হৃদমোহিনী - পর্ব ১৪ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


৪৩!! 

মাথায় বাজ পড়লে যেমন হয়, হঠাৎ বাবার এরকম কথা শুনে একই অবস্থা হয়েছে মেঘালয়ের। মিশুকে সে অনেক আপন করে নিয়েছে, এখন যদি বাসার লোকজনরা নিতে না পারে তাহলে কি হবে মেয়েটার? এত বড় মুখ করে নিয়ে এসেছে তাকে, সমস্ত কথাই মিথ্যে হয়ে যাবে যে।
মিশু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কি হয়েছে? বাবা কি বললেন?'

মেঘালয় করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বলতে পারলো না কিছু। মিশু মেঘালয়ের কোলের উপর উঠে বসে দুহাতে গলাটা জড়িয়ে ধরলো। মুখটা এগিয়ে এনে মেঘালয়ের মুখের সামনে কাৎ করে বললো, 'আসো।'
মেঘালয় কোনো সাড়া দিলো না। প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে ওর। মিশু মেঘালয়ের মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে চুলগুলো মুঠো করে ধরে ফেললো। মুখটা ক্রমশই কাছে এগিয়ে আনতে আনতে বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, 'বাবা কি বললেন? আমরা কবে বাসায় যাবো? আপু সবকিছু ম্যানেজ করেছে তাইনা?'
মিশু মেঘালয়ের মুখের একদম কাছাকাছি চলে এলে নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠতে শুরু করলো ওর। আবেশে চোখ বুজে আসতে চাইছে। মিশু দুহাতে মেঘালয়ের চুলগুলো খামচি দিয়ে ধরে আরো কাছে টানতে টানতে বললো, 'চব্বিশ ঘন্টা কি এখানেই কাটাবো? বাসায় যাবো কবে?'
কথাটা বলতে বলতে ঠোঁট দুটো একদম কাছে এগিয়ে এনে মেঘালয়ের ঠোঁট স্পর্শ করতে যাবে এমন সময় মেঘালয় বললো, 'বাবা বলেছে আর কখনো বাসায় এসোনা। কখনো আমাকে ফোনও দিওনা।'

বড় ধরণের ধাক্কা খাওয়ার মত চমকে উঠে মেঘালয়ের মাথাটা ছেড়ে দিলো মিশু। সরে গেলো অনেকটা দূরে। এরকম কথা শোনার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলোনা ও। মেঘালয় কয়েকদিন ধরে ভরসা আর বিশ্বাস দিয়ে আগলে রেখেছে ওকে। মৌনি নিজেও নিজের গলার চেইন খুলে পড়িয়ে দিয়ে গেছে। মেঘালয়ের কাছে যতটুকু জেনেছে, পরিবারটা অনেক বেশি সুন্দর। তাহলে এরকম কেন হলো?
দুজন দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। মিশুর বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠছে। ওর জন্য মেঘালয়ের সাথে বাবার সম্পর্কটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না ও। কষ্ট হচ্ছে খুব। মেঘালয়ের কোল থেকে উঠে বিছানা থেকে নেমে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালো ও। মেঘালয় মাথায় হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগলো এবার কি হবে? সায়ানের নাম্বারে কল দিলে কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গেলো। বাধ্য হয়ে মায়ের নাম্বারে কল করলো মেঘালয়। সেটাও রিসিভ হলোনা। এবার সত্যিই প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে। 

মেঘালয় বিছানা থেকে নেমে বেলকুনিতে গিয়ে মিশুর পাশে দাঁড়ালো। মিশু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘালয় একবার নাম ধরে ডাকলো, 'মিশু..'
পাশ ফিরে মেঘালয়ের দিকে তাকালো মিশু। দুজনের চেহারাতেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো মেঘালয়ের। মেয়েটা অনেক ভয় পেয়ে গেছে। মেঘালয় মিশুর মুখটা ধরে আশ্বাস দিয়ে বললো, 'ছাড়বো না রে পাগলী।'
আচমকা মেঘালয়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে জাপটে ধরলো মিশু। বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেললো। দুহাতে মেঘালয়ের শার্ট খামচে ধরে বললো, 'আমি কোথায় যাবো ছেড়ে দিলে?'
- 'বললাম তো কখনো ছাড়বো না। আমি তোমার, তোমাকে একা কোথাও ছাড়বো না।'

মিশু আর কথা বলতে পারলো না। শক্ত করে ধরে কেঁদেই চললো। মেঘালয়ের নিজেরও বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে। বাসার কেউই ফোন ধরছে না। মৌনি এখনো কিছুই জানালো না। এরপর কি যে হবে বলা যাচ্ছে না। মায়ের সাথে একবার কথা বলাটা বিশেষ দরকার। সেও ফোন রিসিভ করছে না। মিশুকে বুকে জাপটে ধরে এসবই ভেবে চলেছে মেঘালয়। অনেক্ষণ কেটে গেলো এভাবে।

৪৪!! 

রুমে এসে দুজনেই বসে আছে বিছানায়। কারো মুখে কোনো কথা আসছে না। মেঘালয় নিশ্চুপ হয়ে ভেবে চলেছে বাবাকে কিভাবে বুঝিয়ে বলবে সবটা। মিশুকে নিয়ে সোজা বাসায় গিয়ে তুলবে কিনা? তারপর বাবাকে সবটা ভালোভাবে বুঝালেই বুঝবে। এসব ভেবে মেঘালয় যখন নিজেকে সামলে নিচ্ছিলো, এমন সময় মায়ের নাম্বার থেকে কল। অনেক আশা নিয়ে ফোন রিসিভ করলো মেঘালয়। কিন্তু ওপাশ থেকে মৌনির উদ্বিগ্ন গলা শোনা গেলো, 'ভাইয়া..'
- 'হুম মৌনি, কি হয়েছে?'
- 'আব্বুর হার্ট এটাক হয়েছে ভাইয়া।'
- 'কিহ!'
চিৎকার করে উঠলো মেঘালয়। মিশুর ভয়েই বুকটা কেঁপে উঠলো। মেঘালয়কে এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন! কোনো বিপদ ঘটলো না তো?
মিশু এগিয়ে এসে মেঘালয়ের পাশে বসে শোনার চেষ্টা করলো ওপাশ থেকে কি বলছে।  মৌনি বললো, 'ভাইয়া, তোর সাথে কথা বলে ফোন রাখার পরপরই আব্বুর শরীরটা খারাপ করলো। হার্ট এটাক হয়েছে বলে আমার ধারণা। এখন হসপিটালাইজড। আম্মু একটা অপারেশনে গেছে, আব্বুকে আমিই হসপিটালে নিয়ে এলাম। এখন ডক্টর দেখছেন আব্বুকে।' 

মেঘালয় বললো, 'এরকম কেন হলো? তুই কি বলেছিলি আব্বুকে?'
মৌনি একটু নিশ্চুপ থেকে বললো, 'ভাইয়া রে সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আজকে বলবো ভেবেছিলাম। কিন্তু তার আগেই...'
মেঘালয় উৎকণ্ঠা ভরা কণ্ঠে বলল, 'তার আগেই কি?'
মৌনি আর চুপ থাকতে পারলো না। বললো, 'ফেসবুকে কে বা কারা তোদের ছবিসহ আপলোড দিয়েছে, মাঝরাতে নোংরামি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। মিশুর নামে কিছু লেখা নেই কিন্তু তোর নামে অনেক আজেবাজে কথা লিখেছে। শহরের আকর্ষণীয় যুবক ভূলিয়ে ভালিয়ে ঘর থেকে বের করে এনেছে গ্রামের সরল মেয়েটাকে। ধর্ষণের চেষ্টা করেছিস ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক বিশ্রী একটা ব্যাপার।'
বলতে বলতে ওর গলা ভিজে উঠতে শুরু করলো। বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে মেঘালয়ের। নিজের নামে কখনো এরকম কিছু শুনতে হবে সেটা কল্পনাও করেনি ও। আজীবন সম্মানের সাথে বেঁচে থেকে আজকে এটা কি হলো! অসম্ভব!
মৌনি বললো, 'কোনোভাবে আমাদের এক রিলেটিভের চোখে পড়েছে সেই ছবি। এরপর সরাসরি আব্বুর কানে। আব্বু যখনি বলেছে আমি পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছি। কিন্তু আব্বুর রাগ একটাই, এডভেঞ্চার করতে ইচ্ছে করে তো আর জায়গা পায়নি? নদীতে ভেসে জোৎস্না দেখার জন্য টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যেতে পারতো। ওরকম গণ্ডগ্রামে কেন গেছে? মাঝেমাঝে ছোট্ট একটা ভূলই মানুষের সারা জীবনের সুনাম নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ভাইয়া।'
মেঘালয় নিশ্চুপ। সত্যিই ভূল করে ফেলেছে সেটা এখন বুঝতে পেরেছে। নিজে একা নদীতে ভাসা আর একটা মেয়েকে নিয়ে নদীতে ভাসা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। এরকম বিপদ ঘটতে পারে জানলে কখনোই যেতো না সে। কিন্তু এর আগে সে যখন একাই নদীতে নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিল, তখন মনে হয়েছিলো প্রিয়জনকে নিয়ে কোনো এক রাতে বের হওয়াটা নেহাত মন্দ হবেনা। গ্রামের লোকজন এরকম খারাপ ভাবে নেবে সেটা ভেবে দেখেনি ও। 
মৌনি বললো, 'বলতে কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। বিশ্বাস করতেও বাঁধছে আমার। আমরা তো কখনো কারো ক্ষতি করিনি তাহলে এমন কেন হলো আমাদের সাথে? একজন ইউনিভার্সিটির লেকচারারকে সব স্টুডেন্টস গুরুর মত মানতো। একজন যদি জানতে পারে পুরো ইউনিভার্সিটি ভাইরাল হয়ে যাবে ব্যাপারটা। তোর সাথে সাথে আব্বু আম্মুর সম্মানটা কোথায় নেমে যাবে ভাবতে পারিস? একজন ভালো ডক্টর হিসেবে আম্মুর একটা লেভেল আছে, আমাদের একটা স্ট্যাটাস আছে। কোনো বাবা মানতে পারবে এটা? হাজারটা পোস্ট দিয়েও মানুষের ভূল ভাঙাতে পারবি তুই? রিলেটিভরা কি বলবে? সবাই হাসবে তোর এডভেঞ্চারের কথা শুনলে।'

মেঘালয় নিশ্চুপ। কথা বললেই হয়ত গলা ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যাবে। কিইবা বলার আছে? আজীবনের জমিয়ে রাখা সমস্ত সম্মান, অর্জন সবকিছু ধূলায় মিশে যাবে। একদিকে সম্মান, অন্যদিকে বাবার হার্ট এটাক। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। এমন কেন হলো? কোন ভূলের অপরাধে এই শাস্তি পাচ্ছে ওরা? একটা জোৎস্না বিলাস আজীবনের সমস্ত অর্জনকে নষ্ট করে দেবে নিমেষেই। এটাই ভূল?

মৌনি বললো, 'বাবা সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু যাদের কানে পৌঁছে গেছে কথাটা, তারা এতক্ষণে পুরো দুনিয়াকে জানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে হয়ত। আব্বুর অফিসে কথাটা ভাইরাল হলে কি যে হবে। দুদিন পর তোকেই বিজনেসের দায়িত্ব নিতে হবে। অফিসে কোন মুখে যাবি ভাইয়া? কি করলি এটা তুই?'

মিশু সব কথা শুনলো ফোনের পাশে বসে থেকে। আর শুনতে পারছে না। ওর ইচ্ছে করছে মাটির ভেতর ঢুকে যায়। মাটিটা কেন দুইভাগ হয়ে যাচ্ছেনা? মরে গেলেও এই লজ্জা কমবে না। মেঘালয়ের এই দূর্দশার জন্য সেই দায়ী। প্রথমদিন যদি চিপস খেতে না চাইতো তাহলে মেঘালয় কখনোই ট্রেন থেকে নামতো না। ট্রেন থেকে মিশুকেও লাফ দেয়ার দরকার হতোনা। যমুনায় ভেসে চাঁদ দেখার সাধও ওর জাগতো না। মিশু রীতিমতো ফোর্স করেছিলো যমুনায় ভেসে চাঁদ দেখার জন্য। আর তার ফল আজকের এই করুণ পরিণতি। ওর জন্য এতকিছু করেও ছেলেটার এমন দশায় পড়তে হলো! রক্তমাখা শরীরে কোনো মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে তুলবে কোন ছেলে? ধর্ষণের হাত থেকে পালিয়ে মিশুর মরার মত অবস্থাই হয়েছিল। সে রাতে মেঘালয় ছিলো বলেই প্যাড বদলানো থেকে শুরু করে খাবার খাওয়ানো, ওষুধ খাওয়ানো, সেবাযত্ন পেয়ে বেঁচে আছে মিশু। যার জন্য মিশু বেঁচে গেলো আর আজকে সেই মানুষ টাকেই ধর্ষণের দায় কাঁধে নিতে হবে? সমাজ ভালো মানুষ গুলোকে এভাবেই কষ্ট দেয়। এমন ফেরেশতার মত একজন মানুষ আজ সবার চোখে খারাপ হয়ে যাবে। 
মেঘালয় ফোন রেখে দুহাতে মুখ ঢেকে মাথাটা নিচু করে ফেললো। লজ্জায়, ক্ষোভে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। মিশু আর সহ্য করতে পারছে না। আস্তে করে উঠে দরজা খুলে এক ছুটে হোটেল থেকে বেড়িয়ে এলো ও। একটা পরিবারের সবাই সাফার করছে তার জন্য। সামান্য পাগলামির জন্য কতগুলো মানুষের সম্মান শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই মুখ আর কখনো মেঘালয়কে দেখাতে চায়না মিশু। মেঘালয়ের পরিবারকে তো নয়ই। 

—————

৪৫!! 

মৌনি অনেকটা ডিটেকটিভ মাইন্ডের মেয়ে। সবসময় রহস্য খুঁজতে আর উদঘাটন করতে ভালোবাসে। প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়েটি কখনো অন্যায়ের কাছে হার মানেনা। স্পষ্ট কথা অনায়াসে বলে ফেলে আর সবসময় আত্মবিশ্বাসী। বাবাকে হসপিটালে অসুস্থ অবস্থায় রেখেই বেড়িয়ে পড়েছে সমস্যার সমাধান করতে। মাকে রেখে গেছে বাবার পাশে। মা নিজেও একজন ভালো ডক্টর। মা থাকতে বাবার পাশে আর কাউকে প্রয়োজন নেই। 

যে আত্মীয়ের কাছ থেকে বাবার কাছে প্রথম কল এসেছে প্রথমেই তার কাছে যাবে ও। মেঘালয়ের মানসিক অবস্থা এখন খুবই খারাপ। সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সামান্য উপকারে আসতে পারলেও মৌনির নিজেকে বোন হিসেবে সার্থক মনে হবে। মেঘালয় মৌনির কলিজার অর্ধেক। মেঘের জন্য সবচেয়ে বেশি কেউ ভেবে থাকলে সেটা মৌনি নিজেই। 

মৌনির এক পরিচিত মেয়ে এয়ারলাইন্সের টিকেট বিক্রির জব করে। ও সবার আগে মেয়েটিকে ফোন দিয়ে বলে দিলো যেভাবেই হোক কক্সবাজার থেকে ঢাকার দুটো টিকেট ম্যানেজ করতে পারবে কিনা? মেয়েটি বলেছে খোঁজ নিয়ে জানাবে।

এরপর গেলো সেই আত্মীয়ের বাসায়। লোকটি মেঘালয়ের চাচাতো ভাই। বয়সে মেঘালয়ের চেয়ে বছর চারেক বড় হবে। মৌনি সোজা বাসায় গিয়ে ওকে ডেকে নিয়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। বাড়ির লোকজন সবাই থ!

মৌনি সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, 'রাফিন ভাইয়া তুমি কি দেখেছো ফেসবুকে ক্লিয়ার করে বলোতো?'

রাফিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মৌনির দিকে। মৌনির চেহারায় যে দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে তা দেখেই ভেতর থেকে একটা ভালোলাগা কাজ করছে। ইচ্ছে করছে অকপটে কথা বলি মেয়েটার সাথে। 

রাফিনকে চুপ থাকতে দেখে মৌনি বললো, 'ভাইয়া এখানে কয়েকটা জীবনের জীবন মরণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। একটা ফ্যামিলির সম্মান জড়িয়ে আছে।'
- 'মানে!'
- 'বাবার হার্ট এটাক হয়েছে।'

হা হয়ে গেলো রাফিন। আকাশ আহমেদকে সবাই যে পরিমাণ ভালোবাসে আর সম্মানের চোখে দেখে, তাতে এরকম খবর শুনলে সত্যিই খারাপ লাগে। রাফিন বললো, 'আমি তোকে পোস্টটা দেখাচ্ছি।'
- 'একটা পোস্টও যে কারো হার্ট এটাকের কারণ হতে পারে জানতাম না। আমাদের আত্মীয়রা নিশ্চয়ই খুব মেতেছে এটা নিয়ে?'

রাফিনের সাথে কথা বলে বোঝা গেলো এখনো সেরকম ভাবে ছড়ায়নি কথাটা। তবে অনেকবার শেয়ার হয়েছে পোস্টটা। মেঘালয়ের স্টুডেন্টস রা কেউই হয়ত জানেনা এটার ব্যাপারে। জানলে হাজারবার শেয়ার হতো পোস্টটা। মৌনি সব শুনে বললো, 'দেখি আমাকে দেখাও।'

রাফিন তৎক্ষণাৎ ফেসবুকে ঢুকে সেই পোস্টটা বের করে দেখালো মৌনিকে। পোস্টে মেঘালয় ও মিশুর যে ছবি দেয়া, সেটা দেখে মোটেও মেঘালয়কে ধর্ষক কিংবা অপরাধী মনে হচ্ছেনা। বরং দুজনকে সুখী নব দম্পতি মনেহচ্ছে। মৌনি ভালো করে খেয়াল করে দেখলো ছবিটা বিয়ের পর তোলা। কারণ বিয়ের আগে মেঘালয়ের গায়ে মাত্র একটা শার্ট ছিলো আর এখন যে শার্টে আছে সেটা নতুন কেনা। তারমানে ছবিটা কেউ মিশুদের বাড়িতে থাকা অবস্থায় সংগ্রহ করেছে! অন্যরকম রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে মৌনি।

মিশুদের বাড়িতে থাকা অবস্থায় এই ছবি আর এই নিউজ আপলোড দিয়ে সে কি বুঝাতে চায়? ওদের তো বিয়েই হয়ে গেছে, তাহলে? রহস্যজনক ব্যাপার। কোনো একটা ব্যাপার এখানে নিশ্চয়ই আছে। মৌনি পোস্টের তারিখ ও সময় দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো যে এটা কারো ইচ্ছেকৃত ভাবে করা ষড়যন্ত্র। কারণ পোস্টটা যেদিন আপলোড করা হয়েছে সেদিন মিশু আর মেঘালয় কক্সবাজারের পথে। তারমানে!

মৌনি পোস্টদাতা ব্যক্তির ওয়াল ও এবাউট পড়ে পুরোপুরিভাবে বুঝে গেলো ব্যাপারটা। শার্লক হোমসের মত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস মৌনির। পোস্টকারীর বাসা রংপুরে। এই ব্যক্তি কে হতে পারে আগে সেটা জানা দরকার।

মৌনি পূর্বকে কল দিয়ে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললো। তারপর পোস্ট টার স্ক্রিনশট সহ পোস্টদাতার ছবি পাঠিয়ে দিলো পূর্ব'র কাছে। পূর্বকে দ্রুত বলে দিলো মিশুদের বাসায় যেতে।

পূর্ব ও সায়ান দ্রুত গতিতে বাইক চালিয়ে মিশুদের বাসায় গিয়ে হাজির। মিশুর বাবাকে ছেলেটার ছবি দেখানোর পর আংকেল জানালেন এটা তার আপন ছোট ভাইয়ের ছেলে অর্থাৎ মিশুর চাচাতো ভাই। ছেলেটা বহু আগে থেকেই মিশুর কোনোরকম সাফল্য সহ্য করতে পারতো না। তাছাড়া পারিবারিক একটা দ্বন্দ্ব তো আছেই। এই দ্বন্দ্ব থেকেই শত্রুতা করে সে ইচ্ছেকৃত ভাবে কাজটি করেছে। 

সমস্যা উদঘাটন করা হলো, এবার সমাধান দরকার।

সায়ান ফোনে মৌনিকে বললো, 'আইডি ডিজেবল করে দিই?'

মৌনি বাঁধা দিয়ে বললো, 'তাতে সমস্যা আরো বাড়বে। অলরেডি পোস্টটা একাশি বার শেয়ার করা হয়েছে। যদি তিনশ জন মানুষ ও দেখে থাকে, তাদের থেকে এক হাজার জনে ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কাজেই আমাদেরকে কঠিন ভাবে একটা সমাধানে আসতে হবে।'

সায়ান কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কি করতে চাইছো তুমি?'

মৌনি বললো, 'আমি যা করার করেছি। এখন বাকি কাজ করবে তোমরা। শুধুমাত্র আমার প্লান অনুযায়ী করতে হবে। যদি প্লান সাকসেসফুল হয় তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে।'

এরপর মৌনি পুরো প্লানটা খুলে বললো সায়ান ও পূর্বকে। কথাগুলো শোনার পর হেসে উঠলো সায়ান। মৌনির বুদ্ধির সাথে পারে কে? এত ট্যালেন্ট মেয়ে খুব কমই আছে জগতে। ওরা দ্রুত নেমে পড়লো কাজে।

৪৬!! 

মেঘালয় মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ভাবছে এবার কি হবে? বাবার জন্য বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে ওর। কোথ থেকে কি হয়ে গেলো! এতকিছু ঝামেলা কিভাবে মিটবে কেউ বলতে পারেনা। বাবা সুস্থ হবে কিনা, সবার কাছে সত্য ঘটনাটা কিভাবে বেরিয়ে আসবে সবকিছুই ভাবাচ্ছে মেঘালয়কে। অপরাধ না করেও আজ সবার চোখে খারাপ হতে হলো তাকে। অসহ্য একটা ব্যাপার।
মেঘালয় মাথা তুলে দেখলো মিশু রুমে নেই।

বেলকুনিতে গেছে হয়ত এটা ভেবে চুপচাপ বসে রইলো সে। এমন সময় মৌনির নাম্বার থেকে কল। মেঘালয় রিসিভ করতেই মৌনি বললো, 'ভাইয়া, আব্বুর শরীর সুস্থ হয়ে যাবে দেখিস। টেনশন করিস না।'
- 'কি হবে এবার?'
- 'সব ঠিক হয়ে যাবে ভাইয়া। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। টিকেটের ব্যবস্থা হয়ে গেছে, দ্রুত এয়ারপোর্টে গিয়ে কনফার্ম করে আয়।'
- 'মানে! এত দ্রুত কিভাবে পারলি?'
- 'ভাইয়া, মৌনিকে কি মনেহয় তোর? ফ্লাইট কখন জেনে আয়। আর টেনশন না করে তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে আয়। আমি দেখছি কি করা যায়। এমন প্লান করেছি, এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মরবে এবার।'
- 'বুঝলাম না। কিসের পাখি?'
- 'অনেক গুলো পাখি। এক প্লানে কতগুলো কাজ কার্যকর করি দেখার জন্য অপেক্ষা কর। শুধু আমাকে এখন বুদ্ধি খাটিয়ে কাজটা করতে হবে।'
- 'কি করতে চাইছিস বলতো?'
- 'সেটা না হয় রহস্যই থাক। ধামাকা দেখার জন্য অপেক্ষা কর। আর দোয়া করিস যেন সাকসেস হই।'
- 'আচ্ছা। আমি মিশুকে ডেকে আনি, ফোন রাখ। আর আব্বুর শরীর কেমন হয় আমাকে আপডেট জানাস।'

মেঘালয় ফোন রেখে বেলকুনিতে এসে খুঁজলো কিন্তু মিশুকে পেলোনা। করিডোরেও মিশুকে দেখতে না পেয়ে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো ওর। দরজা খোলা দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো। দরজা খোলা, তারমানে মিশু? ভাবতে পারছে না মেঘালয়। মেয়েটা গেলো কোথায়? একসাথে এতগুলো টেনশন দিলে কেমন লাগে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp