৫১!!
রাত নেমেছে অনেক্ষণ আগেই। মিশু সদ্য শ্বশুরবাড়িতে এসেছে। বাড়ি দেখেই হতবাক হয়ে গেছে ও। মেঘালয়ের রুমটা একেবারে ওর স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর। এরকম একটা ঘর ওর হবে ভাবতেও পারেনি কখনো। ঘরের সবকিছুতেই এক ধরণের শুভ্রতা ছেয়ে আছে। মনটা না চাইতেও ভালো হয়ে যায়। প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় ভেতরটা। আর বিছানা দেখেই মনেহয় শুয়ে পড়লেই ঘুমে চোখ বুজে আসবে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিশু মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘালয় সোফার উপর বসে ল্যাপটপ কোলে বসিয়ে কি যেন করছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছে কিছু একটা নিয়ে। মিশু বিছানা থেকে উঠে ধীরেধীরে এগিয়ে এলো মেঘালয়ের কাছে। পাশে বসে বললো, 'কি করছেন?'
- 'একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ করছি। একটু অপেক্ষা করো।'
মিশু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আজকে মেঘালয়ের কাজ শেষ করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে হয়ত। হতাশ হয়ে উঠতে যাবে এমন সময় মেঘালয় ওর হাত টেনে ধরে বললো, 'মন খারাপ কোরোনা। কাজটা শেষ করেই আসছি।'
মিশু মুচকি হেসে বললো, 'মন খারাপ করিনি। আপনি কাজ শেষ করেই আসুন।'
মিশু বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। শহরটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে এখান থেকে দেখতে। কত মোহময় একটা রূপ আছে এই শহরের। চেনা শহরটাকেও রাত্রিবেলা কেমন যেন অচেনা লাগে। মুগ্ধ হয়ে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলো মিশু। মেঘালয়ের কাজ কি এখনো শেষ হয়নি? তখন তো খুব করে বলেছিলো আজ রাতে তোমার খবরই আছে। তাহলে এখন আবার কি হলো? এরপর আবার নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, 'আচ্ছা কাজ করছে যখন করুক।'
হঠাৎ মেঘালয় ডেকে বললো, 'কল এসেছে ফোনে।'
মিশু একটু অবাকই হলো। মেঘালয় কি পারতো না ফোনটা নিয়ে বেলকুনিতে এসে দাঁড়াতে? কাজের প্রতি খুব মনোযোগী ছেলেটা সেটা বোঝাই যাচ্ছে। মিশুর মন খারাপ হলেও রুমে এসে ফোন রিসিভ করলো। বাবা ফোন করেছে। ও রিসিভ করে বললো, 'ঘুমাওনি?'
- 'ঘুম আসছে না মা। আমি কাল সকালে বাসে উঠবো। ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি।'
মিশু কি যেন ভেবে বললো, 'আব্বু তুমি আরো কয়েকদিন পরে এসো।'
বাবা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, 'কেন?'
মিশু ফোন নিয়ে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালো। বললো, 'আমাকে দুটো দিন এদের সাথে একাকী মিশতে দাও। আমি দেখতে চাই সবাই আমার সাথে কেমন আচরণ করে। তুমি কয়েকদিন পরে আসো।'
- 'ঠিক আছে মা। কিন্তু তোর শ্বশুরকে কি বলবো?'
- 'আমি বলে দিবো আম্মুর শরীরটা একটু খারাপ। তাই তুমি দুদিন পরে আসবে।'
- 'তুই যা ভালো মনে করিস। রাতে খেয়েছিস মামনি?'
- 'হ্যা। তুমি?'
- 'হ্যা রে মা। তোর কি মন খারাপ?'
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, 'না আব্বু। কাল কথা বলবো, ঘুম পেয়েছে আমার।'
ফোন কেটে দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মিশু। মেঘালয়কে ছাড়া একটা মুহুর্তও ভালো লাগেনা ওর। তাহলে কি ধীরেধীরে মেঘালয়ের প্রতি এক ধরণের মায়া তৈরি হচ্ছে? মায়া জিনিসটা বড্ড অদ্ভুত। কিভাবে কখন কার প্রতি জন্মে যায়, বোঝাই যায়না।
এমন সময় মেঘালয় এসে আচমকা কোলে তুলে নিলো মিশুকে। রুমে এসে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মিশু শিউরে উঠে দুহাতে খামচে ধরলো মেঘালয়ের শার্ট। মেঘালয় নিচু হয়ে এসে মিশুর কপালে আলতো চুমু এঁকে দিয়ে বললো, 'আমার বউটা একটু বেশিই মিষ্টি দেখতে। কি বলেছি মনে আছে তো?'
মিশু চোখেচোখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, 'কি?'
মেঘালয় বললো, 'আমার বউকে আমার মত হতে হবে।'
মিশু চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। মেঘালয় আরো কাছে এসে ওর গলায় মুখ গুঁজে দিলো। চোখ বন্ধ করে ফেললো মিশু। চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো দুফোটা। এটা কিসের কান্না বুঝতে পারলো না ও। হয়ত সুখের কিংবা অচেনা কোনো যন্ত্রণার...
৫২!!
চারদিন কেটে গেছে। মিশুর বাবা এসেছেন, আগামীকাল ফ্লাইটে চলে যাবেন মিশুকে নিয়ে। বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে পনের দিন পর। আয়োজন করতে একটু সময় তো লাগবেই। মিশুর মনটা আজ একটু বেশিই খারাপ। চলে যাওয়ার কারণে নয়। মন খারাপ অন্য একটা কারণে। বিয়ের পর থেকে এই কয়েকদিন মেঘালয় ওর শরীরটাকে ইচ্ছেমত ঘেটেছে। এমনকি মিশুও অনেক নতুন কিছু অধ্যায় আবিষ্কার করেছে মেঘালয়ের সম্পর্কে। এখন ও ছেলেদের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানে যা আগে জানা ছিলো না। প্রতিটা রাতেই নতুন ভাবে একটা অন্যরকম জগতে ঘুরিয়ে আনে মেঘালয়। হঠাৎ করেই মিশু বড় হয়ে যাচ্ছে এরকম অনুভব করছে। দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার ব্যাপারে যেকেউ জিজ্ঞেস করলে মিশু নিঃসন্দেহে বলবে সে অনেক সুখী মেয়ে। কিন্তু মিশু কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা। একটা শূন্যতায় ভুগছে সবসময়। এটা কিসের শূন্যতা?
আকাশ আহমেদের আচরণ, ভালোবাসা, কেয়ারনেস সবকিছুই একজন মেয়ের সত্যিকার বাবার মতন। মা ও নিজের মেয়ের মতই গ্রহণ করেছেন মিশুকে। মৌনি যতক্ষণ বাসায় থাকে সবসময়ই চেষ্টা করে মিশুকে গল্পে ব্যস্ত রাখার। স্মার্টনেসের নতুন কিছু সংজ্ঞা মৌনির কাছেই জেনে ফেলেছে মিশু। কিন্তু তবুও কিসের যেন শূন্যতা?
মিশু অনেক ভেবে যে জিনিসটা সবার আগে উপলব্ধি করলো সেটা গভীরভাবে ভাবতে গেলে চোখে জল এসে যাবে। তবুও ভাবতেই হলো মিশুকে। সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো, মেঘালয় নিজের দায়িত্ব খুব কঠোরভাবে পালন করলেও, এখনো ওদের দুজনের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা শুধুই একজন স্বামী স্ত্রী'র সম্পর্ক। যেখানে দায়িত্ববোধ আছে, বিশ্বাস আছে, সম্পর্ক আছে কিন্তু ভালোবাসার মত ভালোবাসাটা নেই। মিশু ছোটবেলা থেকেই সবসময় চেয়েছিলো কেউ ওকে পাগলের মত ভালোবাসুক। কিন্তু মেঘালয় এখনো ওকে সেভাবে ভালোবাসছে না। তাহলে কি মেঘালয়ের মাঝে এখনো ওর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়নি?
মিশু খুব গভীরভাবে ভাবছে। এই কয়েকদিন ধরেই ও বুঝতে পেরেছে এই শূন্যতা টুকু সবসময় ঘিরে রাখে ওকে। মেঘালয় দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অত্যধিক সচেতন থাকলেও মন থেকে ভালোবাসছে না। মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি কি তবে? এই একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো মিশুর। অনেক সময় এমন হয় যে, দিনের পর দিন হাসিমুখে সংসার চালিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু সবকিছুর আড়ালে ভালোবাসার একটু ফাঁক ফোঁকর থেকেই যায়। কক্সবাজারে গিয়ে অনেক কেয়ারনেস দেখালেও এখন কেবলই মনেহয় মেঘালয় নিজের দায়িত্ববোধ টুকুই মন দিয়ে পালন করে। কিন্তু ভালোবাসা? প্রত্যেকটা মনই যে ভালোবাসার কাঙাল। কেউ স্বীকার করে আর কেউ করেনা।
মেঘালয় রুমে এসে মিশুকে এভাবে মনমরা হয়ে ভাবতে দেখে বললো, 'তুমি কি কোনোকিছু নিয়ে আপসেট?'
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, 'না।'
- 'দেখে আপসেট মনেহচ্ছে। কিছু লাগবে?'
- 'হ্যা।'
- 'কি লাগবে বলো? কিছু দরকার হলে অবশ্যই আমাকে বলবা।'
মিশু চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বললো, 'ভালোবাসা।'
চমকে উঠলো মেঘালয়। চোখ নামিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকালো। নিজেরই কেমন যেন লাগছে। সত্যিই মেঘালয় এখনো মিশুকে মন থেকে ভালোবাসতে পারেনি। দিনের পর দিন একই ঘরে থাকছে, একসাথে সব কাজই করছে কিন্তু প্রিয়জনের প্রতি যেরকম আলাদা একটা টান থাকে সেটা এখনো মিশুর প্রতি হয়নি ওর। মেঘালয় নিজেই এটা স্বীকার করে। মিশুর প্রতি মন থেকে আকর্ষণ অনুভব করেনা ও। যেটা অনুভব করে সেটা শুধুমাত্র শারীরিক আকর্ষণ। এটাই কি হবার কথা ছিলো?
দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে মেঝের দিকে চেয়ে আছে। কেউই মুখে কিছু বলছে না। কিন্তু একজন ঠিকই বুঝতে পারছে আরেকজন কি ভাবছে। দৈহিক আকর্ষণ কয়েকদিন পর আর থাকবে না। দায়িত্ববোধ থেকেই হয়ত সংসার থেকে যাবে, দিনের পর দিন একসাথে থাকা হবে, রাতের পর রাত একই বিছানায় ঘুমানো হবে। কিন্তু আত্মার জন্য আত্মার ছটফটানি অনুভব করাটা যে একান্তই জরুরী। একসাথে চলতে চলতে কি সেটা হয়ে যাবে? যদি না হয় তাহলে দুজনে সুখী হবে কি করে?
কেউ কথা বলছে না। মিশু ই প্রথমে বললো, 'অনেক বিয়ের ক্ষেত্রেই তো পাত্র পাত্রীর কখনো কথাও হয়না বিয়ের আগে। শুধু একজন আরেকজনকে দেখে, বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করে একজন অচেনা মানুষকে মেনে নিতে হয়। আমাদের বিয়েটা তো সেরকম ছিলোনা। আমাদের পরিবারও চায়নি আমাদের বিয়ে হোক, আমরাও চাইনি বিয়ে করতে। হুট করেই প্রকৃতি আমাদের এক করে দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের মাঝে ভালোবাসার বন্ধনটা কতটুকু শক্ত করে দিয়েছে? জানেন আপনি?'
মেঘালয় একটু চুপ থেকে বললো, 'অনেক জটিল ধাঁধায় ফেলেছো। আমি কখনো মিথ্যে বলতে পারিনা। তাই খারাপ লাগলেও সত্যিটাই বলছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমার প্রিয়জনকে যতটা ভালোবাসার কথা ছিলো এখনো ততটা বাসতে পারিনি।'
মিশুর খুব খারাপ লাগলো কথাটা শুনতে কিন্তু মেঘালয়ের সততা দেখে ভালো লাগছে। কথাটা একদমই সত্যি। ধীরেধীরে মিশুর মাঝে এক ধরণের শুন্যতা কাজ করতে আরম্ভ করেছে। একটা সময় এটা বেড়েও যেতে পারে। বাড়তে বাড়তে যদি সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে যায়?'
মিশু একটু ভেবে বললো, 'আমিতো কাল সকালে চলেই যাবো। এরপর অনেক দিন দেখা হবেনা।'
মেঘালয় কাছে এসে মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, 'তুমি কি আমাকে অপরাধী ভাবছ? আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি তোমাকে মানিয়ে নেওয়ার।'
- 'মানিয়ে নেয়া আর ভালোবাসা একদমই আলাদা জিনিস। আমি একটা কথা ভাবছি।'
- 'কি?'
মিশু বলল, 'বিয়ে আরো পনেরো দিন পর। পনেরো দিন আমরা দূরে থাকবো কিন্তু আমরা সময় নেবো দশদিন।'
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, 'দশদিন মানে! কিসের দশদিন?'
মিশু বললো, 'এই দশদিন আমাদের যোগাযোগ থাকবে না। এরমধ্যে যদি আমাদের দুজনেরই মনেহয় আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, যদি মন থেকে ফিল করতে পারি তবেই আমি আসবো। আর যদি আমাদের মনেহয় মন থেকে ফিলিংস আসছে না, তাহলে বিয়েটা ক্যানসেল করে দিবো অর্থাৎ আমি আর এ বাড়িতে আসবো না। আমরা আলাদা হয়ে যাবো।'
মেঘালয় চমকে উঠলো। আলাদা হয়ে যাবো কথাটা শুনেই বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে চাইলো। অবাক হয়ে তাকালো মিশুর দিকে। এটা কেমন শর্ত? মিশু কি পাগল হয়ে গেলো নাকি?
মিশু বললো, 'এই কয়েকদিনে আমরা দুজন দুজনকে এতটাই কাছে পেয়েছি যে এতটুকুও দূরত্ব ছিলোনা। কিন্তু দৈহিক আকর্ষণের বাইরেও একটা টান থাকে। স্ত্রী শুধুমাত্র বিছানার সাথী নয়।'
- 'আমার কোনোকিছুতে কখনো সেটা প্রকাশ পেয়েছে?'
- 'সেরকম নয়। কিন্তু চোখের দিকে তাকালে বুকটা ধক করে ওঠা, একজন আরেকজনের আত্মাকে অনুভব করা, আত্মার জন্য আত্মার ছটফটানি, সবসময় অস্থির লাগা, এক পলক না দেখলে পাগল হয়ে যাওয়া এই জিনিসগুলোকে মিস করি আমি।'
মেঘালয় কিছু বললো না। অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলো মিশুর দিকে। মিশু কি যেন বলতে চেয়েও বললো না। মেঘালয় এগিয়ে এসে মিশুর কাঁধে হাত রাখলো। দুজনে দুদিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। কেমন যেন লাগছে। একট অশান্তি অনুভব করছে দুজনেই। সবকিছু পেয়েও কি যেন না পাওয়ার অতৃপ্তি গ্রাস করে ফেলেছে ক্রমশই।
—————
৫৩!!
হঠাৎ করেই বাবা মায়ের মৃত্যুটাকে মেনে নিতে পারছে না তন্ময়। মিশুকে যেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলো, সেদিন রাতেই বাবা মা ঢাকায় ফিরছিলেন। পথে রোড এক্সিডেন্টে দুজনের মৃত্যু। তিন/চারদিন প্রচণ্ড মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগছিলো তন্ময়। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছিলো ওর। মিশুর সাথে প্রতারণা করার ফলশ্রুতিতে বাবা মাকে হারিয়েছে সেটাই ভেবে ভেবে অনুশোচনায়নায় দগ্ধ হচ্ছে। এর জন্য মিশুর পায়ে ধরে হলেও মাফ চাইতে হবে। বাবা মা ছাড়া পুরো জগতটাই অন্ধকার হয়ে গেছে, এখন মিশুকে খুব প্রয়োজন। এই কয়েকদিন মিশুকে ভেতর থেকে অনুভব করেছে তন্ময়। অনুতপ্ত হতে হতে নিজেকে শেষ করে ফেলেছে। মিশুর সাথে দেখা করতেই হবে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিশুর নিষ্পাপ মুখটা মনে করার চেষ্টা করছে ও। মেয়েটার ছোট্ট একটা মুখ, খাড়া নাক, শীতল একটা ভাব আছে চেহারায়। অনেক মায়া মিশে আছে সেই ছোট্ট মুখে। চোখের দিকে তাকালে অন্যরকম মায়া অনুভূত হয়। সেই মেয়েটাকে কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলো ও? নিজের কাছে নিজেকেই আজ ছোট ছোট লাগছে। মিশুকে দেখার জন্য প্রচণ্ড ছটফট লাগছে ওর। মিশুর নাম্বার বন্ধ, মিশুর মায়ের নাম্বারে কল দিলে ব্যস্ত বলে। নাম্বার ব্লাকলিস্টে রাখা। মেসেজ পাঠিয়েও কোনো লাভ হচ্ছেনা। মিশুর বাবার নাম্বারে কল দিলে কেউ রিসিভ করেনা। এখন একমাত্র উপায় সরাসরি মিশুর বাসায় চলে যাওয়া। ফেসবুকে অনেক মেসেজ পাঠিয়েছে কিন্তু সিন হচ্ছেনা। অনেক দিন যাবত মিশু অনলাইনে আসেনা। মেয়েটা ঠিক আছে তো? ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তন্ময়ের। নিজের প্রতারণার জন্য নিজেকেই মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে ওর। মনেমনে ভেবে রাখলো যেভাবেই পারে আগামীকাল মিশুর বাসায় গিয়ে হাজির হবে ও। সকালের বাসেই রওনা দেবে। মিশুর সাথে দেখা করতেই হবে। মেয়েটা যেন ঠিক থাকে সেটাই মনেমনে প্রার্থনা করতে লাগলো।
৫৪!!
বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে মিশু ও মেঘালয়। মাঝখানে একহাত দূরত্ব। দুজনে দুদিকে কাৎ হয়ে শুয়ে আছে। বিয়ের পর থেকে প্রত্যেকটা রাত এই সময়ে মেঘালয়ের স্পর্শে পাগল হয়ে যেতো মিশু। একটা সময় মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তো। আর আজ দুজনে দুদিকে! কোনো ঝগড়া হয়নি, তর্ক হয়নি অথচ কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলতে পারছে না। দুজনেরই নিজেকে ছোট ছোট লাগছে।
মেঘালয় কখনো মুখে না বললেও মনেমনে চাইতো ওর জীবনসঙ্গিনী ওর সমান সমান হবে। মিশুর বয়সও নিন্তান্তই কম। মনেপ্রাণে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও কেন যেন ভালোবাসাটা ঠিকমত হয়ে উঠছে না। মন থেকে ভালোবাসতে পারছে না ওকে। দশদিন পর কি আদৌ সম্ভব হুট করে ভালোবাসা হয়ে যাওয়া? না হলেও মিশুকে গ্রহণ করতে হবে। নয়তো অন্যায় করা হবে ওর সাথে। আবার গ্রহণ না করলেও অন্যায় হয়ে যাবে। দুটো ব্যাপার ভেবেই মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মেঘালয়ের। ভালোবাসা আকস্মিক ভাবে জন্ম নেয়। ইচ্ছেকৃত ভাবে কাউকে ভালোবাসা যায়? সেটা তো অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মত। উলটা পালটা অনেক কিছু ভেবে মেঘালয় নির্ঘুম রাত পার করছে।
মিশু নিরবে চোখের জল ফেলছে। শীত লাগছে খুব। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠাণ্ডাও বাড়ছে। কিন্তু উঠে কম্বল টেনে নেয়ার কোনো ইচ্ছেই করছে না ওর। ঠাণ্ডায় রীতিমত কাঁপতে লাগলো। অজান্তেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো, 'এত শীত লাগছে কেন!'
মেঘালয় চমকে উঠে পাশ ফিরলো। মিশু অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। মেঘালয় নিজেই কম্বল টেনে নিয়ে মিশুর গায়ের উপর দিয়ে দিলো। নিজেও ঢুকে পড়লো কম্বলের ভেতর। মাঝখানে এখনও এক হাত দূরত্ব। দুজনে কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। অনেক রাত অব্দি শুধু একে অপরকে অনুভব করেই গেছে সেটা কেউই জানেনা। নানান আজগুবি চিন্তা ভাবনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো একসময়।
সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর মিশু উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে বুঝতে পারলো মেঘালয়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে। একহাতে জাপটে ধরে আছে মেঘালয়কে আর সে নিজেও দুহাতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেছে মিশুকে। দুজনে তো মাঝখানে একহাত দূরত্ব রেখে ঘুমিয়েছিলো তাহলে এভাবে জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়লো কখন? নাকি মেঘালয় টেনে নিয়েছে কাছে? প্রশ্নটা মাথায় রেখেই ওঠার চেষ্টা করলো মিশু। মেঘালয় ওর বাহুতে টেনে ধরে বললো, 'উহু নড়াচড়া করছো কেন? কতবার বলেছি আমাকে বিছানায় একা ফেলে উঠবা না?'
মিশু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মেঘালয়ের ঘুম জড়ানো মুখটার দিকে। দেখলেই বুকটা ধুকধুক করে ওঠে। এটাকে কি মায়া বলে? কোনো এক অচেনা মায়ায় জড়িয়ে আছে দুজনে। এই মায়া থেকেই কি ভালোবাসা হয়? আজকে কেন যেন মেঘালয়কে ছেড়ে যেতে একদমই ইচ্ছে করছে না। বাসায় যাওয়ার কথা ভাবতেই বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মিশু মনেমনে ভাবলো, 'আমি যে মেঘালয়কে ভালোবাসতে শুরু করেছি সেটা কি ও বুঝতে পারছে?'
চোখ মেলে তাকালো মেঘালয়। মিশুকে অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, 'উঠবে না?'
- 'না ছাড়লে উঠবো কিভাবে?'
- 'যদি না ছাড়ি?'
- 'রংপুর যাবো না।'
হেসে ফেললো মেঘালয়। মিশুকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বললো, 'ঘুম থেকে ওঠার পর আমার বউটাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে।'
- 'চোখে সরষে ফুল ফুঠেছে বোধহয়। আমাদের জুটিটাকে একদমই মানায় না।'
- 'হুম মানায় ই না তো। চলে যাও, ছেড়ে দিলাম।'
মিশু বিছানার উপর বসতে বসতে বললো, 'আমি গাইয়া ক্ষ্যাত।'
- 'গাইয়া মেয়েদের একটা ন্যাচারাল লুক থাকে।'
- 'আমি হাইটে শর্ট।'
- 'খাটো মেয়েদের জড়িয়ে ধরতে আরাম লাগে। খাটো মেয়েদের মাথাটা বুকে এসে ঠেকে।'
- 'শুনেছি অয়ন্তিকা অনেক লম্বা।'
- 'ফেরাউনের মত লাগে।'
- 'একটা লম্বা মেয়ে দরকার।'
- 'লম্বা মেয়েরা তাড়াতাড়ি কুঁজো হয়ে যায়।'
- 'একটা ধবধবে ফর্সা মেয়ে দরকার।'
- 'সাদা তো ব্রয়লার মুরগিও হয়।'
মিশু মুখ টিপে হেসে পিছনে ফিরে মেঘালয়ের দিকে তাকালো। মেঘালয় শুয়ে আছে আর ও বসে আছে। মেঘালয়ের ঠোঁটের কোণেও বাকা হাসির আভাস।
দুজনেই হাসছে মুখ টিপে। মিশু বললো, 'আমি এখনো বয়সে বাচ্চা।'
- 'বাচ্চাদের খুব কিউট লাগে। কোলে বসিয়ে আদর করা যায়।'
মিশু আবারো হাসলো মুখ টিপে। বললো, 'আমি কেবল ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিলাম। একটা গ্রাজুয়েট মেয়ে দরকার।'
- 'গ্রাজুয়েট মেয়েরা অত্যধিক ম্যাচিউর হয়। পিচ্চি বউয়ের পাগলামি গুলা ভালোলাগে।'
মিশু নিচু হয়ে এসে মেঘালয়ের শার্টের কলার ধরতে গিয়ে দেখলো শার্ট ই নেই গায়ে। খালি গায়ে শুয়েছে। মিশু চোখে চোখ রেখে বললো, 'আমিই আপনার জন্য পারফেক্ট। হয়েছে?'
মেঘালয় হেসে বললো, 'আমি সেকেন্ড হ্যান্ড মেয়ে নিবো না। আমার জন্য এমন মেয়ে লাগবে যে কখনো কারো প্রেমে পড়েনি।'
মিশু রেগে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই মেঘালয় বাহু চেপে ধরে কোলের উপর টেনে নিয়ে বললো, 'দুষ্টুমি করলাম তো।'
- 'ছাড়ুন আমাকে। আমি চলে যাবো।'
- 'যদি যেতে না দিই?'
- 'আমি তো সেকেন্ড হ্যান্ড।'
- 'সেকি! কুমারীত্ব তো আমিই হরণ করেছি। তাহলে?'
লজ্জায় মেঘালয়ের বুকে মুখ গুঁজে দিলো মিশু। মেঘালয় দুহাতে জাপটে ধরে বললো, 'পাগলী। একটা রাত দুজন দুজনের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে কি বুঝলে? অজান্তেই যে একজন আরেকজনের প্রতি কতটা দূর্বল হয়ে পড়েছি সেটা কি বোঝো?'
মিশু লাজুক স্বরে বললো, 'আপনি একটা খুব খারাপ।'
- 'এই খারাপ টাকে ছেড়ে থাকতে পারবা?'
- 'পারবো।'
মেঘালয় হেসে বললো, 'যত বড় মুখ নয় ততবড় কথা। তবে কালকে তোমার কথাগুলো ভালো ছিলো।'
- 'অপ্রিয় সত্য কথাই বলেছি। আমাকে পাগলের মত ভালো না বাসলে আমি থাকবো না।'
- 'পাগল হলে ভালোবাসবো কিভাবে? ভালোবাসার জন্য তো আমাকে সুস্থ থাকতে হবে। হা হা হা।'
- 'আপনি সিরিয়াসলি একটা খুব খারাপ।'
মেঘালয় শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসি থামার পর বললো, 'দশদিন যোগাযোগ থাকবে না কিন্তু। ফোন দিলে খবর আছে বলে দিলাম।'
- 'ঠিকাছে। পনেরো দিন পর সব উসুল করে নিবো।'
এরপর কিছুক্ষণ দুজনেই শান্ত হয়ে রইলো। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অনুভব করছে শুধু। কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মিশু বললো, 'যদি এর মাঝে খুব করে আত্মার জন্য আত্মা ছটফট করে?'
- 'বুঝতে পারবে।'
- 'যদি দেখার জন্য অস্থির লাগে?'
- 'ফ্লাইটে রংপুর যেতে মাত্র ঊনষাট মিনিট লাগে।'
মিশু চুপ করে গেলো। কে বলেছে মেঘালয় ভালোবাসে না? একটা রাত কথা বন্ধ রাখতেই একে অপরকে খুব করে অনুভব করছে। মেঘালয়কে ছাড়া মিশুরও যে চলবে না। একটা মুহুর্তও চলবে না।
৫৫!!
বাসার সবার কাছে থেকে বিদায় বেড়িয়ে পড়লো বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। মেঘালয় এয়ারপোর্টে এসেছে ওদের সাথে। বাবার পাশে বসে দুজনেই শান্ত হয়ে বসে ছিলো। কিন্তু বুকের ভেতরটা ঠিকই ফাটছিলো। দুজনই দুজনকে অনুভব করছে। মেঘালয়ের কষ্ট হচ্ছে মিশুকে ছাড়তে আর মিশুরও কষ্ট হচ্ছে মেঘালয়কে রেখে যেতে। বারবার শুধু চোখাচোখি হচ্ছিলো। শেষ চোখাচোখির সময়ে মেঘালয়ের চোখে অন্যরকম মায়া খুঁজে পেয়েছিলো মিশু।
খুব উৎফুল্ল মনে বাসায় ফিরলো মিশু। সন্ধায় কলিং বেল বেজে উঠলে দরজা খুলে বড় ধরণের ধাক্কা খেয়ে গেলো। তন্ময় কেন এসেছে! আবার কোন বিপদ ঘটাতে এসেছে সে?