিন্তু একটা শর্ত আছে। "
সহসাই রেজওয়ানের দু-চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠলো।
" হ্যাঁ বল মা কী করতে হবে? "
" মা'কে ফেরাতে হবে তোমাকে। সেটাও তিন মাসের মধ্যে। "
" আমি ফেরাবো অর্পাকে। সবকিছু করবো তোদের জন্য। প্রয়োজনে আমি সবার সামনে ওর পায়ে পড়বো। আমি ভালো নেই তোর মা'কে ছাড়া, একটুও না!"
" হুম চলো বাসার যাই। "
বাবার সাথে বাড়ি পৌঁছুলো প্রিয়ন্তি। তিয়াস অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে প্রিয়ন্তির কলের জন্য। আবরিশামের সামনাসামনি হবে না বলে প্রিয়ন্তি আসার পরে একটা কল দিতে বলেছিলো তিয়াস। কিন্তু বাবাকে দেখে সেসব ভুলে গেছিলো প্রিয়ন্তি। তিয়াস বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোতেই প্রিয়ন্তিও বাসা থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়। চোখের সামনে হঠাৎ করে প্রিয়ন্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ায় তিয়াস। প্রিয়ন্তিও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিয়াসের দিকে। মানুষটা আগের চেয়ে যেনো দ্বিগুণ সুদর্শন হয়ে গেছে। এসব ভাবতে মনে মনে নিজেকে বেহায়া সম্মোধন করলো সে। কালো জিন্সের প্যান্টের সাথে কালো টি-শার্ট পরনে তিয়াসের। তিয়াস এগিয়ে আসছে। প্রিয়ন্তির বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। এই মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ালেই বুকের ভেতর কেমন করে উঠে। প্রিয়ন্তি কিছু বুঝে উঠার আগেই তিয়াস হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরে তাকে। প্রিয়ন্তি বাকরুদ্ধ, কিন্তু সময় নষ্ট না করে দ্রুত মাথা গুঁজে দেয় তিয়াসের বুকে। একবুক তৃষ্ণা নিয়ে যে সে-ও অপেক্ষা করেছে এতদিন। মিনিটখানেক পরে তিয়াস ছাড়ে প্রিয়ন্তিকে।
" বাকিটা তোলা থাক রাতে বুকের মধ্যে মিশিয়ে রাখবো অনেকক্ষণ। এখন কেউ দেখে ফেললে তোমাকে কথা শুনতে হবে। কেমন আছো সেটা কিন্তু জিজ্ঞেস করলাম না।"
প্রিয়ন্তি মুচকি হাসলো। চোখে চোখ রেখে শুধালো,
" কেনো জিজ্ঞেস করলে না?"
" কারণ আমি জানি আমাকে দেখা মাত্র তুমি পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভালো থাকা মানুষদের মধ্যে একজন হয়েছো। তোমার চোখের দৃষ্টি আর ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা হাসির ঝিলিক তার প্রমাণ। "
প্রিয়ন্তি লজ্জা পেলো কিঞ্চিৎ। দৃষ্টি মাটিতে নিবদ্ধ করে লজ্জা মাখা মুখখানা আড়াল করলো।
" ইশশ! আমার লজ্জাবতী প্রিয় লজ্জা পাচ্ছে। এসে কল দিলে না কেনো? আর ব্যাগপত্র কোথায়! "
" বাবা এসেছিলো নিতে। এতটা আকুতি করলো ফেরাতে পারিনি গো। দেখে মনে হচ্ছে বাবা যথেষ্ট অনুতপ্ত হয়েছে। তবুও আমি শর্ত দিয়েছি মা'কে ফেরাতে হবে নইলে আমি উনার সাথে থাকবো না। "
" সবই বুঝলাম। কিন্তু উনার সাথে না থাকলে কোথায় থাকবে শুনি?"
" কেনো? তোমার বাড়ি কি আমার জায়গা হবে না? "
" আমার বাড়ি তো তোমারই। আমি আলাদা বাড়ি করবো শীঘ্রই। তাছাড়া এখুনি আমাদের বিয়ে হবে না। ধর্মীয় কিছু বিধিনিষেধ আছে তো। সবে এলে তুমি, তাই না?"
প্রিয়ন্তি একটু ভেবে" হুম "সূচক শব্দ বললো। তারপর তিয়াসের সাথে মা'কে দেখার জন্য গেলো। এতদিন পরে মেয়েকে দেখে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো খুশি হয়েছে অর্পা। মেয়ের কপালে,গালে আদরে ভরিয়ে দিয়েছে। প্রিয়ন্তি মা'কে জড়িয়ে ধরে ছিলো অনেকক্ষণ। মায়ের বুকে আলাদা একটা সুখ থাকে। মা'কে জড়িয়ে ধরায় যে প্রশান্তি সেটা আর অন্য কিছুতেই নেই। তিয়াসের খালামনিও প্রিয়ন্তিকে দেখে বেশ খুশি হয়েছে। ঘন্টাখানেক থাকার পরে সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরে আসে প্রিয়ন্তি। স্নেহা আসবে আগামীকাল দেখা করতে। রিক্তা যোগাযোগ করেনি কিছুদিন ধরে। প্রিয়ন্তি বাসায় চলে আসার পরই পাশের বাসার এক ভদ্রমহিলা আসেন তিয়াসের বাড়ি। ভদ্রমহিলা নানানভাবে প্রিয়ন্তির বিষয় কথা বলে। তিয়াসও সেখানে উপস্থিত আছে।
" বুঝি না আজকালকার ছেলেমেয়ের ব্যাপার-স্যাপার। বিয়ে যেভাবেই হোক সংসার করা উচিত ছিলো। এখন ডিভোর্সি হয়ে এসে একটা অবিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করা কী সমাজ ভালো চোখে দেখবে? "
ময়না আক্তারের কথায় কষ্ট পায় অর্পা। অবশ্য এসব কথা তো শুনতেই হবে। তিয়াসের খালা নিশ্চুপ। ক'জনকে চুপ করাবেন উনি? আমাদের সমাজটাই তো এমন। তিয়াস এতক্ষণ চুপচাপ শুনলেও রাগে ফেটে পড়েছে এখন। কিছুটা উচ্চস্বরে ভদ্রমহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
" বিয়ে আমার, সংসার করবো আমি। লোকের কথায় আমি চলি না আর না তো লোকে আমাকে খাবার-দাবার দিয়ে যায়। ছোটো থেকেই লোকের কথা শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছি। তাই এই লোক আর সমাজকে পরোয়া করার সময় নেই আমার। আসবেন, বসবেন। পান খেয়ে চলে যাবেন কিন্তু এ ধরনের কথাবার্তা আর বলবেন না।"
তিয়াস আর কালক্ষেপণ না করে স্থান ত্যাগ করে। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। এটা কেমন সমাজের রীতিনীতি! কই একটা ডিভোর্সি পুরুষ একটা অবিবাহিতা মেয়েকে বিয়ে করলে কেউ কোনো কথা তোলে না! তাহলে মেয়েদের বেলায় কেনো এতো দুমুখো আচরণ সমাজের?
.
.
.
চলবে.............................