গাড়ির দু'পাশের জানালার কাঁচ নেমে এলো। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কোমল হাওয়া ছুঁয়ে গেল। সকালের স্নিগ্ধ রোদের রশ্মি মুখাবয়ব স্পর্শ করল। সুন্দর সকালের ব্যস্ত শহরটি দেখতে মন্দ লাগল না তন্ময়ের। সচরাচর সে রাস্তাঘাট নিখুঁত চোখে দেখে না; প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয় না। তবে মাস কয়েক ধরে নির্নিমেষ চোখে আশপাশটা দেখে। এই পৃথিবীর সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করা সে অরু থেকে শিখেছে। ও সবকিছুতে বড়ো আগ্রহী। শহুরে নীরব রাস্তাঘাট চঞ্চল চোখে দেখতে ব্যাকুল রয়। প্রকৃতি উপভোগ করতে ভালোবাসে। আকাশ ভর্তি তারা, পূর্ণাঙ্গ চাঁদ–সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, নদীজল, ফুলগাছ; পাখিদের আনাগোনা সহ আরও অনেক কিছুতেই মুগ্ধ হয়ে বসে থাকে। ওর বিচলিত চোখের মুগ্ধতা তাকেও এসবের প্রতি আগ্রহ করে তুলেছে। আজকাল সেও পৃথিবীতে স্থাপিত অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করে বেড়ায়। অরুর মতন হয়তো মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে না। তবে দেখতে তার আজকাল ভালোই লাগে। আরও অসাধারণ লাগে অরু পাশে– খুব কাছাকাছি থাকলে। এইযে মহারানি পার্শ্ববর্তী সিটে উদাসীন ভঙ্গিতে বসে। মুখে রা নেই। নিশ্চল, নিশ্চুপ অরুকে সে রীতিমত ভয় পায়। সেইবার ওই চঞ্চল চোখজোড়া তার পানে না চেয়ে, কথাবার্তা না বলে, দূরত্ব বাড়িয়ে–তার হৃদয় ছুরি চালিয়ে র ক্তাক্ত করে রেখেছিল। আহা, কতটাই না নিদারুণ ব্যথিত প্রহর সে পেরিয়েছে। সেই দিনগুলোর কথা ভাবতেই মন শীতল হয়ে আসে। তীব্র ভাবে কেঁপে ওঠে ভেতরটা।
শক্তপোক্ত হাতজোড়া স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যস্ত। অবিচল চোখজোড়া সড়কপথে চেয়ে আছে। একফাঁকে চোরাচাহনি ফেলে অরুকে দেখে নিলো। যুক্তির সুর তুলে–আগবাড়িয়ে নীরবতার সুতো ছিঁড়তে তন্ময় শুধাল,
'ব্রেকফাস্ট করেছিলি?'
অরু কয়েকমুহূর্ত চুপ থাকল। হনহনিয়ে ফিরে তাকাল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে, একরোখা গলায় সময় নিয়ে জবাব দিলো,
'খেতেই তো নেমেছিলাম। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সাতসকালে এক অবিশ্বাস্য অসাধারণ, ব্রিলিয়ান্ট– মাইন্ডব্লোয়িং, বিউটিফুল দৃশ্য দেখে খাওয়ার রুচি হুড়মুড়িয়ে চলে গেছে।' এতটুকু বলে ক্ষণিকের জন্য থামল। যেন নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত দম গুছিয়ে নিচ্ছে। দম নিয়ে পরপরই তেড়ছা গলায় কলকল করে বলে গেল,
'ডিরেক্টর-দের যে ভ্যালেন্টাইন উইশ করতে ফ্লাওয়ার্স পাঠাতে হয়, গেঁয়ো আমি জানতাম না। তাহলে তো আমিও পাঠাতাম আমার প্রিয় আনম্যারিড প্রফেসরকে। সমস্যা নেই এখন জেনে গেছি। আজই পাঠা…'
তন্ময়ের চোয়াল শক্ত হলো। কপালে নীল শিরা-উপশিরা ফুলে উঠল। চোখ রাঙিয়ে তাকাল। ধমকে সুরে বলল,
'চুপ। একদম চুপ।'
এই চাপাস্বরের ধমকটা অরুর ঠিকঠাক হজম হলো না। বদহজম হলো বুঝি। সে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে নাক ফুলালো। অভিমানী কণ্ঠে পরিষ্কার ভাবে আদেশ ছুঁড়ল,
'গাড়ি থামান। আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। বাসায় ফিরব।'
তন্ময় যেন শুনেও শুনল না। বিয়ের পর মেয়েটার সাহস গুনেগুনে দশ ধাপে বেড়ে গেছে। ভয়ডর বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই আর। আগে যাও ধমক-টমক দিলে চুপসে যেতো। এখন উলটো তাকে চুপসে যেতে হয়, শাহজাহান তন্ময়কে! প্রেয়সীর রাগিত–টগবগে লালিত মুখমণ্ডল দেখে কণ্ঠ নরম করে বলল,
'আই ডোন্ট নো হার। যেভাবে পাঠিয়েছে সেভাবেই বাইরে রাখতে বলেছি। আই ডিডন্ট ইভেন টাচ দ্যাট থিং।'
কথার পিঠে অরু মিনমিনে গলায় বলল,
'সাহস দিয়েছেন বলেই পাঠানোর স্পর্ধা করেছে! আমাকেও ভার্সিটিতে যারা-যারা প্রপোজাল দেবে সবাইকে পরিষ্কার রিজেক্ট করব না। দোনামোনা করব। তাহলে পিছু লেগেই থাকবে। বাসায় বুকেও আসবে—'
মেইন রোডের পাশেতে গাড়িটা সজোরে ব্রেক কষল তন্ময়। অরুর তেঁতো-ঝাঁজাল কথাবার্তা থামাতে–পরমুহূর্তেই ওর ফোলাফোলা নরম গাল দুটো; ডানহাতের সাহায্যে চেপে ধরল। বুড়ো আঙুল ডান গালে, বাকি চার আঙুল বামগালে। রাগান্বিত, তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,
'যে প্রপোজ করবে ওর পা ভেঙে ফেলব। বাসায় ফুল পাঠাবে যে-হাতে ওই হাত ভেঙে ফেলব। বোঝা গেল?' রাগিত কণ্ঠ খানা অসহায় হয়ে এলো এযাত্রায়,
'আর কখনো বাসায় এসব আসবে না। কক্ষনো না। হুঁ? চুপ এবার।'
অরুর চোখমুখ ছোটো-ছোটো হয়ে এলো। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেল। তন্ময় ওর গাল ছাড়ল। মুখটা দৃষ্টির কাছাকাছি থাকায় স্পষ্ট দেখল ফর্সা গাল দুটো রক্তিম হয়ে গিয়েছে। আঙুলের ছাপ বসেছে। চোখের পলকে মাথাটা এগিয়ে ঝটপট দুগালে গাঢ় চুমু বসিয়ে দিলো। অরু আশ্চর্য হলো। এতটাই যে, চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে এলো। তন্ময় নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করল। যেন কিছুই হয়নি কিছুক্ষণ পূর্বে। সড়কপথে
দৃষ্টি রেখে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
'কেএফসি যাচ্ছি তবে। পার্সেল আনব? নাকি ওখানে বসে খাবি?'
অরু তখনো স্তব্দ। তবে দৃষ্টি ছন্নছাড়া-এলোমেলো। ভুলবশতও তার দিকে চাইছে না। জড়সড়ভাব বসবার। তন্ময় আড়চোখে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাজুক ভঙ্গিতে মিটিমিটি হাসতে শুরু করেছে। ওর পূর্বের অভিমান পোঁটলাপুটলি বেঁধে পালিয়েছে। চঞ্চলতা ফিরেছে দৃশ্যমান রূপে। রয়েসয়ে মিহি গলায় জানায়,
'ভিড় হবে আজ। পার্সেল আনুন–গাড়িতেই খাব।'
কেএফসির সম্মুখে গাড়ি থামাল তন্ময়। বেরিয়ে অরুকে ভেতরে রেখেই গাড়ি লক করল চাবি দিয়ে। এগোল কেএফসির ভেতর। অরুর কথামতন আজ দারুণরকমের ভিড় কেএফসি জুড়ে। কপোত-কপোতি দিয়ে প্রত্যেকটি টেবিল বুকড। দাঁড়ানোর জায়গাটুকু অবশিষ্ট নেই। পার্সেল নিয়ে বেরোতে তন্ময়ের পনেরো মিনিট লাগল। খাবার অরুর হাতে ধরিয়ে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করল। উদ্দেশ্যে উদ্দেশ্যহীন।
————
অরুকে ঘুরিয়েফিরিয়ে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা। দুয়ার পেরোতেই আশ্চর্যজনক ভাবে অয়নকে দেখা গেল। সে লিভিংরুমে বসে। হাতে চায়ের কাপ। তার সম্মুখে মোস্তফা সাহেব। শক্তপোক্ত মুখ করে বসে। দোতালার পিলারের পেছনে শাবিহা নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে। অরু আড়চোখে মোস্তফা সাহেবের গম্ভীরমুখ দেখে দোতলায় চলে গেল। দাঁড়ানোর সাহস পেলো না। তন্ময়কে দেখতেই দাঁড়াতে চাইল অয়ন। তন্ময় হাতের ইশারায় বসবার তাগাদা দিলো। নিজেও ওর পাশে এসে বসল। জিজ্ঞেস করল,
'কী খবর? চোখমুখ এমন কেন?'
অয়ন আড়চোখে ভবিষ্যৎ শ্বশুরের মুখপানে চেয়ে বলল, 'শাবিহাকে ঘন্টাখানেকের জন্য নিতে চাচ্ছিলাম।'
তন্ময় হেসে সাবলীল গলায় বলল,
'তো যাও নিয়ে। কে আটকেছে? শাবিহা কোথায়?' পরপর উচ্চকণ্ঠে ডাকল,
'এই শাবিহা! অয়ন অপেক্ষা করছে। তৈরি হয়ে নাম।'
মোস্তফা সাহেব আর কিছু বললেন না। তবে তার মুখাবয়ব পরিষ্কার জানাচ্ছে তিনি অসন্তুষ্ট। শাবিহা তৈরি হয়েই ছিল। ভাইয়ার পারমিশন পেতেই নেমে এলো সঙ্গে সঙ্গে। এতে খানিক নির্বাক হলেন মোস্তফা সাহেব। পুনরায় চোখের সামনে পরিষ্কার হলো, মিয়াঁ বিবি রাজি–তো কেয়া কারেগা, কাজি? কিছুই না। চুপচাপ দেখবেন শুধু। অয়ন সালাম জানিয়ে শাবিহাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তন্ময় উঠে দাঁড়াল। সিঁড়ির দিক যেতে-যেতে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
'শুক্রবার অয়নের বাবা-মা আসবেন। শাবিহাকে আংটি সেদিন পরিয়ে যাবেন।'
মোস্তফা সাহেব বোঝবার ন্যায় মাথা দোলালেন। আংটি পরিয়ে গেলে বিয়ের দেরি নেই। আগামী মাসেই বিয়ের তারিখ পড়বে হয়তো। শাহজাহান বাড়ির বড়ো মেয়ের বিয়ে বলে কথা! এক্সাপশনাল ভাবে আয়োজন না করলে হবে নাকি? তবে মোস্তফা সাহেব আরেকটি বিষয় ভাবছেন। ওই বিষয়ে পার্সোনালি কথা বলতে হবে ছেলের সঙ্গে।
তন্ময় উঠে এলো দোতলায়। অরুর রুমের দরজা খোলা। যাবার সময় না চেয়েও তাকিয়ে বসল। অরু দাঁড়িয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে। ব্যস্ত হাতে অর্নামেন্টস খুলছে। তন্ময় ঠাঁই দাঁড়িয়ে কিছু মুহূর্ত দেখল। অরু একপর্যায়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। আশ্চর্য অরু শুধাল,
'কী হয়েছে?'
তন্ময় শব্দ করে গলা পরিষ্কার করার ছুঁতোয়; নিজ রুমের দিক যেতে নিয়ে বলল, 'একমগ কফি দিয়ে যা।'
.
.
.
চলবে............................