হৃদমোহিনী - পর্ব ০৯ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


মৌনির আচরণে মুগ্ধ সকলেই। মৌনি যখন বসার ঘরে মিশুর বাবা মায়ের সাথে কথা বলছিলো মিশু তখন রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলো। মৌনি কি পরিমাণ স্মার্ট একটা মেয়ে, ভাবলেই বুকটা কেমন যেন করে। ইচ্ছে করে মৌনির মত হয়ে যাই। যেমনি চলার ভংগী, তেমনি কথা বলার স্টাইল। গলার স্বর আর প্রত্যেকটা উচ্চারণে অন্যরকম মাধুর্যতা ফুটে ওঠে। একবার শুনলেই ইচ্ছে হয় আরো শুনি, এমন স্মার্ট কেন মেয়েটা?

মিশু যখন আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলো, পেছন থেকে মেঘালয় জড়িয়ে ধরলো ওকে। চমকে উঠে আয়নায় তাকালো মিশু। আয়নায় দেখতে পাচ্ছে মেঘালয় ওর কাঁধের উপর মাথাটা রেখে আয়নার দিকেই তাকিয়ে ওকে দেখছে। মেঘালয় ভ্রু দুটো নাচালো। মিশু বললো, 'কি?'
- 'একটা জিনিস খুব মজার সেটা খেয়াল করেছো?'
- 'কি জিনিস?'
- 'খাটো মেয়েকে বিয়ে করলে একটা মজা আছে।'
- 'কিরকম?'

মেঘালয় মিশুকে আচমকা একবার ঘুরিয়ে সামনা সামনি দাড় করিয়ে নিলো। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, 'জড়িয়ে ধরলে মাথাটা বুকে এসে ঠেকে যায়।'
- 'কিহ!'

লজ্জায় কথাই বলতে পারলো না মিশু। মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে দুহাতে জাপটে ধরার চেষ্টা করলো। মেঘালয় বললো, 'লম্বা মেয়েকে বিয়ে করলে সমানে সমান হয়ে যেতাম। জড়িয়ে ধরলে ওর কাঁধে মাথা রাখতে হবে নয়ত মাথাটা রাখতে পারবো না শান্তিমত। অথচ তোমার মাথাটা আমার বুকে এসে ঠেকে যাচ্ছে, আমার শান্তি লাগছে বুকে চেপে ধরতে। আর তোমার ও শান্তি লাগছে আমার বুক বরাবর মাথা রাখতে পেরে।'

মিশু লাজুক স্বরে বললো, 'আপনি অনেক দুষ্টু।'
- 'সেটা শুধুমাত্র তুমি জানবে। আর কারো জানার সাধ্য নেই।'
- 'হুম। সবাই জানে লোকটা কি পরিমাণ সুন্দর, কিন্তু এতটা দুষ্টু সেটা কল্পনাও করা যায়না। ভিজা বিড়ালের মতন।'

মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো,' প্রথম থেকেই একে অপরকে জড়াজড়ি করে ছিলাম তাইনা? কোলে নেয়া, সিনজিতে বুকে জড়িয়ে ধরা, ট্রেনে বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছো। ট্রাকেও গায়ের সাথে লেপ্টে ছিলে। সবসময়ই একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে আছি, সে কারণেই বোধহয় একজন আরেকজনের হয়ে গেছি এত দ্রুত৷ শরীরটা হচ্ছে চুম্বক বুঝলে? বিপরীত ধর্মী চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে।'

মিশু লজ্জায় কিছু বলতে পারল না। মেঘালয় বললো, 'তুমি সুস্থ এখন?'
- 'হুম। কেন?'
- 'তাহলে আজকে রাতে তো তোমার খবরই আছে।'

শিউরে উঠলো মিশু৷ কেঁপে উঠতে লাগলো বারবার। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলো ওর। মেঘালয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আলতো করে কোলে তুলে নিলো মিশুকে। মিশু দুহাতে মুখ ঢেকে আছে। মেঘালয় ওকে কোলে নিয়েই আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, 'দেখেছো আমাদেরকে কতটা হ্যাপি কাপল মনেহচ্ছে?' 
- 'উহু আমি দেখবো না।'
- 'দেখে নাও, দেখে নাও। এক সপ্তাহে তোমার চেহারা চেঞ্জ করে দিবো '
- 'কিভাবে?'
- 'পুরুষ মানুষের স্পর্শ পেলে কি হয় জানোনা? আকর্ষণীয় বানিয়ে দিবো।'

মিশু দুহাতে কিল বসাতে শুরু করলো মেঘালয়ের বুকে। মারতে মারতে বলতে লাগলো, 'দেখে মনেহয় সাধুবাবা। কি খারাপ একটা লোক। ছিইহহ ছাড়ুন আমাকে। খুব খারাপ আপনি।'

মেঘালয় হা হা করে হাসছে। পুতুলটাকে কোলে নিয়ে দারুণ মজা লাগছে ওর। মিশু সমানে মারছে আর মেঘালয় হাসছে। এমন সময় মৌনি এসে দাঁড়ালো দরজায়। ওদের দুজনকে এভাবে দেখে বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেলো ওর। ভাইয়া তাহলে মেয়েটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে! সুখী হলেই হয়, ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসে মৌনি।

মৌনি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বললো, 'আসবো?'
মিশু কোল থেকে নামার জন্য সমানে দুইপা ছুঁড়তে আরম্ভ করেছে। কিন্তু মেঘালয় কোল থেকে কিছুতেই নামাবে না। ও বললো, 'মৌনি ভেতরে আয়। দরজাটা বন্ধ করে দিস তো।'

মৌনি ভেতরে ঢুকে দরজা লাগানোর পর যখন সামনে তাকিয়ে দেখলো মেঘালয় এখনো মিশুকে কোল থেকে নামায় নি, ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মিশু লজ্জায় মরে যাচ্ছে প্রায়। দুহাতে মুখটা ঢেকে নিশ্চুপ হয়ে আছে। মেঘালয় বললো, 'বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামাতে ইচ্ছে করছে না। বলতো আমাদের কেমন মানিয়েছে?'
- 'ভাইয়া, সিরিয়াসলি তোদেরকে যা মানিয়েছে! এনিওয়ে, আমি কি এখন এয়ারপোর্টে গেলে টিকেট পাবো?'

মেঘালয় একটু ভেবে বললো, 'প্লেনে যাওয়ার চেয়ে বাসে যা। এত তাড়ার কিছু নেই৷'
- 'বাবা মাকে রাজি করাতে হবে তো৷'
- 'হ্যা, সেজন্যই বাসে যাবি। বাসে বসে চিন্তা করতে করতে পৌঁছে যাবি।'
- 'আচ্ছা। রাতের বাসে উঠবো। আরাফ ভাইয়াকে সাথে নিয়ে যাবো?'
- 'তোর ইচ্ছা৷'

মৌনি ব্যাগ থেকে ওর ফোনটা বের করে দিয়ে বললো, 'তোর তো ফোন নেই। আমার ফোনটা তোর কাছে রাখ, আমি আরাফের নাম্বার থেকে কল দিবো।'

মৌনি ফোনটা বিছানার উপর রেখে বললো, 'আমি তাহলে আসি। ভাবি কি মুখ ঢেকেই রাখবে?'

মিশু কি করবে বুঝতে পারলো না। প্রচন্ড লজ্জা লাগছে ওর। ননদের সামনে এভাবে কোলে নিয়ে থাকলে লজ্জা লাগাটাই স্বাভাবিক। তবুও মুখটা ঢেকেই রইলো। বললো, 'আপু আমি সরি।'

মৌনি হাসতে হাসতে বললো, 'সরি বলার মত কিছু করোনি। দেখি একটু মুখটা?'

মিশু কিছুতেই মুখ খুলতে চাইছিলো না। এবার আর না খুলে পারলো না। মুখ থেকে হাত সরিয়ে চোখ বন্ধ করেই রইলো। মেঘালয় মিশুকে কোলে নিয়ে বিছানার উপর বসে পড়লো। মিশু বারবার মনে মনে ভাবছে, কোল থেকে নামালে কি হয়? এমন কেন লোকটা?

মিশুকে অবাক করে দিয়ে মৌনি নিজের গলা থেকে একটা স্বর্ণের চেইন খুলে মিশুর গলায় পড়িয়ে দিয়ে বললো, 'প্রথম ভাবির মুখ দেখার গিফট এটা৷ আমার ভাইকে বেশি বেশি আদরে রাখবা, সে একটু বেশিই রোমান্টিক। টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স দৌঁড়ের উপর রাখবা ওকে?'

মিশু চোখ মেলে বললো, 'আমার না লজ্জা করছে। আপনারা এত ভালো কেন?'
- 'আমার বাসায় গেলে বুঝবা, আব্বু আম্মুও এরকম ফ্রি। এখন ভাবছি কিভাবে বলবো কথাটা৷ ছেলে না জানিয়ে বিয়ে করেছে শুনলে একটু শকড হবে।'

মেঘালয় বললো, 'যা ঘটেছে সরাসরি সব বলবি। আমি মিশুকে নিয়েই বাকিটা জীবন কাটাতে চাই, মন থেকেই চাই এটাও বলবি।'
- 'বেশ। সাবধানে থাকিস ভাইয়া৷ তোকে একদিন না দেখলে আমি থাকতে পারিনা রে৷ নিজের খেয়াল রাখিস '
- 'তুইও নিজের খেয়াল রাখিস।'

মৌনি এগিয়ে এসে মিশুর হাতটা ধরে বললো, 'সামলে রেখো আমার ভাইটাকে৷ ভালোবেসো হ্যা?'

মিশু লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললো। এখনো মেঘালয়ের কোলে বসে আছে ও। মৌনি বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। মেঘালয় মিশুর মুখটা দুহাতে ধরে একটু কাছে এগিয়ে এনেছে এমন সময় আরাফ এসে বললো, 'ভাই ভূলে গেলি?'

মেঘালয় ক্ষেপে বললো, 'বিয়ের পরের দিন বউ ছাড়া বাকি সবাইকে ভূলে যাওয়াটা নৈতিক দায়িত্ব। এর বিরুদ্ধে গেলে বউ মামলা করতে পারে। এবার যা।'

আরাফ হেসে ফেললো। মেঘালয়কে সবাই একটু বেশিই ভালোবাসে। আরাফের ইচ্ছে করছিলো একবার এগিয়ে এসে মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরতে৷ কিন্তু মিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছে বলে সেটা করতে পারল না। ও মুচকি হেসে চলে আসলো সেখান থেকে। 

ওরা চলে যাওয়ার পর মেঘালয় মিশুকে কোলে নিয়ে এসেই দরজা লাগিয়ে দিলো। মিশু বললো, 'আপনার লজ্জা করেনা বোনের সামনে এভাবে কোলে নিয়ে থাকতে? কেউ না থাকলে কোলে নিতে পারতেন না? খুব খারাপ আপনি।'

মেঘালয় বিছানায় এসে বসলো। মিশুকে কোলের উপর বসিয়ে নিয়ে বললো, 'ম্যাডাম, আমি একটু চালাকি করছিলাম বুঝেন নি? আমি তোমাকে বুঝাতে চাইছিলাম যে আমার বোনের চেয়েও আজকে আমি আমার বউকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, আর মৌনিকে বোঝাতে চাইছিলাম যে এই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসতে আরম্ভ করেছি। এটা আমার পুতুল, সারাক্ষণ কোলে বসিয়ে রেখে আদর করার জন্য৷ বুঝলেন?'

মিশু অবাক হয়ে বললো, 'কি চালাক! আমাকে চালাক বানিয়ে ছাড়বেন মনেহচ্ছে?'
- 'উহু, তোমাকে আমার বাবুর আম্মু বানাবো।'

মিশু আবারও দুটো কিল বসালো মেঘালয়ের বুকে। মেঘ হেসে বললো, 'স্বপ্নে দেখেছো কি যেন? আমরা একগাদা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হানিমুনে গেছি? হা হা হা।'
মিশু লজ্জা পেয়ে বললো, 'হুম।'
- 'আচ্ছা একটা হানিমুন করা যাক না। এখানে শান্তিমত প্রেমও করতে পারবো না, শ্বশুর শ্বাশুড়ির সামনে সংকোচ লাগবে। আর এরপর বাসায় আব্বু আম্মু ব্যাপারটা মেনে নেয়ার পরও হানিমুনের কথা তোলা যাবেনা৷ এখনই সেরে ফেলা যায়না?'

মিশু অবাক হয়ে বললো, 'সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে৷ হুট করেই বিয়ে, হানিমুন। কি থেকে কি হয়ে গেলো!'
- 'এখনো অনেক সারপ্রাইজ বাকি আছে ম্যাম। ওয়েট।'

মিশু হা হয়ে চেয়ে রইলো। মেঘালয় সত্যিই হানিমুনের ব্যাপারে সিরিয়াস সেটা দেখে অবাক হতেই হলো। মেঘালয় মৌনিকে কল দিয়ে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে বলে দিলো। এখন কথা হচ্ছে শ্বশুর শ্বাশুরিকে কিভাবে বলা যায় কথাটা?

২৭!! 

মেঘালয় সরাসরি মিশুর বাবার পাশে বসে বললো, 'বাবা একটা কথা বলার ছিলো।'

বাবা মেঘালয় ও মৌনির প্রতি অনেক খুশি হয়েছেন। উনি আগ্রহের সাথে জানতে চাইলেন, কি কথা?

মেঘালয় বললো, 'মিশুর সাথে অনেক বাজে একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছিলো সেটা তো জানেন। যেকোনো মেয়ের কাছেই ধর্ষণের মত আতংক আর হয়না। অনেক শকড হয়েছে মেয়েটা।'

বাবা একটু চিন্তিত মুখে বললেন, 'হুম। ওই তন্ময় ছেলেটাকে সামনে পেলে মেরে ফেলতাম আমি।'

মেঘালয় বললো, 'বাবা এখন আর ওর কথা বলে কিছুই হবেনা। মিশু সুস্থ শরীরে ফিরেছে এটাই অনেক।'
- 'এরজন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো বাবা। আর এখন তুমিই ওর সবকিছু। আমার মেয়েটাকে একটু আগলে রেখো'
- 'সেটা আমার দায়িত্ব বাবা। আর গতকাল এরকমভাবে বিয়েটা হলো, মিশু এখনো স্বাভাবিক হতে পারছে না। ওর মনের অবস্থা খারাপ, লোকজন আমাদেরকে এভাবে অপমান করেছে সেটা ভূলতেই পারছে না।'
- 'হুম। বুঝতে পেরেছি।'
- 'বাবা আমি সেজন্যই চাচ্ছিলাম ওকে নিয়ে কোথাও গিয়ে দুটো দিন ঘুরে আসতে। আমাকেও মন থেকে গ্রহণ করতে পারছে না, আর ওর মানসিক অবস্থাও ভালো নেই। ঘুরে এলে আশাকরি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।'

বাবা একটু নিশ্চুপ থেকে বললেন, 'হুম এটা ভালো বলেছো। যাও ঘুরে আসো। সমস্যা নেই।'
- 'আপনাদের আত্মীয় স্বজন কিভাবে নেবে ব্যাপারটা সেটাই ভাবছি।'
- 'এদিক ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। শুনলাম তোমার বন্ধুর বিয়ে হচ্ছে, ইচ্ছে হলে বিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসো। লোকজনের কথা ধরে চললে তো হবেনা।'

মেঘালয় মনেমনে খুশি হয়ে উঠল। বাবাকে সন্তুষ্ট করতে পেরে আনন্দ হচ্ছে ওর৷ যে কাউকে বশ করতে মেঘালয়ের বেশি সময় লাগেনা। ও হাসিমুখে বললো, 'বাবা আমরা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসতে চাইছিলাম।'
- 'বাইরে বলতে? দেশের বাইরে?'
- 'না মানে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি?'
- 'আচ্ছা বেশ। যা ভালো মনে করো। তোমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে দ্বিধা নেই আমার।'
মেঘালয় বাবাকে রীতিমতো জাপটে ধরে বললো, 'আপনি আমার আব্বু, আমার বাবা। মিশুকে নিয়ে কোনোরকম দুশ্চিন্তা করবেন না আপনি।'

বাবা মেঘালয়ের পিঠ চাপড়ে দিলেন।

—————

২৮!! 

মিশুর চোখে ঘুম চলে এসেছে। মেঘালয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে চোখ বুজে আসছিলো। মেঘালয় বাবার রুমে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে৷ একটু পরপর বাবার হাসির শব্দ কানে আসছে। বাবার সাথে এত দ্রুত মেঘালয়ের সম্পর্কটা এরকম সুন্দর হয়ে যাবে মিশু ভাবতেও পারেনি। প্রসন্ন মনে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা।

মেঘালয় কথা শেষ করে রুমে এসে দেখলো মিশু ঘুমাচ্ছে। দরজাটা বন্ধ করে বিছানার কাছে এগিয়ে এসে বললো, 'মিশমিশ ঘুমাচ্ছো?'

মিশুর কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। মেঘালয় একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে মনেমনে বললো, 'পাগলীটা ঘুমিয়ে গেলো, কতকিছু ভেবে রাখলাম! থাক, আজকে আর ঘুম ভাঙাবো না। আরাম করে ঘুমালে শরীরটা ভালো লাগবে।'

রুমের লাইট নিভিয়ে মেঘালয় মিশুর পাশে শুয়ে পড়লো আস্তে করে। গায়ে কম্বল টেনে নিয়ে মিশুকে জাপটে ধরে রইলো। অন্ধকারেও কল্পনা করছে মিশুর মায়াবী চেহারাটা। মিশুর মুখটা ছোট্ট একটু, বয়স আঠার হয়েছে দেখলে বোঝাই যায়না। মনেহয় এইতো ষোল হবে। বড্ড ইনোসেন্ট চেহারা, মায়াও আছে ঢের। মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিলো মেঘালয়। 

এমন সময় ফোন বাজতে শুরু করলো। মৌনির ফোনটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে মিশু। মেঘালয় বিছানার শিয়রে তাকিয়ে দেখলো সেখানে ফোন নেই। ফোনটা কম্বলের ভেতরে বাজছে সেটা বুঝতে পেরে বিছানায় হাত দিয়ে হাতরাতে লাগলো। ফোনটা বিছানার মাঝামাঝি বাজছে, কিন্তু মেঘালয় খুঁজে পাচ্ছেনা। বাধ্য হয়েই কম্বলটা সরিয়ে মিশুর হাতের কাছে খুঁজতে লাগলো৷ ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো আরাফের নাম্বার থেকে কল। মেঘালয় রিসিভ করে হ্যালো বলতেই মৌনি বললো, 'ভাইয়া আমার নাম্বারে দশ হাজার টাকা গেছে দ্যাখ? কালকে দশ হাজার পাঠাবো।'
- 'আচ্ছা। আমার লক্ষী বোনটা, সাবধানে যাস।'
- "ওকে ভাইয়া, হ্যাপি ম্যারেড নাইট৷ হা হা হা।'

মেঘালয় ও শব্দ করে হাসলো। তারপর কল কেটে দিয়ে কম্বলটা গায়ে টেনে নেয়ার চেষ্টা করলো। ফোনের মৃদু আলোয় দেখতে পেলো মিশুর পেটের উপর থেকে আঁচল সরে গেছে৷ ফর্সা পেটটা লাল রঙের ব্লাউজে কি যে অপূর্ব লাগছে! এরকম দৃশ্য দেখার পর কি আর স্বাভাবিক থাকা যায়? স্লিম মেদহীন পেট ও কোমরটা দেখে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো মেঘালয়ের। ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে অনেক্ষণ পেটের দিকে তাকিয়ে রইলো স্তব্ধ হয়ে। নাভীর দিকে তাকিয়ে থেকে রীতিমতো ঘোর লেগে গেলো। নিশ্বাস ঘন হচ্ছে ক্রমশই৷ মেঘালয় আবেশে চোখ বুজে ফেললো। তারপর ডান হাতটা রাখলো মিশুর পেটের উপর। 

মিশু পুরোপুরি ঘুমায়নি। ঘুমের ঘোর লেগে এসেছিলো মাত্র। পেটের উপর মেঘালয়ের স্পর্শ পেয়ে চমকে ঘুমটা ভেঙে গেলো মিশুর৷ শরীরটা শিউরে উঠলো। আঁৎকে উঠতে গিয়েও উঠলো না। অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। নিশ্বাস বন্ধ করে থাকার চেষ্টা করলো। 

মেঘালয় চোখ দুটো পিটপিট করছে৷ চোখ সরাতে পারছে না। হাতটা একটু নড়াতেই মিশু বাঁধা দিয়ে মেঘালয়ের হাত ধরে ফেললো৷ মেঘালয় মিশুর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে হাতটা সেখান থেকে সরিয়ে ফেললো৷ এরপর অন্য হাতটা দিয়ে পেটটা আলতো করে ছুঁয়ে দিলো। মিশু এবার আর সহ্য করতে পারছে না। অস্থির হয়ে উঠে বসলো বিছানার উপর। 

আবছা আলো আবছা অন্ধকারে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, 'কি করছেন আপনি?'
- 'সরি মিশু।'

সরি বলেই মাথাটা নামিয়ে ফেললো৷ সরি শব্দটা মেঘালয় এমনভাবে বললো যে মিশুর নিজেকেই অপরাধী মনে হলো৷ মেঘালয়ের বাহুতে হাত রেখে বললো, 'কি হলো আপনার? রাগ করছেন?'
- 'না, তুমি হয়ত এসব পছন্দ করোনা। আসলে আমি কিচ্ছু করিনি বিশ্বাস করো। দেখছিলাম শুধু।'

ফিক করে হেসে ফেললো মিশু। হাসতে হাসতে বললো 'আপনি যেন আমার কে?'
- 'মানে!'
- 'আজব! আপনি আমার বর সেটাও জানেন না?'

মেঘালয় নিজেও হেসে ফেললো। মিশুর মুখটা দুহাতে ধরে বললো, 'তুমি খুব সুইট একটা মেয়ে মিশমিশ।'

কথাটা বলেই মেঘালয় মুখটা এগিয়ে নিয়ে আসছিলো। মিশু বললো, 'বন্ধ করুন।'

মেঘালয় চমকে মিশুর মুখটা ছেড়ে দিয়ে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। মিশু মুচকি হেসে বললো, 'ফোনের টর্চটা বন্ধ করুন।'

বলেই আবারো হাসলো। মেঘালয় হাসতে হাসতে ফোনের আলোটা নিভিয়ে সেটা শিয়রে ছুড়ে মারলো। খপ করে মিশুর মাথাটা ধরে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ৭৪ কেজি ওজনের শরীরটার নিচে পড়ে মিশু ছটফট করতে শুরু করেছে। অন্যরকম ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছে। অন্ধকারে মেঘালয় এ কোন বিপজ্জনক রকমের আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগলো বুঝে উঠতে পারলো না মিশু৷ শুধু দুহাতে মেঘালয়ের মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে রইলো।
পেটের উপর মেঘালয়ের মাথাটা চেপে ধরে কতক্ষণ কেটে গেছে কেউই বলতে পারলো না। এক পর্যায়ে এসে মিশু বাঁধা দিয়ে বললো, 'আমার না বড্ড ভয় করছে।'
মেঘালয় মিশুকে বুকে নিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে বললো, 'তাহলে ঘুমানোর চেষ্টা করো৷ আমি কখনও কোনোকিছুর ব্যাপারে জোর করবো না।'

মিশু মেঘালয়কে জাপটে ধরে বললো, 'আপনি এত ভালো কেন?'
- 'বারে সবসময়ই তো বলো, আপনি একটা খুব খারাপ। আজকে আবার এত ভালো হয়ে গেলাম?'
- 'না, আপনি সত্যিই একটা খুব খারাপ। কিন্তু এই খারাপটাকেই আমার ভালোলাগে, খুব ভালোলাগে। কারণ এই খারাপ মানুষটার দুষ্টুমি গুলো শুধু আমি জানি৷ আর কেউ জানেনা।'

২৯!! 

সকালে নাস্তার টেবিলে বসে বাবা একটা টিকেট মেঘালয়ের হাতে দিয়ে বললেন, 'শ্যামলী, বিকেল চারটায় ছাড়বে।'
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, 'টিকেট ও কাটা হয়ে গেছে!'

বাবা মুচকি হেসে বললেন, 'কালকেই হয়ে গেছে। রাতে তোমাকে দেইনি, ভাবলাম সকালে একটা সারপ্রাইজ হবে দুজনের জন্য।'

মিশু ও মেঘালয় দুজনেই হা হয়ে চেয়ে আছে বাবার দিকে। বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে গেছে। বাবা বললেন, 'টিকেট তো দুদিন আগেই করে রাখতে হয়। সিটটা প্রথম দিকে নিতে পারিনি, মাঝখানের দিকে হয়েছে৷ সমস্যা হবে?'

মেঘালয় কৃতজ্ঞতার ভংগীতে হেসে বললো, 'আরে না না। কোনো সমস্যা হবেনা। আমার তো একেবারে অবাক লাগছে।'
- 'আর হ্যা, আমি রয়েল টিউলিপে বুকিংয়ের ব্যাপারে কথা বলে রেখেছি। তোমরা গিয়ে শুধু টাকা দিয়ে রুমে চলে যাবে।'

মেঘালয় ও মিশু হা হয়ে বললো, 'বাবা!'

দুজনকে এভাবে অবাক করে দিতে বাবার দারুণ মজা লাগছে৷ কক্সবাজারের ফাইভ স্টার হোটেল হচ্ছে রয়েল টিউলিপ। বিলাসবহুল আর মানের দিক থেকেও সেরা। সেখানে বুকিংয়ের কথা শুনে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। সত্যিই সারপ্রাইজ ছিলো বটে।

বাবা বললেন, 'সৌদিয়ার টিকেট কাটতাম কিন্তু রংপুর থেকে সরাসরি কক্সবাজার যাওয়ার জন্য শ্যামলীই আছে শুধু। আর এখন তো শীতকাল, এসির দরকার হবেনা।'

মেঘালয় বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, 'এমনিতেও এত বিলাসিতার দরকার ছিলোনা বাবা। আপনি এতকিছুর ব্যবস্থা করে ফেলবেন ভাবতেও পারিনি।'
- 'মেয়ের জন্য এইটুকু তো করতেই পারি। বিয়েতে কোনো খরচই করতে পারিনি৷ আর তোমার সন্তুষ্টির একটা ব্যাপার আছে তো৷'
- 'সত্যিই আব্বু অবাক লাগছে। আপনি অনেক মহান।'
- 'হা হা হা।'

সবাই মিলে কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ করলো৷ খাওয়াদাওয়ার পর মা মিশুকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কিছু টাকা হাতে দিয়ে বললেন কাপড়চোপড় কেনাকাটার জন্য। মেঘালয়ের কোনো জামাকাপড় নেই। মেঘালয় রীতিমতো অবাক হয়ে গেছে এরকম আতিথেয়তা দেখে৷ বাবা গ্রামের মানুষ হলেও মিশুর চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট। মার্কেট থেকে কেনাকাটা শেষ করে বাসায় ফিরলো দুপুরবেলা। লাঞ্চ সেরে লাগেজ গুছিয়ে নিতেই বিকেল হয়ে এলো। বাসার সবার থেকে বিদায় নিয়ে নবদম্পতি বেড়িয়ে পড়লো হানিমুনের উদ্দেশ্যে৷ বাস ছাড়লো বিকেল চারটায়। বাস ছাড়ার পর মিশুর আনন্দ আর দেখে কে? 

একদিকে মেঘালয়ের মত একজন সাথী, অন্যদিকে  "দ্যা জার্নি"..

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp