৯০!!
দ্রুত গাড়ি টেনে শহর থেকে দূরে একটা বৃক্ষঘেরা দোকানে নিয়ে এলো মেঘালয়। গাড়ি থেকে নেমে প্রাণভরে শ্বাস নিলো মিশু। শহরের শব্দদূষণে ঘেরা গরম পরিবেশ থেকে কিছুক্ষণের জন্য স্বস্তি। এখানে তেমন কোনো শব্দ নেই, আলো নেই, মাঝেমাঝে দূরের রাস্তায় হুশ করে একটা গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ কানে আসে। বেশ ভালোই লাগছে।
মেঘালয় মিশু'কে দোকানের ভিতরে নিয়ে গেলো। একজন মধ্যবয়সী মহিলা দোকানদারি করছেন। মেঘালয় কাছে যেতেই উনি হেসে বললেন, 'কেমন আছেন সাহেব?'
- 'ভালো আছি খালা। তুমি ভালো আছো?'
- 'এইতো আছি। বহুদিন পর এসেছো। প্রেমিকা?'
মেঘালয় হেসে বললো, 'বউ। বিয়ে করেছি খালা।'
- 'ওমা! মেয়েটা মিষ্টি আছে।'
- 'থ্যাংকস খালা। আইসক্রিম হবে না?'
- 'হবে। শুধু ভ্যানিলা হবে, চকোলেট শেষ হয়ে গেছে।'
- 'ওটাই দিও। আমাকে সুজির রসবড়া আর কফি দিও। আর ওকে আইসক্রিম।'
- 'দিচ্ছি, বসো গিয়ে। আইসক্রিম কাপে দেবো না কোণে?'
- 'কাপেও না, কোণেও না। একটা বালতি কিংবা গামলা থাকলে গামলা বালতি ভরতি করে দাও। আমার বউয়ের আইসক্রিমের সাধ মেটাবো আজ।'
হো হো করে হেসে উঠলেন দোকানি মহিলা। মিশু হা করে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। বললো, 'ইস এমনভাবে বলছে যেন আমি রাক্ষস। আইসক্রিম ভালো লাগে বলে এমন নয় যে এক গামলা আইসক্রিম খাবো।'
মেঘালয় মিশু'র দিকে তাকিয়ে বললো, 'এক বালতি দিতে বলেছি। এটা তো বলিনি যে ইয়া বড় বালতি হবে। বালতির সাইজ হবে ছোট্ট একটু। চার ইঞ্চি।'
মিশু ক্ষেপে গিয়ে দাঁত কিড়মিড় করলো। দোকানি মহিলা হেসে বললেন, 'তুমিও যা দুষ্টু বাবা। বৌ মনি তুমি মন খারাপ কইরো না। আমি তোমাকে কোণেই দিচ্ছি। একবার শেষ হয়ে গেলে আবার নিও। গামলায় দিলে তো গলে যাবে। তুমি অল্প অল্প করে এক গামলা খেও।'
মিশু বললো, 'আমি কি রাক্ষস? আর মেঘমনি সবার সামনে আমাকে এভাবে বলেন কেন? সবাই মনেমনে বলবে মেয়েটা রাক্ষসী। ওর স্বামীর টাকা পয়সা সব বুঝি খেয়েই শেষ করে দেবে।'
হো হো করে হেসে উঠলো মেঘালয়। তারপর কাছে এসে মিশুর কাঁধে হাত রেখে ওকে টেনে নিয়ে বললো, 'তোমার বর অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকে প্রচুর পরিশ্রম করেছে বুঝলে? যাতে করে তার লক্ষী বউটার সব আবদার পূরণ করতে পারে। আমার লক্ষী বউটার তো তেমন কোনো আবদার ই নেই, শুধু খাওয়া ছাড়া। আমার পরিশ্রম টাকে সার্থক করতে হবে না?'
মিশু মেঘালয়ের চোখে চোখ রেখে বললো, 'তাছাড়া আর কি আবদার করবো শুনি?'
- 'বউদের কতরকম আবদার থাকে..'
- 'যেমন?'
মেঘালয় মিশুকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো। চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা। দূর থেকে আলোর ঝলকানি এসে পড়ছে কোলের উপর। বসতে বসতে মেঘালয় বললো, 'রূপচর্চা, অর্নামেন্টস, আজকে এইখানে ঘুরতে যাবো, কালকে ওইখানে ঘুরতে যাবো, শপিংয়ের অভ্যাস তো আছে ই। এগুলোর বাইরেও কত কি..'
মিশু বললো, 'এগুলোতে কি আর এমন খরচ হয়?'
- 'হা হা হা। বাবু তুমি তো ঢাকায় থাকো না, তাই জানো ও না। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের রূপচর্চা করতে দেখে পুরো হা হয়ে গিয়েছিলাম।'
- 'কেন?'
মেঘালয় বললো, 'একদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো। দুপুর আমাকে কল দিয়ে বললো মিনা বাজারের সামনে থেকে আমাকে একটু বাসায় রেখে আসবি? আমি রীতিমত মিনা বাজারে এসে তাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। পরে সে বেড়িয়ে এসে বললো, আমিতো ফারজানা শাকিলে ছিলাম। আমি হা হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সেটা আবার কি? সে বললো, মেইকওভার। ফেসিয়াল ট্রিটমেন্ট করতে এসেছিলাম।'
কৌতুহল বশত জানতে চাইলাম, তোদের এই রূপচর্চায় খরচ কেমন রে?
সে হেসে হেসে বললো, 'আজকে শুধু ফেসিয়াল করেছি, তিন হাজার লেগেছে। মেনিকিউর, পেডিকিউর, হেয়ার ট্রিটমেন্ট, বডি ওয়াশ, ম্যাসাজ এইগুলোতে আলাদা আলাদা খরচ। এগুলোর বাইরেও কন্সিলার, প্রাইমার, ফেস পাউডার সব বিদেশি প্রোডাক্ট লাগে। একটা সানস্ক্রিনের দাম দুই হাজার টাকা। ভাবা যায়?'
মিশু হা হয়ে শুনছিলো এতক্ষণ। মেঘালয় ভ্রু নাচাতেই ও বললো, 'আমার এসব ভালো লাগে না। কিন্তু বডি ম্যাসাজ টা কিভাবে করায়? সুড়সুড়ি লাগে না?'
- 'আমি সুড়সুড়ি ভেঙে দিয়েছি না?'
ক্ষেপে গিয়ে মেঘালয়কে মাইর শুরু করে দিলো মিশু। আর মেঘালয় হো হো করে হেসেই চলেছে। দোকানি খালা এসে ট্রে সামনে রেখে বললেন, মারামারি করছো কেন?
মিশু মাইর বন্ধ করে বললো, 'জানেন খালা, এই লোকটা এত দুষ্টু! ওনার হাড়ে হাড়ে শয়তানি কিলবিল করে।'
- 'জানি জানি। এইগুলা সহ্য করো। ছেলেরা একটু দুষ্টু না হলে হয় না।'
মেঘালয় সুজির রসবড়া নিয়ে এক চামচ মুখে দিয়ে বললো, 'ইয়াম্মি! খালা বহুদিন পর খেলাম। তুমি এটা যা বানাও না..'
মিশু বললো, 'এমা! এগুলো তো মিষ্টি। আমিও খাবো।'
- 'হা করো। খাইয়ে দিচ্ছি।'
মিশুকে মিষ্টি তুলে খাওয়ালো মেঘালয়। খালা দোকানে ফিরে এলেন। মিষ্টি শেষ করে মেঘালয় কফিতে চুমুক দিলো আর মিশু আইসক্রিম। আইসক্রিম দেখে সে কি আনন্দ মেয়েটার। ছোট ছোট আনন্দগুলোই জীবন টাকে কত উপভোগ্য করে তোলে।
মেঘালয় বললো, 'জায়গাটা কেমন লাগছে তোমার?'
- 'খুব নিরিবিলি। একটা রাত এখানে থাকতে পারলে ভালো হতো। মনে করো প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। তুমি আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি উপভোগ করছি। তুমি আমাকে কোলে নিয়ে ঘরে যাবা।'
- 'নিরিবিলি দেখলেই তোমার খালি কোলে উঠে ঘরে যেতে ইচ্ছে করে তাই না?'
মিশু আবারো ক্ষেপে এগিয়ে এলো। হাসি শুরু করে দিলো মেঘালয়। হাসি থামিয়ে মিশু'কে বুকে টেনে নিয়ে বললো, 'মিশু, তোকে খুব ভালোবাসি রে। এত কাছে থাকার পরও ইচ্ছে করে তোকে আমার বুকে পিষে ফেলি। কলিজার ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে রে। তুই আমাকে রেখে ইন্ডিয়ায় গেলে আমি থাকবো কি করে?'
গলা ধরে এলো মেঘালয়ের। আমি থাকবো কি করে- কথাটা শুনেই বুকের ভেতর কেমন উথাল পাথাল শুরু হয়ে গেলো মিশুর। সত্যিই তো, এই মেঘালয়কে ছাড়া সে নিজেও কি থাকতে পারবে? এই মুহুর্তগুলো সবসময় হৃদয়ে কাঁপন ধরাবে। ইচ্ছে করবে ছুটে চলে যাই মানুষটার কাছে। কিন্তু চাইলেও আসা সম্ভব হবে না। মাঝখানে একটা সীমান্ত দুজনকে দুভাগ করে রাখবে। মিশু মেঘালয়ের শার্ট খামচে ধরলো। বুকের উপর জোরে খামচে ধরতে ধরতে অনেক খানি জায়গা একেবারে দাগ করে দিলো। ব্যথা পেলেও কোনো শব্দ করলো না মেঘ। ভালোবাসার এই আচঁড় গুলোও অনেক শান্তি দেয়। যন্ত্রণাগুলো কমিয়ে দেয়।
মিশু বিড়বিড় করে বললো, 'আমি কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে। আমার কষ্ট হবে, ভীষণ কষ্ট হবে। অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে তোমাকে আপন করে পেয়েছি। আমি দূরে সরে গেলে তুমি মরেই যাবে।'
মিশুকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো মেঘালয়। চোখে পানি এসে গেছে ওর। একইসাথে প্রিয় মানুষটাকে আপন করে পাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে হারানোর ভয়ের যন্ত্রণা। ভালোবাসারা এমন ই, খুব আপন করে পেলে হারানোর ভয়টা মনে চেপে বসে।
মিশু বললো, 'আজকাল কয়েক বছর সংসার করার পর মানুষটাকে আর ভালো লাগে না, বিরক্তি এসে যায়। আমার ক্ষেত্রে আপনার এমন হবে না তো?'
- 'তুমি এমনই একটা মেয়ে, যাকে শত শত বছর সামনে বসিয়ে রাখলেও বিরক্তি আসবে না মিশু।'
- 'সত্যি?'
মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে বললো, 'নাহ। ঢপ মারলাম। তোকে আমার এত বিরক্ত লাগেএএএ, ন্যাকা একটা মেয়ে। শাবনূরের মাসি, শাহতাজের চাচী, সাফা কবিরের নানী।'
মিশু আবারো ক্ষেপে তেড়ে এলো মেঘালয়ের দিকে। ভয়ানক রাগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজকে মেঘালয়ের রক্ষে নেই। ধরতে পেলেই খবর আছে। মেঘালয় উঠে একটা ভো দৌড় দিলো। বেঞ্চের চারিদিকে দুজন মিলে দৌড় প্রতিযোগিতা চলতে লাগলো। মেঘালয় চাইলেই বেঞ্চের উপর দিয়ে লাফ পারে কিন্তু মিশু পারে না। ক্লান্ত হয়ে ঘাসের উপর বসে পড়লো মিশু। মেঘালয় পিছনে ওর কানের কাছে এসে বললো, 'ম্যাও!'
মিশু চমকে উঠলো। মেঘালয় হাসতে হাসতে আবারো দৌড়। মিশু নিজেও হেসে ফেললো। কিছুক্ষণ পর মেঘালয় এসে মিশুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো ঘাসের উপরেই। মিশু মেঘালয়ের নাক টেনে ধরে বললো, 'এখন মারি?'
- 'মিউ মিউ মিউ।'
মিশু হেসে মেঘালয়ের কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলো। মেঘালয় আঙুল তুলে আকাশে ঝুলতে থাকা পূর্ণিমার চাঁদ টা দেখিয়ে দিয়ে বললো, 'দেখেছো কি অপরূপ?'
- 'হুম। কি সুন্দর আলো ছড়িয়েছে!'
- 'তার চেয়েও সুন্দর আলো কোনটা জানো?'
- 'কোনটা?'
- 'তুমি। আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছো।'
মিশু মুচকি হেসে বললো, 'উহু। তুমি আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ আলো।'
মিশুর আঙুলের ফাঁকে আঙুল রাখলো মেঘালয়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের নানান অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে যেতে লাগলো মিশুকে। দুজনে গল্প করতে করতে কোনো এক কল্পলোকে হারিয়ে গেলো। চারিদিকের মুগ্ধকর পরিবেশ সবাই ওদেরকে সাহায্য করছিলো জীবনটাকে নতুনভাবে উপভোগ করতে।
—————
৯১!!
কয়েকদিন পর
স্কলারশিপের চিঠি এসে গেছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ। দু'মাস আগে মিশু যেমনটা চেয়েছিলো ঠিক তেমনটাই হয়েছে। কিন্তু এই দু'মাসের মাঝে যে মেঘালয় জীবনে এসে সবকিছু এলোমেলো করে দেবে সেটা অজানা ছিলো। এলোমেলো বলাটা অন্যায় হয়ে যাবে, সে তো জীবনে আলো হয়ে এসেছে। সেই আলো নিভিয়ে দিয়ে দূর পরবাসে চলে যাওয়াটা কতটা ন্যায়সঙ্গত হবে?
ভাবতে ভাবতে মনটা উদাস লাগছে। চারিদিক থেকে শূন্যতা গ্রাস করে ফেলছে মিশুকে। বসে থাকতে না পেরে ছুটে বসার ঘরে এলো। এ ঘরে পুরো দেয়ালের একদিকে বিশাল কাঁচ লাগানো। বাইরে মেঘের ঘনঘটা জমতে আরম্ভ করেছে। এমন ধূসর কালো মেঘের সাথে দমকা হাওয়া দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। বুকের ভেতর কেমন কেমন করতে শুরু করে। মাঝেমাঝে মনেহয় মেঘ - বৃষ্টির সাথে মনের একটা বিশেষ যোগসূত্র আছে। সবকিছু তোলপাড় হওয়ার মত একটা ধাক্কা লাগে, আবার নতুন নতুন প্রেমে পড়ার স্বাদ অনুভূত হয়।
মিশু জানালার কাঁচ ঘেষে বসে একমনে বাইরে তাকিয়ে আছে। কলিংবেলের শব্দ ওর কানে পৌঁছাচ্ছে না। ভীষণরকম উদাসীনতা ভর করলে যা হয়। পুরনো স্মৃতি মনে করতে ইচ্ছে করছে, আবার নতুন স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। আকাশের কালো মেঘের ভেলা আরো কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে।
মেঘালয় এসে পাশে দাঁড়ালো। গা থেকে কোট খুলতে খুলতে বললো, অনেক্ষণ থেকে বেল বাজাচ্ছি শুনতে পাওনি?
মিশু চমকে বললো, 'না তো। কখন এলেন?'
- 'এইমাত্র। তোমার মন খারাপ?'
- 'কারণ জানতে চাইবেন না। মন খারাপের কারণ বলাটা বিরক্তিকর।'
- 'বেশ। জানতে চাইলাম না। কিন্তু মন খারাপের স্থায়িত্ব কমানোর চেষ্টা করলে কি আমার পাপ হবে?'
- 'না। তবে সবসময় মন ভালো করার চেষ্টা না করাই ভালো। মাঝেমাঝে মন খারাপের দরকার আছে।'
- 'বেশ। এখন বিদ্যুৎ চমকাবে। ঘরে এসো।'
- 'মাঝেমাঝে বিদ্যুৎ চমকানো দেখতে ভালো লাগে।'
- 'মাঝেমাঝে কি আমাকে অসহ্য লাগে?'
মিশু এবার চোখ তুলে মেঘালয়ের দিকে তাকালো। একটা হাফ সিল্ক নীল রংয়ের শার্টের সাথে বেগুনি টাই পড়েছে মেঘালয়। সুদর্শন যুবকের মত লাগছে। দেখার পর নিমেষে মন ভালো হতে চাইলেও মিশু মুখ ভার করে বললো, 'এই মুহুর্তে অসহ্য লাগছে। আমার সামনে থেকে যান।'
মেঘালয় আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে গেলো। মিশু নিষ্পলকভাবে বৃষ্টির ফোঁটা দেখছে। কতক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে নিজেও জানেনা। মেঘালয় হাত ধরে টেনে তোলার সময় ওর হুঁশ হলো।
- 'রাজকন্যার হয়েছে টা কি হুম?'
- 'আমার আজ খুব মন খারাপ।'
- 'আরেকটু খারাপ করে দেই?'
মিশুর উত্তরের অপেক্ষা না করে মেঘালয় ওকে কোলে নিয়ে রুমে এলো। জানালার পাশে ওকে দাড় করিয়ে দিয়ে বললো, 'এখন কি আমাকে সহ্য হচ্ছে?'
- 'এখনো অসহ্য লাগছে।'
- 'আমি চলে যাবো?'
মেঘালয় চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মিশু ওর শার্ট খামচে ধরে বললো, 'ভিসার সব কাগজপত্র পাঠাতে বলেছে। আমি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। আপনি বলে দিন না আমি কি করবো?'
- 'পাঠিয়ে দাও।'
- 'যদি না পাঠাই?'
- 'তাহলে তোমাকে ইন্ডিয়ায় থাকতে দেবে না।'
- 'না দিলে কি আমার খুব ক্ষতি হবে? প্রত্যেকটা রাত স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে?'
মেঘালয় মিশু'র চোখের দিকে তাকালো। চোখ পাথরের মত কঠিন। সেই পাথর ফেটে জল আসছে মনে হচ্ছে। বাবা মা সবাই মিলে বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা মিশুকেই নিতে বলেছে। ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা মেঘালয়ের। ও পিছনে সরে এসে সাউন্ডবক্সে একটা গান ছেড়ে দিলো।
মিশু জানালার এক কোণে দাঁড়িয়ে, মেঘালয় আরেক কোণে।
মিউজিকটা শুনেই মনটা কেমন করতে শুরু করেছে। এরপর বাজতে লাগলো গান,
'স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে, যেন মনেতে উঁকি দেয়,
শিশিরভেজা মনটা আমার, লুকোচুরি খেলে নীলিমায়..
যেন স্বপ্নে হারাই, আমি স্বপ্ন কুড়োই,
হৃদয়ে সুখের অনুরণ।
ভাবে মন অকারণ সারাক্ষণ,
অনুভবে সুখের আলোড়ণ।'
গান বেজে চলেছে। মিশু অস্থির হয়ে বললো, 'গানটা শুনে নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছি। কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি তখন ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ি, রেডিওতে বারবার গানটা বাজতো। প্রতিদিন রাত ১১ টা থেকে বারোটায় আম্মু গানটা শুনতো। আমি আম্মুর পাশে শুয়ে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম। কি অদ্ভুত সব স্মৃতি!'
মেঘালয় অবাক হওয়ার ভান করে বললো, 'তাই!'
মিশু বললো, 'হুম। আমার আপুর একটা বাটন ফোন ছিলো, সেটা নিয়ে মাঝেমাঝে ইয়ারফোনে গানটা শুনতাম আর ধানক্ষেতের পাশে বসে হাওয়া খেতাম। সেই ছোট্টবেলা, সেই সোনালি স্মৃতি! বুকের ভেতরটা কেমন কেমন যেন করছে।'
- 'হুম। আমার টিনএজের গান এটা। একদিন কক্সবাজার থেকে আসার পথে পুরো রাস্তাটাই এই গান শুনতে শুনতে এসেছি।'
মিশু কাছে এসে মেঘালয়ের হাত ধরে বললো, 'স্মৃতি এত পোড়ায় কেন? স্মৃতিগুলো সুন্দর তবুও বুকটা খানখান করে। ছেলেবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে।'
- 'আর আমাকে কোন স্মৃতিতে বাঁধলে? আমাকে মনে পড়ার মত স্মৃতি কি মগজে একটাও নেই?'
মিশু খপ করে মেঘালয়ের বাহু চেপে ধরে ওকে জাপটে ধরলো। তারপর শুরু করলো আবারো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। মেঘালয় এটুকু বেশ ভালো করেই জানে যে এই মেয়েটাকে একা কিছুতেই ছাড়া যাবে না। তবুও সে যদি যেতে চায়, বাঁধা দিলে হয়ত কষ্ট পাবে। কাজেই এমন কিছু করা দরকার যাতে মেঘালয়কে রেখে দূরে যাওয়ার ভূতটা একেবারেই মাথা থেকে দূর হয়ে যায়। এ জন্য সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ হচ্ছে একটা ট্যুর। ঘুরতে গেলে তিনদিন একসাথে কাটানোর পর এতবেশি মায়া জন্মে যাবে যে আর দূরে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারবে না মিশু।
মেঘালয় মিশুর মুখ তুলে বললো, 'শরীর ভালো লাগছে?'
- 'হ্যা। শুধু মনটাই খারাপ।'
- 'ঘুরতে যাবা?'
মিশু চোখ তুলে তাকানো মাত্রই ফিক করে হেসে ফেললো। ওর হাসির কারণ বুঝতে না পেরে মেঘালয় হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে। মিশু বললো, 'এই ঝড় বৃষ্টিতে কোথায় যাবো আবার?'
মেঘালয় বললো, 'রাতের বাসে। ঝুম বৃষ্টিতে, অন্ধকার বাসে তুমি আর আমি। শিরশির করে হাওয়া এসে কানে লাগবে। পানির ঝাপটায় গা ভিজে যাবে তোমার। তুমি হন্তদন্ত হয়ে জানালা লাগাতে গিয়ে হাতে ব্যথা পাবে। তারপর আমি জানালা লাগিয়ে দিয়ে আমার বুকের ভেতর শক্ত করে তোমাকে চেপে ধরবো। তুমি নড়াচড়া করবা, আমি আরো শক্ত করে চেপে ধরবো। বুকের সাথে পিষে ফেলবো তোমাকে।'
মিশু ইতিমধ্যে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেছে। মেঘালয়ের বলার যা ভঙ্গি, শুনলেই মনের ভেতর আগডুম বাগডুম বাজতে শুরু করে। ইশ! কখন যাবো বেড়াতে?
মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, 'দাঁড়াও টিকেট বুকিং দিই।'
৯২!!
অফিসের কাজগুলো গোছানোর জন্য অফিসে গেছে মেঘালয়। মিশু বাসায় বসে ব্যাগ গোছাচ্ছে। এখন ওর মন বেশ ফুরফুরে। স্কলারশিপ, ভিসা দূরে যাক। আগে ট্যুর দিয়ে আসি। মেঘালয়ের সাথে ঘুরতে যাওয়া মানেই একটা কল্পনার রাজ্যে প্রবেশ করা। সেই আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার মানেই হয় না।
কলিংবেল বেজে উঠলে দৌড়ে দরজা খুলতে গেলো মিশু। মেঘালয় ভেতরে ঢুকতেই মিশু হাত বাড়িয়ে কোলে ওঠার বায়না ধরলো। মেঘালয় ওকে সরিয়ে দিয়ে সোজা রুমে গিয়ে ঢুকলো। মিশু মুখ কালো করে পিছুপিছু ছুটলো ওর। এসে দেখলো মেঘালয় টাই খুলে রেখে বাথরুমে ঢুকে পড়েছে। মিশু কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেঘালয় বাসায় ফিরে একটা কথাও বললো না।
মিশু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে বসলো। মেঘালয় তোয়ালে চাইলে তোয়ালে হাতে ছুটে বাথরুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল মিশু। কিন্তু তোয়ালে নিয়ে গা মুছে মেঘালয় বেড়িয়ে এলো বাথরুম থেকে। একবার মিশু'র সাথে কথাও বললো না। মিশুর কান্না এসে যাচ্ছে।
মেঘালয় তোয়ালে ছুড়ে মেরে রুম থেকে বেড়িয়ে খাবার টেবিলে চলে গেলো। মিশু থ হয়ে বসে পড়লো মেঝের উপর। এই লোকটা আজ এমন কেন করছে? তোয়ালে ছুড়ে মারার অভ্যাস তো কখনোই ওনার ছিল না। এই কয়েক ঘন্টায় কিছু হয়েছে বোধহয়।
মেঘালয়ের গলা শোনা গেলো, 'মিশু, এই মিশু।'
মিশু ছুটে এলো খাবার টেবিলে। মেঘালয় টেবিলে বসে আছে। মিশুকে দেখে বললো, 'বসো। খিদে পেয়েছে অনেক।'
মিশু ভয়ে ভয়ে সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লো। কোনো কথা না বলে প্লেটে খাবার তুলে দিলো। মেঘালয় খাবার খাওয়ার সময়েও কোনো কথা বললো না। মিশু বারবার ভয় ভয় চোখে তাকাচ্ছিলো ওর দিকে। কিন্তু মেঘালয়ের কোনো ভাবান্তর নেই। সে দিব্যি খেয়েই চলেছে। খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে গেলো। অথচ প্রতিদিন মিশু'র খাওয়া শেষ না হলে হাত ও ধোয় না সে। মিশু মুখ কাচুমাচু করে তাকাচ্ছে। আর খেতে পারলো না ও।
মেঘালয় জামাকাপড় বদলে চুল আচড়াচ্ছে। মিশু দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, 'কি হয়েছে আপনার?'
- 'কই কিছু না তো।'
- 'আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?'
- 'রেগে থাকবো কেন আজব তো।'
- 'হঠাৎ আপনার সবকিছু বদলে গেছে।'
- 'আরে পাগলী মেয়ে, কিছু হয়নি আমার।'
মেঘালয় ঘড়ি হাতে পড়ে ওয়ালেট খুঁজতে লাগলো। মিশু সেটা এগিয়ে দিতেই মেঘালয় বললো, 'থ্যাংকস।'
তারপর রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য মাত্রই পা বাড়িয়েছে, এমন সময় মিশু ওর পিঠে শার্ট খামচে ধরলো। মেঘালয় পিছন ফিরে বললো, 'কি?'
মিশু অনেক জোরে খামচে ধরে শার্ট ছিঁড়ে নিতে চাইলো। মেঘালয় ওর দিকে হাত বাড়াতেই মিশু ওর বুকে ঢলে পড়লো। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, 'কি হয়েছে আপনার? আমি কি কিছু করেছি? আমাকে এভোয়েড করছেন কেন আপনি?'
মেঘালয় মিশু'র মুখটা তুলে ধরে বললো, 'না রে পাগলী, এভোয়েড করছি না। আমি একটু ঝামেলায় আছি। প্রচুর টেনশন হচ্ছে আমার।'
- 'কেন? আমি ছোট বলে আপনার টেনশনের কারণ শুনতে পারি না?'
- 'ছোট বড় ব্যাপার নয়। বললে তুমিও টেনশন করবে তাই বলতে চাই না। আমার আচরণে কষ্ট পেলে সরি হ্যা?'
- 'সরি বলতে হবে না। শুধু বলুন না কেন এমন করছেন?'
- 'কিছু হয় নি রে পাগলী। আমি আরেকবার বাইরে যাবো। এসে কথা হবে কেমন?'
মেঘালয় মিশুর হাত ছাড়িয়ে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মিশু মৃদু স্বরে বললো, 'আমরা আজকে ঘুরতে যাবো না?'
মেঘালয়ের স্পষ্ট গলা শোনা গেলো, 'না।'
থ মেরে বিছানার উপর বসে পড়লো মিশু। মেঘালয়ের কি হতে পারে সেটা ভেবে অস্থির হয়ে উঠলো।