হৃদমোহিনী - পর্ব ০১ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


১!! 

-"হেই সুইট ডার্লিং, কাম অন। তন্ময় নেই তাতে কি বেবি? আমিতো আছি। লেটস এনজয়।"

লোকটার বিশাল থাবা এগিয়ে এলো মিশুর দিকে। ভয়ংকর দুটো চোখ এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন কোটর থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইছে চোখ দুটো। মিশুর গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম করে হাতুরি পিটতে লাগলো। নিজের ভূলেই নিজে ফেঁসে গেছে। লোকটা বিদঘুটে হাসি হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো কাছে। মিশু ভয়ে লোক বন্ধ করে ফেললো। লোকটা মিশুর মাথার পিছন দিকে একহাত দিয়ে শক্ত করে মাথাটা ধরে কাছে টেনে নিলো। মিশুর খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। বাকশক্তি বন্ধ হয়ে গেছে বোধকরি। লোকটা মিশুকে দুহাতে জাপটে ধরে বিছানার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। শয়তানটার বিশাল দেহের নিচে পড়ে মিশুর ছোট্ট শরীরটা কেবলই একটু মুক্তির জন্য হাসফাস করছে। আর মনেমনে প্রার্থনা করছে, "হে আল্লাহ আমায় রক্ষা করো। আমায় রক্ষা করো মাবুদ।" 

মিশু গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে লোকটাকে ছাড়াতে চেষ্টা করছে কিন্তু পেরে উঠছে না। ক্রমশই ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। লোকটা শরীরের এখানে সেখানে হাত দিচ্ছে আর কি বিশ্রী সেই আচড়, মিশুর শুধু মনেহচ্ছে আগামীকাল পত্রিকায় বুঝি ওর প্রাণহীন নিথর দেহের একটা ছবি বের হবে। আচ্ছা,আব্বু খুব কষ্ট পাবেনা ছবিটা দেখে? আব্বুর কত স্বপ্ন ওকে নিয়ে,সব এই একটা রাতের মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধানে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? মিশু সুইসাইড করলে বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে কে? বাবার কথা মনে হতেই একটা অন্যরকম মনোবল পেয়ে গেলো সে। গায়ের জোরে দাঁত বসিয়ে একটা কামড় দিলো হিংস্র লোকটার কাঁধের উপর। কামড়ের চোটে একটু সরে যেতেই উঠে দাঁড়ালো মিশু। 

কিন্তু পালাতে পারলো না। লোকটা আবারো লম্বা হাতটা বাড়িয়ে ধরে ফেললো ওকে। একহাতে মিশুর গলাটা টিপে ধরে কাছে টেনে নিলো। এই মুহুর্তে আর কিছুই ভাবতে পারছে না মেয়েটা। এখানে কেউ ওকে বাঁচাতে আসবে না, নিজেকেই বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। মনোবল হারালে চলবে না। মিশু ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকালো লোকটার দিকে, ওর চোখে আগুন ঝরতে লাগলো। গাল, মুখ শক্ত হয়ে উঠলো নিমেষেই। লোকটা ওর গলা টিপে ধরে আছে,মিশু ওর সামনে দাঁড়িয়ে ডান পা তুলে সোজা লোকটার পুরুষাঙ্গ বরাবর একটা লাথি দিয়ে বসলো। জায়গামত আক্রমণ করেছে একেবারে। শয়তান লোকটা ওখানে দুইহাতে চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়লো। মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে, এক ধরণের গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে মুখ দিয়ে। মিশুর ইচ্ছে করলো শুয়োর টাকে পারলে খুন করে ফেলতে। কিন্তু রিস্ক নেয়া যাবেনা, খুন করার সাধ্য ওর নেই। এখন দ্রুত পালিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। দ্রুত, একটা সেকেন্ড ও দেরি করলে চলবে না। মিশু একটু এগিয়ে এসে হাতের কনুই দিয়ে গায়ের জোরে মারলো লোকটার মাথার উপর। পশুটার আর ওঠার শক্তি নেই। মিশু বড় আঘাত দিয়ে ফেলেছে মগজ বরাবর। 

দরজা একটানে খুলে কোনোদিকে না তাকিয়ে ছুটতে শুরু করলো মেয়েটা। যত দ্রুত পারে ওকে পালাতে হবে,এই বাড়ির বাইরে গেলে অনেকটাই বিপদমুক্ত সে। শুধু মনেহচ্ছে পায়ে একটুও জোর নেই। স্বপ্নে দৌড়ালে যেমন রাস্তা একটুও এগোয় না,এখনো সেরকম মনেহচ্ছে। তবুও বারবার আব্বুর স্বপ্নের কথা ভেবে মনের শক্তি বাড়িয়ে নিতে লাগলো। সিঁড়ি দিয়ে ছুটে সাত তলা থেকে নিচে নেমেও কোথাও একদণ্ড দাঁড়ালো না। ছুটতেই থাকলো, কোনদিকে ছুটে কোথায় যাচ্ছে তা সে জানেনা, শুধু একটাই চিন্তা এখান থেকে পালাতে হবে। পায়ে যেন এতটুকুও জোর নেই, কেবল মনের জোরেই ছুটে চলেছে মেয়েটা।

২!! 

মেঘালয় ওর বন্ধুরা সহ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। এদিকে সিএনজি আসেনা, সিএনজির জন্য মেইন রোডে যেতে হবে। এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বন্ধু পূর্ব'র জন্য।

এমন সময় দেখতে পেলো একটা মেয়ে খুব জোরে ছুটতে ছুটতে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে জোরে জোরে হাফাতে লাগলো। মেয়েটি কয়েকবার জোরে শ্বাস নিতে নিতেই অজ্ঞান হয়ে রাস্তার উপর ধপ করে পড়ে গেলো। চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো ওদের সবার। মেয়েটির দৌড়ের গতি দেখে মনেহচ্ছিলো সে কোনো ভয়াবহ বিপদ থেকে মুক্তির জন্য ছুটছে, চোখেমুখেও সাংঘাতিক ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। মেয়েটি রাস্তার উপর পড়ে গিয়ে আর একটু নড়াচড়াও করছে না, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ওরা সবাই ছুটে মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়ালো। সকলে উপুড় হয়ে চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগলো সদ্য কৈশোর পেড়িয়ে তারুণ্যে পা দেয়া মেয়েটির দিকে। চেহারায় লাবণ্য আর মায়া যতটা আছে তারচেয়ে দূরন্তপনাই বোধহয় বেশি। দেখেই মনেহচ্ছে ঝরনার মত উচ্ছল একটি মেয়ে। ওরা সবাই একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। 

মেঘালয় ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে কয়েকবার ছিটা দিলো মেয়েটির মুখে। কয়েকবার চোখ পিটপিট করেই চোখ মেলে তাকালো মেয়েটি। মুখের উপর এতগুলো ছেলের মুখ দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেলো একেবারে। গলায় একটুও জোড় নেই তবুও চিৎকার করার বৃথা চেষ্টা করতে যাবে এমন সময় দেখলো দুটো মেয়ের মুখও দেখা যাচ্ছে। একটি মেয়ে খুবই সুন্দরী দেখতে। ওর মাধুর্যভরা মুখটা দেখে ভয়টা কেটে গেলো একটু। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো। 

সায়ান বললো, "এই মেয়ে, এভাবে ছুটছো কেন? কি হয়েছে?"

মেয়েটি চোখ মেলে তাকালো সায়ানের দিকে। চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। জোরে শ্বাস নিতে নিতে ঢোক গিললো। কথা বলার মত শক্তিও পাচ্ছেনা। সবাই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে ওর দিকে। প্রত্যেকের চোখে প্রশ্ন, কি হয়েছে? 

মেঘালয় মেয়েটির পাশে বসে কানের কাছে কিছু বলতে যেতেই মেয়েটি ভয়ে কেঁপে উঠলো। মেঘালয় বুঝতে পেরেছে সে খুব ভয় পেয়ে এভাবে ছুটছে। তাই ভয় কাটানোর জন্য বললো, "ভয় পেওনা। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। কি হয়েছে আমাদের বলো?"

মেয়েটি তাকালো মেঘালয়ের চোখের দিকে। চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। হেডলাইটের আলোয় ছেলেটার চোখ দুটো কত পবিত্র দেখাচ্ছে। এত পবিত্র চাহনি কোনোদিন দেখেনি ও। কত বিশুদ্ধভাবে চেয়ে আছে, সহানুভূতিতে পরিপূর্ণ সে দৃষ্টি। অথচ একটু আগে যে জানোয়ার গুলোর হাতে পড়েছিলো ওদের.. মিশু আরেকবার কেঁপে উঠলো ভয়ে। 

মেঘালয় ইশারায় ওর বান্ধবী রোদকে বোঝালো মেয়েটিকে ধরার জন্য। রোদ মিশুকে দুহাতে ধরে টেনে তুলে দাড় করিয়ে দিতেই রাস্তার উপর রক্তের দাগ চোখে পড়লো ওদের। সবাই অবাক হয়ে তাকালো মেয়েটির পায়ের দিকে। হয়ত কোথাও কেটে গেছে। পায়জামা বেয়ে রক্তের স্রোত নেমেছে। ওরা কৌতুহলী চোখে তাকালো মেয়েটির দিকে। যেন জানতে চাইছে,কি হয়েছে? কোথায় কেটে গেছে? 

মিশু চোখ বন্ধ করে ফেললো। এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হবে ভাবেনি। এতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে কিভাবে বলবে কথাটা? ওর পিরিয়ড চলছে, সাত তলা থেকে ছুটে নিচে নেমে আবার এক কিলোমিটারের মত দৌড়ে আসার পর শরীরের অবস্থা মারাত্মক খারাপ।খুবই ব্লাড আসছে। একটা প্যাড আর কতক্ষণ কুলোয়? কিন্তু এটা কিভাবে বলবে ওদের? ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নিচু করে ফেললো ও। 
রোদ ওকে জড়িয়ে ধরে বুঝতে পারলো মেয়েটি কাঁপছে। ও মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "কার ব্যাগে চাদর আছে?"

সায়ান ব্যাগ থেকে চাদর বের করে দিলো। মেঘালয় ওটা মেয়েটির গায়ের উপর পেঁচিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে ধরে রাস্তার ধারে এনে বসালো। সে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, কাঁপছে রীতিমত। মেঘালয় বললো, "সায়ান আমার ব্যাগে স্যালাইন আছে একটু পানিতে গুলিয়ে ওকে খেতে দে।"

সায়ান কথামত স্যালাইন বের করলো। আর মেঘালয় মিশুর সামনে বসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো, "আমার চোখের দিকে তাকাও তো। পলক ফেলবে না।"

মিশু তাকালো ওর চোখের দিকে। আশ্চর্যের ব্যাপার ওর চোখের দিকে তাকাতে একটুও ভয় লাগছে না। মেঘালয় চেষ্টা করছে ওকে একটু হিপনোটাইজড করতে। যেহেতু মেয়েটি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে ,এখন সম্মোহন করার চেষ্টা করে যদি একটু কথা বের করা যায়। এর আগে মাত্র একবার একজনকে সম্মোহিত করেছিলো মেঘ,কতটা কার্যকর হবে জানা নেই।

মেঘালয় একদম মিশুর মুখের সামনে এগিয়ে এসে বললো, "আমার চোখ বরাবর তাকিয়ে থাকো।"

মিশু কিছুই বুঝতে পারছে না। কোথায় আছে,কি করছে, কি হচ্ছে ওর সাথে সবকিছু কেমন দুঃস্বপ্নের মত লাগছে। তবুও মেঘালয়ের চোখের দিকে চেয়ে রইলো অপলক ভাবে। মেঘালয় ওর চোখের দিকে একটানা অনেক্ষণ চেয়ে রইলো। ওর বন্ধুরা সবাই চারিদিকে ঘিরে ধরে দেখছে ওর কাণ্ড। মেঘালয় একটা আঙুল এগিয়ে এনে মিশুর কপাল বরাবর ধরে কিসব যেন বললো। কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। মেঘালয় হুট করেই কি যেন করলো, মেয়েটি একেবারে রোবটের মতন হয়ে গেলো। চোখে অসম্ভব ঘোর, কোনো নড়াচড়া করছে না,এমনকি কাঁপুনিও বন্ধ হয়ে গেছে। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, "কে তুমি?"

মেয়েটি একদম পাথরের মত স্তব্ধ। কিন্তু ঠোঁট দুটো অদ্ভুত ভাবে নড়ে উঠলো, "আমি মিশু।"
সবাই রীতিমত অবাক! মেঘালয়ের তাহলে হিপনোটাইজ কাজে লেগে গেছে। ওরা বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে ফেললো। মেঘালয় আবারো জিজ্ঞেস করলো, "বাসা কোথায়?"
-"রংপুর।"
-"এভাবে ছুটছিলে কেন?"

মেয়েটি যেন রিমোট কন্ট্রোল পুতুল হয়ে গেছে। মেঘালয় যা জিজ্ঞেস করছে একদম শুধু সেটার ই উত্তর দিচ্ছে। মেঘালয় আবারো জিজ্ঞেস করলো, "কি হয়েছিলো তোমার সাথে?"
-"আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিলো।"
মেয়ে তিনজন শিউড়ে উঠলো কথাটা শুনে। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, "কারা মারতে চাইছিলো?"
-"একটা খারাপ লোক।"
-"তুমি এখানে কোথায় থাকো?"
-"আমি রংপুরে থাকি।"
-"এখানে কেন এসেছিলে?"
-"আমার বয়ফ্রেন্ডের কাছে।"
-"তোমার বয়ফ্রেন্ড কোথায়?"
-"আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।"

মেঘালয় ওর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললো,"আপাতত আর কিছু জানার দরকার নেই। এখন ওর কাছে ওর বাবার নাম্বার নিয়ে তাকে ফোন দিয়ে কথা বলে জানাতে হবে ব্যাপারটা।"
সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, "হুম। সেটাই কর।"

দুপুর বললো, "এখন একে নিয়েই আমরা পড়ে থাকবো? আমাদের ট্রেন মিস হয়ে যাবেনা?"
আরাফ রেগে কটমট করে তাকালো দুপুরের দিকে, "এইজন্যই মেয়েদেরকে আমি সহ্য করতে পারিনা। একটা মেয়ের জীবন মরণের প্রশ্ন আর সে আছে ট্রেন জার্নি নিয়ে।"

দুপুর মুখটা কাচুমাচু করে বিড়বিড় করে বললো, "জানতাম কিছু একটা ঘটবেই। জানতাম আমাদের যাওয়া হবেনা। আমি যখনই কোনো কিছু নিয়ে বেশি লাফালাফি করি লাস্ট অব্দি সেখানে যাওয়াই হয়না আমার। আজকেও যাওয়া হবেনা আমি শিওর।"
সায়ান রেগে বললো, "আরাফ ওর গালে একটা বসা তো। মানুষ হবেনা ও জীবনে।"

দুপুর মুখটা বাঁকা করলো।
মেঘালয় আবারো মিশুর চোখে চোখ রেখে বলল, "তোমার বাবার নাম্বার বলতে পারবা?"
মিশু মাথা দুদিকে নাড়লো। এই মুহুর্তে হয়ত মনে করতে পারছে না। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, "তোমার গায়ে কোথাও কেটে গেছে?"
-"না।"
-"ব্লাড?"
-"অনেক্ষণ ছুটেছি। পিরিয়ডের রক্ত।"

মেঘালয় মাথাটা নিচু করে ফেললো। সায়ান ও আরাফ ও অন্যদিকে তাকালো। মেঘালয় রোদের দিকে তাকিয়ে বললো, "প্যাড আছে?"
রোদ বললো, 'হুম আছে। কিন্তু এখানে ওয়াশরুম কোথায় পাবো?"
-"সেটা ব্যবস্থা করা যাবে। এখন ওর হিপনোটাইজ কাটাতে হবে।"

কথাটা বলেই কষে থাপ্পড় লাগালো মিশুর গালে। মিশু মাথাটা ঝাড়া দিয়ে কেঁপে উঠলো আবারো। ভয়েই কুঁকড়ে গিয়ে মেঘালয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জাপটে ধরলো মেঘালয়কে। মেঘালয় একহাতে মিশুকে শক্ত করে ধরে আরেকহাতে বোতলটা নিয়ে মিশুর মুখে ধরে বললো, "স্যালাইন, খেয়ে নাও।"

মিশু তবুও কিছু বললো না। কাঁপতে লাগলো। মেঘালয় ওর মুখে বোতলটা ধরে একটু স্যালাইন খাইয়ে দিলো ওকে। তারপর দুহাতে জড়িয়ে ধরে রইলো বুকে। চাদরটা গায়ে ভালোমতো পেঁচিয়ে দিয়ে বললো, "শীত করছে?"

মিশু দুদিকে মাথা নাড়লো। মেঘালয় আর এই অচেনা মানুষগুলোর ওর প্রতি এমন সহানুভূতি দেখে ওর অবাক লাগছে। এত ভালো মানুষ ও দুনিয়ায় আছে! কিন্তু এতক্ষণ কি হয়েছিলো ওর? মিশু চোখ পিটপিট করতে লাগলো। একটু আগে ওর কিছু একটা হয়েছিলো, কিন্তু কি হয়েছিলো বুঝতে পারছে না সেটা। 

এমন সময় পূর্বকে দেখা গেলো। ও দুলতে দুলতে এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "হোয়াট হ্যাপেন্ড?"

রোদ গিয়ে ওকে ধীরেধীরে সবটা খুলে বললো। মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়ে মিশুকে ধরেই জিজ্ঞেস করলো, "হাঁটতে পারবা কিছুদূর?"

মিশু মাথাটা আস্তে করে নাড়ালো। উত্তর হ্যা নাকি না বোঝা গেলো না। মেঘালয় সবার দিকে একবার তাকিয়ে বললো, "এখানে তো রিক্সাও পাওয়া যাবেনা। আমরা তাহলে রাস্তার দিকে এগোই?"
সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, "হুম চল।"

মেঘালয় মিশুর প্রতি এক অন্যরকম সহানুভূতি অনুভব করছে। কত বাচ্চা একটা মেয়ে! ভয়াবহ বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেছে। ও মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "তোমার তো হাঁটার ও শক্তি নেই দেখছি। আমি কোলে নিলে কি সমস্যা হবে?"

মিশু চমকে উঠলো। যদিও এই মুহুর্তে ওর বিস্মিত হবার মত অবস্থা নেই। তবুও এতটুকু বোধ আছে যে ওর পায়জামা আর পায়ে রক্তের ঢাল নেমেছে, এই অবস্থায়ই ছেলেটা ওকে কোলে তুলতে চাইছে! এত সুন্দর একটা মানুষ সত্যিই কি দুনিয়াতে আছে? নাকি আল্লাহ ওর জন্য ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছেন? সত্যিই হয়ত ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছেন। মিশু এসব ভাবছে আর এই সম্পূর্ণ অচেনা ছেলেটা ওকে কোলে নিয়ে অনায়াসে হেঁটে চলেছে। ওর বন্ধুরাও পাশে হাঁটছে ওদের সাথে। 

মেইন রোডে পৌছে মেঘালয় একটা সিএনজিতে মিশুকে বসিয়ে দিয়ে রোদকে বললো, "চেঞ্জ করে দে ওকে।"
তারপর ড্রাইভারকে বললো, "মামা আপনি একটু বাইরে আসেন তো।"

ড্রাইভার অবাক হয়ে বাইরে বের হয়ে আসলো। মেঘালয় ওকে সিটে বসানোর সময়েও মিশু অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো ওর মুখের দিকে। আর মনেমনে ভাবছিলো, সত্যিই কোনো ফেরেশতা হবে। আজীবন প্রত্যেকটা মেয়ে পিরিয়ডের সময় ছেলেদের থেকে লাঞ্চিত হয়েছে, হাসির পাত্র হয়েছে। অথচ এরা কত সুন্দর! আর কিছু ভাবার মত সক্ষমতা এখন মিশুর নেই।

মেঘালয় ও ওর বন্ধুরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ওরা কয়েকজন বন্ধু বান্ধবী মিলে একসাথে পঞ্চগড় যাচ্ছে এক বান্ধবীর বিয়ের দাওয়াতে। অবনীর বিয়ে। অবনী ওদের ই দলের একজন ছিলো। ওর বাসা পঞ্চগড়ে আর ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করতো। সবাই মিলে ওর বিয়েতে যাওয়ার জন্য বেড়িয়েছে, পূর্ব'র বাসার আগেই একটা গলিতে দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো তখনই মিশুকে দেখতে পায় ওরা। 

রোদ সিএনজি থেকে ডাকলো ওদের। মিশুর নিজেকে খুবই অসহায় লাগছে। কেননা ওর কেবল মস্তিষ্ক টাই সচল আছে যেটা সবকিছু ভাবতে পারছে। তাছাড়া আপাতত আর কিছুই করতে পারছে না ও। 

মেঘালয় এসে সিএনজিতে মিশুর পাশে বসে ওর মাথাটা কাঁধে নিলো। মিশুর পিঠের পিছন দিক দিয়ে একটা হাত দিয়ে একহাতে শক্ত করে ধরলো ওকে। তারপর ডানহাতে রুটি গরম চায়ে চুবিয়ে ওর মুখে তুলে দিলো। একটু নরম খাবার পেয়ে আস্তে করে গিলতে চেষ্টা করলো মিশু। মেঘালয় একহাতে মিশুকে ধরে আছে,আরেকহাতে রুটি চায়ে চুবিয়ে খাওয়াচ্ছে। সায়ান চায়ের কাপ হাতে সিএনজির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘালয় পারতো রোদ কিংবা মৌনিকে বলতে যেন মিশুকে খাইয়ে দেয়। কিন্তু মেয়েদেরকে বলে কতটা লাভ হবে জানা নেই। তাছাড়া মেঘালয় নিজ দায়িত্বে যতটুকু সেবা করবে, অন্যকেউ সেটা করবে না। সেজন্যই ও অন্যকারো উপর ভরসা করতে পারেনি। 

অনেক্ষণ সময় নিয়ে একটা রুটির অর্ধেকটা খাইয়ে দিলো মিশুকে। তারপর স্যালাইন মেশানো পানি আর সাথে দুটো জ্বর ও ব্যাথার ট্যাবলেট খাইয়ে মিশুর মাথাটা নিজের বুকের উপর নিয়ে বললো, 'এবার ঘুমাও। এরপর দেখবে আর কোনো বিপদ নেই।"

মিশু কিছু বলতে পারলো না। মেঘালয়ের বুকের উষ্ণ স্পর্শে ও সত্যিই একবার চোখ বোজার চেষ্টা করলো। আরেকটা সিএনজি নিয়ে সবাই দুটোতে উঠে পড়লো স্টেশনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মেঘালয় ঠিক করে ফেললো, যেহেতু মেয়েটির বাসা রংপুরে আর ওরাও সেদিকেই যাচ্ছে। কাজেই এখন ওকে জাগানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করুক, তারপর না হয় ওর বাবার নাম্বার নিয়ে ফোন দেয়া যাবে। মিশুর চুলে দুবার হাত বুলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটা।

বন্ধুরা মেঘালয়কে নিয়ে খুব গর্ববোধ করে। এরকম ফেরেশতার মতন মানুষ সত্যিই আজ দূর্লভ। মেঘালয়ের মানবতা আর নিঃস্বার্থ সেবা, সহানুভূতি, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর মমত্ব সত্যিই মুগ্ধ করে সবাইকে। মিশু ঘুমে ঢলে পড়েছে মেঘালয়ের বুকে। মেঘালয় চেপে ধরে রইলো ওকে। চাদরটা ভালোভাবে টেনে দিলো গায়ে। এদিকে দশটা পেরিয়েছে,ট্রেন সাড়ে দশটায়। শেষ অব্দি ট্রেন পাবে কিনা সেটাই এখন ভাব্বার বিষয়। 

—————

৩!!

পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে। অপার্থিব এবং অদ্ভুত সুন্দর। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে সবকিছু। গাছের পাতায় আলো লেগে ঝিকমিক করে উঠছে। ট্রেন ছুটে চলেছে দ্রুত গতিতে। ট্রেনের ঝাঁকুনি অনুভব করছে মিশু। থেকে থেকে দুলে দুলে উঠছে আর ঝিকঝিক শব্দ কানে আসছে। মাঝেমাঝে কিছু তরুণ তরুণীর হাসির শব্দ ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দকেও হার মানাচ্ছে। মিশু কারো শরীরের উষ্ণতা মাপতে পারছে। মনেহচ্ছে কেউ বুকের বা পাশে ঠিক বাহুর কাছাকাছি পরম যত্নে জড়িয়ে রেখেছে ওকে,তার পেশিবহুল বাহুর উপস্থিত টের পাচ্ছে নিজের বাহুর উপর। সে আলগোছে মেয়েটির বাহু ধরে রেখেছে, মাঝেমাঝে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে শক্ত করে চেপে ধরছে। ভ্রম লেগে যাচ্ছে মিশুর। সেই শয়তানটা নয়তো? শুয়োরটা ট্রেনে করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

চিৎকার করে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো মিশু। চোখ মেলে দেখলো পরিস্থিতি অন্যরকম। একটা দারুণ হ্যান্ডসাম মতন ছেলের বুকের বা পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছিলো সে। সেই ছেলেটিই ওকে আলগোছে ধরে ছিলো বুকের সাথে। সামনের সিটে, পাশের সিটে কয়েকটা যুবক যুবতীর কৌতুহলী চোখ দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো। এরা আবার কারা? ওদের সাথে আমি কোথায় চলেছি? আর এই ছেলেটিই বা কেন এভাবে আমায় বুকে জড়িয়ে রেখেছিলো? সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগছে। ঘোর ঘোর লেগে যাচ্ছে রীতিমত। মিশু মনে করার চেষ্টা করলো।

আস্তে আস্তে মনে পড়ে যাচ্ছে সবকিছু। পালানোর জন্য প্রাণপণে ছুটছিলো সে। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো মাত্রই আর কিছু বলতে পারেনা। খুব সম্ভবত সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলো। তারপর কি যেন হয়ে গেলো বুঝতে পারেনি সে। কয়েকটা কৌতুহলী মুখ উপুড় হয়ে তাকে দেখছিলো। হ্যা,এইতো সেই কৌতুহলী মুখগুলো। এখন যারা পাশে বসে আছে তাদেরকেই তো দেখেছিলো। এবার বেশ মনে পড়েছে, মিশু ভেবেছিলো আল্লাহ কোনো ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছেন ওর জন্য। এই পাশে বসে থাকা হ্যান্ডসাম ছেলেটা ওকে কোলে নিয়ে হাঁটলো, তারপর সিএনজিতে বসে রুটি আর ওষুধ খাইয়ে দিলো। হুম,এরপর ছেলেটি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিলো ঘুমিয়ে পড়তে, ঘুমালে নাকি আর বিপদ থাকবে না। সত্যিই তো,তারপর মিশু ঘুমিয়ে পড়েছিলো আর এখন অদ্ভুত ভাবে বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু ওরা কারা? আর ট্রেনে উঠলো কিভাবে?

মিশুকে এমন উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘালয় বললো, "শরীর কেমন লাগছে এখন?"

মিশু চমকে উঠলো। এত সুন্দর, স্পষ্ট, নিঁখুত কারো গলার স্বর হতে পারে! প্রত্যেকটা শব্দ যেন আয়নার মত পরিষ্কার, বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে মাথার ভিতর বাজতেই লাগলো। মিশু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আমি এখানে কিভাবে এলাম?"

মেঘালয় উত্তর দিলো, "তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। ঘুমের ঘোরেই ধরে এনে ট্রেনে তুললাম মনে পড়ছে না?"

ও হ্যা মনে পড়েছে। ট্রেনে ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছিলো। সিএনজি থেকে নেমে সবাই ছোটাছুটি করে গিয়ে ট্রেনে উঠলো। আর এই ছেলেটি রীতিমত কোলে করে নিয়ে ওকে ধরে এনে ট্রেনে তুলে দিলো। অবাক হলো মিশু। কিন্তু ওর পায়ে তো রক্ত... মিশু নিজের পায়ের দিকে তাকালো। জামাকাপড় বদলে দিলো কে? মনে পড়েছে, সিএনজিতে বসে একটা মেয়ে জামাকাপড় আর প্যাড বদলে দিয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত লাগছে এটাই যে ওর অসুস্থতার কথা এরা কিভাবে জানলো? যতদূর মনে পড়ে ওর বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তাহলে ওরা কিভাবে.. ভেবেই পাচ্ছেনা মিশু। 

সবচেয়ে চঞ্চল মেয়েটি বললো, "মিশু, তোমার এখন কেমন লাগছে?"

এবার আরো অবাক হতে হলো। ওরা নামও জানে! কি অদ্ভুত!  এবার হয়ত এমন কিছু বলবে যাতে মিশু আরো অবাক হবে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব হলো এটা? কারো কি টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা আছে নাকি? 

মেঘালয় এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে বললো, "নাও মুখ ধুয়ে ফেলো।"

মিশু উঠে দাঁড়ালো। সত্যিই এখন বেশ ভালো লাগছে। গায়ে শক্তিও পাচ্ছে। জানালার কাছে এসে বাইরে তাকালো। অদ্ভুত সুন্দর জোৎস্না ছড়িয়েছে চারিদিকে। যদিও আজকে সবই অদ্ভুত লাগছে। কেমন যেন অলৌকিক ব্যাপার মনেহচ্ছে। তবে যাই হোক,একটা বড় ধরণের বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আর এই ছেলেমেয়ে গুলো না থাকলে এখন শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারতো না বোধহয়। সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ দিতে হয় ওই হ্যান্ডসাম মতন ছেলেটাকে। মিশু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মেঘালয়ের দিকে। চোখাচোখি হয়ে গেলো। মেঘালয়ের দৃষ্টি কত ঠাণ্ডা অথচ তীক্ষ্ণ। একদম ভেতরে পৌছে যায়। কত মায়াবী লাগে চোখ দুটোকে কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। সত্যিই ছেলেটার চোখ দুটো ভয়ংকর রকমের সুন্দর! কোনো ছেলের চোখও এত সুন্দর হয় নাকি? 

মিশু অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে মেঘালয়ের দিকে। ঘোর লেগে যাচ্ছে। ছেলেটা মৃদু হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে আছে, চোখে কত অপার্থিব মায়া! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না। মিশু মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মৌনি জানালার পাশের সিট থেকে সরে গিয়ে বললো, "এখানে বসো।"

মিশু সিটটায় বসতে বসতে তাকালো মেয়েটির দিকে। এই মেয়েটির চেহারার সাথে ওই হ্যান্ডসাম ছেলেটির চেহারায় অনেক মিল। আচ্ছা,বারবার হ্যান্ডসাম ছেলেটি ভাবছি কেন? ওই লোকটার নামটা কি জানা যায়না? প্রশ্নটা মনে আসতেই মিশু মেঘালয়ের দিকে ছুড়ে দিলো, "আপনার নাম কি?"

সবাই যতটা অবাক হলো মেঘালয়ের ঠিক ততটাই মজা লাগলো। কখনো কেউ এভাবে ওর নাম জিজ্ঞেস করেনি,সেখানে এই পিচ্চিটার মত অসংখ্য স্টুডেন্টস ওর আছে। ও হেসে বললো, "মেঘালয়।"

মিশু চোখ কপালে তুলে বললো, "মেঘালয় আবার কারো নাম হয়? হিমালয় থেকে হিমু,আপনার নাম কি মেঘালয় থেকে মেঘু?"
মেঘালয় ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো, "নাহ, আমাকে শর্ট করে সবাই মেঘ বলে ডাকে।"

মিশু চোখ পিটপিট করে বললো, "সার্টিফিকেট দেখি।"
-"কিসের সার্টিফিকেট?"

মিশু বললো, "হিমুকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে নাম কি? বলে হিমু। ভালো নাম? হিমালয়। ইয়ার্কি মারেন? তখন হিমু পকেট থেকে সার্টিফিকেট বের করে দেখায়। তারপর সে বলে, আপনি কি সবসময় সার্টিফিকেট পকেটে নিয়ে ঘোরেন? তখন হিমু জবাব দেয়, আপনার মত অনেকেই বিশ্বাস করতে চায়না আমার নাম হিমালয়। তখন সার্টিফিকেট বের করে দেখাই।"

সবাই হেসে উঠলো মিশুর কথা শুনে। সিটের উপরের ঝোলানো সিট থেকে সায়ান মাথা ঝুলিয়ে তাকালো। অদ্ভুত একটা ক্যারেক্টার তো! এতক্ষণ বোবা বনে ছিলো আর এখন মুখে খই ফুটছে। দারুণ করে কথা বলে তো মেয়েটা।

পূর্ব জিজ্ঞেস করলো, "তোমার কি হিমুসমগ্র মুখস্থ নাকি?"
-"নাহ, তবে এতবার পড়েছি যে কিছু কিছু লাইন মুখস্থ হয়ে গেছে।"
-"বাহ! তাই নাকি?"
মৌনি মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, "ভাইয়া তুইও এখন থেকে সার্টিফিকেট পকেটে নিয়ে ঘুরবি।"

মিশু তাকালো মৌনির দিকে। এই মেয়েটা কি ওই ছেলেটার বোন? হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ চেহারায় মিল আছে আর মেয়েটা ওকে ভাইয়া বলে ডাকছে। প্রশ্নটা করতে যাবে এমন সময় মেঘালয় বললো, "কিছু খেয়ে নাও।"
-"কি খাবো?"
-"কি খেতে চাও? বিরিয়ানি?"

মিশু কিছু বললো না। খিদে পেয়েছে এটা সত্যি। বিরিয়ানি ওর খুবই পছন্দ। কিন্তু কিভাবে বলবে বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। ও মাথাটা দুদিকে নাড়লো। মেঘালয় বললো, "একটু হেঁটে আসো তাহলে ভালো লাগবে।"
-"কোথায় হাঁটবো?"
-"আমার সাথে আসো। খাবার বগিতে নিয়ে যাই, যা খেতে ইচ্ছে হবে খেয়ে তারপর আবার আসবো।"

মিশুর এতক্ষণে খেয়াল হলো এটা একটা কেবিন। পুরো কেবিনটাই ওরা বুক করে নিয়েছে। এরা নিশ্চয়ই বন্ধু বান্ধবী হবে। সেটা পরে জিজ্ঞেস করা যাবে,আগে পেট ভরাতে হবে। সত্যিই বড্ড খিদে পেয়েছে।
মিশু উঠে দাঁড়ালো। মেঘালয় ওকে সাথে নিয়ে কেবিন থেকে বের হলো। সবাই আড্ডায় মেতে উঠলো একসাথে। মিশুকে নিয়েই কথা চলতে লাগলো ওদের মধ্যে। মেয়েটা বেশ সরল সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে ইন্টারেস্টিং একটা মেয়ে। 

মেঘালয় মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, "রংপুরে কোথায় তোমার বাসা?"
-"শহরেই। আপনি কিভাবে জেনেছেন এই তথ্য?"
-"হিপনোটাইজ করে।"
-"সিরিয়াসলি!"

মিশুর মুখ হা হয়ে গেলো। এইটুকু সময়ের মধ্যে হিপনোটাইজ করা কিভাবে সম্ভব! অবশ্য এই ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যায় একটু সবার থেকে আলাদা। চেহারায় একট আইনস্টাইন আইনস্টাইন ভাব আছে। বোধহয় সাইকোলজি ফিলসফি ইত্যাদি ইত্যাদি চর্চাও করে। যাকগে সেসব,অতকিছু ভেবে লাভ নেই। এখন কিছু ভাবতে ভালো লাগছে না। মাথাটা কেমন যেন ভারী হয়ে আছে। মস্তিষ্কের একটা নিউরন বোধহয় এখনো তন্ময়ের কথা ভেবে চলেছে। ভাবতে না চাইলেও মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে ছেলেটা। 

এইতো মাস ছয়েক হবে। একদিন রাতে লগ আউট করে ঘুমাতে যাচ্ছিলো তন্ময়। সেই সময়ে হুট করেই একটা আইডি থেকে মেসেজ আসে ওর ফোনে, "এই তন্ময়"

এমন ভাবে ডাকলো যেন কত বছরের চেনা। তন্ময় বেশ অবাক হয়ে গেলেও ভাবলো ফেক আইডি হবে। সিন করে রেখে দিলো। কিছুক্ষণ পর আবারো সেই আইডি থেকে মেসেজ, "একবার ফোন দিবা?" নিঃসংকোচ আবেদন। চমকানোর মতই। মেসেজ দেখেই মনেহচ্ছিলো যেন নিজের বয়ফ্রেন্ডকে সে ফোন দিতে বলছে। তন্ময় রিপ্লাই দিলো, "কে আপনি খালা?"

তন্ময়কে অবাক হয়ে দিয়ে মেয়েটি একটা উচ্ছল কিশোরীর ছবি সেন্ড করে দিয়ে বললো, "আমাকে তোমার খালা মনেহয়? বিলাই,চামচিকা, বান্দর,ব্যাংজাদা,ছাগলজাদা, ভোটকা বাছুর, বাল"

তন্ময়ের হাসি পেলো গালি দেখে। প্রথমত ছবিটা দেখে দারুণ লেগেছে আর দ্বিতীয়ত মজা লাগলো গালি গুলো দেখে। মেয়েটি এখনো কতটা বাচ্চা বোঝাই যাচ্ছে। তন্ময় একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে মেসেঞ্জারে কল দিলো মিশুকে। আর তারপর.. বাচ্চা মেয়েটিকে নিজ হাতে প্রেম শেখালো ছেলেটা, রোজ রাতে কথা বলা,সারাদিন টুকটাক মেসেজিং করা, ইস! কত কেয়ার নিতো ছেলেটা। কিন্তু হুট করেই এমন হবে কে জানতো তখন?

-"কি ভাবছো এমন তন্ময় হয়ে?"

চমকে উঠলো মিশু। তন্ময় হয়ে তো সে তন্ময়ের কথাই ভাবছিলো। ভাবলেও যতটা কষ্ট হয়নি,মেঘালয়ের মুখে নামটা শুনে তারচেয়ে দ্বিগুণ কষ্ট হলো। ইচ্ছে করছিলো লাফ দিয়ে ট্রেনের চাকার নিচে চলে যায়। এতটা যন্ত্রণা হচ্ছে মাথার ভেতর। ও একটা প্রতারক, সেইসাথে বেঈমান ও। স্বার্থপর ছেলেটা এভাবে অপমান করে চরম বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো ওকে। নাহ,একদম ই আর ওকে নিয়ে ভাববে না মিশু। কিছুতেই ভাব্বে না। ও মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, "আমার খুব বিষ খেতে ইচ্ছে করছে। গাড়িতে বিষ পাওয়া যায় না?"

মেঘালয় বিস্ময় লুকালো। এতটুকু একটা মেয়ে, বয়স আর কতই হবে? আঠারো ছুঁই ছুঁই কিংবা সতের বছর। তার এতকিসের কষ্ট যে বিষ খেতে হবে? একটা বিচ্ছেদ নিশ্চয়ই জীবনের অর্থ বদলে দিতে পারেনা। মেয়েটার সাথে কথা বলতে হবে এটা নিয়ে। 
প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করলো, "মুরগির মাংস দিয়ে গরম গরম ভাত খাও।"
মিশু বললো, "আমি ভাতের চেয়ে বিরিয়ানি বেশি খেতে পারি।"
-"আচ্ছা বেশ। মাটন বিরিয়ানি হবে, খাবা?"
-"লেবু দেবে সাথে?"

মেঘালয় হেসে বললো, "হুম দেবে অবশ্যই। সাথে কাচা মরিচ আর পেয়াজ ও দেবে।"

মিশু কিছু বললো না। একটা সিটে বসে পড়লো। মেঘালয় একটু দূরে গিয়ে কাকে যেন কি বলে আসলো। এসে পাশেই বসে পড়লো। খাবার দিতেই মিশু হাত ধুয়ে খেতে আরম্ভ করলো। মেঘালয় পাশে বসে চেয়ে আছে ওর দিকে। মেয়েটার চেহারায় একটা সরল আর নিষ্পাপ ছাপ মিশে আছে এরকম একটা মেয়েকে ছেড়ে কোন ছেলেটা চলে গেলো সেটাই ভাবছে মেঘ।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, "কি হয়েছিলো বলবে? তুমি এখানে কিভাবে এলে আর ওভাবে ছুটছিলে কেন?"
মিশু খাবার মুখে দিতে দিতে বললো, "এখন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না।"
-"বেশ। তবে খাও পেট ভরে। একবার মরিচে কামড় দাও,তাহলে খেতে পারবা।"

মিশু ওর কথামত মরিচে কামড় দিয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। মেঘালয় পানি তুলে দিলো ওর মুখে। একদম ই ঝাল সহ্য করতে পারেনা মেয়েটা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবারো মেঘালয়ের সাথে কেবিনের দিকে রওনা দিলো। একটা দরজায় এসে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিতে নিতে বললো, "ইস! কি সুন্দর লাগছে সবকিছু!"
মেঘালয় পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, "তোমার শরীর দূর্বল। আবার মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যাবা।"
-"পড়ে গেলেই ভালো হয়। সোজা চাকার তলে চলে যেতাম।"

মেঘালয় মিশুর হাত ধরে একটা হেচকা টান দিয়ে পিছনে টেনে নিলো। মিশু ওর বুকে এসে ঠেকলো একেবারে। আচমকা এরকম করার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, "এটা কি হলো?"
-"উল্টা পালটা কথা বলছিলে। আবার ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ো কিনা ভাবছি।"
-"পড়বো না,হাত ছাড়ুন।"

মেঘালয় মিশুর হাত ছেড়ে দিলো। হাত ছাড়ুন কথাটা শুনতে কেমন যেন লাগলো। এতক্ষণ মেয়েটার সেরকম হুশ ছিলো না তাই বুকে জড়িয়ে থাকলেও কিছু হয়নি। কিন্তু এখন সে দাঁড়াতে পারছে বলে 'হাত ছাড়ুন' কথাটা এমন ভাবে বললো যেন হাত ধরায় বড় অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু মনে করলো না মেঘালয়। দরজায় দাঁড়িয়ে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে দরজা আটকে ধরে মিশুকে বললো, "আমার হাতের উপর দিয়ে তাকিয়ে থাকো তাহলে ভালো লাগবে।"

মিশুর ভালো লাগলো ব্যাপার টা। হাত দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করে তাকে বাইরে দেখতে বলছে। এমন কেন ছেলেটা? এত ভালো মানুষ হতে হয়? অবাক বিস্ময়ে বাইরে তাকালো মিশু। খুব সুন্দর বাতাস এসে গায়ে লাগছে, বাইরে চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে সবকিছু। ট্রেন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছে। 

মিশু উৎফুল্ল হয়ে উঠলো ক্রমশই। এখন বেশ ভালো লাগছে ওর। বললো, "আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?"
-"পঞ্চগড় একটা ফ্রেন্ডের বিয়েতে এটেন্ড করতে যাচ্ছি আমরা। ওরা সবাই আমার বন্ধু। তুমি চিন্তা করোনা,তোমাকে বাসায় পৌছে দেয়া হবে। তবে সবকিছু খুলে বললে ভালো হতো।"
-"বারবার কেন মনে করিয়ে দিচ্ছেন সবকিছু? বললাম তো আমার বলতে ইচ্ছে করছে না। ধেৎ ভালোই লাগেনা।"
-"আচ্ছা বাবা সরি। আর বলবো না।"
-"আমি আপনার বাপ নই,নানীও নই। আমি মিশু।"
-"হা হা, আচ্ছা বেশ। এখন চলো কেবিনে যাই। ওরা সবাই খুব ফ্রেন্ডলি। ওদের সাথে একটু মেশার চেষ্টা করলে দেখবে খুব ভালো লাগবে।"

মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, "ঠিকাছে। আমরা কি যমুনা ব্রীজ পেরিয়েছি?"
-"না, এখনো অনেক বাকি।"
-"আমাকে যমুনাসেতুর উপরে উঠলে দরজায় এনে দেখাবেন?"
-"আচ্ছা দেখাবো। এখন যাই চলো।"

মিশু হাঁটতে ধরে উলটে পড়ে যাচ্ছিলো। মেঘালয় ওকে ধরে ফেলতেই মিশু বাঁকা চোখে তাকালো মেঘালয়ের দিকে। মেঘ ছেড়ে দিয়ে বলল, "সরি বাবা। সরি, সরি মিশু।"
মিশু হেসে ফেললো ওর কথা শুনে। বললো, "সমস্যা নেই। আসুন। আমি এখন হাঁটতে পারবো।"

মিশু আগে আগে হাঁটছে। মেঘালয় ওর পিছুপিছু। মেয়েটির সরলতা মুগ্ধ হওয়ার মত। কেবিনে গিয়ে গল্প শুরু করে দিতে হবে। হাসি ঠাট্টার মাঝে থাকলে স্বাভাবিক হতে পারবে মেয়েটা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp