হৃদমোহিনী - পর্ব ১৫ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


৪৭!! 

ছুটতে ছুটতে সাগর পাড়ে এসে থামলো মিশু। জোরে জোরে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। জীবনটা অদ্ভুত খেলা শুরু করেছে! এত এত দুর্ভোগ চলে যাচ্ছে। একটার পর একটা এক্সিডেন্ট। আর ভালো লাগছে না কিছু। মেঘালয়ের সম্মানের কথা ভেবেই কষ্ট হয় খুব। বাবা মায়ের মুখটা ছোট হয়ে গেছে সবার সামনে, এখন আবার মেঘালয়ের পরিবার। নিজেই নিজেকে বললো, ' বড্ড ছেলেমানুষি করি আমি। আর কোনোদিনো কারো সামনে যাবো না। মেঘালয়কে একা ছেড়ে দিবো। ওরা সবাই ভালো থাকুক। আমার মত অভাগিনীকে আর ওদের দেখতে হবেনা।'

এদিকে মেঘালয় দ্রুত করিডোর দিয়ে খুঁজতে খুঁজতে হোটেলের বাইরে বেড়িয়ে এলো। মিশু আবার অভিমান করে কোথাও চলে গেলো না তো? আগে সমুদ্রের পাড়ে দেখা দরকার। মেয়েটা যে কেন এত টেনশনে ফেলে দেয়? একা একা কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে! এখানে সমুদ্র ছাড়া আর কোথায় ই বা যাবে? পাগলের মত খুঁজতে খুঁজতে মেঘালয় হাফিয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে দৌড়ে সবখানে খুঁজতে লাগলো। 

মিশু তীর দিয়ে হেঁটে হেঁটে পিছন দিকের ঝাউবনের দিকে চলে গেলো। কোথায় যাবে এখনো জানেনা ও। ঝাউবনে এসে আধ ঘন্টার মত বসে থাকার পর নিজের ভূলটা বুঝতে পারলো। কাজটা মোটেও ঠিক করেনি। বাইরের পৃথিবীটা যে অনেক বেশি কঠিন। এভাবে বেড়িয়ে আসাটা কি উচিৎ হলো? হাতে একটাও পয়সা নেই। কক্সবাজারে চেনা পরিচিত কেউ নেই আর কক্সবাজার থেকে এক পা বাইরে এগোনোর জন্যও টাকার দরকার। সে রাতে মেঘালয় পাশে ছিলো বলে পালিয়ে বেঁচেছে। কিন্তু আজকে সেই মেঘালয়কে রেখে কেন পালাবে ও? আপন মনেই ভাবতে লাগলো কথাগুলি। রাগ ও ক্ষোভের বশে সত্যিই একটা ভূল করে ফেলেছে ও। এখনি ফিরে যাওয়া উচিৎ।

আবারো উঠে একটা ভোঁ দৌড় দিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে এলো মিশু। মেঘালয় এখনো বিচ ধরে এদিক সেদিক খুঁজে বেড়াচ্ছে ওকে। মাথাটাই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এলাকাটা অনেক রিস্কি, এভাবে কোথায় গেলো কে জানে! খুঁজতে খুঁজতে মেঘালয়ের পাগল হওয়ার মত অবস্থা। বিচ থেকে ঝাউবনের দিকে গিয়ে সেখানেও খুঁজে দেখলো দৌড়ে দৌড়ে। এরপর হতাশ হয়ে হোটেলে ফিরে এলো। 

মেঘালয় দরজায় নক করার পর যখন মিশু দরজা খুলে দিলো, চমকে উঠে চোখ বড়বড় করে ফেললো মেঘালয়। মিশু মাথাটা নিচু করে অপরাধীর ভঙ্গিতে বললো, 'সরি।'

সরি বলার পর এক মুহুর্ত দেরি না করে ঠাস করে কষে একটা থাপ্পড় এসে পড়লো মিশুর গালে। মেঘালয়ের দৃষ্টিতে যেন অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে। মিশু প্রথমাবস্থায় বুঝে উঠতে পারলো না কি ঘটলো। মেঘালয় রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, 'নূন্যতম বিবেকবোধ নেই তোমার? দরজা খুলে কোথায় বেড়িয়ে গিয়েছিলে?'

মিশু হঠাৎ ই কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, 'আমার জন্য সবার এত সমস্যা হচ্ছে। আপনাকে বিপদে ফেলে দিয়ে আমার নিজেকে অপরাধী মনেহচ্ছিলো। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো।'
- 'তাহলে ফিরলে কেন? মরে যেতে। মরার সাহস নেই?'
- 'আপনার কথা ভেবে। আপনি ই তো বলেছেন দেশের জন্য কিছু করার আগে যেন না মরি।'

মেঘালয় রেগে বললো, 'তোমার মরার ইচ্ছে হচ্ছিলো না? আসো আমি খুন করে ফেলি।'
মিশু একটু এগিয়ে এসে বললো, 'মেরে ফেলুন তো আমাকে। আমার মরে যাওয়া উচিৎ।
মেরে ফেলুন প্লিজ।'

মেঘালয় খপ করে মিশুর মুখটা দুহাতে ধরে আচমকা ঠোঁট দুঠো নিজের ঠোঁটের ভেতরে নিয়ে নিলো। পরম আবেশে চুম্বন করতে লাগলো মিশুর আলতো ঠোঁটে। সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা সমস্তকিছুর অবসান যেন একসাথে হয়ে যাচ্ছে। মিশুর দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। এটা কিসের কান্না সে নিজেও জানেনা।

অনেক্ষণ পর মেঘালয় ওকে ছেড়ে দিয়ে বললো, 'আমি এয়ারপোর্ট যাবো। তুমিও রেডি হয়ে নাও।'

৪৮!! 

মৌনির কথামত মিশুর বাবা সোজা গেলেন উপজেলা পরিষদে। উপজেলা চেয়ারম্যানকে নিয়ে সরাসরি বসে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললো সায়ান ও পূর্ব। মেঘালয় আর আকাশ আহমেদের সম্মানের ব্যাপারটাও বুঝিয়ে বলা হলো। মিশুর বাবা অনুরোধ করে বললেন, 'বিয়েটা একটা দূর্ঘটনাবশত ঘটলেও আমরা দুই পরিবার মেনে নিয়েছি এটা। এখন এই ছেলেটা অযথা এরকমভাবে বাজে ব্যাপার রটিয়ে দিয়ে মান সম্মান নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে। ভাই, কিছু একটা ব্যবস্থা নিন।'

উপজেলা চেয়ারম্যান মিশুকে ও ওর বাবাকে আগে থেকেই চিনতেন। মিশুর বাবার মোটামুটি ধরণের একটা সুনাম আছে নিজের এলাকায়। তার সম্মানের সাথে জড়িয়ে আছে ব্যাপারটা, আর একটা মিথ্যেকে জিততে দেয়া যায়না। উনি রাজী হলেন সাহায্য করতে। 
এরপর সরাসরি থানায় জিডি করার পর সেই ছেলেটাকে ধরে এনে স্বীকারোক্তি নেয়া হলো। ছেলেটা নিজ মুখে বললো, 'জ্যাঠা আর মিশুর সম্মানহানির জন্যই এই কাজ করেছি। মিশু ও ওর স্বামী এরকম কোনো কাজই করেনি।'

এভাবে উক্তি  নিয়ে ভিডিওটা সেই ছেলের আইডি থেকেই আপলোড করে দেয়া হলো। তারপর ওকে হাজতে ঢুকিয়ে দিয়ে সায়ান ও পূর্ব মিশুদের বাসায় গেলো। মৌনি ফোনে উপজেলা চেয়ারম্যানকে সবকিছু বুঝিয়ে বলার পর যে ব্যাপারটা ঘটলো সেটা কেউ কল্পনাও করেনি।

উনি নিজ মুখে মৌনিকে বললেন, 'আপনার সাথে কথা বলে সত্যিই ভালো লাগছে। একটা মানুষের চিন্তাশক্তি কিভাবে এতটা সুন্দর হতে পারে? আমি যদি আপনাদেরকে সাহায্য করতে চাই?'

মৌনি অবাক হয়ে বললো, 'কৃতজ্ঞ হলাম। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাইনা। আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।'
এরপর চেয়ারম্যান নিজে একটা ভিডিও বানালেন আর সাথে স্থানীয় পত্রিকাতেও রিপোর্ট করে দিলেন। রিপোর্টটা ছিলো এরকম - 

"সমাজ ভালো মানুষগুলোকে এভাবেই খুন করতে প্রস্তুত। অথচ যারা সত্যিকার অর্থে অপরাধী, তাদের কোনো বিচারের দায় কেউই নিতে চায়না। গত কয়েকদিন আগে মিশু নামক এক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হতে হতেও বেঁচে যায়। সেখান থেকে পালিয়ে এসে রাস্তায় বেহুশ হয়ে পড়েছিলো। যে মানুষটা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে,নিজ দায়িত্বে বাসায় পৌঁছে দিতে চাইছে, সেই মানুষ টাকেই আজ এই ধর্ষণের দায় দেয়া হচ্ছে। এ কেমন নিয়ম? মেঘালয় নামক ছেলেটার সম্পর্কে আমি ব্যক্তিগত ভাবে খোঁজ নিয়েছি। তার মত ভালো মানুষ কমই হয়। অথচ তাকে নিয়েই আমাদের এলাকায় এমন কুৎসা রটে গেছে আর পাশাপাশি তার পরিচিত মহলেও তাকে নিয়ে ট্রল করা হচ্ছে। ঘটনার সত্যতা সবার জানা দরকার। তাদের নামে যে গুজব ছড়ানো হয়েছে সেটা নিতান্তই ষড়যন্ত্র। সত্যিকার ঘটনার মূলে আছে একটা করুণ ইতিহাস। মিশুর হাঁটার মতও অবস্থা ছিলোনা, সে এতটাই অসুস্থ ছিলো। মিশুর কথা বলার মতও অবস্থা ছিলো না। বাধ্য হয়েই মেঘালয় ওকে কোলে নিয়ে যাচ্ছিলো। গ্রামের মূর্খ কিছু মাতাল ব্যাপারটাকে বিশ্রী বানিয়ে এলাকার সামনে উপস্থাপন করেছে। মেঘালয়ের ফোন, টাকা পয়সা সবকিছু কেড়ে নিয়ে এরপর এলাকায় অনেক অপমানও করা হয়। তারপর মিশুর আত্মীয় স্বজনরা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় দুজনের মধ্যে। বিয়ের পর সত্যিকার ঘটনা প্রকাশ পায় সবার সামনে। মিশুর পরিবার চেয়েছিলো ভূল শুধরানোর জন্য মেয়েকে ছাড়িয়ে নিতে। কারণ, ভুলটা যেহেতু তাদেরই। অযথা একজন ভালো মানুষকে ঝামেলায় ফেলে দিতে চাননি তারা। কিন্তু এক্ষেত্রে মেঘালয় চরম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়। সে নিজেই মিশুর দায়িত্ব নিয়ে বলে, "মিশু এখন আমার স্ত্রী। আমি দায়িত্ব এড়াতে পছন্দ করিনা।" এরপর দুই পরিবারই কথা বলার মাধ্যমে বিয়েটা মেনে নেয়। মিশু এখন তার শ্বশুরবাড়িতেই আছে। তারা দুজন, দুটো পরিবারের সকলেই খুশি। মাঝখান থেকে এক ছেলে অযথা এদেরকে নিয়ে ভূলভাল তথ্য ছড়িয়ে এলাকাবাসীর কাছে মেঘালয়কে হাসির পাত্র বানিয়ে দিচ্ছে, পাশাপাশি সমস্ত আত্মীয় স্বজনের কাছেও মুখ দেখানোর মত অবস্থা আর নেই। মেঘালয় একজন ইউনিভার্সিটির লেকচারার ছিলেন। তাকে শিক্ষার্থীরা গুরুর মত সম্মান করতো। তাকে নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছেও উপহাসের পাত্র বানানোর চেষ্টা করার মত অপরাধের দায়ে মানহানির মামলা করা হয়েছে মাসুদের ( মিশুর চাচাতো ভাই এর) নামে। একজন অপরাধী তো শাস্তি পেলো কিন্তু যারা এরকম একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে গ্রামের মানুষদের সামনে অপমানিত করলো, টাকা পয়সা মোবাইল ফোন সব কেড়ে নিয়ে আবার বেঁধেও রেখেছিলো। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য থানায় ডায়েরি করা হয়েছে। উক্ত এলাকায় সম্প্রতি কিছু মাতাল ও ছিনতাইকারীর উদ্ভব হয়েছে। এদের নির্মূলের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। পাশাপাশি মিশুকে ধর্ষণের মত জঘন্য আচরণ দ্বারা উত্যক্ত করার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও দৃষ্টি আরোপ করা জরুরি।"

৪৯!! 

তিন দিন কেটে গেলো মাঝখানে। তিন দিন পরের ঘটনা এতটা অবিস্মরণীয় যা সত্যিই কল্পনার বাইরে ছিলো সবার। বাবার শরীরের অবস্থা অনেকটাই ভালো। আর এই নিউজ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে মিশুদের এলাকায় স্থানীয় পত্রিকাতেও প্রকাশ করা হলো। ফলে এলাকার লোকজনরা সকলেই নিজেদের ভূল বুঝতে পেরেছেন। সবার ঘরে ঘরে আলোচিত হচ্ছে ব্যাপারটা। যারা ওদেরকে ভূল বুঝেছিলো সবাই সত্যিটা জানার পর আর কোনো কথা বলেনি। এমনকি শত্রুরা পর্যন্ত থেমে গেছে।

মাসুদ এখনো জেলে। এদিকে যে মাতাল লোকগুলো মেঘালয়কে ওরকমভাবে অপদস্থ করেছে সবার নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এবার সব শত্রু একসাথে সাজা পাবে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার এটাই যে, মেঘালয়ের আত্মীয় স্বজনরা প্রায় সবাই আকাশ আহমেদকে দেখতে আসছেন আর মুরুব্বিরা বলে দিচ্ছেন দ্রুত ছেলের বিয়ের প্রোগ্রাম করে বউকে ঘরে তোলা হোক। সবাই বিয়ের দাওয়াত খেতে চায় আর নতুন বউয়ের প্রাপ্য সম্মানটাও তাকে ফিরিয়ে দেয়া দরকার। মিশু ভাবতেও পারেনি ব্যাপারটা এভাবে সুন্দরভাবে সমাধান হয়ে যাবে। মৌনির প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে মেঘালয় ও মিশু। 

—————

৫০!! 

আকাশ আহমেদ ব্যক্তিগত ভাবে মিশুর সাথে কথা বলতে চাইলেন। কথাটা শুনেই হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে মিশুর। শ্বশুরমশাইয়ের সাথে এখনো একবারও কথা হয়নি ওর। কি যে বলবেন ধারণা করা যাচ্ছেনা।

 মানুষটা অনেক গম্ভীর হয়ে আছেন। সবাই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে মিশু ওনার বেডের কাছাকাছি এগিয়ে আসলো। মেঘালয়ও মিশুর পাশে এসে দাঁড়ালো। আকাশ আহমেদ ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোকে কি আলাদা করে যেতে বলবো?'

মেঘালয় মিশুর আরো কাছাকাছি এসে বললো, 'আমি সবসময় এই মেয়েটার পাশে থাকতে চাই। তুমি কি বলবে জানিনা, কিন্তু যাই বলবে দুজনকেই বলো। কারণ আমরা অপরাধী হলে দুজনেরই সমান অপরাধ।'

বাবা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, 'দুদিনেই এত প্রেম?'
- 'প্রেম তো বটেই। প্রেমের চেয়েও বড় আমার দায়িত্ববোধ। মেয়েটার এখানে কেউ নেই আমি ছাড়া। আমি ওকে এনেছি, আমিই ওর সবকিছুতে থাকবো।'

বাবা হেসে ফেলে বললেন, 'যাক। ছেলেটা মানুষ হলো তবে? যেখানে আজকালকার ছেলেরা মাইয়া রে মাইয়া রে তুই অপরাধী গান গায়। হা হা হা।'

বাবাকে হাসতে দেখে চমকে উঠলো মিশু। মিশু ও মেঘালয় একে অপরের দিকে তাকালো অবাক হয়ে। বাবা হেসেছে! তারমানে কাম হোয়াগা। মেঘালয় মিশুর দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো। মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে তাকালো। 

মেঘালয় বললো, 'কি বলতে চাও আব্বু?'
- 'যা বলার তুই তো বলেই দিলি। আমি আর কি বলবো?'
- 'তোমার কি নেগেটিভ কিছু বলার ইচ্ছে ছিলো?'
- 'তা নয়। আমি জানতে চাই এই বাচ্চার এইম কি? এখনি কি সংসার শুরু করতে চায়?'

মিশু একবার মেঘালয়ের দিকে তাকালো। প্রশ্নের অর্থ বুঝতে না পেরে অবাক হয়েই চেয়ে রইলো। আকাশ আহমেদ বললেন, 'ব্যাপারটা যেহেতু এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে কাজেই বিয়েটা ধুমধাম করেই আয়োজন করা উচিৎ। কিন্তু ওর তো এখনো কৈশোরই কাটেনি, এত তাড়াতাড়ি কি সংসারে মন বসবে? যেকোনো মেয়ের  জন্যই অন্তত বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে নিজের মত থাকতে দেয়া উচিৎ। জগতের বড় বড় বিস্ময়গুলো দেখে ফেলা উচিৎ। তারপর না সংসার। সুখী হওয়ার গোপন রহস্য হচ্ছে জগতের সব বড় বড় বিস্ময় দেখে ফেলা।'

মিশুর চোখেমুখে মুগ্ধতা। শ্বশুরমশাই দারুণ কথা বলেছেন তো! 
আকাশ আহমেদ বললেন, 'কি রে মেয়ে, অবাক হচ্ছিস?'

মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, 'হুম।'

আকাশ আহমেদ এবার শব্দ করে হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, 'আমার কাছে জীবন একটা উপভোগ্যকর জিনিস। একটা ছেলে জেনারালি সাতাশ আটাশ বছর বয়স পর্যন্ত লাইফটাকে নিজের মত এনজয় করতে পারে। সেখানে একটা মেয়ে ষোল বছরে পা দিলেই আমরা ভাবি মেয়ে বড় হয়ে গেছে। সতের হতেই বিয়ের চিন্তা করি, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করতে করতেই বিয়ে দিই। একটা মেয়ে ইন্টার পাশ করার পর মাত্র জীবনকে বুঝতে শেখে। তাকে অন্তত কয়েকটা দিন নিজের জীবনটাকে উপভোগ করতে দেয়া উচিৎ তাইনা? বিয়ে তো একদিন দিতেই হবে। দু এক বছর সে থাকুক না তার মত। বই পড়ুক, ট্রাভেল করুক, গ্রাজুয়েট হোক, চাকরি নিক, দুটো দিন আয়েশ করে নিজের টাকায় শপিং টপিং করুক। ঘোরাফেরা করুক, তারপর বিয়ে দিলে ক্ষতি কি?'

মেঘালয় বাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতটা ধরে বললো, 'স্যালুট ইউ আব্বু।সব বাবারা যদি তোমার মত ভাবতো।'
- 'আহা, সব বাবাকে আমার সাথে কম্পেয়ার করছিস কেন? সব বাবারা বলবে, মেয়েকে ঘরে বন্দি করে রাখো। এত কিসের ঘোরাঘুরি? বিয়ে হলে জামাইয়ের সাথে ঘুরবে। আমি তো সবার থেকে আলাদা। হা হা হা।'

মেঘালয় ও মিশুও হেসে উঠলো বাবার কথা শুনে। মিশু নিঃসংকোচে বললো, 'সত্যিই আপনি আলাদা।'
- 'আমি কি তোর আংকেল?'

মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালো। আকাশ আহমেদ বললেন, 'বাক্যের শেষে বাবা শব্দটা যোগ করিস না কেন?'

মিশু মুচকি হেসে বললো, 'আমি তো আপনাকে বাবা বলবো না, আমিও আব্বু বলে ডাকবো।'
- 'তোর আম্মু আবার মাইন্ড করবে না তো? হা হা হা।'

মেঘালয় ও মিশু মুখ টিপে হাসলো। হাসপাতালের বেডে শুয়েও মানুষটা কি সুন্দর করে হাসছে! এরকম হাসি দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ইচ্ছে করে মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখতেই থাকি। 

মিশু বললো, 'আপনি অনেক ভালো বাবা।'
- 'বাবারা সবসময় ভালোই হয় রে মা। প্রত্যেক মেয়ের কাছেই তার বাবা রাজকন্যা। সরি ভূল বললাম। প্রত্যেক বাবার কাছেই তার মেয়ে রাজকন্যা। হা হা হা।'

দুজনেই হেসে উঠলো। বাবা হাসি থামিয়ে বললেন, 'হাসি হচ্ছে সর্বরোগের মহৌষধ। এজন্য বেশি বেশি হাসবা। হাসতে হাসতে আজকে হার্টের বাপের নামও ভূলিয়ে দিবো। সে যে এটাক হয়েছিলো সেটাও ভূলে যাবে।'

মিশু মুচকি হেসে বললো, 'আমি প্রচণ্ড ভয়ে ছিলাম। এখন অনেক হালকা লাগছে।'
- 'তুই তো এমনিতেও হালকা। নয়ত কি আর মেঘালয় কোলে নিয়ে ক্ষেতের আইল দিয়ে হাঁটতে পারে? হা হা হা, হো হো হো।'

মিশু লজ্জা পেয়ে হাসলো। সাংঘাতিক রকমের রসিক মানুষ তো! অথচ কি ভয় টাই না পেয়েছিলো মিশু। মেঘালয় আরেকবার মিশুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারলো। আকাশ আহমেদ মিশুকে কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'বাসায় কে কে আছে?'
- 'আব্বু আম্মু আর ছোটবোন।'
- 'তোর কয়টা আব্বু? ও হো হো হো।'

মিশুও না হেসে পারলো না। হাসি থামিয়ে বললো, 'আপনি অনেক দুষ্টু।'
- 'আরে মা হার্টের বাপের নাম ভুলিয়ে দিচ্ছি হেসেহেসে। হাসলে হার্ট পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। তুই কি একটা গল্প শুনিস নি?'
- 'কি গল্প আব্বু?'

আকাশ আহমেদ বললেন, 'এক লোক মৃত্যুশয্যায় চলে গিয়েছিলো। সবাই ধরে নিয়েছিলো সে আর বাঁচবে না। কিন্তু তার মনোবল ছিলো অনেক বেশি। সে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে একটা বাড়িতে চলে গেলো। জগতের সবচেয়ে হাসির হাসির গল্প, কমেডি মুভি দেখে প্রচুর হাসতে লাগলো। দিনের অধিকাংশ সময়েই সে হাসতে হাসতে এক সময় সুস্থ হয়ে গেলো। মনোবলের সাথে হাস্যরস খুব কাজে দেয় বুঝলি?'

মিশু মুগ্ধ হয়ে বললো, 'সত্যি! তারপর সে বেঁচে গেলো?'
- 'তাহলে কি সুস্থ হয়ে মরে গেলো নাকি? হা হা হা।'

মিশু ও মেঘালয় দুজনেই হেসে উঠলো। হাসি থামার পর বাবা বললেন,  'তো ইয়াং ম্যান, হানিমুন কেমন হলো?'

মিশু লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো। মেঘালয় বললো, 'একদমই ভালো না। আরেকবার হানিমুনে যাবো।'
- 'টাকা কি তোর বাপে দেবে?'
- 'বাপ ছাড়া আর কে দেবে?'
- 'বাপের টাকায় হানিমুন করতে লজ্জা করেনা? কাল থেকে অফিসে বসবি।'
- 'ঠিকাছে। তাহলে আজকেই হানিমুন সেরে আসি?'
- 'হা হা হা। বাপের সাথে ইয়ার্কি করো ব্যাটা?'
- 'বাপকা ব্যাটা বলে একটা কথা আছে না?'

আকাশ আহমেদ হেসে বললেন, 'আমি আজকেই বাসায় যেতে চাই। আর মিশুর বাপকেও আজকে চলে আসতে বলো। সবকিছু ফাইনাল কথা বলতে চাই। উনি এসে মিশুকে নিয়ে যাবেন।'

মেঘালয় ও মিশু একে অপরের দিকে তাকালো। বুকটা ধক করে উঠলো মিশুর। নিয়ে যাবেন মানে! হঠাৎ এই কথা কেন বললেন বাবা? মুখটা করুণ করে তাকিয়ে রইলো মিশু। 

বাবা বললেন, 'আরে তোমরা এমন প্যাঁচার মত মুখ করে আছো কেন? মিশুর বাবা এসে বিয়ের তারিখ ফাইনাল করে যাবেন। আর আমরা গাড়ি নিয়ে গিয়ে রংপুর থেকে আয়োজন করে নতুন বউ নিয়ে আসবো।'

হাসি ফুটে উঠলো মেঘালয় ও মিশুর মুখে। মেঘালয় মুচকি হেসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, 'তুমি একটা ভালোবাসা। তাড়াতাড়ি বাসায় চলো তো।'
- 'ওকে যাচ্ছি এবার বলতো অয়ন্তিকা মেয়েটার কি হবে?'
- 'ও নাহয় অপরাধী গান গাইবে।'

বাবা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেন রে? গোপনে কিছু করেছিস নাকি?'
- 'আব্বুউউউ...'

হেসে উঠলেন বাবা। মিশুও হাসলো। বাবা ওঠার চেষ্টা করে বললেন,  'একটু ওয়াশরুমে যাবো।'

মেঘালয় বাবাকে ধরে উঠিয়ে দিয়ে বললো, 'একটু কেন? পুরোটাই যাও।'
- 'হা হা, আমি একাই পারবো।'

তবুও মেঘালয় হাত দিয়ে ধরে বাবাকে উঠতে সাহায্য করলো। বেড থেকে নামিয়ে বাথরুমের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বাবা বলে দিলেন উনি একাই যেতে পারবেন। বাবাকে ছেড়ে দিয়ে মেঘালয় মিশুর কাছে এসে বললো, 'দারুণ একটা বাবা না আমার?'

বাবা বাথরুমে যেতে যেতে বললেন, 'দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিস বাবা।'

বলেই হেসে উঠলেন। মিশু লজ্জা পেয়ে মেঘালয়কে বললো, 'এত দুষ্টু কেন উনি?'
- 'আমার বাবা তো। কিংবা আমিই বাবার জিন পেয়ে এতটা দুষ্টু হয়েছি।'

কথাটা বলতে বলতে মেঘালয় মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, 'কি পরিমাণ টেনশনে কাটিয়েছি এই দুটো দিন। আজকে রাতে কিন্তু রেডি থেকো মিস ফুল্টুসি।'
- 'আব্বু এলে তো আমাকে নিয়ে যাবে। কতদিন লাগবে বিয়ের প্রোগ্রাম এরেঞ্জমেন্ট করতে?'
- 'দশদিন তো লাগবেই। দশটা দিন দূরে থাকবো! ফোনে ফোনে প্রেম করতে হবে। এতদূর তো হুট করে চলে যেতেও পারবো না।'
- 'এই ছাড়ো, আব্বু চলে আসবে।'
- 'ঠিকাছে, এখন ছাড়ছি। কিন্তু কি বলেছি মনে থাকে যেন। আজকে তোমার খবর ই আছে।'

মিশু শিউরে উঠে বললো, 'ছাড়ো তো।'

মেঘালয় ওকে ছেড়ে দিয়ে ভদ্র ছেলের মত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বড্ড সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। এত এত দুশ্চিন্তার পর সুখের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মেয়েটার জীবনে একটার পর একটা দূর্ভোগ, এখন যদি একটু সুখের মুখ দেখে। মিশুকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে হিসেবে দেখতে চায় মেঘালয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp