৫৮!!
সারারাত খুব ভালো ঘুম হলো মিশুর। রাতে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। শেষরাতে হঠাৎ কারো হাতের উষ্ণ স্পর্শে ঘুমটা ভেঙে গেলো। কোলবালিশটা কত্ত ভালো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এরকম কোলবালিশ সবসময় দরকার। মিশু দুহাতে শক্ত করে জাপটে ধরলো বালিশটাকে। কোলবালিশও তার একহাতে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে অন্যহাতে জড়িয়ে ধরলো মিশুকে। বাহ, কোলবালিশ জড়িয়ে ধরতে শিখেছে! মিশু দুহাতে জাপটে ধরতে ধরতে গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিলো। এমন সময় কপালে আলতো চুমুর স্পর্শ পেয়ে আচমকা ঘুম পালিয়ে গেলো। কোলবালিশ চুমু খেতেও শিখে গেছে! কিভাবে সম্ভব?
চোখ মেলে তাকালো মিশু। মেঘালয়কে দেখে চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেলো ওর। খুব কাছ থেকে মেঘালয়কে তাকিয়ে থাকতে দেখে রীতিমত হা হয়ে গেলো। মেঘালয় এসেছে! এটা স্বপ্ন নয়তো?
মিশুর নিজের নখে নিজেই কামড় দিয়ে লাফিয়ে উঠলো। ব্যথা পেয়েছে। তারমানে স্বপ্ন নয়। মিশু চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানার উপর উঠে বসলো। অনেকটা থ মেরে তাকিয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে। কিন্তু মেঘালয়কে গতকাল ই ঢাকায় রেখে এসেছে ও। তবে সে কিভাবে এসে হাজির হলো!
মেঘালয় হাসতে হাসতে ভ্রু দুটো নাচিয়ে বললো, 'সারপ্রাইজড?'
- 'আপনি! কোথ থেকে এলেন?'
- 'ঢাকা থেকে।'
- 'এত রাতে! আপনি রওনা দিয়েছেন কখন?'
- 'মিতু ফোন দিয়ে বললো তন্ময় এসেছে। তোমাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। আমার বউকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে আর আমি বসে বসে দেখবো?'
মজা পেলো মিশু। মেঘালয়ের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে ওকে। চোখ দুটো ফুলে আছে। একদিনেই এই অবস্থা? মনেমনে বললো, 'এত টান! আমিও ডাকলাম আর তুমিও চলে এলে।' কিন্তু মুখে বলল, 'আপনি তো আমাকে এখনও ভালোই বাসতে পারেননি। এত কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিলো?'
মেঘালয় বললো, 'না আসলেই বুঝি খুশি হতে?'
মেঘালয়ের গলার স্বরে এক ধরণের রাগ মিশে আছে। বেশ মজা লাগছে মিশুর। ওকে আরেকটু জ্বালানোর জন্য বললো, 'তা জানিনা। কিন্তু কে আমাকে বেশি ভালোবাসে সেটা বুঝতে সুবিধা হতো।'
ভ্রু কুঁচকে মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, 'মানে!'
- 'মানে তন্ময় তো নিজের ভূল বুঝতে পেরেছে। আর ছেলেটা আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। আপনি যেহেতু এখনো বাসেন না, কাজেই আমার তন্ময়কে নিয়েও একবার ভেবে দেখা উচিৎ।'
মেঘালয় ভয়াবহ রেগে গেলো। কিন্তু মুখে রাগ দেখাতে পারলো না। মিশু তাকিয়ে দেখে মেঘালয়ের চোখে যেন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। মুখ টিপে হেসে ও বললো, 'আজীবন একসাথে থাকতে হবে। সবকিছুর আগে একবার ভেবেচিন্তে তারপর ডিসিশন...'
মেঘালয় হাত বাড়িয়ে মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, 'কিসের ডিসিশন? আমি তোমার হাজব্যান্ড। আমার সামনে এই কথা বলার আগে বুকটা একবার কাঁপলো না?'
- 'কথা বলার সময় কি কাঁপে তাও জানেন না দেখছি। ঠোঁট কাঁপে ঠোঁট। অন্যকিছু নয়।'
মেঘালয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিশুর চোখের দিকে। মিশুর চোখে হাসির ঝিলিক। ঠোঁটে দুষ্টুমি হাসি মিশে আছে। মেঘালয় রাগবে নাকি হাসবে বুঝতে পারলো না। মিশুর আঙুলের ফাঁকে আঙুল রাখতে রাখতে বললো, 'মেরে হাড্ডি গুড়া করে দিবো। খুব পাঁজি হয়ে গেছো।'
- 'সেকি! আপনি আমাকে মারবেন? তন্ময় বলেছিল কোনোদিনো আমার গায়ে হাত তুলবে না।'
- 'হাত তুলবে কোথ থেকে? হাত থাকলে তো তুলবে। আমার বউকে কেড়ে নিয়ে গেলে আমি হাত রাখবো নাকি?'
মিশু মেঘালয়ের সামনে বসে বললো, 'খুব তো আমার বউ আমার বউ করছেন। বউয়ের জন্য কি এনেছেন শুনি?'
মেঘালয় আমতা আমতা করে বললো, 'না মানে এত দ্রুত গাড়ি টেনে এনেছি যে কিছুই আনতে পারিনি।'
- 'হাহ। আর তন্ময় আমাকে বলতো যতবার বাইরে যাবে ততবারই আমার জন্য চকোলেট, আইসক্রিম, বিস্কুট টিস্কুট নিয়ে তবেই বাসায় ফিরবে। হাউ কিউট!'
মেঘালয় তেলে বেগুনে জ্বলে গেলো। তন্ময়ের নাম নিয়ে বারবার ক্ষেপানো হচ্ছে। কিন্তু মিশুর মনে তন্ময়ের জন্য একটু জায়গা ফাঁকাই ছিলো সেটা মেঘালয় জানে। নয়তো গত রাতে ওভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়তো না। মেঘালয়ের ফোনও রিসিভ করেনি ও। এতটাই হতাশায় পড়ে গিয়েছিলো। তাহলে কি এখনো তন্ময়কে ভালোবাসে ও?
কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করেই বসলো মেঘালয়, 'তুমি কি এখনো তন্ময়কে ভালোবাসো মিশু?'
মিশু দুষ্টুমি করে বললো, জানিনা।'
- 'জানোনা মানে! সত্যি করে বলোতো তুমি এখনো ওর কাছে যেতে চাও কিনা।'
- 'যদি বলি চাই?'
থমকে গেলো মেঘালয়। অনেক্ষণ কথা বলতে পারলো না। মেঝের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বললো, 'আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো।'
বুকটা চিনচিন করে উঠলো মিশুর। এই কথাটা শুনলেই বুক ফেটে কান্না আসতে চায়। কিছুতেই সহ্য করা যায়না। মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো কত মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে ও! যদি ছেড়েই দেবে তাহলে এত কষ্ট করে কি এতটা পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসতো? মিশু একটু হলেও বোঝে। মিশু চোখেচোখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, 'ভালোবাসেন খুব তাইনা?'
মেঘালয় চোখেচোখে উত্তর দিলো, 'হুম। আর কখনো এরকম কথা দুঃস্বপ্নেও বলবা না বলে দিলাম।'
আচমকা মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো মিশু। দুহাতের বন্ধনে শক্ত করে ধরার চেষ্টা করলো। মেঘালয়ও পাগলের মত মিশুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে রইলো যেন বুকের সাথে পিষে ফেলতে চাইছে। মিশুকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে পারলে তবেই বোধহয় সুখ লাগবে। খুব আপন করে নিতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে। কতটা আপন হলে যে আর দূরে মনে হবেনা..!
দুজনের কেউই আর কোনো কথা বলতে পারলো না। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেই বসে রইলো। একটু পরেই শোনা গেলো পাখির কিচিরমিচির।
৫৯!!
গোসলের পর চুল মুছতে মুছতে মিশু রুমে এসে দেখলো মেঘালয় এখনো ঘুমাচ্ছে। সারারাত জার্নি করে এসেছে, একটু ঘুমানো দরকার। মিনিট দুয়েক মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মিশু এগিয়ে এসে বিছানায় বসলো। ঘুমানোর সময় মেঘালয়ের শরীরটা অন্যরকম উষ্ণ হয়ে ওঠে। ওর উষ্ণ গলাটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। মিশু নিচু হয়ে এসে মেঘালয়ের গলায় হাত রাখা মাত্রই টের পেয়ে গেলো মেঘ। ও জেগেই ছিলো। তবুও চোখ মেললো না। চুপটি মেরে মিশুর স্পর্শকে অনুভব করার চেষ্টা করলো। মিশু গলায় হাত রেখে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে নিচু হয়ে এসে মেঘের কপালে ঠোঁট স্পর্শ করালো। এমন সময় মেঘালয় দুহাতে জাপটে ধরলো ওকে। মিশু মুখটা তুলে মেঘালয়ের মুখের উপর উপুড় হয়ে এলো। দুপাশের ভেজা চুল মেঘালয়ের গলার উপর হেলে পড়েছে। মেঘালয় বললো, 'তোমাকে কোন ড্রেসে সবচেয়ে সুন্দর লাগে জানো?'
- 'না। কিসে?'
- 'শাড়িতে। শাড়ি পড়বা?'
- 'নতুন শাড়ি কিনতে হবে।'
- 'আজকে শপিংয়ে নিয়ে যাবো। নতুন কয়েকটা ড্রেসও কিনতে হবে তোমার। তোমাকে যে ড্রেসে সবচেয়ে বেশি মানায় সেগুলো নিয়ে দিবো।'
- 'আচ্ছা। আমিতো জানতাম আমাকে সব ড্রেসেই মানায়।'
- 'উহু। গায়ের রংয়ের সাথে ড্রেসে শুট করার একটা ব্যাপার থাকে। আর হাইট ও ওয়েট অনুযায়ী কোন জামাটা পড়লে বেশি সুন্দর লাগবে সেটাই পড়া উচিৎ তাইনা?'
- 'উম। আচ্ছা আপনি এতকিছু জানেন কি করে?'
- 'জানতে হয় রে পাগলী। সাধে কি মেয়েরা তোমার বরের জন্য পাগল হয়?'
- 'ইইইই খুব খারাপ। ছাড়ুন আমাকে।'
মেঘালয় একহাতে মিশুর চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বললো, 'সবসময় যে স্টাইলে চুল বাঁধো, মাঝেমাঝে একটু ভিন্নতা আনাও যায়। এতে একটা আলাদা লুক চলে আসবে।'
- 'উফফ আপনি ফ্যাশন ডিজাইনার হলেন না কেন বলুন তো?'
- 'বউয়ের ফ্যাশন ডিজাইনার হবো বলে।'
- 'হয়েছে। এবার ছাড়ুন, আর উঠে ফ্রেশ হয়ে আসুন দ্রুত।'
মেঘালয় মিশুকে আরো জোরে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, 'ছাড়বো না। আজকে সারাদিন শুয়ে থাকবো।'
কথাটা বলেই মিশুকে টেনে বিছানায় তুলে নিলো। কম্বলের ভিতরে টেনে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে রইলো। মিশু এই মানুষটার সাথে পারেনা কিছুতেই। শক্ত হাত দুটো দিয়ে মিশুকে এমনভাবে ধরে রইলো যে মিশুর নড়াচড়া করার ও শক্তি রইলো না। খুনসুটি চলতে লাগলো দুজনাতে।
সারাটা দিন শপিং, খাওয়াদাওয়া,দুষ্টুমি আর ঘুরাঘুরি করেই কাটলো। রাত্রিবেলা হঠাৎ খবর এলো তন্ময়কে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। যে ছেলেটা মিশুর উপর আক্রমণ করেছিলো তাকে মারতে মারতে মরার মত অবস্থা করে ফেলেছে তন্ময়। আর সেলিমকেও প্রচুর মেরেছে। দুজনের অবস্থা আশংকাজনক। কথাটা শুনেই বুকটা কেমন করে উঠলো মিশুর। তন্ময়কে ছাড়ানোর জন্য ওকেই যেতে হবে। কারণ ওর যে এখন কেউই নেই। আর মিশুকেও সাক্ষী দিতে হবে সত্য ঘটনার। তবে ওদের এই করুণ অবস্থা করার কারণে মেঘালয় তন্ময়ের প্রতি অনেকটা সন্তুষ্ট। বারবার বলছিলো, 'এতদিনে কাজের কাজ করেছে ছেলেটা। এরকম প্রেমিকই তো দরকার।'
—————
৬০!!
শেষ অব্দি আর কাউকেই যাওয়ার প্রয়োজন হলোনা। তন্ময়ের জামিনের ব্যবস্থা করেছেন মিশুর বাবা। গত কয়েকদিন আগে উপজেলা চেয়ারম্যান নিজেই সাক্ষী থেকে সরাসরি মন্ত্রনালয়ে অভিযোগ জানানো হলো আসামিদের ব্যাপারে৷ ফলে ওই দুজনকেই পুলিশের তত্ত্বাবধানে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে আর তন্ময়ের জামিনের ব্যবস্থাও হয়ে গেছে।
মাঝখানে কেটে গেছে দুটো দিন। দুদিনে যেন দুজন মানুষ নতুন করে বুঝতে শিখেছে ভালোবাসার অনুভূতিগুলো কেমন হয়? একে অপরকে গভীরভাবে অনুভব করতেও শিখে গেছে। তন্ময়ের সাথে আর কোনোভাবেই যোগাযোগ করেনি মিশু। পুরনো অধ্যায় শেষ করে দিয়ে নতুন অধ্যায়ে পা ফেলেছে, অতীতের ধূলো ঝেড়ে ফেলে দিয়ে জীবনে নতুনভাবে প্রত্যাবর্তন দরকার।
মেঘালয়ের উপযুক্ত করে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য কঠোর শ্রমও দিতে হচ্ছে। মেঘালয়ের এথলেটদের মত বডি, ব্যায়ামপুষ্ট শরীর। মাসল দেখলেই বুকের হার্টবিট ধরাস করে বেড়ে যায়। মিশুও ব্যায়াম করা শুরু করে দিয়েছে। মিশু আগে চুল বাঁধতে পারতো না, সবসময় অগোছালো হয়ে থাকতো। এখন চেষ্টা করছে চুল সবসময় পরিপাটি করে রাখার৷ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি থাকলে যেকোনো মেয়েকেই সুন্দর দেখায়। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে কথা বলার ক্ষেত্রে। মেঘালয় খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে, তার মত করে কথা বলাও শিখতে হবে৷ দুজনই যেন অনুধাবন করতে পারে দুজন মিলে একটা পারফেক্ট জুটি।
মিশু গ্রীন টি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরপর চুমুক দিচ্ছে চায়ে। মেঘালয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে কিভাবে বারান্দা সাজাতে হবে। বিয়ের প্রোগ্রামের আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। মিশুকে রেখে মোটেও আর ঢাকায় যেতে ইচ্ছে করছে না। মেঘালয় ভেবে রেখেছে বিয়ের একেবারে দুদিন আগে ফিরলেই হবে। মুহুর্তের জন্যও মিশুকে আড়াল হতে দেয়া যাবেনা।
মিশু চায়ে চুমুক দিয়ে মেঘালয়ের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। মিশুর ভেজা গলা দেখে চমকে উঠলো মেঘালয়। ভ্রু কুঁচকে ইশারায় বলল, 'কি হয়েছে?'
মিশু বেশ দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে চেঁচিয়ে বললো, 'একটানা বিশ বার বুকডন ডান।'
মেঘালয় হেসে ইশারায় বললো, 'বাহ!'
মিশুর ঘর্মাক্ত কাঁধ ও গলা দেখে বুকের চিনচিনিনিটা বেড়ে যাচ্ছে মেঘালয়ের। ওয়েডিং প্লানারকে বাকি কাজটা দ্রুত বুঝিয়ে দিয়ে মিশুর দিকে এগিয়ে এলো। মিশু চুলে বেনী করে সামনে বামপাশে এনে রেখেছে। মুখের দুপাশে বাঁকা চুল ঝুলছে। মুখটাও ঘেমে একাকার। ঘেমে গেলে মেয়েদেরকে কি যে অপূর্ব দেখায়। মিশু জিজ্ঞেস করলো, 'কি দেখছেন?'
মেঘালয় বললো, 'তোমার স্বর্ণের লকেট আছে?'
- 'না। আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে ওসব।'
- 'তুমি কি জানো তোমার ঘেমে যাওয়া গলায় একটা লকেট ঝুলতে দেখলে কত সুন্দর দেখাবে? আর চুলের নিচে কাঁধের উপর যখন চেইনটা লেপ্টে থাকবে, উফফ! ভাবতেই পারিনা।'
মিশু মুচকি হেসে বললো, 'তাই বুঝি? ঠিকাছে একটা বানাতে দিবো।'
- 'রুমে আসবে একটু?'
- 'কেন?'
- 'দরকার ছিলো একটু। আমি যাচ্ছি, তুমি তারাতারি আসো।'
মিশু চায়ের কাপ মেঘালয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, 'আপনি খান বাকিটা।'
মেঘালয় কাপটা নিয়ে ভালোভাবে খেয়াল করলো মিশু কোন জায়গায় চুমুক দিয়েছিল। সেখানে আলতো করে চুমুক দিলো। তারপর বাঁকা চোখে তাকালো মিশুর দিকে। মিশু কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো, 'কি?'
মেঘালয় বললো, 'তোমার অর্ধেক খেয়ে ফেলে রাখা চায়ে একটা আলাদা গন্ধ মিশে আছে। রিমিক ঝিমিক প্রেম আছে, চিনিক চিনিক ব্যথা আছে, দুটো কবিতার লাইন আছে, ঠোঁট ছোঁয়ানো অনুভূতি আছে, ঘুমের আদর মেশানো ভালোবাসা আছে, আর আছে প্রেমস্বাদ যুক্ত মধু।'
মিশু রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। চোখের পলক ও পড়তে চাইছিলো না। একটা চায়ের উপমাও কেউ এত সুন্দর করে দিতে পারে সেটা ওর জানা ছিলোনা। মুচকি হেসে বললো, 'দারুণ! কবিতা লেখা শুরু করে দিন।'
মেঘালয় চায়ের কাপে আরেক বার চুমুক দিয়ে বললো, 'আমার গলার স্বরে তোমার জন্য একটা স্বপ্নরাজ্য বুনে ফেলবো। আঙুলের ভাঁজে অজস্র কাব্য রটাবো। শুধু তুমি 'হৃদমোহিনী' হয়ে থেকো।'
প্রাণখোলা হাসি শুরু করে দিলো মিশু। মেঘালয় কবিতা লেখা শুরু করে দিয়েছে নাকি? হাসি থামানোর পর বললো, 'আমি মুখে পানি দিয়ে আসি।'
মেঘালয় বাঁধা দিয়ে বললো, 'না। ওভাবেই রুমে আসো।'
- 'কেন? গা ঘেমে গেছে, মুখটা ধুয়ে আসি।'
মেঘালয় কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বললো, 'তোমার শরীর থেকে সমস্ত লবণাক্ততা দূর করে দিই?'
মিশু লাজুক স্বরে বললো, 'কিভাবে?'
- 'আমি বিদ্যা জানি। কামড়ে খেয়ে ফেলবো।'
- 'আহা, যদি আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েন?'
মেঘালয় আবারও ফিসফিস করে বললো, 'তখন তুমি আমার শরীর থেকে সমস্ত বিষ শুষে নিবা।'
শিউরে উঠলো মিশু। এমনিতেই মেঘালয়ের কণ্ঠটা অসম্ভব মায়াবী আর সুন্দর। তার উপর এভাবে বললে পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে যায়না? হার্টবিট বেড়ে গেলো হঠাৎ করেই। এত জোরে বিট হচ্ছে বোধহয় বারান্দায় বসে থাকা ওয়েডিং প্লানারও শুনতে পারবে সেই বিটের শব্দ। ধুকপুক করছে বুকটা। প্রচন্ড অস্থির লাগতে শুরু করেছে মিশুর। এক মুহুর্তও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। দ্রুত রুমে এসে দাঁড়াতেই মেঘালয় তাকিয়ে দুষ্টুমি হাসি দিলো। মিশু রাগী রাগী চেহারায় তাকালো ওর দিকে।
মেঘালয় এগিয়ে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে কোলে তুলে নিলো মিশুকে। মিশু দুহাতে মেঘালয়কে মারতে মারতে বললো, 'আপনি একটা খুব খারাপ। তারাতারি ঢাকায় চলে যান তো।'
- 'আমি যখন থাকবো না, তখন কষ্ট হবেনা?'
মিশু করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, 'অলুক্ষণে কথা বলবেন না। ডাকলেন কেন?'
- 'একটু আগে যেটা বলেছি সেটা আবার শুনতে ইচ্ছে করছে?'
মিশুর লজ্জায় মরে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে গেলো। মেঘালয়কে জাপটে ধরে বুকে মুখটা লুকাতে লুকাতে বললো, 'চুপ একদম চুপ।'
হেসে উঠলো মেঘালয়। মিশুকে বিছানায় জোরে ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর। মিশু চোখ বুজে রেখেছে। লজ্জায় চোখ মেলতে পারছে না। মেঘালয় দুহাতে মিশুর মুখটা ধরে বললো, 'এই হৃদমোহিনী..'
মিশুর চোখে পানি। একই সাথে অনেক ধরণের অনুভূতি কাজ করছে। ও মৃদু গলায় বললো, 'আমার না কান্না পাচ্ছে। খুব সুখের মুহুর্তগুলোতে আমার বড্ড কান্না পায়। একটু কান্না করি?'
- 'কাঁদো। তারপর তোমার চোখের জল...'
মিশু মেঘালয়ের ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বললো, 'আমি জানি। ওষ্ঠে তুলে নেবেন তাই তো?'
মেঘালয় হেসে বিছানার উপর উঠে বসলো। মিশুকে টেনে নিয়ে নিজের কোলের উপর মিশুর মাথাটা নিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, 'আমি যদি কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যাই?'
- 'মানে! যেখানেই যাবেন আমাকে সাথে নিয়ে যেতে হবে।'
- 'যদি কখনও হারাই?'
মিশু রেগে বললো, 'একদম রহস্য করবেন না। এরকম ফাজলামি কক্ষনো করবেন না। আমি পাগল হয়ে যাবো আপনাকে হারালে।'
- 'তোমার না তন্ময় আছে?'
মিশু রেগে দুটো মাইর লাগালো মেঘালয়ের বুকে। মেঘালয় বুকে হাত রেখে চেঁচিয়ে উঠলো, 'উহ এত জোর তোমার গায়ে?'
- 'তো? এরকম ফালতু কথাবার্তা আরেকবার বললে খুন করে ফেলবো।'
কথাটা বলেই আবার নিজেই মেঘালয়ের বুকে হাত রেখে মালিশ করতে লাগলো। মেঘালয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিশুও নিচু হয়ে চোখ বরাবর তাকিয়ে আছে হা হয়ে। এই চোখ দুটো ভয়ংকর, বড্ড ভয়ংকর। কি যে মিশে আছে চোখে, সেই অর্ধেক ফেলে রাখা চায়ের মত। একসাথে অনেক কিছু। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে যায়। ঘুমের আদর মেশানো ভালোবাসায় মাতাল হতে ইচ্ছে করে।
মিশু মাথাটা নামিয়ে আনতে আনতে মেঘালয়ের মুখের কাছাকাছি চলে আসলো। মেঘের মুখের উপর মিশুর নিশ্বাস পড়ছে। মেঘালয় দুহাতে মিশুর মুখটা ধরে কাছে টেনে আনার চেষ্টা করছে। হঠাৎ...