হৃদমোহিনী - পর্ব ১৩ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


৩৯!! 

হোটেল থেকে বেড়িয়ে মেরিন ড্রাইভের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো ওরা। মিশু একটা হালকা গোলাপি রঙের জামা পড়ে পুতুলের মত সেজেছে। মেঘালয়ের পাশে বসে উৎসুক চোখে বাইরে তাকিয়ে রইলো ও। 

মেরিন ড্রাইভ রোডে গাড়ি ওঠার পর থেকেই মিশু ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগলো। একদিকে সমুদ্র, একদিকে পাহাড়! নীলাকাশ সাগরের নীলে নেমে এসেছে দেখে এক মু্ুহুর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। নেমে যাওয়ার জন্য লাফালাফি শুরু করে দিলো মিশু। মেঘালয় গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লো মাঝ রাস্তায়।

রাস্তাটা মোটামুটি ধরণের চওড়া, একদিকে গাছের সাড়ি। সমুদ্রের ঢেউ আচড়ে পড়ছে তীরে আর অপরদিকে পাহাড়। একবার পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আরেকবার সমুদ্রের দিকে তাকালো মিশু। কোনদিকে যাবে বুঝে উঠতে পারলো না। মেঘালয় ওকে হাত ধরে সমুদ্রের দিকে নিয়ে গেলো। সমুদ্রে এসে দূরন্ত কিশোরীর মত পা ভিজিয়ে দৌঁড়াতে লাগলো মিশু। এখানে সমুদ্র অনেক শান্ত, কিন্তু রূপ যেন আরো অনেক বেড়ে গেছে। মেঘালয় সেলফি তোলার জন্য পকেটে হাত দিয়ে মুখটা করুণ করে বললো, 'ধেৎ আমার তো ফোনই নেই।'

মেঘালয়ের মুখ দেখে প্রচন্ড খারাপ লাগলো মিশুর। ও বললো, 'মন খারাপ করবেন না প্লিজ। সব আমার জন্য হয়েছে।'

মেঘালয় মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, 'পাগলী টা এভাবে বলেনা। তোমার জন্য আমি জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি সেখানে একটা ফোন?'

মিশু হেসে বললো, 'আপনি খুব ভালো। আচ্ছা আমার ব্যাগে তো মৌনি আপুর ফোনটা আছে, ওটা দিয়ে সেলফি তুলি?'
- 'আচ্ছা তুমি এখানে থাকো আমি গাড়ি থেকে ফোনটা নিয়ে আসি।'

মিশু বাঁধা দিয়ে বললো, 'আমার একটু চুলগুলো ঠিক করতে হবে। আপনি এখানে থাকুন, আমিই ফোনটা নিয়ে আসছি।'
- 'আচ্ছা।'

মেঘালয় একটা পাথরের উপর বসে সমুদ্রের জলে পা ভেজাতে লাগলো। দূরে দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত সমুদ্র আর পাহাড়। এখানে নীল ছাড়া আর কিছুই নেই। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনটা কেমন যেন করে ওঠে।

মিশু গাড়িতে উঠেই বুঝতে পেলো ফোনে রিং হচ্ছে। দ্রুত ব্যাগের চেইন খুলে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো একটা নাম্বার থেকে কল আসছে, Oyontika নামে। 

মিশু একটু ভেবে কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একটা মিষ্টি স্বর ভেসে আসলো, 'হ্যালো আপু..'

মিশু কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো, 'হ্যালো..'

ওপাশের মিষ্টি কণ্ঠের মেয়েটি বললো, 'আপুউউউ। আমি কতবার ফোন দিলাম রিসিভ কেন করলে না? তোমরা এত নিষ্ঠুর কেন?'

মিশু চুপ করে শুনে গেলো। যখনই বলতে যাবে আমি আপু নই। তার আগেই মেয়েটি বললো, 'আপু গো, মেঘের নাম্বার বন্ধ কেন পাঁচদিন ধরে? বাধ্য হয়েই তোমাকে কল দিলাম। মেঘের কি হইছে আপু? কিছু বলছো না কেন?'

মিশু চমকে উঠলো এবার। কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা নিয়ে মেয়েটি প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। সে এত করে মেঘালয়ের খোঁজ করছে কেন? প্রশ্নটা কানে আসতেই খটকা লাগলো বুকে। মিশু আরেকবার বললো, 'হ্যালো।'

মেয়েটি বললো, 'আপু বলোনা মেঘ কোথায়? ওর নাম্বার কেন বন্ধ? সবাই মিলে সেই যে বিয়ে বাড়িতে গেলে তারপর থেকেই বন্ধ। আচ্ছা ও এতটা স্বার্থপরের মত আচরণ কিভাবে করতে পারে? আমার সাথে একবার যোগাযোগ করবে না? পূর্ব ভাইয়াকে কল দিলাম সেও রিসিভ করলো না। আমার প্রচুর টেনশন হচ্ছে আপু।'

মিশুর বুকটা চিনচিন করে উঠলো। কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন যেন অস্থির লাগতে শুরু করেছে। মেঘালয়কে নিয়ে অন্যকেউ টেনশন করবে সেটাও অসহ্য লাগবে ওর। কে এই মেয়েটা?

মিশু বললো, 'একটু কথা বলার সুযোগ দিন প্লিজ। আমি মৌনি নই, আপুর ফোনটা আমার কাছে।'

মেয়েটি দ্রুত জবাব দিলো, 'মানে! আপনি আবার কে?'

মিশু কিছু না ভেবেই বললো, 'আপনি কে?'
- 'আমি মৌনি আপুর রিলেটিভ। আমার নাম বললেই আপু চিনবে।'
- 'আপু এখানে নেই। উনি ঢাকায় গেছেন।'
- 'মানে! আপু ঢাকায় আর আপুর ফোন রংপুরে? আপনি কে? আপনার কাছে আপুর ফোন কেন? একজনের নাম্বার বন্ধ, আরেকজনকে পাওয়া যাচ্ছেনা। সে ফোন রংপুরে রেখে ঢাকায় এসেছে। এসব হচ্ছেটা কি?'

মিশু বললো, 'একটু কথা বলার সুযোগ দিলে সবকিছু বলি?'

মেয়েটি ঝটপট জবাব দিলো, 'সরি। আসলে আমি প্রচুর টেনশনে আছি তাই এত প্রশ্ন করছি। খুলে বলুন তো কি হয়েছে?'

মিশুর খুব অস্থির লাগছিলো মেয়েটির কথা শুনতে শুনতে। তবুও বললো, 'আমিও ওনার রিলেটিভ। আমাকে চিনবেন না। আপুর একটু দরকারে বাসায় যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। আর ওনার ভাইয়ের ফোনটা হারিয়ে গেছে বলে ওনার ফোনটা ভাইকে দিয়ে গেছেন।'

মেয়েটি অবাক হয়ে বললো, 'হারিয়ে গেছে! উফ শিট। এনিওয়ে মেঘ কোথায়? তাকে ফোনটা দিন না।'

মিশুর বুকে এসে বিঁধলো কথাটা। ঢোক গিলে বললো, 'উনি একটু দূরে আছেন। আমি ওনাকে আপনার কথা বলে কল দিতে বলে দিচ্ছি।'
- 'প্লিজ এক্ষুণি যদি বলতেন? মেঘ ভালো আছে তো?'
- 'হুম।'

মিশুর কেমন লাগছে সেটা নিজেই বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটা কে হতে পারে আন্দাজ করতে পারছে ও। তবুও একবার প্রশ্ন করেই ফেললো, 'আচ্ছা আপনি মেঘালয়কে নিয়ে এত টেনশন করছেন কেন?'

মেয়েটি বললো, 'ওইটা আমার কলিজা। আমার সবকিছু। আমি টেনশন করবো না তো কে করবে? এত্তদিন ধরে ফোন অফ আর সে একবার ফোনও দিচ্ছেনা। কাইন্ডলি একটু তাকে ইনফর্ম করুন। প্লিজ? '

মিশুর বুকে যেন সমুদ্রের ঢেউ আচড়ে পড়লো এসে। একটা মেয়ে এতটা ভালোবাসে অথচ তাকে ভূলে দিব্যি নতুন বউকে মেনে নিয়েছে। এমন ভাব ধরছে যেন এর আগে কখনও কারো প্রেমে পড়েনি। মেঘালয়ের প্রেমিকা থাকতে পারে কথাটা কখনও ভেবে দেখেনি মিশু। এখন কোনো এক অজানা কারণে খুব কষ্ট হচ্ছে। যদিও মেঘালয় এখন ওর। কিন্তু এত নিঁখুত অভিনয় কেউ কিভাবে করতে পারে! মেয়েটাকে ভূলে গিয়ে... আর ভাবতে পারছে না মিশু। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে এলো। 

মেঘালয়ের কাছাকাছি আসতেই বুকের ভেতরটা আরো বেশি চিনচিন করছিলো। মেঘালয় এমন একটা মানুষ যাকে ভালো না বেসে থাকা যায়না। আর ভালোবাসলে তাকে নিয়ে কেউ টেনশন করুক সেটাও সহ্য হয়না। সবকিছু কেন এমন হলো! ওর একটা পুরনো প্রেমিকা না থাকলে কি এমন হতো?

মেঘালয় বললো, 'কি সমস্যা?'

মিশু চমকে উঠে ফোনটা এগিয়ে দিলো মেঘালয়ের দিকে। মেঘালয় ক্যামেরা অন করে সেলফি নিতে যাবে এমন সময় মিশু বললো, 'পরে ছবি তুলুন। আগে একটা জরুরি কল করে নিন।'

মেঘালয় উৎসুক চোখে জিজ্ঞেস করলো,  'কেউ ফোন দিয়েছিলো?'
- 'হুম, অয়ন্তিকা নামে একজন।'

চমকে উঠলো মেঘালয়। চোখাচোখি হয়ে গেলো মিশুর সাথে। মেঘালয়ের বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। মিশুর চোখেমুখে অন্যরকম একটা চাপা অভিমান ফুটে উঠেছে। তারমানে অয়ন্তিকা কিছু উলটা পালটা বলে ফেলেছে! এমনিতেই মিশু অনেক সেনসিটিভ একটা মেয়ে, অয়ন্তিকা আরেক পাগলী। দুজনের মনের অবস্থার কথা ভেবে এদিকে সেদিক তাকালো মেঘালয়। 

মিশু মেঘালয়কে রেখে ধীরেধীরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা দূরে চলে গেলো। সমুদ্রের তীর ঘেষে হাঁটতে লাগলো আর নানান প্রশ্ন জাগতে লাগলো মনে। ভীষণ মন খারাপ লাগছে হুট করেই। কেন এই মেয়েটার উদ্ভব হলো! মিশু শুধু নিজের মনের কথা ভাবছে না। মেঘালয়ের অপ্রস্তুত হওয়ার কথা, অয়ন্তিকার মনের অবস্থা সবটাই ভেবে দেখছে। সব ভেবে প্রচন্ড খারাপ লাগছে ওর। 

মেঘালয় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মিশু হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে গেছে। তীর ঘেষে হাঁটছে আর মাঝেমাঝে নিচু হয়ে শামুক কুড়িয়ে নিচ্ছে জল থেকে। পিছন থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছেনা মেয়েটির মন খারাপ নাকি ভালো। তবে খুব চুপচাপ হয়ে গেছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। 

মেঘালয় অয়ন্তিকাকে কল দিয়েই বললো, 'হ্যালো অয়ন, ফোন দিয়েছিলে? আমি আসলে একটু ঝামেলায় আছি।'

অয়ন্তিকা বললো, 'তুমি কি মানুষ? একবার ফোন দিতে হয়না?'
- 'অয়ন আমি বিয়ে করেছি।'
- 'তো?'

তো বলার পরপরই চেঁচিয়ে উঠলো অয়ন্তিকা- 'হোয়াট! বিয়ে মানে! ফাজলামি করছো?'

মেঘালয় বললো, 'আমি সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে ফাজলামি করিনা। গত কয়েকদিন আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আরাফের নাম্বারে কল দিয়ে আপুর সাথে কথা বলে সবটা জেনে নিও। আমি এখন ওয়াইফের সাথে কক্সবাজারে আছি। এখন রাখি, আর হ্যা উলটা পালটা কিছু কোরো না।'

অনেক্ষণ অয়ন্তিকার কোনো কথা শোনা গেলো না। মেঘালয় আরেকবার বললো, 'অয়ন উলটা পালটা কিছু কোরোনা।'
- 'তুমি হুট করে বলবা বিয়ে করেছো আর আমি কিছু করবো না?'
- 'তুমি আমার গার্ল ফ্রেন্ড নও যে তোমার কথা ভেবে আমাকে কিছু করতে হবে।'

অয়ন্তিকা হঠাৎ কেঁদে ফেললো, 'এত নিষ্ঠুর ভাবে না বললেও পারতে মেঘ।'
- 'অয়ন আমার ওয়াইফ কাঁদছে। মেয়েটা অনেকটা পাগলী আছে। বাচ্চা মেয়ে, কেঁদে বুক ভাসাবে। তুমি আর ফোন দিওনা।'
- 'মেঘ, এরকম কেন হলো?'
- 'কিছু করার নেই।'

অয়ন্তিকার কান্নাভেজা গলা শোনা গেলো। কিন্তু মেঘালয় কল কেটে দিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো৷ এতটা নিষ্ঠুরভাবে না বললেও হতো। কিন্তু মিশুর কষ্টটা এখন অয়ন্তিকার কষ্টের চেয়েও বেশি মনেহচ্ছে। কারণ মেঘালয় মিশুকে ভালোবাসে। ব্যাপারটা এখানে মিটিয়ে দিলেই ভালো হয়। 

আবারও বেজে উঠলো ফোনটা। ব্যাপারটা সত্যিই বেদনাদায়ক। প্রিয় মানুষটার হুট করে বিয়ের খবর শুনলে কোনো মেয়ের পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব না। মেঘালয় রিসিভ করে বললো, 'অয়ন আমার ফোন নেই। তুমি ফোন দিলে এটাও বন্ধ করে রাখতে হবে।'
- 'কিন্তু..'
- 'প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো। সবটা আপুর কাছে শুনে নিও।'

কল কেটে দিয়ে মেঘালয় তাকালো মিশুর দিকে। তাকানো মাত্রই ভয়ে শরীর কাটা দিয়ে উঠলো মেঘালয়ের। আশেপাশে চারিদিকে শুধুই শূন্যতা। উপরে মহাশূন্য আর সামনে বিশাল সমুদ্র। মিশু কোথায় গেলো? বুকটা ধক করে উঠলো ওর। সমুদ্রে ততটা ঢেউও নেই, শান্ত হয়ে আছে সমুদ্রটা। তাহলে মিশুর কি হলো? 

চিন্তিত মুখে পাগলের মত তাকাতে লাগলো এদিক সেদিক। মিশুকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। মেয়েটার মাথাটা এমনিতেই খারাপ, আবার রাগে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েনি তো? মেরিন ড্রাইভ রোডটাও ফাঁকা, আশেপাশে পাহাড় আর সমুদ্র চারিদিকেই ফাঁকা। কোথাও কোনো জনমানব নেই। একটা মেয়ে একা কোথায় চলে গেলো? এলাকাটাও তেমন সুবিধার না, প্রচন্ড রিস্কি। শংকায় বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো মেঘালয়ের। 

—————

৪০!! 

মিশুকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেনা মেঘালয়। মেয়েটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই কোথায় উধাও হয়ে গেলো বোঝা যাচ্ছেনা। কিছুক্ষণ সমুদ্রের পাড়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে কোথাও না পেয়ে রাস্তায় এসে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলো। গাড়ির ড্রাইভারও দেখেনি ওকে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই উধাও হওয়ার ব্যাপারটাকে রহস্যময় লাগছে মেঘালয়ের কাছে। মিশু ঠিক আছে তো? কোনো বিপদ হলো কিনা কে জানে!

কয়েক মুহুর্ত রাস্তাতেই খুঁজে খুঁজে কাটলো। রাস্তা একদম ফাঁকা। সামনে বিশাল পাহাড় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ উধাও হয়ে যাবেই বা কোথায়? যেদিকে যাবে অবশ্যই চোখে পড়বে। অবশ্য বিপদের সময় কোনোদিকেই নজরে আসেনা। এসব ভেবে ভেবে মাথাটা খারাপ হতে শুরু করেছে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। মেঘালয় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মিশুর বাবা ফোন দিয়েছেন। কি বলবে বুঝতে না পেরে প্রথমে রিসিভ করতে চাইলো না। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার পর কানে ধরে হ্যালো বলার আগেই উনি বললেন, 'বাবা তুমি কোথায়? মিশু আর্মিদের ক্যাম্পের কাছে আছে তারাতারি ওর কাছে যাও।'

মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, 'কোথায়?'
- 'তোমার নাম্বার ওর কাছে নেই তাই আমাকে ফোন দিয়ে বললো তোমাকে জানাতে। দ্রুত মিশুর কাছে যাও।'

আর কিছু জিজ্ঞেস না করে মেঘালয় ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো, 'আশেপাশে আর্মিদের ক্যাম্প ট্যাম্প কিছু আছে?'
- 'হ্যা, সামনেই একটা আছে।'
- 'দ্রুত চলুন তো।'

গাড়ি ছেড়ে দিলে মেঘালয় ফোন রেখে দিলো। বেশিক্ষণ লাগলো না পৌঁছাতে। গাড়ি থেকেই দেখতে পেলো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দুজন আর্মির সাথে কথা বলছে মিশু। এখানে কিভাবে আসলো ভাবতে ভাবতে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে আসলো মেঘালয়। 

আর্মিদের কাছে আসার পর একবার মিশুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আর্মিদের দিকে তাকালো। দুজনের মধ্যে বেশি বয়স্ক লোকটি বললেন, 'আপনি ওনার হাজব্যান্ড?'

কথাটা বলেই উনি হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়ালেন। ওনার মুখে প্রসন্ন হাসি দেখে চিন্তা থেকে স্বস্তি পেলো মেঘালয়। তারমানে কোনো বিপদের আশংকা নেই! কাহিনী পরে শোনা যাবে, আপাতত দুশ্চিন্তা নেই ভেবে হাফ ছেড়ে বাঁচলো মেঘালয়। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো লোকটির সাথে। বললো, 'মেঘালয় আহমেদ'

লোকটি বললেন, 'আমি আবদুল কালাম। আপনি বোধহয় টেনশনে পড়ে গিয়েছিলেন?'
- 'হ্যা সেটাই স্বাভাবিক। হঠাৎ ওকে দেখতে না পেয়ে প্রচন্ড টেনশন হচ্ছিলো।'
- 'উনি আমাদের হেল্প করেছেন। যদিও এখানে পুরো রাস্তায় গার্ড আছে, সেরকম বিপদের সম্ভাবনা নেই। তবুও রিস্কি জোন তো, ভয় একটু থাকবেই।'

মেঘালয় একবার মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, 'হেল্প বলতে?'
- 'এক আসামি পালাচ্ছিলো, ওকে ধরতে সাহায্য করেছেন আমাদের।'

মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে তাকালো মিশুর দিকে। বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেলো ওর! মিশু আসামি ধরতে সাহায্য করেছে? এটা কিভাবে সম্ভব?

আবদুল কালাম নিজে থেকেই বললেন, 'আসামি বাবা পাঁচার করছিলো। মেয়েটি ভদ্র মেয়ের মতো যাচ্ছিলো। আপনার ওয়াইফ কিভাবে বুঝতে পেরেছে জানিনা, মেয়েটাকে সরাসরি গিয়ে ধরে ফেলেছে।'

মেঘালয় এখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ভাবছে, মেয়েরাও ইয়াবার ব্যবসা করছে! তাকে আবার ধরে ফেলেছে আরেক মেয়ে। বাহ! মিশু দেখছি ডিটেকটিভ হয়ে গেছে! মিশুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কিভাবে বুঝলে তুমি?'

মিশু বললো, 'মেয়েটা হয়ত কোথাও যাচ্ছিলো। আমাকে খেয়াল করেনি। রাস্তা থেকে নেমে এক ছুটে সমুদ্রে নেমে হাত পা ধুচ্ছিলো। হঠাৎ কি যেন পড়ে গেলো ওর জামার ভিতর থেকে। চোখের পলকে মেয়েটা সেটা লুকিয়েও ফেললো। কিন্তু ততক্ষণে আমি বুজে গেছি সেটা ইয়াবা। দ্রুত গিয়ে আলাপ জমাতে চেষ্টা করলাম। মেয়েটা এড়িয়ে যাচ্ছিলো। কথা বলতে বলতে একহাতে ওর ওড়নাটা দিয়েই ওর গলা পেঁচিয়ে ধরে হেচকা টান দিয়ে আটকে ফেলেছিলাম। যখনি তোমাকে ডাকতে যাবো তার আগেই দেখি ওনারা আসছেন।'

মেঘালয় হেসে বললো, 'বাহ! ডিটেকটিভ মিশু হয়ে গেছো দেখছি। গ্রেট!'

মিশু বললো, 'মেয়েটা আমার হাত থেকেও পালাতে চেষ্টা করছিলো। ওনাদের সাথে আমিও পিছনে ধাওয়া করি, তারপর গাড়িতে করে এখানে চলে এলাম।'

মেঘালয় মুখে হাত দিয়ে হাসলো। পাশেই একটা টিনের ঘর থেকে আরেকজন লোক বেড়িয়ে এসে মেঘালয়ের সাথে হ্যান্ডশেক করলেন। এরপর চেয়ার নিয়ে এসে বসতে বললো মেঘালয় মিশুকে। বসে দুকাপ চা খেয়ে টুকটাক গল্প ও করে নিলো দুজনে। মেঘালয় বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিলো মিশুর দিকে। মিশুকে হঠাৎ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে ওর কাছে। রহস্যটা কি?

চা খাওয়া শেষ করে সৌজন্যতা বিনিময় করে মেঘালয় ও মিশু এসে আবারও গাড়িতে উঠলো৷ গাড়ি ছুটলো হিমছড়ির উদ্দেশ্যে। 

৪১!! 

মেঘালয় বললো, 'অয়ন্তিকা আমার ফ্রেন্ড। মেয়েটার সাথে একটা ভালো ফ্রেন্ডশিপ আছে। ও আমার অনেক কেয়ার করে, ওই সবসময় ফোন টোন দেয়। রিসিভ করে টুকটাক কথা বলতাম, এতটুকুই।'

মিশু মুচকি হেসে বললো, 'আমি কি জানতে চেয়েছি?'

চোখাচোখি হয়ে গেলো মেঘালয়ের সাথে। মিশুর চোখেমুখে হাসির ঝিলিক। আর্মিদের কাছে সম্মানিত হবার কারণে অনেক আনন্দ হচ্ছে। মেঘালয় চোখে চোখ রেখেই বললো, 'জানানোটা আমার দায়িত্ব। আমার স্ত্রী যেন কখনো ভূল না বোঝে।'
- 'সে আপনার প্রেমিকা হলেও আমার কিছু যায় আসেনা।'
- 'তাই নাকি? যদি প্রেমিকা হতো?'
- 'আপনার উপর ডিপেন্ড করতো সেটা। আপনি যদি বলতেন আপনি তার সাথেই থাকতে চান, আমি জায়গা ছেড়ে দিতাম।'
- 'হা হা হা।'

হো হো করে হেসে উঠলো মেঘালয়। হাসতেই লাগলো শব্দ করে। গাড়ির ড্রাইভার একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো ওর হাসি। প্রাণবন্ত হাসি হাসছে ছেলেটা। হাসি থামিয়ে বললো, 'তোমার মধ্যে অনেক গুণ আছে দেখছি।'
- 'থাক, আর বলতে হবেনা।'
- 'আমি টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম বিশ্বাস করো।'
- 'করলাম। একটা চুমু খাবো।'

কথাটা বলেই মিশু চোখ বন্ধ করে ঠোঁট এগিয়ে আনলো। মুচকি হেসে সেই ঠোঁট স্পর্শ করলো মেঘালয়। ঠোঁটে ঠোঁটেই শত না বলা কথা বলা হয়ে গেলো। 

হিমছড়িতে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে টিকেট কেটে নিলো। মিশু ঘুরেঘুরে আশেপাশের দোকানগুলো দেখছিলো। গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সোজা গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা আরম্ভ করতে হলো৷ লম্বা লম্বা শতাধিক সিঁড়ি। সব পেড়িয়ে সোজা পাহাড়ের উপর চলে যেতে হবে। দুজনেই হাত ধরাধরি করে ওঠা শুরু করে দিলো। কিছুদূর ওঠার পর ওড়নাটা মাথায় বেঁধে ফেললো মিশু। ওড়না দিয়েই টুপি বানিয়ে আবারও ওঠা শুরু করে দিলো। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না মেঘালয়ের। মুখটা বিকৃত করে বললো, 'নিচে নামো, আগে ক্যাপ কিনে নিয়ে আসি তারপর উপরে উঠবো।'

মিশু বাঁধা দিয়ে বললো, 'আরে না না। ক্যাপ লাগবে না আমার।'
- 'প্রচন্ড রোদ আজকে। একটা হ্যাট নিয়ে আসি? তুমি দাঁড়াও।'

মেঘালয় সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করতেই মিশু হাত ধরে আটকালো। বললো, 'লাগবে না। এতদূর কষ্ট করে আবার নিচে যাবেন? প্রয়োজন নেই। আজকে রোদ লাগলেও কিছু হবেনা।'
- 'মিশু, অনেক রোদ।'
- 'বললাম তো কিছু হবেনা।'
- 'তাহলে ওড়নাটা মাথায় বেঁধেছো কেন?'
- 'খারাপ লাগছে? খারাপ লাগলে খুলে ফেলি?'
- 'ভালো লাগছে না সিরিয়াসলি। খুলে ফেলো।'

মিশু ওড়না দিয়ে বানানো টুপিটা মাথা থেকে খুলে মাথায় ওড়না দিয়ে বললো, 'এবার ঠিক আছে?'

মেঘালয় কিছু বললো না। আবারও ওঠা শুরু করলো দুজনে। বেশ কিছুদূর ওঠার পর হঠাৎ মেঘালয় মিশুকে একটানে বুকে টেনে নিলো। আশেপাশে পাহাড়ের উপর চারিদিক একদম ফাঁকা। তবুও মিশু নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, 'বাইরে কাছাকাছি না আসলেও চলবে।'

মেঘালয় হতাশ হয়ে মিশুকে ছেড়ে দিয়ে বললো, 'তুমি বড্ড আনরোমান্টিক।'
- 'তাই? বাইরে পাবলিক প্লেসে ঢোলাঢুলি করাটাকে রোমান্টিকতা বলে? যদি তাই হয় তবে আমি সেরকম রোমান্টিক হতে চাইনা।'

মেঘালয় হেসে মিশুকে কোলে তুলে নিলো। কাজটা এত দ্রুত আর আচমকাই করে ফেললো যে মিশু থতমত খেয়ে গেলো। বাঁধা দেয়ার সুযোগ পেলো না। মেঘালয় কোলে তুলে নিয়ে অনায়াসে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। মিশুর লজ্জা লাগছে প্রচন্ড। এভাবে কোলে নিয়ে উপরে উঠছে, লোকজন কি বলবে?

চারিদিক একদম ফাঁকা। পাহাড়ের উপর তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে মেঘালয়। মিশু লজ্জায় চোখ বন্ধ করে আছে। হঠাৎ চোখ মেলে দেখলো চারিদিকে ঘন সবুজ! তারমানে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেছে! এত অনায়াসে কোলে নিয়ে লোকটা কিভাবে যে উঠলো? ছোট্ট পুতুলের মত করে কোলে নিয়ে উঠে এসেছে। পারেও বটে।

মিশুকে কোল থেকে নামানোর পর মাটিতে পা রাখলে একজন আর্মি এসে বললেন, 'ভালোই লাগছিলো দুজনকে।'

লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে মিশুর। মাথা নিচু করে তাকিয়ে রইলো পাহাড়ের দিকে। হঠাৎ মেঘালয় মিশুর চোখের উপর হাত রেখে সামনে এগিয়ে নিয়ে আসলো। এরপর চোখ থেকে হাত সরানো মাত্রই মিশুর চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড়। সামনে শুধুই আসমানী রঙের মেলা! পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্র দেখতে এত ভালো লাগে আগে জানতো না মিশু। সামনে বিশাল সমুদ্র আর বিশাল আকাশ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। দেখেই বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে যেন।

মিশু মুগ্ধ হয়ে বললো, 'এত্ত সুন্দর কেন! সমুদ্র আর আকাশটা আমার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে!'

কথাটা বলতে বলতে অজান্তেই মেঘালয়ের বুকের শার্ট খামচে ধরছিলো। মেঘালয় ধরে রইলো মিশুকে। পাহাড়ের উপর চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখার পর বসে পড়লো মাটিতে। সমুদ্র আর পাহাড়ের সাথে মন খুলে কথা চালিয়ে যেতে লাগলো মিশু। আর মেঘালয় উপভোগ করতে লাগলো মিশুর এই মুগ্ধতাকে!

পাহাড় থেকে নেমে এসে হিমছড়ি ঝরনায় চলে গেলো দুজনে। ঝরনাকে যতটা বড় হবে ভেবেছিলো ততটা নয় দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো মিশুর। তবুও দুজনে কিছুক্ষণ ঝরনার নিচে বসে হিমশীতল জলে গোসল করে নিলো। গোসলের সময়ে জড়িয়ে রইলো একে অপরকে। আর বারবার হাসছিলো শব্দ করে। দুজনেই সদ্য প্রেমে পড়া দুজন প্রেমিক প্রেমিকার মতো উচ্ছ্বল হয়ে উঠছে ক্রমশই। দুজনের একজনও কল্পনাও করতে পারেনি সামনে কত দুঃসময় অপেক্ষা করছে ওদের জন্য! 

৪২!! 

হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে আছে ওরা। মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জাপটে ধরে রেখেছে মিশু। সূর্যাস্ত দেখতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে মনে মনে। কিন্তু একদমই উঠতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে এভাবেই একটা জীবন কাটিয়ে দিই। 

মেঘালয় বললো, 'আমাদের চব্বিশ ঘন্টার প্রোগ্রাম কার্যকর করা হবে কবে থেকে?'

মিশু মেঘালয়কে আরো জোরে জাপটে ধরে বললো, 'এখনই? আমার লজ্জা করে।'
- 'আহারে, বলতে লজ্জা করেনি?'
বলেই হেসে উঠলো শব্দ করে। মিশু মেঘালয়ের মুখের উপর মুখটা এনে দুহাতে ওর মাথাটা চেপে ধরলো। মুখটা একদম কাছে এগিয়ে নিয়ে এসেছে তখনই বেজে উঠলো ফোনটা। 

মেঘালয় বিরক্ত হয়ে ফোনটা নিয়ে সাইলেন্ট করতে যাবে এমন সময় খেয়াল করে দেখলো বাবা ফোন করেছে। একবার মিশুর দিকে তাকিয়ে অনেকটা কৌতুহল বশত মেঘালয় ফোন রিসিভ করলো। বাবার সাথে কথা হয়না প্রায় এক সপ্তাহ। আর তাছাড়া মৌনি বিয়ের ব্যাপারে কতটুকু বলে দিয়েছে কে জানে!

মেঘালয়ের কণ্ঠ শুনেই বাবা বললেন, 'কোথায় আছো?'
- 'হুম আব্বু। কেমন আছো?'

বাবা অনেকটা রাগী গলায় বললেন, 'কোথায় আছো জানতে চেয়েছি?'
- 'কক্সবাজারে।'
- 'ওকে। সেখানেই থাকো। আর কখনও বাসায় এসো না। ফোন করবে কি না জানিনা, তবে দয়া করে আমাকে ফোন দিও না কখনও।'

মেঘালয়কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বাবা ফোন কেটে দিলেন। কথাটা কেন বললেন আর বাবা কতটুকুই বা জেনেছেন কিছুই বুঝতে পারছে না মেঘালয়। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো বিছানায়। কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ। দুঃসময় পিছু ছাড়তে চাইছে না কিছুতেই। আগামীতে কি হবে ভেবেই শিউরে উঠলো মিশু!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp