হৃদমোহিনী - পর্ব ১৭ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


তন্ময়কে দেখেই ভয়ে কেঁপে উঠলো মিশু। শরীরটা কাঁপতে লাগলো রীতিমত। একদিকে পাগলের মত ভালোবাসা, প্রতারণা, সেই রাতের ভয়াবহ ঘটনা সবকিছু ভেবে শিউরে উঠলো ও। এই কাপুরুষ টাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে একইসাথে অনেক ধরণের অনুভূতি কাজ করছে। ডুকরে কান্না আসছে, আবার ঘৃণায় ওর গালে থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মিশু জানে ওটা করতে পারবে না ও। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে ওর। তন্ময় হঠাৎ একটু এগিয়ে এসে মিশুর মুখটা একহাতে ধরতেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল মিশু। 

তন্ময় ওকে ধরে জোরে মিশুর মাকে উদ্দেশ্য করে আন্টি আন্টি বলে ডাকতে শুরু করে দিলো। মা ছুটে এসে মেয়েকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আঁৎকে উঠলেন। উনি এসে মিশুকে ধরার চেষ্টা করার আগেই তন্ময় ওকে কোলে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলো।

আন্টি পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে বললেন, 'কে তুমি? তোমাকে দেখে ও সেন্সলেস হয়ে গেলো কেন?'
তন্ময় মিশুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললো, 'আন্টি আমি তন্ময়।'

মা নিজেও শিউড়ে উঠলেন নাম শুনে। এই মুহুর্তে বাসায় ওনার স্বামীও নেই। এই ছেলেটার জন্য একটার পর একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। মান সম্মান ধূলায় মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। সমস্ত ঘটনার উৎস এই তন্ময় থেকেই। আর সে এখন সামনে দাঁড়িয়ে আবার মিশুকে ছুঁয়েও দেখেছে? খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। 

আন্টি রাগ সামলে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে মিশুর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। তন্ময় বললো, 'একটু পানি আনুন আন্টি। ওর কিছু হয়নি।'

তন্ময় পাশেই টেবিলের উপর রাখা গ্লাস থেকে কিছু পানি ছিটিয়ে দিলো মিশুর মুখে। আন্টি মিশুর হাতের তলা ও পায়ের তলা মালিশ করছেন। মিতু এসে তন্ময়কে দেখেই আঁৎকে উঠলো। তন্ময়ের ছবি দেখেছিলো ও। মিতুও প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে। তন্ময় মিশুর পাশে বসে বারবার ডাকতে লাগলো, 'মিশু...'

খানিক বাদেই চোখ মেললো মিশু। কিন্তু চোখ মেলে সামনে তন্ময়ের মুখ দেখে ভয়েই আড়ষ্ট হয়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো সেই ভয়াবহ রাতের কথা। একটা ভয়ংকর মুখ সামনে এগিয়ে আসছিলো, তার হিংস্র থাবা গ্রাস করে ফেলতে চাইছিলো মিশুর কোমল দেহটা। মিশু শিউড়ে উঠে চিৎকার করে উঠলো।

তারপর পরই পাশে রাখা বালিশটা নিয়ে নিজের মুখে চাপা দিয়ে বললো, 'ওকে চলে যেতে বলো। সামনে থাকলে বটি দিয়ে ওর মাথাটা কেটে ফেলবো আমি। চলে যেতে বলো ওকে।'

তন্ময় বললো, 'মেরে ফেলো আমাকে তবুও প্লিজ চলে যেতে বলোনা। আমি তোমার কাছে মাফ চাইতে এসেছি।'

তন্ময়ের গলাটা যেন বিষের মত বিঁধছে। মিশু দুহাতে কান চেপে ধরে বললো, 'ওকে চলে যেতে বলো কেউ। প্লিজ বলো। আমি ওর মুখ দেখতে চাইনা, ওর গলাও শুনতে চাইনা। আমার শরীর খারাপ লাগছে। প্লিজ ওকে চলে যেতে বলো।'

কেঁদে ফেললো মিশু। মিশুর মা তন্ময়ের হাত ধরে টেনে এনে দরজায় দাড় করিয়ে বললো, 'মিশুর যে অবস্থা তুমি করেছিলে তার জন্য ও কোনোদিনো তোমাকে ক্ষমা করবে না। আমিও করবো না। কেমন মা তোমাকে পেটে ধারণ করেছিলেন আমি জানিনা তবে সে খুব দুর্ভাগা তোমার মত সন্তান জন্ম দিয়ে।'

তন্ময় মেঝের দিকে তাকিয়ে বললো, 'জানি। আমার মাও আমাকে হয়ত ক্ষমা করবে না। অভিমান করে চলে গেছে। সেজন্যই মিশুর কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আন্টি মিশু যেদিন চলে আসে সেদিন রাতেই আমার বাবা মা এক্সিডেন্টে মারা যায়।'

মা অনেক্ষণ কিছু বলতে পারলেন না। নিশ্চুপ হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, 'তোমার অনেক কঠিন শাস্তি হয়ে গেছে। এবার চলে যাও। আর হ্যা, মিশুর বিয়ে দিয়েছি। বিয়ের প্রোগ্রাম আর পনেরো দিন পর। তুমি আর কোনো ঝামেলা কোরোনা। আল্লাহর কাছে মাফ চাও নিজের ভূলের জন্য।'

তন্ময় অবাক হয়ে বললো, 'বিয়ে মানে!' 

আন্টি আর কিছুই বলার সুযোগ দিলেন না। তন্ময়কে হাত ধরে বাইরে বের করে দিয়ে বললেন, 'আমার মেয়েটা এখন সুস্থ আছে বাবা। ওর মাথা খারাপ হলে খুনোখুনি হয়ে যাবে। তারচেয়ে তুমি চলে যাও।'
- 'আন্টি ওকে বলুন না আমাকে খুন করতে। তাহলে শান্তি নিয়ে মরতে পারবো।'
- 'আমার মেয়ে তোমার মত খুনী নয়।'

কথাটা বলেই আন্টি তন্ময়ের সামনে থেকে চলে গেলেন। মিতুকে বলে দিলেন দরজা লাগিয়ে দেয়ার জন্য। তন্ময় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেললো। খুনী শব্দটা যেন বাবা মায়ের মৃত্যুটাকেই ইংগিত করে বলা। কথাটা শুনে আর কান্না ধরে রাখতে পারলো না ও। মাকে বড্ড মনে পড়ছে। আর মায়ের আত্মাও দূর থেকে দেখবে আর কাঁদবে ছেলেকে মানুষ করতে পারেনি ভেবে। মা কি ক্ষমা করবে? মায়ের থেকে ক্ষমা চাইতে হলে আগে মিশুর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। মিশু ক্ষমা না করলে কেউ করবে না। মায়ের আত্মাও শান্তি পাবেনা। 

অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে তন্ময়। মিতু এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। মিতুকে জিজ্ঞেস করলো সত্যিই মিশুর বিয়ে হয়েছে কিনা? কিন্তু মিতু কোনো জবাব দিলোনা। এখন কিভাবে মিশুর সাথে একবার কথা বলা যায়? বিয়ের ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছেনা ওর। মিশুর বাবা মাকে ও যতটা চেনে, ওনারা এত তাড়াতাড়ি মেয়ে বিয়ে দেবেন না। আর মাত্র এই কয়েকদিনে বিয়ে হওয়ার ও কথা নয়। 

বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো তন্ময়।

৫৬!! 

ডুকরে কান্না করেই চলেছে মিশু। মায়ের মুখে শুনেছে তন্ময়ের বাবা মা মারা গেছে। খারাপ লাগছে ওর। কিন্তু এই সময়ে এসেই নিজের ভূলটা বুঝতে পারলো ও? ওর আগে কোনো ছেলের সাথে কথাও বলেনি মিশু। সেই মানুষ টাকেই ভালোবাসতে চেয়েছিলো পাগলের মত। এখন মেঘালয়কে ছাড়তেও পারবে না, তন্ময় নতুন করে এসে মাথাটা এলোমেলো করে দিতে শুরু করে দিলো। তন্ময়কে এই কয়েকদিনে চরম ঘৃণা করেছে মিশু। কিন্তু ওর অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া চেহারাটা দেখে আর রেগে থাকতে পারছে না। মনেমনে ভাবছে, যদি আবারো তন্ময়ের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায়? তাহলে মেঘালয়ের কি হবে? মেঘালয়কেও ভালোবাসতে আরম্ভ করেছে ও। এদিকে তন্ময় এসে এ কোন দোটানায় ফেলে দিলো ওকে? জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে এখন।
পাগলের মত কাঁদতে লাগলো মিশু। মেঘালয় ফোন করলে মিতু রিসিভ করে সবকিছু বলে দিলো। 

সবটা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো মেঘালয়ের। তন্ময় নিজের ভূল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছে? তারমানে মিশু এখন ওর হয়ে যাবে। মেঘালয় আপন মনেই বললো, 'যেহেতু আমাদের মধ্যে এখনও ভালোবাসা হয়নি, কাজেই তন্ময় একবার মাফ চাইলেই মিশু সবকিছু ভূলে গিয়ে ওকেই আপন করে নেবে। কারণ তন্ময় ওকে অনেক ভালোবাসা দেখিয়েছিলো। অবশ্যই আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসা দেখিয়েছে। তাহলে মিশু যদি তন্ময়ের সাথে চলে যায়? আমি মানতে পারছি না এটা।'

বুকটা চিনচিন করছে মেঘালয়ের। একটা অজানা ব্যথা এসে ভর করেছে বুকে। অথচ এর আগে কক্ষনো এমন হয়নি। শুধু একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে, 'আমি তো মিশুকে বলেছি আমি এখনো তোমাকে প্রিয়জনের মত ভালোবাসতে পারিনি। তারমানে তন্ময় একবার ভালোবাসি বললেই মিশু ওর হয়ে যাবে। মিশু তো বলেছে দশদিন পর যদি ভালোবাসা না হয় তাহলে আর কখনো আসবে না। এখন যদি তন্ময় ওকে কেড়ে নিয়ে যায়? এটা কিছুতেই হতে পারেনা।'

বুকের চিনচিনিনি টা বাড়ছে। একটা সেকেন্ডও স্থির হয়ে থাকতে পারছে না মেঘালয়। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে মিশুর কাছে। কিন্তু এত দূরত্বের পথ এখনি যাওয়াও অসম্ভব। ফ্লাইট এত রাতে আছে কিনা কে জানে আর টিকেট ও পাওয়া যাবেনা। তাহলে? কিন্তু একটা কথা মেঘালয় কিছুতেই বুঝতে পারছে না, মিশুকে যদি ভালো নাই বাসবে তবে এরকম ছটফট লাগছে কেন? অন্য একজন পুরুষের আগমন সত্যিই যন্ত্রণা ধরিয়ে দিয়েছে। আর সাথে হারানোর ভয়টাও পেয়ে বসেছে। ভালোই বাসেনা তাহলে হারানোর ভয় কেন? উফফ মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসি কিংবা নাই বাসি, মিশু আর কারো হতে পারেনা। 

আপন মনেই বলতে বলতে দেয়ালে মাথাটা বাড়ি দিলো মেঘালয়। এমন সময় মৌনি ওকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে বললো, 'ভাইয়া তুই এমন করছিস কেন? মাথাটা দেয়ালে আঘাত করছিস কেন? কি হয়েছে তোর?'
- 'মিশুকে আর কেউ ভালোবাসবে না। শুধু আমি বাসবো। মিশু শুধু আমার। ওকে অন্যকেউ ছুঁলে আমি তাকে খুন করে ফেলবো।'
- 'এসব বলছিস কেন?'
- 'ওকে শুধু আমি কোলে নেবো। অন্যকেউ কেন নেবে? আমি ওই কুত্তার বাচ্চাকে মেরে ফেলবো। আমার মিশুকে কোলে নেয়ার সাহস ওকে কে দিলো? মিশুর শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপও আমার।'

মৌনি হা হয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কি হলো মেঘালয়ের? এমন করছে কেন? কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কে কোলে নিলো আবার?'

মেঘালয় রেগে বললো, 'চুপ। ওকে কেউ ছোঁবে না। আমি সহ্য করতে পারবো না। মৌনি আমি এক্ষুনি ওর কাছে যেতে চাই। প্লিজ কি করবো বল?'
- 'মিশুর কাছে?'

মেঘালয় সবকিছু খুলে বললো মৌনিকে। সবটা শুনে মৌনি বলল, 'তুই এখনই ড্রাইভারকে নিয়ে বেড়িয়ে পড় ভাইয়া। বাসে গেলে সকাল হয়ে যাবে। গাড়িতে গেলে আশাকরি শেষরাতে পৌঁছাতে পারবি।'
- 'ওকে। ভাইয়ার জন্য দোয়া করবি।'

মৌনি মেঘালয়ের চুলগুলো একহাতে ঠিক করে দিয়ে বললো, 'এত ভালোবেসে ফেলেছিস?'

মেঘালয় নিজেও অবাক হয়ে গেলো একটু আগে করা পাগলামি গুলোর কথা ভেবে। মুচকি হেসে বললো, 'জানিনা রে। তবে এটুকু বুঝতে পারছি, মিশু পাগলীটা আমার হৃদমোহিনী। আমার কলিজাটা। পিচ্চিটাকে আর কেউ কোলে নিলে আমি প্রলয় ঘটিয়ে ছাড়বো।'

মৌনি হেসে বললো, 'পাগল ভাই আমার। সাবধানে থাকবি কেমন?'

অবশেষে দ্রুত বেড়িয়ে পড়লো মেঘালয়। সম্পর্কের মাঝে কাটা ঢুকে পড়েছে। ব্যথা হওয়ার আগেই কাটা উপড়ে ফেলে দিতে হবে। মিশুকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা, বারবার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। সকালেই তো চলে গেলো অথচ রাত হতে না হতেই বুকটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পৌঁছাতে হবে ওর কাছে। 

—————

৫৭!! 

জানালায় ঠকঠক শব্দ শুনে মিশু জানালা থেকে পর্দা সরাতেই দেখতে পেলো তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজ বিগড়ে গেলো মিশুর। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, 'চলে যাও এখান থেকে। দয়া করে আর কক্ষনো এসোনা।'

তন্ময় হাত জোর করে অনুরোধ করলো একটু কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য। মিশু কিছুতেই ওর কথা শুনতে চাইলো না। জানালায় পর্দা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো। মিনিট দশেক পর কৌতুহল বশত পর্দাটা সরাতেই কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখতে পেলো তন্ময় এখনো দাঁড়িয়ে আছে। বুকটা ব্যথা করছে মিশুর। তন্ময়কে কিছু কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া দরকার। কথাগুলো না বললে সে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। আর কিছু কথা তন্ময়কে বলাটাও উচিৎ।

অনেক কিছু ভেবে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো ও। জানালা খুলে তন্ময়ের দিকে তাকালো। মিশুকে জানালা খুলতে দেখে তন্ময় চমকে উঠলো। পিছন ফিরতেই মিশু ওকে বললো, 'তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। কিন্তু আমি বাইরে গেলে আর কেউ দেখে ফেললে বাজে ব্যাপার হয়ে যাবে। গ্রামের লোকজন অনেক খারাপ ভাববে। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি, ভেতরে এসে সোজা ছাদে চলে যাবা। আমি আসছি।'
- 'আচ্ছা মিশু।'
- 'বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করবে না একদম। কথা বলা শেষ হলে চলে যাবে।'
- 'আচ্ছা ঠিকাছে।'

মিশু মেইন দরজা খুলে তন্ময়কে ভেতরে আসতে বললো। তন্ময় ভেতরে প্রবেশ করে সোজা ছাদে চলে গেলো। মিশু গায়ে একটা চাঁদর জড়িয়ে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে ছাদে উঠে এলো। তন্ময় মিশুকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারলো না। দ্রুত রীতিমত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো মিশুকে। হতবাক হয়ে গেলো মিশু। এটা ও কিছুতেই আশা করেনি। তন্ময়ের বুকের সাথে মাথাটা ঠেকতেই অস্থির লাগতে শুরু করলো। এরকম করলে তো দূর্বল হয়ে পড়বে ও। তারচেয়ে যে কথাগুলো বলতে এসেছে সেগুলো বলা উচিৎ।

মিশু নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই তন্ময় আরো জোরে বুকে চেপে ধরলো। মিশুর পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে। যন্ত্রণার আগুনে দগ্ধ হতে হতে আর বোধহয় কিছুই অবশিষ্ট নেই। তন্ময়কে এখনি চলে যেতে বলতে হবে। তন্ময় মিশুকে বুক থেকে সরিয়ে দাড় করিয়ে দুহাতে ওর মুখটা ধরে ফেললো। মিশু সমানে চেষ্টা করলো তন্ময়ের হাত সরানোর কিন্তু পারছে না। গলা দিয়ে শব্দও বের হচ্ছেনা। চোখ বন্ধ করে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলো। তন্ময় মিশুর চোখ মুছে দিয়ে বললো, 'কাঁদবে না তুমি আর।'

মিশু অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে শক্ত করার কিন্তু পারছে না। ক্রমাগত দূর্বল হয়ে পড়ছে। মনেমনে ভাবলো, এটা অন্যায় হচ্ছে। আমি মেঘালয়কে ঠকাতে পারবো না। আমাকে শক্ত হতেই হবে। অনেক কষ্টে বললো, 'একটু ছাড়ো তো। আমি এখুনি আসছি।'

তন্ময় মিশুকে ছেড়ে দেয়ার পর এক দৌড়ে মিশু নিচে চলে গেলো। বাথরুমে গিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে মনেমনে মেঘালয়ের কথা মনে করার চেষ্টা করলো। মেঘালয় মিশুকে শিখিয়েছে কিভাবে আত্মসম্মান বজায় রাখতে হয়। দূর্বলতাকে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। জোরে জোরে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিলো। তারপর ছোটবোন মিতুকে ডেকে বললো ছাদের দরজার কাছে থাকতে যাতে তন্ময় উলটা পালটা কিছু করার চেষ্টা করলে মিতু এগিয়ে আসতে পারে। মিতুকে পাঠিয়ে দিয়ে মিশু চলে গেলো রান্নাঘরে। ওর চেহারায় যেন আগুন ঝরছে। বটিটা হাতে নিয়ে অগ্নিমুর্তি ধারণ করে ছাদে চলে এলো। 

বটি হাতে মিশুকে দেখে তন্ময় অবাক হয়ে বললো, 'একি! এটা কেন?'
- 'আর একবার আমাকে টাচ করলে খুনোখুনি হয়ে যাবে। এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম যেদিন তোমার মুখোমুখি হতে পারবো। কয়েকটা কথা তোমাকে বলা দরকার।'

তন্ময় বিস্ময়ে কিছুই বলতে পারলো না। কয়েকদিন আগে যে মিশুর সাথে দেখা হয়েছে, একটু আগে যে মিশুকে জড়িয়ে ধরেছে, সেই মিশুর সাথে এই মিশুর আকাশ পাতাল পার্থক্য। এই অগ্নিমুর্তি ধারণ করা কিভাবে সম্ভব! তাও আবার বটি হাতে! অদ্ভুত লাগছে।গলার স্বরেও দৃঢ়তা যেন হঠাৎ করেই মিশুর বয়স অনেক বেড়ে গেছে।  এটা সত্যিই মিশু তো? 

মিশু বললো, 'আমাকে যে অপমান তুমি করেছো তার ক্ষমা হয়, কিন্তু তোমার জন্য আমার সম্মান যেভাবে নষ্ট হতে যাচ্ছিলো আর আমি যে পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছি তার জন্য তোমার ক্ষমা হয়না।'

তন্ময় অবাক হয়ে বললো, 'কি হয়েছে বলোতো? তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছি বলে আমি অনুতপ্ত। কিন্তু তার জন্য এভাবে কেন বলছো? আমি তোমাকে অপমান করেছি মানছি কিন্তু তোমার সম্মান কেন নষ্ট হবে?'

মিশু রেগে বললো, 'জানো না? অন্তত আমার সাথে এরকম ন্যাকামি কোরোনা।'
- 'মিশু প্লিজ বলো কি হয়েছে? আন্টিও বললো তোমার আর তাদের সম্মানের কথা। এলাকার লোকরা কি জানে তুমি আমার কাছে গিয়েছিলে? ঠিক কি হয়েছিলো?'
- 'এলাকায় তো রীতিমত প্রলয় ঘটে গেছে। আর আমার জীবনে? তোলপাড়।'
- 'মানে! খুলে বলবে প্লিজ?'
- 'তুমি কি সত্যিই কিছু জানোনা? তুমি সেদিন আমাকে রাস্তায় ফেলে যাওয়ার পর আমার সাথে কি কি ঘটে গেছে জানোনা তুমি?'

তন্ময় অবাক হয়ে বললো, 'না তো। সেটাই তো জানতে চাইছি। বলবে প্লিজ? আমিতো তোমাকে রেখে সোজা আমার এক বন্ধুর বাসায় চলে যাই। পরেরদিন ফোন আসে আব্বু আম্মু হসপিটালে। আর তারপর বাসায় যাই ওদের লাশ নিয়ে। এই কয়েকটা দিন আমি অনুতপ্ত হতে হতে শেষ হয়ে গেছি মিশু।'

মিশুর এবার অবাক হওয়ার পালা। একটু থমকে গিয়ে বললো, 'তারমানে তুমি জানোনা?'
তন্ময় একটু এগিয়ে এসে বললো, 'জানিনা। বলো কি হয়েছে?'

মিশু একহাতে নিজের কপালে হাত রেখে একটা ঢোক গিললো। তন্ময়ের তেমন দোষ দেয়া যায়না। জীবন এ কেমন খেলা খেললো ওর সাথে? মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে এতকিছু ঘটে গেলো! মেঘালয় জীবনে না আসলে আজকে তন্ময় নতুন করে বাঁচতে শিখতো। কিন্তু যে মেঘালয় মিশুকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে তাকে ছেড়ে আসা কিছুতেই সম্ভব না। সেটা করতে মিশুর বিবেকে বাঁধবে। কোথ থেকে কি যে হয়ে গেলো।
তন্ময় উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে মিশুর দিকে। জানতে চাইলো কি ঘটেছে মিশুর সাথে। 

মিশু বলতে আরম্ভ করলো, 'তুমি আমাকে ফেলে চলে যাওয়ার পর আমি হঠাৎ বড় ধরণের ধাক্কা খেয়ে যাই। বারবার ফোন দিচ্ছিলাম কিন্তু বন্ধ পাচ্ছিলাম। অনেক স্বপ্ন নিয়ে তোমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সব স্বপ্ন এভাবে তুচ্ছ হয়ে যাবে ভাবিনি। তুমি আমাকে ঠকাবে সেটা বিশ্বাস করা শক্ত ছিলো আমার জন্য। আমি অসংখ্যবার ফোন দিই কিন্তু ব্লাকলিস্টে রেখে দিয়েছিলে। কখনো ব্লাকলিস্ট, কখনো বন্ধ। আমার মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। বাধ্য হয়েই তোমার বাসার এড্রেস অনুযায়ী চলে যাই। তুমি জানোনা এসব?'

তন্ময় অবাক হয়ে শুনছিলো। এবার বললো, 'আমি সত্যি জানিনা তুমি আমার বাসায় গিয়েছিলে। আমি তোমার নাম্বার ব্লাকলিস্টে রেখে আমার ফ্রেন্ডের বাসায় চলে যাই। আমি ভেবেছিলাম তুমি বাসায় চলে এসেছো।'

মিশু বললো, 'আমি বাসায় আসিনি। এক পা তোলার মত শক্তি আমার ছিলোনা। যে মেয়েটা কেবলমাত্র তোমার ভরসাতেই এতদূর থেকে ঢাকায় গিয়েছে তাকে ফেলে তুমি চলে গেলে। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছিলো। কথা বলার শক্তিটাও পাচ্ছিলাম না। শুধু বারবার ফোন দিচ্ছিলাম তোমার নাম্বারে। তোমাকে না পেয়ে তোমার বাসায় চলে যাই। তারপর..'

মিশু থেমে গেলো। তন্ময় কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর কি হলো? 

মিশু আবারো বলতে শুরু করলো, 'আমি দারোয়ানকে তোমার কথা বলার পর উনি তোমাকে ডাকতে চলে গেলো। এরপর একটা ছেলে এসে বললো, 'তন্ময় রুমে আছে। আসেন আমার সাথে। ছেলেটার নাম ছিলো সম্ভবত সেলিম। তোমার ফ্রেন্ড।'

তন্ময় চেঁচিয়ে উঠে বললো, 'সেলিম! ও আমার ফ্রেন্ড না। ও তো আমার এক বড় ভাইয়ের ফ্রেন্ড। আমাদের ফ্ল্যাটের বড় ভাইয়ের কাছে আসতো মাঝেমাঝে। ড্রিংকস করতে আর মাঝেমাঝে মেয়ে নিয়ে আসতো। ও তোমাকে রুমে ডেকে নিয়ে গেছে আমার কথা বলে? ও মাই গড, আমি আবার সেদিন বড় ভাইকে কল দিয়ে বলেছিলাম তোমাকে রংপুর পাঠিয়ে দিয়েছি। ব্রেকাপ করছি আর আমি ফ্রেন্ডের বাসায় যাচ্ছি। এইজন্যই ওরা সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে। তারপর কি হলো?'

মিশু কিছুক্ষণ তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে রইলো নিশ্চুপ হয়ে। ব্যাপারটা এরকম সেটা মিশুও জানতো না। আজ সব পরিষ্কার হয়ে গেলো। ডুকরে কান্না করতে ইচ্ছে করছে ওর। তন্ময় এগিয়ে এসে জানতে চাইলো, 'তারপর কি হলো? ওরা তোমার সাথে বাজে আচরণ করেনি তো? ওরা তো ড্রাগস নেয়। তোমাকে খারাপ কিছু বলেছে?'

মিশুর গলা বন্ধ হয়ে গেছে। সে রাতের ভয়ংকর কথাগুলো মনে করতে গেলে পাগল হয়ে যাবে ও। চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো টপটপ করে। তন্ময় বারবার জানতে চাইলো ওরা খারাপ কিছু বলেছে কিনা? 

মিশু বললো, 'শুধু কি বলা? সেলিম নামের ছেলেটাকে কে যেন নাম ধরে ডাকছিলো তখন ওর নামটা শুনতে পাই। আমি ভাবছিলাম এ নামে তোমার তো কোনো ফ্রেন্ড নেই। সেই মুহুর্তে ও বলল তুমি ছাদে আছো সে গিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিবে। এরপর রুমে এক বিশালদেহী ভয়ংকর লোককে ঢুকিয়ে দেয়। লোকটার হিংস্র থাবা আমার শরীরটাকে  ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করতে চাইছিলো। ধর্ষণের পর কেন কোনো মেয়ে মারা যায় সেদিনই বুঝতে পেরেছি। ওই লোকটা আমার উপর হিংস্র পশুর মত আক্রমণ করেছিলো........'

আর বলতে পারলো না, ডুকরে কেঁদে উঠলো মিশু। তন্ময় ধপ করে বসে পড়লো। মিশুর সাথে এরকম বাজে কিছু ঘটবে এটা ও ভাবতেও পারেনি। মিশু যে ওর বাসায় চলে যাবে এটাও কল্পনা করেনি। ওই ছেলেগুলোর জন্য বহুবার ফ্ল্যাট বদলাতে চেয়েছিলো কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠেনি। আজ ওরাই মিশুর সাথে এরকম কিছু করবে তন্ময় দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। বুকটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। 

মিশু চোখ মুছে বললো, 'আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সেই মুহুর্তে কোথ থেকে আমার শক্তি এলো জানিনা, আমি ওই লোকটার লিঙ্গ বরাবর জোরে লাত্থি বসিয়ে দিই। তারপর ছুটে পালিয়ে আসি। এরপরের অধ্যায় আরো অকল্পনীয়। যেটা তুমি আমি কেউ কখনো কল্পনাও করিনি।'

তন্ময় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ওর। কথা বলার মত অবস্থা নেই। নিজেকে আজ সত্যিই খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। 

মিশু বললো, 'আমার পিরিয়ড চলছিলো। পাগলের মত ছুটতে ছুটতে এসে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। তারপর আমার সাথে কি কি ঘটেছে আমার স্পষ্ট মনে নেই। এরপরের ঘটনাগুলো আবছা মনে আছে। চোখ মেলে দেখি আমার সামনে অনেকগুলো ছেলেমেয়ের মুখ উপুড় হয়ে আছে। সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা আমাকে তুলে ধীরেধীরে রাস্তার পাশে এনে বসায়। আর সবচেয়ে সুন্দর দেখতে ছেলেটা সবার সামনে আমাকে কোলে নিয়ে সিএনজিতে তোলে। পাগলের মত ছুটেছিলাম বলে পিরিয়ডের ব্লাড পা, জামা পাজামায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছিলো। সেই অবস্থায়ই ওই মানুষটা আমাকে কোলে নিয়ে সিএনজিতে তোলে। ওর বোন অর্থাৎ সেই সুন্দর মেয়েটা আমার প্যাড বদলে দেয়। আমিতো ভেবেছিলাম মানুষ রূপী কোনো ফেরেশতা। নয়তো যেখানে ছেলেরা মেয়েদের এসব নিয়ে হাসাহাসি করে সেখানে ওরা কত ভালো সবাই! সেই সুন্দর মানুষটা আমাকে খাবার খাওয়ায়, আমার হাত পা মালিশ করে দেয়। আমাকে নিয়ে হসপিটালে যায়, সেখান থেকে আবার কমলাপুর রেইলওয়ে স্টেশনে এনে কোলে করে ট্রেনে তোলে। আমার একদমই হুশ ছিলোনা। একটু পরপর শুধু চোখ মেলে টের পাচ্ছিলাম এরকম কিছু ঘটছে। ওষুধ খাওয়ার পরপরই সেই মানুষটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়। আমার ঘুম ভাঙে ট্রেনে, তখনো সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। এত সুন্দর কোনো মানুষ কিভাবে হতে পারে! আমি এখনো ভেবেই পাইনা।'

তন্ময় অবাক হয়ে শুনছিলো। এবার বললো, 'ওই মানুষটা সত্যিই দেবদূত হয়ে এসেছিলো। এমন মানুষও আছে আমার জানা ছিলোনা। তাকে হাজারো স্যালুট। এই সুন্দর মানুষটা আর ওই মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে পারবা? ওদের সালাম জানাতে চাই আমি। আমার মিশুকে বাঁচিয়েছে ওরা।'

মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, 'এই সুন্দর মানুষটা হচ্ছে এখন আমার স্বামী মেঘালয় আহমেদ আর সেই মেয়েটা আমার ননদ মৌনি।'

তন্ময় আঁৎকে উঠে বললো, 'কিহ! আন্টি যা বলেছে সেটাই তাহলে ঠিক? মানুষটা তোমাকে একেবারে বিয়ে করে নিলো?'

মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, 'বিয়েটাও একটা গল্প ছিলো। মানুষটা যেমন ভালো তেমনি অনেক বেশি স্মার্ট আর অনেক বেশি আকর্ষণীয়। সে আমাকে কখনোই বিয়ে করতে চায়নি আর আমিও চাইনি। এমনকি দুই পরিবারের কেউই চায়নি। প্রকৃতি চেয়েছিলো তাই এক্সিডেন্টলি বিয়েটা হয়ে গেছে। আমি চেয়েছিলাম ওনাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু উনি বলেছিলেন, বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তখন দায় এড়ানোর কোনো মানেই হয়না।'

তন্ময় বললো, 'কি বলছো এসব? মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই এতকিছু হয়ে গেলো! কিন্তু শুধু দায়বদ্ধতা থেকেই কি আজীবন থাকা যায়? তুমিও মেনে নিলে?'

মিশু গর্বের সাথে বললো, 'মেঘালয়কে দেখলে দেখতেই ইচ্ছে করে, কথা বললে ওর কথাই শুনতে ইচ্ছে করে, যার স্পর্শ পেয়ে পাগল হয়ে গেছি আমি। ওই মানুষটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি, ইনফ্যাক্ট পাগলের মতই ভালোবাসতে চাই। আল্লাহ তাকে আমার চরম বিপদের মুহুর্তে পাঠিয়েছে, যেভাবেই হোক আমাদের জুটি বেঁধে দিয়েছেন। সেই সৌভাগ্যকে আমি আর পায়ে ঠেলে দিতে পারবো না। একটা কথা কি জানো তন্ময়? স্মার্টনেস শুধুমাত্র আউটলুক দিয়ে হয়না, স্মার্টনেসের নতুন সংজ্ঞা আমি জেনেছি আমার মেঘালয় আর মৌনি আপুর কাছ থেকে। তোমার দেয়া আঘাতটা আমি ভূলেই গিয়েছিলাম। তুমি এসে আর দয়া করে আমার জীবনটাকে শেষ করে দিওনা। দোহাই লাগে, তুমি চলে যাও। আর কোনোদিনো যোগাযোগ করার চেষ্টাও কোরোনা।'

মেঘালয়ের কথা বলতে বলতে মিশুর চোখেমুখে এক ধরণের প্রসন্নতা ফুটে উঠেছিলো। তন্ময় মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো শুধু। মিশু সুখী হলে আর বাঁধা দিতে চায়না ও। মেয়েটা অনেক ঝড় সামলে উঠেছে, আর কোনো ঝড় যেন না আসে। তন্ময় মিশুর পায়ে হাত রেখে বললো, 'মাফ করে দিও আমাকে।'

মিশু দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে বললো, 'কি করছো? প্লিজ এরকম কোরোনা।'
- 'আমি আর কক্ষনো আসবো না, যোগাযোগ ও করবো না। তুমি সুখী হও সেটাই আমাকে সুখ দেবে। আমি নাহয় দূর থেকেই আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো।'

মিশু বললো, 'তন্ময়, কেউ ভালোবাসলে তাকে অপমান করতে হয়না। আমি শর্ট, আমি গাইয়া এসব বলে তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছো। আমি গ্রামে জন্মেছি এটা কোনো অপরাধ হতে পারেনা। আর আমার উচ্চতা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। জন্মের উপর কারো হাত থাকেনা। জানো মেঘালয় কি বলে? ওর হাইট প্রায় ছয় ফুট। অথচ ও আমাকে বলে, 'মিশু তুমি আমার কাছে একটা ফুটফুটে পুতুলের মত। যাকে কোলে বসিয়ে আদর করা যায়। খাটো মেয়েদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলে অনেক আরাম লাগে।' আর আমি আন স্মার্ট বলে ও আমাকে ছেড়ে যায়নি বরং আমাকে শিখিয়েছে স্মার্টনেস কি? জানো মেঘালয় একজন সত্যিকার মানুষ। আমি খুব ভাগ্য করে ওকে পেয়েছি।'

তন্ময়ের আর বলার মত কিছু নেই। মিশুকে ফিরিয়ে দেয়াটা জীবনের সবচেয়ে বড় ভূল ছিলো সেটা স্বীকার করে সেখান থেকে চলে গেলো। হাত থেকে বটিটা ফেলে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো মিশু। আজ সমস্ত কনফিউশন, সমস্ত রাগ অভিমানের অবসান ঘটেছে। তন্ময়কে যা যা বলতে চেয়েছিলো সব বলতে পেরেছে। আর মেঘালয়কে নিয়ে থাকা সমস্ত কনফিউশনও দূর হয়ে গেছে। এখন তো ইচ্ছে করছে বিয়ের দিনটা যেন দ্রুত এগিয়ে আসে। মেঘালয়কে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে। ছাদে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে লাগলো মিশু। তন্ময় রাস্তায় এসে একবার ছাদের দিকে তাকাতেই মিশু হাত নেড়ে বিদায় দিলো। তন্ময়ও হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। উফফ কি যে শান্তি লাগছে! অনেক দিন পর খুব শান্তি লাগছে মিশুর। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, 'মিস ইউ মেঘালয়। দশদিন ফোন দিতে বারণ করেছি কিন্তু আমি নিজেই তো দশদিন থাকতে পারবো না। রিয়েলি মিস ইউ। বড্ড সুখ সুখ লাগছে আমার। এই সুখের সময়ে যদি সকালে ঘুম থেকে উঠেই তোমাকে দেখতে পেতাম, ইস যদি সম্ভব হতো! হুট করে চলে আসতে যদি, আমার মত খুশি আর কেউ হতো না। আসবে মেঘমনি? তোমার মিশুর কাছে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp