হৃদমোহিনী - পর্ব ২৫ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


বুঝে উঠতে সময় লাগলো অনেক্ষণ। গাড়ি ব্রেকফেইল করেছে। ভাগ্যিস হঠাৎ থেমে গেছে। নয়তো সামনের কোনো গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট হলে কিংবা পাশের ডোবায় পড়ে গেলে বড়সড় দূর্ঘটনা ঘটতে পারতো।

তন্ময় মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, 'ব্যথা পেয়েছো?'
- 'সামান্য। এটা ব্যাপার না, কিন্তু এখন কি হবে?'

সুপারভাইজার এসে জানালো অনেক সময় লাগবে ঠিক করতে। এমনিতেই সন্ধ্যে নেমে এসেছে। যদি এতক্ষণ সময় লাগে তাহলে বাসায় পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে। মিশুর মুখটা ছোট্ট একটু হয়ে গেছে। বারবার মেঘালয়কে বলেছিলো সাথে আসার জন্য। কিন্তু মেঘালয় এলো না। এত রাতে একা একা যাওয়াটাও রিস্কি হয়ে যাবে। 
বাস থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলো দুজনে। বাসের মেরামত চলছে। মিশু নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। তন্ময় ওর পাশেই দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর মিশু বললো, 'তুমি যেখানে যাবে সেটা কতদূর এখান থেকে?'
- 'সিএনজিতে ঘন্টাখানেক লাগবে হয়ত।'
- 'তাহলে তুমি চলে যাও।'
- 'তুমি একা একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে? রাত নেমে এসেছে। আমিও বরং থাকি, তোমাকে বাসে তুলে দিয়ে তারপর চলে যাবো।'

মিশু কিছু বললো না। বড়সড় দূর্ঘটনা হয়নি তাতেই শোকরিয়া। কিন্তু এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। গাড়ি এমন একটা জায়গায় দাড় করিয়েছে যেখানে কোনো দোকানও নেই। খুব টেনশন বাড়ছে মিশুর। 
তন্ময় বললো, 'তোমাকে অন্য একটা বাসে তুলে দিই তুমি চলে যাও?'
মিশু একবার ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বললো না। ভালো লাগছে না ওর। মেঘালয়কে কল দিয়ে জানালো কিরকম সমস্যায় পড়েছে। কথাগুলো শুনে টেনশন ওরও বেড়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু তন্ময় পাশে থাকায় কিছুটা ভরসা পাচ্ছে। মেঘালয় মিশুকে বললো ফোনটা তন্ময়ের কানে দিতে। 

তন্ময় রিসিভ করে বললো, 'হ্যালো..'
- 'ভাই তন্ময়, তুমি মিশুকে বাসা পর্যন্ত রেখে আসতে পারবে না?'
- 'পারবো। কিন্তু অনেক রাত হয়ে যাবে, আমি আবার অত রাতে ফিরতে পারবো না। মিশুর বাবা মায়ের মুখোমুখি হতে চাচ্ছিলাম না।'
- 'ওকে একা পাঠাতে চাইছিলাম না।'
- 'আচ্ছা আমি নিজে গিয়ে রেখে আসবো, টেনশন কোরো না।'

প্রয়োজনীয় কথা সেরে ফোনটা রেখে দিলো মেঘালয়। মিশু ও তন্ময় দুজনে চাতকের মত রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো। গাড়ির পিছনে বিশাল জ্যাম লেগেছে, আর কোনো গাড়ি ই চলাচল করতে পারছে না। ঠিক করতে কতক্ষণ লাগবে বোঝা যাচ্ছে না। অপেক্ষা করাটা বিরক্তিকর। তবুও অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। 
এমন সময় আকাশে মেঘ করে আসতে শুরু করেছে। যদি বৃষ্টি নামে তখন আরেক মুছিবত হবে। কারণ এভাবে ভিজে তো আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। মিশুর চেহারায় চিন্তার ছাপ পড়লো। 

তন্ময় সবকিছু ভেবে বললো, 'মিশু, তুমি বরং আমার সাথে চলো। তোমার কোনো সমস্যা হবেনা, আমার কাজিনের বাসা। রাতটা থেকে কাল সকালে তোমাকে বাসে তুলে দেবো।'

মিশু আপত্তি জানালো। তন্ময়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতেই ওর অপ্রস্তুত লাগছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে পারলেই যেন বাঁচে। তন্ময় মেঘালয়ের কাছে ফোন দিলো আরেকবার।
মেঘালয়কে কথাটা বলামাত্রই ও বললো, 'এটা তো অনেক ভালো কথা। এত রাতে একা ওকে পাঠানোর প্রয়োজন নেই, আর তোমারও তাহলে ওর সাথে যেতে হবে না। তুমি বরং ওকে সাথে নিয়ে যাও, সকালে বাসে তুলে দিও।'

মেঘালয়ের সাথে তন্ময়ের অনেক ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। একজন আরেকজনকে অনেক বেশি বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে। সেখানে মিশুকে বাসায় পৌঁছে দেয়াটা এখন তন্ময়ের দায়িত্ব। মেঘালয় সরল মনে মিশুকে ওর সাথে পাঠিয়ে দিলো।

তন্ময়ের দূর সম্পর্কের বোনের বাসা। বাসায় মেয়েটা ছাড়া আর কেউ নেই। রাস্তায় থাকা অবস্থাতেই বৃষ্টি নেমেছে। ওরা বৃষ্টিতে ভিজে সেখানে পৌঁছালো রাত নয়টায়।

৮০!! 

ভেজা কাপড় বদলে একটা আকাশী রঙের কামিজ পড়েছে মিশু। চুলে তোয়ালে বেঁধে খাবার টেবিলে আসলো। ওর সদ্য স্নাত চেহারার দিকে তাকিয়েই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো তন্ময়ের। হার্টবিট টা লাফ দিয়ে অনেকখানি বেড়ে গেলো যেন। মিশুকে বাসে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো। তার উপর ঘাম, জার্নির ধকল, ধূলাবালি আর এলোমেলো চুলে খুব মলিন দেখাচ্ছিলো। অথচ এখন ওর চেহারায় যে লাবণ্যময়তা ফুটে উঠেছে তা দেখে যে কারো দৃষ্টি আটকে যাবে। বাইরে হাওয়ার ঝাপটানির সাথে সাথে বুকের ভেতরেও ঢিপঢিপ করতে আরম্ভ করেছে। 
টিনের চাল হওয়ার কারণে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্লেটে খিচুড়ি দেখে মিশুর চোখদুটো ঝিকমিক করে উঠলো। উৎফুল্ল হয়ে টেবিলে বসে পড়লো ও। তন্ময় ওর প্রফুল্ল মুখটা যতবার দেখছে, ততবার খুন হয়ে যাচ্ছে।

মিশু খিচুড়ি মুখে দিয়ে বললো, 'উম ইয়াম্মি। আপু, লেবু নেই বাসায়? লেবু থাকলে আরো মজা হতো।'
- 'লেবু আছে, আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।'

মেয়েটা লেবু আনার জন্য রান্নাঘরে ছুটে গেলো। তন্ময় পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে মিশু'র দিকে। যেন প্রথমবার দেখছে ওকে। দৃষ্টিটা ওর মায়াবী মুখেই আটকে আছে, বিন্দুমাত্র নড়ানো যাচ্ছে না। মিশু খিচুড়ি খেতে খেতে বললো, 'আজকের সন্ধ্যাটা অনেক সুন্দর না তন্ময়?'

তন্ময় চমকে উঠলো। মেয়েটা খুব সুন্দর করে ওকে ডাকে, কতদিন পর এভাবে নাম ধরে ডাকলো! 

মিশু বললো, 'এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? খিচুড়ি খাও, দারুণ মজা হয়েছে খেতে।'
- 'মিশু..'
- 'হুম বলো।'
- 'এই মোমের আলোয় তোমাকে অনেক মায়াবতী লাগছে।'

চোখ তুলে তন্ময়ের দিকে তাকালো মিশু। ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তন্ময়। এ চোখে কোনো কামনা নেই সত্যি, কিন্তু ভালোবাসা আছে। ভালোবাসার দৃষ্টিগুলো সবসময়ই ভয়ংকর হয়। সহজে এড়ানো যায় না। বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো মিশু'র। ও প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বললো, 'আচ্ছা বাস টা কি এখন ঠিক হয়েছে? যদি ঠিক না হয় তাহলে যাত্রীরা কিভাবে কে কি করছে বলোতো? আমার তো টেনশন হচ্ছে সবার জন্য।'

তন্ময় একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো, 'টেনশন কোরো না। বোধহয় ঠিক হয়ে গেছে।'
- 'খিচুড়ি টা অনেক মজা হয়েছে না?'
- 'হুম অনেক মজা হয়েছে।'

আপু লেবু এনে দিলো। মিশু লেবু নিয়ে খুব আয়েশ করে খিচুড়ি খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে অনেক আগেই। এখানে ঝড় বৃষ্টি হলেই আর বিদ্যুৎ থাকে না। 

তন্ময়ের সামনে বসে থাকতে অপ্রস্তুত লাগছে বলে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করলো মিশু। তারপর, 'মাথা ব্যথা করছে' বলে দ্রুত পাশের একটা রুমে চলে এলো। আসার সময় একটা মোম সাথে করে এনেছে। মোমটা টেবিলের উপর রেখে চুল থেকে তোয়ালে খুলে ফেললো। তারপর হাত দিয়ে ঝুল ঝাড়তে ঝাড়তে আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে একবার দেখলো। মনেমনে বললো, 'আজ আমাকে সত্যিই একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে না? নাকি আবহাওয়ার কারণে এমন মনেহচ্ছে?'

ফোনটা নিয়ে মেঘালয়ের নাম্বারে কল দিলো মিশু। এদিকে মিশুকে দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে দমাতে পারেনি তন্ময়। দরজায় এসে হা করে তাকিয়ে আছে। যত দেখছে, তত বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ওর। প্রতিমুহুর্তে মনেহচ্ছে, 'মেয়েটা তো আমারও হতে পারতো। ও তো সবকিছু উজার করে আমাকেই ভালোবাসতো।'

মেঘালয় ফোন রিসিভ করে বললো, 'মিশু, তন্ময়কে পেয়ে আমাকে ভূলে গেছো না?'
- 'এটা আবার কেমন কথা। এজন্যই আমি এখানে আসতে চাইনি। কতটা ভালোবাসি জানেন ই তো, তবুও এই কথা?'
- 'আচ্ছা বাবা মজা করেছি। এবার বলো তো কি করছো?'
- 'খুব জোরে বৃষ্টি নেমেছে গো। চুলগুলো ভেজা বলে বেশি রোমান্টিক ফিল করছি।'
- 'বাবা গো তাই নাকি?'
- 'হুম। অনেক রোমান্টিক ওয়েদার।  চারিদিক অনেক নিস্তব্ধ, শুধু টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ শোনা যায়।'
- 'আমাকে মিস করছো না?'
- 'শুধুই কি মিস? আপনার জন্য রীতিমত আমার কান্না পাচ্ছে।'

টেবিলের উপর মোম জ্বলছে। তার সামনে নিচু হয়ে এসে কথা বলছিলো মিশু। মুখটা ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো। ওর লাজরাঙা মুখটা দেখে তন্ময়ের ভেতরে এমন সব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে যা বলে বোঝানো সম্ভব না। ছেলেটা গলাকাটা পশুর মত ছটফট করছে শুধু। বৃষ্টির শব্দের কারণে মিশু'র কথা কানে আসছে না। অজান্তেই কি বলছে শোনার জন্য কাছে এগিয়ে এলো তন্ময়।
মিশু উঠে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।

মেঘালয়ের কথা শুনতে শুনতে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছে ওর। দেয়ালে হেলান দিয়ে একটা পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালো ও। তারপর মেঘালয়কে বললো, 'আমার একদমই ভালো লাগছে না। বিয়ের প্রোগ্রামটা তাড়াতাড়ি হচ্ছে না কেন? সবসময় আপনাকে আমার কাছেকাছে রাখবো।'
- 'এইতো পাগলী, আর দুটো দিন ধৈর্য ধরো।'
- 'শুনুন, আমি কিন্তু আপনাকে ছাড়া একটা মুহুর্তও একা থাকতে পারবো না বলে দিচ্ছি। আপনি যদি বিজনেসের কাজে দূরে কোথাও তিনদিনের জন্যও যান, সেখানেও আমাকে নিয়ে যেতে হবে বলে দিলাম।'
- 'ওরে পাগলীটা রে, তিনদিনের জন্য গেলেও নিয়ে যাবো?'
- 'হ্যা নিয়ে যেতে হবে। এখন একটু কাছে আসুন তো।'
- 'এখন কিভাবে কাছে আসবো?'

মিশু চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। এদিকে তন্ময় আরো কাছে চলে এলো ওর। মিশুর কথা শোনার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে তন্ময়।

মিশু ফোনে বললো, 'মনেমনে কাছে আসুন। আমার না আপনাকে খুব জড়িয়ে ধরে থাকতে ইচ্ছে করছে। শুধু জড়িয়ে থাকা না, আপনার উপরে উঠে খামচাখামচি, কামড়াকামড়ি করতে ইচ্ছে করছে। শক্ত করে জাপটে ধরে আপনার শরীরটা খামচি দিয়ে দিয়ে একেবারে শেষ করে দিতাম।'
- 'ওরে পাগলী টা, এভাবে বললে আমি থাকতে পারবো না রে। আর তো মাত্র দুটো দিন, ধৈর্য ধরো। এরপর দেখবো কেমন পারো।'
- 'উফফ!  বাসর রাতে আপনাকে কামড় দিয়ে দিয়ে মেরেই ফেলবো আমি। আমার না ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে।'
- 'বুঝতে পারছি রে। এত কাছে পাওয়ার পর কি এভাবে দূরে থাকা যায় বলো?'
- 'উহু যায় না। এরপর আর কক্ষনো আমি আপনাকে দূরে যেতে দিবো ই না যে। এই মেঘমনি..'
- 'হুম বাবুইপাখি, বলো।'
- 'আমার না আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। জড়িয়ে ধরে থাকতে ইচ্ছে করছে। আপনার কোলে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে খুব। খুব খুব।'
- 'আর বলিস না রে, কষ্ট হচ্ছে আমার।'

মিশুর চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। ও আর্দ্র কণ্ঠে বললো, 'প্রচণ্ড মিস করছি মেঘমনি। আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যান না আপনার কাছে। আপনার থেকে দূরে থাকতে পারবো না আমি। নিয়ে যান না তাড়াতাড়ি।'
- 'এভাবে ডাকলে কিন্তু এই রাতেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বো।'
- 'না না এত রাতে এমন পাগলামী করতে হবে না। আমি ধৈর্য ধরে লক্ষী মেয়ে হয়ে যাচ্ছি।'

তন্ময় মিশুর সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে ক্ষোভে, ক্রোধে আগুন হয়ে উঠছে। মিশুকে এখনো প্রচণ্ড ভালোবাসে ও। আর মিশু অন্য একজনকে এভাবে ভালোবাসবে সেটা কিভাবে সহ্য হবে ওর? এতটা রাগ হচ্ছে যে সবকিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। না পারছে কাউকে বলতে, না পারছে সহ্য করতে। শুধু দগ্ধ হচ্ছে ক্রমশ ই।

মিশু বললো, 'এখন এই লক্ষী মেয়েটাকে একটু জড়িয়ে ধরুন তো। জড়িয়ে ধরে.. এই মেঘমনি, আমার না প্রচণ্ড চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।'

ক্ষোভে, হিংসায় শরীরটা কাঁপছে তন্ময়ের। এমনিতেই অন্ধকার রাত, তার উপর ঝড় বৃষ্টি। মিশুর মুখে অন্য কারো জন্য এমন ভালোবাসা সহ্য করতে পারছে না তন্ময়। আরো কাছে এগিয়ে এসে খপ করে মিশুর কোমরে হাত দিয়ে চেপে ধরে ওকে কাছে টেনে নিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় জ্ঞানশূন্য হওয়ার মত অবস্থা মিশু'র। হাত থেকে পড়ে গেলো মোবাইলটা। ভয়ে চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। গলাটা শুকিয়ে গেলো মিশু'র। গলা দিয়ে একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে এলো শুধু, 'তুমি!' 

তন্ময়ের চোখে প্রতিহিংসার আগুন। আগুনচোখে বললো, 'তোমাকে আমি অন্য কারো হতে দিতে পারবো না। আমার সহ্য হচ্ছে না।'

মিশু রেগে বললো, 'আমি তো অন্য কারো হয়েই গেছি, আর কি হতে দেবে না? ছাড়ো আমাকে।'

তন্ময় মুখটা আরো কাছে এনে বললো, 'কিচ্ছু জানিনা। আজ থেকে তোমাকে আমি আর কারো হতে দিচ্ছি না।'

মিশু গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, 'আমাকে ছাড়ো। তুমি পাগল হয়ে গেছো।'
- 'ছাড়বো কেন? তোমার না চুমু খেতে ইচ্ছে করছে?'
- 'আমি আমার স্বামীকে বলেছি। মেঘালয় আমার স্বামী, আমার সব, আমার সবকিছু।'

মিশুকে ছেড়ে দিয়ে ঠাস করে ওর গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তন্ময়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গাল ধরে বিছানার উপর বসে পড়লো মিশু। তন্ময় আরো কাছে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। ফোনটা বেজে চলেছে অনেক্ষণ ধরে। মেঝে থেকে ফোনটা তুলে কল রিসিভ করার সাহসটাও পাচ্ছে না মিশু। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেঘালয় কল করেই যাচ্ছে। 
মিশু নিচু হয়ে ফোনটা তোলার চেষ্টা করতেই তন্ময় আগে তুলে নিলো সেটা। তারপর খুব জোড়ে দেয়ালে আছাড় মারতেই স্ক্রিন ফেটে নিচে পড়ে গেলো। ভয়ে আঁৎকে উঠলো মিশু। কদিন আগেই মেঘালয় কিনে দিয়েছে ফোনটা। চোখের সামনে এভাবে ভেঙে ফেললো! মিশু'র বাকরুদ্ধ হওয়ার মত অবস্থা। 

এমন সময় তন্ময়ের ফোন বেজে উঠলো। মেঘালয় ফোন করেছে। তন্ময় ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে বললো, 'ওর কল ধরা যাবে না। কল দিতেই থাকুক।'

মিশু চেঁচিয়ে ডাকলো, 'আপু, এই আপু..'

মিশুর মুখটা চেপে ধরে তন্ময় বললো, 'চেঁচাবা না। একদম চিল্লাচিল্লি করবা না।'

মিশু'র মুখটা চেপে ধরে রেখেছে তন্ময়। এদিকে তন্ময়ের ফোনে বারবার কল দিয়ে যাচ্ছে মেঘালয়। ফোনের দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে কেঁদে ফেললো মিশু। আজকে ও অনেক অসহায়, এই অসহায় অবস্থা থেকে আদৌ পরিত্রাণ পাবে কিনা জানেনা। দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়াতে লাগলো। এতটা মানসিক চাপ নিতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে তন্ময়ের হাতেই পড়ে গেলো মিশু। 

—————

মিশুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আগে নিজেকে সামলে নিলো তন্ময়। তারপর মেঘালয়ের নাম্বারে কল দিলো। 
মেঘালয় রিসিভ করেই উদ্বিগ্ন স্বরে বললো, 'হ্যালো, হ্যালো..'
- 'হ্যা ভাই বলো। এতবার ফোন করেছো যে? আমার ফোন ভাইব্রেট করা ছিলো, আমি আমার বোনের সাথে গল্প করছিলাম।'
- 'মিশুর নাম্বার বন্ধ কেন? মিশু কোথায়?'
- 'ও তো পাশের রুমে শুয়ে পড়েছে। ওর ফোনে মেয়বি চার্জ নেই। আমি আমার ফোনটা ওকে দিয়ে আসছি এক্ষুনি, টেনশন কোরো না।'

মেঘালয় যেন  হাফ ছেড়ে বাঁচল। এখনি কি যে টেনশন শুরু হয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটাকে একা পাঠানোই উচিৎ হয়নি। তন্ময়কে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখলো মেঘালয়। সাথে সাথে মনেমনে প্রতিজ্ঞা করলো আর ভূলেও কোনোদিনও মিশুকে একা ছাড়বে না। পাগলীটাকে সবসময় সাথে সাথেই রাখবে। ফোন বন্ধ হওয়াতে নিশ্চয় এখন গাল ফুলিয়ে বসে আছে।

এদিকে তন্ময় নিজের ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখলো। তারপর এক গ্লাস পানি এনে হালকা পানির ছিটা দিলো মিশু'র মুখে। চমকে উঠে চোখ মেললো মিশু। এখনো চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। তন্ময়কে দেখে চিৎকার না করে বরং ধীরেসুস্থে উঠে বসলো। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললো, 'কি চাচ্ছো তুমি এখন?'
- 'তোমাকে।'
- 'আমাকে না আমার শরীরটাকে?'
- 'তোমাকে পুরোটাই চাই আমি।'
- 'আমি পুরোটাই মেঘালয়ের হয়ে গেছি। আমার বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। তুমি আমাকে চাইলে বড়জোর রেপ করতে পারবে। এরবেশি কিছুই পাবে না। কিন্তু ভালোবাসাকে কখনো ধর্ষণ করা যায়না তন্ময়।'

মিশু উত্তেজিত হওয়ার বদৌলতে ঠাণ্ডা মেজাজে কথাগুলো বলে গেলো। এতক্ষণ সেন্সলেস হয়ে কি স্বপ্ন দেখলো নাকি মেয়েটা? বিন্দুমাত্র ভয়ের রেশ চেহারায় নেই। ভড়কে গিয়ে তন্ময় তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।

মিশু বললো, 'আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে। আবার হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। তোমার সাথে এই ব্যাপারগুলো খোলাখুলি ভাবে শেয়ার করা দরকার। এখন তুমি আসলে কি চাইছো?'
- 'আমি তোমাকেই চাই মিশু। তোমার সাথে আজীবন থাকতে চাই, তোমার ভালোবাসা নিয়ে থাকতে চাই।'
- 'ভালোবাসা এভাবে পাওয়া যায়? বরং আজকের পর থেকে তোমার প্রতি যে ভালোবাসাটুকু ছিলো সেটাও ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। যেদিন বটি নিয়ে তোমাকে মারতে গিয়েছিলাম, সেদিন কাজটা সম্পন্ন করাই বোধহয় ভালো ছিলো।'

মিশু'র কাছে এগিয়ে আসলো তন্ময়। কাছে এসে ওর মুখটা দুহাতে ধরার চেষ্টা করলো। মিশু বাঁধাও দিলো না, চিৎকারও করলো না। বরং এগিয়ে এসে বললো, 'মুখ ধরতে চাচ্ছো? ধরো। তুমি আসলে কতটা নিম্নশ্রেণীর পশু আমিও আজকে সেটাই দেখবো।'

তন্ময় মিশু'র মুখটা ধরে বললো, 'মিশু আমাকে ভূল বুঝো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। দেখো তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো। আমার টানে রংপুর থেকে ঢাকায় ছুটে গিয়েছিলে তুমি। আমরা কত স্বপ্ন দেখতাম তাইনা? মাঝখানে আমার লাইফে যা যা হয়েছে, এক্সিডেন্ট ভেবে ভূলে যাচ্ছি আমি। তুমিও বিয়েটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভূলে যাও না। তুমি আমি, দুজন মিলে একটা সুন্দর জীবন সাজাই?'

মিশু হাসার চেষ্টা করে বললো, 'যখন তাড়িয়ে দিয়েছিলে তখন কেন বোঝোনি যে ভূল করছো? মেঘালয়ের সাথে আমার আকাশ পাতাল ব্যবধান। আমরা কেউই কাউকে চিনতাম না, তবুও বিয়েটা হয়েছে বলে সে আমাকে নিয়েই থাকতে চাইছে। আমি অনেকবার বলেছিলাম ডিভোর্স হোক আমাদের। কিন্তু মেঘ সেটা হতে দেয়নি। একটার পর একটা ঝামেলা সব একহাতে সামলেছে। ফেরেশতার মত মানুষ পেয়েছি একটা। তাকে ছাড়ার কথা চিন্তা করা যায়?'

তন্ময় মিশু'র মুখটা ছেড়ে দিয়ে বললো, 'ওর সাথে মাত্র কয়েকদিনের সম্পর্ক। সেখানে আমাদের অনেক দিনের রিলেশনশিপ। আমাকে ওর চেয়ে তুমি বেশি ভালোবাসতে। ওকে ছেড়ে আমার কাছে আসা যায় না?'

মিশু সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো। ও তন্ময়কে দীর্ঘদিন ধরে চেনে। আর যাই করুক, অন্তত জোর পূর্বক কিছু করবে না এটা নিশ্চিত। সেই ভরসাতেই ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলার চেষ্টা করলো। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বললো, 'তুমি এতটা অকৃতজ্ঞ কিভাবে হতে পারলে তন্ময়? আজকে বিশ্বাস করে মেঘালয় আমাকে তোমার সাথে পাঠিয়েছে। সেই বিশ্বাসের ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছো তুমি। এতটাও নিচু হতে পারে কেউ! এই তন্ময়কে আমি কখনোই ভালোবাসিনি। ভালোবাসাকে সম্মান করতে পারাটা যার ধাতে নেই।'

তন্ময় কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে বললো, 'আমি কিছু বুঝি না মিশু। আমি অনেক নিঃসঙ্গ। আমার পাশে তোমাকে দরকার।'

মিশু বললো, 'সব দরকারকে পেতেই হবে এমন তো কথা নেই। আমি পুরোপুরি মেঘালয়ের। তবুও তোমার সৌভাগ্য যে এতকিছুর পরও সেই মেঘালয় ই দুজন নার্স রেখে তোমার সেবা করেছে। দুদিন পরপর নিজে ছুটে গেছে তোমাকে দেখতে। এত অসম্মান, এতকিছু মাথায় নিয়েও ছেলেটা বারবার ছুটে গেছে। তুমি নাকি ওর বন্ধু হয়ে গেছো? এই মানুষটাকে কিভাবে ঠকানো যায় তন্ময়?'

তন্ময় মিশুর কাছাকাছি এসে বললো, 'আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে মিশু। সবদিক থেকে এত প্রেশার আমি জাস্ট নিতে পারছি না আর। তোমাকে হারানোটা আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। বাবা মাকে হারিয়েছি, সব হারিয়েছি। আমার জীবনের কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবুও যখন তোমাকে দেখি, মনেহয় এই মেয়েটা তো আমার হতে পারতো। তুমি আমার হলে আমার জীবনটা এরকম নাও হতে পারতো। তখনই মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। ন্যায় অন্যায় সবকিছু ভূলে কেবল তোমাকেই পেতে চাই। তোমাকে পাওয়ার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষটাও আমি হতে রাজি।'
- 'বাহ! যখন আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে? আমি গাইয়া, আমি আনস্মার্ট, তোমার সাথে আমার যায় না। কত কি... রাস্তায় পড়ে পড়ে কেঁদেছি আমি।'
- 'এখন তোমার পা ধরবো মিশু?'
- 'তুমি আমার পা ধরার ও যোগ্যতা রাখো নি তন্ময়। এইযে তোমার সাথে ভালো করে কথা বলছি, এটা মেঘালয়ের আদর্শকে ধারণ করেছি বলে। নয়তো কোনোদিনো আমি পারতাম না তোমার সাথে কথা বলতে।'
- 'মিশু, সব ই বুঝলাম কিন্তু মেঘালয়কে ছেড়ে কোনোভাবেই কি আমার কাছে আসা যায় না?'

মিশু দৃঢ় কণ্ঠে বললো, 'না। আমি মেঘালয়কে ভালোবাসি। তুমি একটু আগে যেটা করেছো, সেটার জন্য আমি কখনো তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো না। অবশ্য জোর খাটিয়ে কি ই বা করতে পারতে। ধর্ষণ? করলে করতে। করে কি পেতে? আমার ঘৃণা ছাড়া কিছুই পেতে না। আমাকে খুন করে ফেললেও তোমার লাভ নেই। হয়তো সাময়িক আনন্দ পেতে কিন্তু একদিন তোমার মস্তিষ্ক ঠিকই তোমাকে শাস্তি দিতো। প্রকৃতি কখনো প্রতিশোধ নিতে ছাড় দেয় না।'
- 'মিশু, তুমি তো আমাকে চেনো। আমি কোনো বাজে ছেলে নই। আমি এসব রেপ টেপ কখনো করতাম না।'
- 'আমি জানি তুমি বাজে ছেলে নও। কিন্তু তোমাদেরকে কখনো বিশ্বাস করা যায়না বুঝলে? কখন কোন পৈশাচিক রূপ বেরিয়ে আসে বোঝা মুশকিল।'
- 'মিশু, আমি জানি বারবার খারাপ কিছু করেছি। কিন্তু সবটাই তোমাকে পাবার জন্য।'
- 'এভাবে পাওয়া যায় না জানোনা সেটা? আমার জন্য তুমি মরে গেলেও আর তোমার কাছে ফেরার রাস্তা আমার জানা নেই। জানো না? নাকি পরকিয়া করার কথা ভাবছো?'

তন্ময় চমকে উঠে মিশু'র দিকে তাকালো। তারপর মাথা দুলিয়ে বললো, 'তোমার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবো না। তবুও যদি কোনোভাবেই কিছু করার না থাকে, পরকিয়া করতেও আমি রাজি। তবুও তোমার ভালোবাসাটুকু আমার চাই ই।'

শব্দ করে হেসে উঠলো মিশু। হাসি থামতেই চাইলো না। অনেক্ষণ ধরে হাসার পর বললো, 'তুমি পাগল হয়ে গেছো। মিশুর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তোমার ধারণা কম আছে। এত নিচু মন মানসিকতার মানুষটাকে আমি কিভাবে একদিন অতটা ভালোবাসতাম সেটা ভেবেই হাসি পাচ্ছে।'

তন্ময় সিরিয়াস চেহারা ধারণ করে বললো, 'এই তন্ময় কখনো এমন ছিলো না। পরিস্থিতি আমাকে এমন বানিয়েছে।'

মিশু তন্ময়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, 'পরিস্থিতির সূচনা তুমিই করেছিলে। তুমি যদি সেদিন আমাকে অপমান করে ফিরিয়ে না দিতে, একটার পর একটা বিপদ কিছুই ঘটতো না। দেখো তন্ময়, আমি জানি তুমি অনেক ভালো একটা ছেলে। তুমি গুণ্ডাদের মত আচরণ করলে তাহলে জগতে আর ভালো মানুষ কে থাকলো বলো? আমি আর মেঘালয় একজন আরেকজনের জন্যই সৃষ্টি। আমাদেরকে আলাদা করতে চেয়ো না প্লিজ। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছো, এরপর থেকেই আমার লাইফে একটার পর একটা বিপদ ঘটে যাচ্ছে। সবকিছুর পরেও আমি সুখী কারণ মেঘালয় আর ওর পরিবারটাকে পেয়েছি। তোমার উপর রাগ বা ভালোবাসা কোনটাই আমার নেই। তোমাকে মনে করার সময় পাই না আমি।'
- 'আমি এতটা খারাপ নই মিশু।'

মিশু বললো, ' তোমার সামান্য একটা ভূলের কারণে আমার জীবনে যে বিপর্যয় আসতে চেয়েছিলো, সেটা কেটে এসেছি। আমি তোমাকে ক্ষমাও করে দিয়েছিলাম। আজকে নতুন করে আর কোনো বিপদ ডেকে এনো না। অনেকেই বলেছে আমি অন্য একটা এলাকায় একটা ছেলের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়েছি। এরপর আমাদের বিয়ে, তারপর চেয়ারম্যানের স্বীকারোক্তি নিয়ে ভিডিও করে প্রমাণ করতে হলো আমরা নির্দোষ। একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে। আজকে যদি এখানে কোনো ঝামেলা হয়, দুদিন পর আমার বিয়ের প্রোগ্রামটা আর হবে না। একদিকে অপমান সহ্য করতে না পেরে আব্বু হার্ট এটাক করবে, অন্যদিকে আমার শ্বশুরবাড়ির রেপুটেশন নষ্ট হবে। আর মেঘালয়ের কি হবে কল্পনা করতে পারিনা আমি। এতকিছু নষ্ট করে দিয়ে কি তুমি ভালো থাকবে? আর আমিও যদি তোমার হাত ধরে পালিয়ে যাই, আমরা কি ভালো থাকবো? ধ্বংস হয়ে যাবে তন্ময়।'

তন্ময় করুণ চোখে মিশু'র দিকে তাকালো। সেই চোখের ভাষা বুঝতে পারলো না মিশু। কিন্তু অপরাধবোধ প্রবল হয়ে উঠেছে। ছেলেটা অনুশোচনা করতে করতে দগ্ধ। 

মিশু বললো, 'আমি জানি তুমি খারাপ ছেলে নও। তুমি খারাপ হলে অন্তত আমি কখনো তোমাকে ভালোবাসতাম না।'

হঠাৎ মিশুর বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তন্ময়। খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে মিশু। আচমকা তন্ময়ের এমন আচরণে কি করবে বুঝতে পারলো না। তন্ময় কাঁদতে কাঁদতে বললো, 'আমাকে কেন মরতে দিলে না তোমরা?'

মিশু ওর মাথায় হাত রেখে বললো, 'মৃত্যুটা সবকিছুর সমাধান নয়। এখন ওঠো, আর আজকে কোনো ঝামেলা কোরো না। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার আজকের এই আচরণের কথা কেউ কখনো জানতে পারবে না।'

মাথা তুলে মিশুর চিবুকে হাত রেখে তন্ময় বললো, 'তুমি এত ভালো কেন মিশু? এত লক্ষী একটা মেয়েকে আমি কষ্ট দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি ভাবলে মরে যেতে ইচ্ছে করে।'

মিশু উত্তরে বললো, 'সবকিছুকে পেয়ে পায়ে ঠেলে দিতে হয় না তন্ময়। গুরুত্বটা বুঝতে হয়। বাহ্যিক রূপ দেখে যদি সৌন্দর্য বিচার করো, তাহলে বলবো আমি সবসময়ই সুন্দর ছিলাম। আমাকে দেখার চোখ তোমার ছিলো না। আর যদি বাইরেটা দেখে স্মার্টনেস বিচার করো তাহলে বলবো, নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখাটাই সবচেয়ে বড় স্মার্টনেস। যেটা আমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।'

মিশুকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো তন্ময়। আর কোনো কথা বললো না। চোখ মুছে বিছানার উপরে রাখা নিজের ফোনটা দেখিয়ে দিয়ে বললো, 'মেঘালয়কে ফোন দাও।'

তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সবকিছুর জন্য আল্লাহ তা'য়ালার প্রতি শোকরিয়া আদায় করলো মিশু। তন্ময় চলে গেছে, তারমানে আর কোনো বিপদ আসার সম্ভাবনা নেই। আল্লাহ তন্ময়ের মঙ্গল করুক। 
কথাটা বলতে বলতে ফোন নিয়ে আগে কল দিলো মেঘালয়কে। 

৮১!! 

মিশু'র কণ্ঠ শুনে কলিজায় শান্তি ফিরে পেলো মেঘালয়। হাফ ছেড়ে বললো, 'মরে যাচ্ছিলাম এখনি। তন্ময় ফোন ধরছিলো না, ওদিকে তোমার ফোনটাও বন্ধ।'

মিশু যথাসম্ভব গলার স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো, 'আমার ফোনটা বন্ধ, চার্জ শেষ। আর তন্ময় এসে দেখে আমি দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। আসলে খুব টায়ার্ড লাগছিলো তো। ও ডেকেছে, আমি শুনতে পাইনি।'
- 'মিশু, জীবনে প্রথমবার আমাকে মিথ্যে বললে তাই না?'
মিশু তোতলাতে তোতলাতে বললো, 'মিথ্যে মানে!'
- 'দরজা লাগিয়ে দিয়ে ঘুমালে তোমার গলার স্বর শুনেই বুঝতাম। আর আমার সাথে কথা না বলে তুমি ঘুমাতেই পারো না। কি করলে বলো তো?'

মিশু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, 'আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন তো?'
- 'সেটা করি বলেই তন্ময়ের সাথে পাঠিয়েছি। কিন্তু তন্ময়কে তো তোমার মত বিশ্বাস করতে পারি না।'
- 'আমি নিরাপদে আছি, ভালো আছি। আমাকে নিয়ে টেনশন করতে হবে না।'
- 'ঠিক আছে। বাদ দাও। আমি যদি আজকে সারারাত তোমার সাথে কথা বলতে চাই তাহলে কি তোমার সমস্যা হবে?'

মিশু খুশি হয়ে বললো, 'এর মত আনন্দ আর হবেনা আমার জন্য।'
- 'তাহলে সারারাত কথা বলবো। রুমের দরজা জানালা সব বন্ধ?'
মিশু চমকে উঠে বললো, 'দরজা খোলা।'
- 'দরজাটাও লাগিয়ে দিয়ে আসো। তাহলে নির্ভয়ে কথা বলতে পারবা।'

মিশু অবাক হলেও কিছু বললো না। উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে আসলো। মোমটা নিভে গেছে। বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিয়েই বললো, 'মেঘমনি, আমাকে কখনো ভূল বুঝবেন না তো?'
- 'না। কিন্তু আমার কাছে সৎ থেকো সবসময়।'
- 'আমি সত্যিই আজকে মিথ্যে বলেছি।'

মেঘালয় বললো, 'বুঝতে পেরেছি। তোমার কোনো সমস্যা না হলেই হলো। তবে আজকে আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এরপর কখনো তোমাকে একা একা শপিং করতেও পাঠাবো না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচবো কি নিয়ে? প্রত্যেকটা সেকেন্ড আমি তোমার সাথে থাকতে চাই মিশু।'

মিশুর চোখে পানি এসে গেলো। ও নিজেও আর কখনো মেঘালয়কে ছাড়া এক পা ও তুলবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp