অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ৯১ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ৯১
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
অতীত~

আমের ভিলায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বাজল প্রিয়তার। বসার ঘরে আসতেই অনুভব করল কেউ আছে রান্নাঘরে। শপিং ব্যাগগুলো সোফায় রেখে সোজা রান্নাঘরেই গেল ও। গিয়ে দেখল পাকোড়ার জন্যে মিশ্রণ বানাচ্ছে জ্যোতি। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকাল জ্যোতি। প্রিয়তাকে দেখে মুচকি হাসল। পুনরায় নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে বলল, 'দেরী হল যে?'

উত্তরে প্রিয়তাও চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলল, 'কুহুর জন্যে একটা স্যালোয়ার স্যুট কিনলাম বুঝলে। কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিলোনা। অনেক খুঁজে অবশেষে পেলাম। ওনাকে আবার বলোনা আমার দেরী হয়েছিল। পরে আবার ক্ষেপে যাবে।'

জ্যোতি হেসে ফেলল, ' আচ্ছা বলবোনা।'

' নীরব-কুহু চলে এসেছে?'

' হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগেই এলো। ভাবলাম তোমারও আসার সময় হয়ে এসছে। তাই একটু স্ন্যাকস বানাই। সবাই মিলে একসঙ্গে খেতে পারব। পরে ধীরেসুস্থে রাতের রান্নাটা করা যাবে।'

ওড়নাটা কোণাকুণি করে কোমরে বেঁধে নিল প্রিয়তা। প্যানটা চুলায় বসিয়ে গ্যাস অন করতে করতে বলল, ' তোমার না মাথাব্যথা করছিল? সে নিয়ে এসব করতে এলে কেন? নার্গিস খালা নেই?'

জেনেশুনেই অতি চতুরতার সাথে প্রশ্নটা করল প্রিয়তা। জ্যোতি ঠোঁট উল্টে বলল, 'কী জানি! ঘুম থেকে উঠে আর দেখতে পেলাম নাতো।'

' ওমা! সন্ধ্যা সন্ধ্যা কোথায় গেছে?'

' কী জানি! দেখো কোথায় গিয়ে আড্ডা জুড়ে দিয়েছে! গসিপিংয়েতো ওস্তাদ ঐ মহিলা। কখনও এর কাছে ওর নামে নিন্দা, ওর কাছে এর নামে নিন্দা। অসহ্য!'

প্যানে তেল ঢালল প্রিয়তা। আঁচ বাড়িয়ে দিতে বলল, 'আর করবেনা!'

ভ্রু কুঁচকে ফেলল জ্যোতি। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, 'কী করবেনা?'

' ভরসন্ধ্যায় গসিপিং। আজ এলে কড়াভাবে নিষেধ করে দেব।'

ফোঁস করে শ্বাস ফেলে আবার কাজে মন দিল জ্যোতি। ফুটতে শুরু করা তেলের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসল প্রিয়তা। জ্যোতি বলল, 'তুমি আবার রান্নাঘরে কেন এলে? যাও ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও।'

' দূর! ঘরে গিয়ে কী করব? এখানেই ঠিক আছি। তোমার মাথাব্যথা কমেছে?'

' হ্যাঁ ঘুমোনোর পরেই কমে গেছে।'

' ব্যাংকে একা গিয়ে কিন্তু ঠিক করোনি তুমি। এখন থেকে গেলে সঙ্গে সাথে লোক নিয়ে যাবে। ঐরকম মাথাব্যথা নিয়ে একা ফিরেছো!'

' একা ফিরিনিতো! আজাদ ভাই পৌঁছে দিয়ে গেছে।'

' আজাত ভাই? তোমার কলিগ? বলেছিলে যে?'

' হ্যাঁ উনিই।'

পাকোড়ার শেপ করে করে ট্রেতে রাখল জ্যোতি। সেগুলো একটা একটা গরম তেলে ছাড়ছে প্রিয়তা। হঠাৎ প্রিয়তা বলে উঠল, 'আজাদ ভাই সম্পর্কে যতটা শুনেছি তোমার কাছে; উনি কিন্তু খুবই ভালো মানুষ। এবার কিন্তু তুমি ভেবে দেখতেই পারো আপু।'

হাত থেমে গেল জ্যোতির। পাকোড়ার মিশ্রণের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ' সবকিছু কী এভাবে হয়?'

' না হওয়ার কী আছে? এভাবে আর কতদিন?'

' এভাবেইতো ভালো আছি বলো।'

' সত্যিই ভালো আছো?'

' অন্যকে জীবনে জড়িয়ে তাকেসহ খারাপ থাকার চেয়ে একা একাই খারাপ থাকাটা ভালো নয় কী?'

উত্তর দিলোনা প্রিয়তা। আবার পাকোড়া ভাজায় মনোযোগ দিল। জ্যোতিও নিজের কাজে মনোযোগ দিল। পরিবেশটা কেমন গুমোট হয়ে উঠল। নিস্তব্ধ পরিবেশে শুধু তেলে ভাজার আওয়াজ। স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে জ্যোতি সামান্য কৌতুক করে বলল, ' কী ব্যপার বলোতো? আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্যে এতো উঠে পড়ে লেগেছো যে? বরকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করছো? ভাবছো সঙ্গীহীনতায় তোমার বরকে দুবেলা গিলে খাই?'

হেসে ফেলল প্রিয়তা, ' হ্যাঁ সেই। অমন চকলেট কেকের মতো বর থাকলেতো একটু ইনসিকিওর ফিল হবেই বলো।'

জ্যোতিও সমানতালে হাসল। সেই হাসির আড়ালে চাপা পড়ে গেল গভীর দীর্ঘশ্বাস, নির্ঘুম একেকটা রাতের চাপা আর্তনাদ; জীবনের প্রথম অনুভূতি, প্রথম আবেগ, প্রথম ভালোবাসার নিষ্ঠুর ব্যর্থতা। 
জ্যোতির দৃষ্টি সরতেই ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল প্রিয়তার। চোখে ভেসে উঠল চাপা ক্রোধ। পাতলা কমলা রঙা ঠোঁটজোড়া কঠিন শক্ত হয়ে জোড়া লেগে রইল। ফুটতে থাকা গরম তেলের মধ্যে স্ট্রাচুলা নাড়তে লাগল উদ্দেশ্যহীনভাবে। রুদ্রর প্রতি জ্যোতির এমন গদগদ প্রেম কোনকালেই পছন্দ ছিলোনা প্রিয়তার। এই মেয়েটা ওর শ্যামপুরুষকে দেখে মুগ্ধ হয়, তাকে দেখলে ওর হৃদস্পন্দন থমকে যায়, আড়ালে আবডালে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে ওর প্রিয় পুরুষের চোখ, মুখ, ঠোঁট, চুল, শরীরের প্রতিটা চলন। ব্যপারটা সহ্য হয়না প্রিয়তার। কোনভাবেই সহ্য হয়না। যখনই জ্যোতির চোখে ও রুদ্রর জন্যে অপার ভালোবাসা দেখে; ইচ্ছে হয় চোখদুটো তুলে ফেলতে। যখন জ্যোতির কন্ঠে রুদ্রর প্রতি প্রেম ঝড়ে পড়ে; ইচ্ছে করে ওর গলাটা টি-পে দিতে। কতটা কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে তা কেবল প্রিয়তাই জানে।
রুদ্র আমের শুধুই প্রিয়র। তাকে অমন প্রেম নিয়ে দেখার অধিকার শুধুমাত্র প্রিয়তারই আছে। তাকে ভালোবাসার অধিকারটাও কেবলই প্রিয়তার। সে অধিকারে একাংশও অন্যকাউকে দিতে রাজি নয় প্রিয়তা। একদমই না।

স্ট্রুচুলাটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল প্রিয়তা। দাঁতে দাঁত পিষল। ইচ্ছে হল এই গরম তেলেই জ্যোতিকে ঝলসে দিতে। কিন্তু সেটা ও করবে না। তারও বহু কারণ আছে। গত দুবছর যাবত নিজের ধৈর্য্যশক্তির সর্বোচ্চ পরীক্ষাটা বোধ হয় প্রিয়তা এক্ষেত্রেই দিয়েছে।

-

' আরও একজন ডোনার আজ মারা গেছে। এই নিয়ে তিনজন! সবাই বলছে হার্ট অ‍্যাটাক। আমারতো ভিন্ন কিছু মনে হচ্ছে গুরু!'

কথাটা বলে ঠোঁট কামড়ে ধরল উচ্ছ্বাস। ফাইল থেকে চোখ তুলে তাকাল জাফর। গম্ভীর কন্ঠে বলল, 'মনে হওয়ার কিছু নেই। ইটস্ কোল্ড ব্লডেট মার্ডার!'

উচ্ছ্বাস বলল, ' আবার সেই একই খেলা খেলা হচ্ছে। আমাদের ভেতরকার ইনফরমেশনগুলো লিক হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে? এতো বেশি গোপন তথ্য কেউ কীভাবে_'

কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই থমকে গেল উচ্ছ্বাস। ঝট করে রুদ্রর দিকে তাকাল। হোলস্টারে মাইক্রোফোন রাখার তাৎপর্য আজ সম্পূর্ণ পরিষ্কার হল ওর চোখে। রুদ্রর প্রতি জমে থাকা অবশিষ্ট অভিমানটুকুও আর রইল না।
জাফরের কন্ঠে বিচলিত ভাব চলে এলো এবার। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, 'ব্যপারটা ভয়ংকর রুদ্র। সময় বেশি নেই আমাদের হাতে। এখনো কয়েক কোটি টাকা জোগাড় করা বাকি! ওরা আর কল দেয়নি ঠিকই। কিন্তু ডেডলাইনের একদিনও বেশি সময় ওরা অপেক্ষা করবেনা। লোক পাঠিয়ে দেবে বাংলাদেশে। আমি আমাদের কথা ভাবছিনা। কিন্তু কুহু মা, প্রিয়তা মা, নীরব ওদের কথা ভাবতে হবে। ওদের জীবন বিপন্ন হবে এসবের মধ্যে।'

রুদ্র চেয়ারে হেলান দিয়ে পায়ে পা তুলে বসে আছে। গম্ভীর শূণ্য দৃষ্টি। সিগারেট টানছে ধীরগতিতে। ওদের কথা শুনছে কি শুনছে না বোঝা মুশকিল। টাকার হিসেবে চোখ বুলিয়ে নিয়ে উচ্ছ্বাস আবার বলল, 'দুটো দল বেশি চাপ দিচ্ছে। ওদের ডেডলাইনটাও খুব কাছে। আমার মাথা কাজ করছেনা!'

এরপর নীরবতা নেমে এলো আমের ফাউন্ডেশনের রাশেদ আমেরের ঘরটাতে। কারো মুখে কোন কথা নেই। ঘন একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে হঠাৎই রুদ্র বলে উঠল, 'আমের মিলস্ আর ছাপাখানাটাগুলো সেল করে দাও!'

নীরব ঘরটাতে যেন বজ্রপাত হল। একই সঙ্গে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল উচ্ছ্বাস আর জাফর। কিছুক্ষণ একটা শব্দও বের হলোনা দুজনের কারো মুখ দিয়ে। অনেকটা কষ্টে জাফর বলল, ' তোর মাথা ঠিক আছে?'

' এছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পাচ্ছো তুমি কাকা?'

জবাব দিতে পারল না জাফর। সত্যিই কোন পথ পাচ্ছেনা ওরা এখন। যাদেরকে চাঁদার জন্যে রেডমার্ক করেছে তাদের তিনজনের কেউ গায়েব হয়েছে, কেউ খুন হয়েছে। বাকিদের কাছ থেকে যা টাকা তুলতে পেরেছে তাতে টার্গেট ফিল আপ হচ্ছেনা কিছুতেই। ক্লাইন্টদের কাছ থেকেও আশা করা এখন নিরাশা। সমানে প্রেশার দিয়ে যাচ্ছে হুসাইন আলী। এদিকে ক্ষেপে উঠেছে বিদেশী পাওয়ানাদার তিনটে দলই। যাদের মধ্যে দু'দলের ডেডলাইন খুবই কাছে। সত্যিই আর উপায় নেই। জাফর বিষণ্ন গলায় বলল, 'ভাইজানের এতো যত্নে তিলতিল করে তৈরী করা মিলস্ আর ছাপাখানা বেঁচে দিতে হবে! স্বপ্নেও কোনদিন কল্পণা করিনি এমন কিছু ভাবতেও হবে! হে আল্লাহ্!'

রুদ্রর ধীরগতিতে একবার চাইল রাশেদ আমেরের শূণ্য চেয়ারটার দিকে। একমুহূর্তের জন্যে মনে হল ওখানেই বসে আছে বাবা। সিগারেটে দক্ষ টান দিয়ে গম্ভীরভাবে ভেবে চলেছে কিছু একটা। এক্ষুনি অসাধারণ কোন সমাধান বলে বসবে লোকটা। বুকের ভেতরটা কেমন খা খা করে উঠল রুদ্রর। অদ্ভুত যন্ত্রণায় সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।
উচ্ছ্বাস এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা রুদ্রর মুখ থেকে এই কথা শুনলো ও। রুদ্রর মুখ থেকে? ও কন্ঠে রাজ্যের অবিশ্বাস ঢেলে বলল, ' তুই ভেবে বলছিস?'

রুদ্র আধখাওয়া সিগারেটটা অ‍্যাশট্রেতে পিষতে পিষতে বলল, 'হটকারী কোন সিদ্ধান্ত নেইনা আমি।'

কথা সত্যি। কিন্তু তবুও মেনে নিতে পারছেনা উচ্ছ্বাস। এই দলটার জন্যে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েছে ছেলেটা। নিজের জীবন, ভালোবাসা সব। অস্থির গলায় বলল, 'আর কোন উপায় নেই? আমরাতো পরিকল্পনা করেছিলাম ডেলিভারির সময় ওদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেব আমরা। ঠিক একইভাবে। তার কী হলো? সে নিয়ে ভাবলে হয়না? সেইসব অস্ত্র বেঁচেওতো_'

থামতে হলো উচ্ছ্বাসকে। বাক্য সম্পূর্ণ করার মতো শব্দ খুঁজে পেলোনা ও। জাফরও সম্মতি দিয়ে বলল, ' ঐ বিষয়ে কী ভাবলি।'

রুদ্র নির্বিকারভাবে বলল, ' সেটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যপার। অতোটা সময় দেবেনা ওরা আমাদের। তাই আর কোন উপায় নেই। আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আর বিন্দুমাত্র রিস্ক নিতে পারব না আমি। যথেষ্ট হয়েছে।

রুদ্রর কথা যৌক্তিক। কিন্তু অস্থির বোধ করল ওরা। উচ্ছ্বাস বলল, ' কিন্তু রিস্কতো থেকেই যাচ্ছে। দুটো দলের টাকা পরিশোধ করে দিলেও; ব্রানধুইস দলের টাকা পরিশোধ করা কিন্তু বাকি থাকবে। ওরা তেমন চাপ দিচ্ছেনা ঠিকই। কিন্তু যখন দেবে শ্বাস নেওয়ার সময়টাও দেবেনা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দল কিন্তু ওটাই।'

রুদ্র এবারও নির্বিঘ্ন জবাব দিল, ' সেটা নিয়ে ভেবে এখনই মাথা নষ্ট করতে চাইছিনা আমি। যখনকারটা তখন দেখা যাবে। আপাতত এই দুটো ঝামেলা মেটানো প্রয়োজন। তাছাড়াও! এসব মিটে গেলে সোলার সিস্টেমের অস্তিত্ব এমনিতেই বিলীন করে দেব আমি। ছেড়ে দেব এসব। তখন আ এসব লোক দেখনো মিলস্, ফ্যাক্টরির প্রয়োজন পড়বেনা। আর পরবর্তীতে যদি ব্রানধুইসকে সামলাতে না পারি তবে_'

' তবে?'

' ছেড়ে দেব আমের ভিলা। সমাধান পাওয়ার আগ অবধি গা ঢাকা দিয়ে থাকব। আর বাড়ির বাকিদের মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেব। কাকীর কাছে।'

রুদ্রর এধরণের কথাবার্তায় চমকাতেও ভুলে গেল উচ্ছ্বাস আর জাফর। এবার থমথমে গলায় বলল, ' আর ওদের? ছেড়ে দিবি?'

জবাব দিলোনা রুদ্র। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ফেলল। উচ্ছ্বাসের কন্ঠ আরও ভারী হলো, 'তোকে দেখে আমার রুদ্র আমের বলে মনে হচ্ছেনা। এতক্ষণ ধরে দেখে চলেছি। ইন্সপেক্টর আজিজের মতো আমিও আমার চেনা সেই রুদ্রকে দেখতে পাচ্ছিনা তোর মধ্যে।'

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। জাফরের চোখেমুখেও স্পষ্ট হতাশার ছাপ। আরও একবার পিনপতন নীরবতা নেমে এলো ঘরটাতে। সময়চক্রের এমন অদ্ভুত পরিবর্তন কিছুতেই মেনে নিতে পারল না ওরা। একটা সময় ছিল, এই সোলার সিস্টেম নামটাই যথেষ্ট ছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডকে কাঁপিয়ে তোলার জন্যে। সেখানে রাশেদ আমের ছিলেন রাজা। আর রুদ্র আমের? সে ছিল ভয় আর আতঙ্কের অন্যনাম! কিন্তু আজ সেই সোলার সিস্টেম ধ্বংসের পথে। রাশেদ আমের আর নেই। চেনা সেই রুদ্র আমেরকেও বড্ড অচেনা লাগছে! বহু খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছেনা সেই তেজ! যেই ধূর্ত মস্তিষ্কের অসাধারণ সব চালে ধরাসাই হয়ে যেতো শত্রুদল। সেই রুদ্র আমের আজ পরাজিত সৈনিকের ন্যয় আচরণ করছে। দিয়ে দাও, সব দিয়ে দাও! কোনদিন যা হয়নি যেন সেটাই হয়েছে আজ। হার মেনে নিয়েছে রুদ্র আমের। আর কোন আশা অবশিষ্ট নেই। শেষ, সত্যিই সবকিছু শেষ।

-

চট্টগ্রাম এসেছে সম্রাট। পরবর্তী মাল ডেলিভারির ডেইট নিকটে। সেসব নিয়েই কিছু কাজ চলছে। ঢাকায় সকালের মিটিংটাতে আরও একটা বিষয় নির্ধারিত হয়েছে। হুসাইন আলীকে হাত করতে হবে এবার। যেহুতু সোলার সিস্টেম তার সঙ্গে করা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তাকে তাতিয়ে দিয়ে নিজেদের দলে টেনে নেওয়ার কাজটা সহজ হবে। এবং এই কাজটা করবে রাণী। মাইক্রোফোনের মাধ্যমে রাণী জানতে পেরেছে আগামীকাল সন্ধ্যায় হুসাইন আলীর কাছে যাবে রুদ্র। কিন্তু তার আগেই ওদের যেতে হবে। আর সেই কাজটাও নিজেই করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাণী। কাল সকালেই হুসাইন আলীর কাছে যাবে রাণী। সোলার সিস্টেমের ধ্বংসের কফিনে শেষ পেরেগটা মেরেই আসবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। এই মেয়ে যতই তেরিংবেরিং করুক। কোন কাজ একবার করবে বললে সেটা যেকোন মূল্যে করেই।

হোটেলের ব্যালকনি দাঁড়িয়ে থাকায় তীব্র ঠান্ডা বাতাস লাগছে। খালি গায়ে শুধু ট্রাউজার পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সম্রাট। ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। রাণীর কথা আরও গভীরভাবে ভাবছে। মেয়েটা মাথা খারাপ করে রেখে দিয়েছে ওর। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেনা। আগেও কখনও পারেনি। কিন্তু তখন ও জানতো রাণী শুধুই ওর। কিন্তু এখন সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনা ও। রাণী কী সত্যিই এখন ওর?

বিট্রেনে থাকাকালীন এক রাতের কথা মনে পড়ল সম্রাটের। নাইট ক্লাবের দীর্ঘ পার্টি নাচানাচি, আনন্দ ফুর্তির পর মাতাল হয়ে কাউচে পড়ে ছিল দুজন। সম্রাট নিজের এক বাহুতে আবদ্ধ করে রেখেছিল রাণীকে। মাতাল অবস্থাতেই টুকটাক কথাবার্তা চলছিল দুজনের মধ্যে। প্রেম শুরু হলেও তখনও খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়নি ওদের মধ্যে। প্রথমবারের মতোই রাণীর ঠোঁটে চুমু খেতে যাচ্ছিল সম্রাট। কিন্তু বাঁধা দেয় রাণী। মাতাল কিন্তু স্পষ্ট আওয়াজে জানায়, 'নট নাও!'

বিস্মিত সম্রাট প্রশ্ন ছোড়ে, 'কেন? আই নিড দিস।' 

বলে এগোতে নিলে আবারও বাঁধা দেয় রাণী। শক্ত কন্ঠে জানায়, 'নো মিনস্ নো সম্রাট।'

' কারণটা জানতে পারি?'

' এতো সহজেই আমাকে ছোঁয়ার অধিকার কাউকে দেইনা আমি। তার জন্যে আরও অনেক সাধনা করতে হবে তোমাকে।'

সেদিনের কথাটা ভেবে তাচ্ছিল্য করে হাসে সম্রাট। সাধনা! অথচ রুদ্রর কাছে কত সহজেই বিলিয়ে দিয়েছে নিজেকে! কথাটা চিন্তা করে তীব্র শীতেও গা গরম হয়ে উঠল সম্রাটের। র-ক্ত যেন ফুটে উঠল টগবগ করে। তিরতির করে রাগ বাড়ল। অসহ্য লাগল সবকিছু।

ঠিক সেসময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক অর্ধন-গ্ন রমনী। কিছুক্ষণ আগে হোটেলের রুমটাতে মেয়েটাকে নিয়ে মৌজমস্তি করছিল সম্রাট। মেয়েটা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল সম্রাটকে। প্রলুব্ধ করা স্পর্শ দিতে শুরু করল ওকে। কিন্তু এখন আর এসবের রুচি পেলোনা সম্রাট। ধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। তিক্ত কন্ঠে বলল, 'টি-টেবিলে তোর টাকা রাখা আছে। নিয়ে বিদায় হ।'

অপমানে কালো হয়ে উঠল রমনীর মুখ। ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে একবার চাইল সম্রাটের দিকে। ধপধপ করে পা ফেলে বিদায় নিল।
সেসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই সম্রাটের। মাথায় শুধু একটা নাম ঘুরছে। রাণী! রাণী! রাণী!

-

আজ বাড়ি ফিরতে খুব বেশি দেরী করলোনা রুদ্র। এগারোটার মধ্যে ফিরে এলো। রুদ্র যখন ঘরে ঢুকল প্রিয়তা তখন ওয়াশরুমে। বন্ধ ওয়াশরুমের দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে থেকেই জ্যাকেটটা খুলল রুদ্র। তখনই বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। রুদ্রকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। রুদ্র জ্যাকেটা খাটের ওপর ছুড়ে রাখল। বিছানায় বসে মোজা খুলতে শুরু করল। কিন্তু কিছু বলল না। প্রিয়তা হাতের তোয়ালেটা পাশে রেখে দিয়ে বলল, ' কখন এলেন?'

' মাত্রই।' এককথায় জবাব দিল রুদ্র।

' খেয়ে এসেছেন?'

' হ্যাঁ। টেক্সট করেছিলাম। দেখোনি?'

' দেখেছি।'

' খেয়েছো?'

' হ্যাঁ। কফি আনব? খাবেন?'

' না, ক্লান্ত লাগছে আজ। শুয়ে পড়ব।'

প্রিয়তা রুদ্রর জ্যাকেট আর মোজা জায়গামতো তুলে রাখল। রুদ্রও উঠে গেল ড্রেসিংটেবিলের কাছে। হাতের ব্রেসলেটটা খুলে রাখল। প্রিয়তা একটা ট্রাউজার আর স্যান্ডো গ্যাঞ্জি এগিয়ে দিল রুদ্রর দিকে। সেগুলো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল রুদ্র। কিছু বলল না।

বিছানায় বসল প্রিয়তা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওয়াশরুমের দরজার দিকে।

পাঁচমিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে এলো রুদ্র। গিয়ে বন্ধ করল বারান্দার দরজাটা। বিছানায় উঠে কম্ফোর্টার গায়ে নিতে নিতে বলল, ' রাত হয়েছে। শুয়ে পরো।'

ঘাড় ফিরিয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল প্রিয়তা। কম্বোর্টারের বাকি অংশটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ল। হঠাৎই পিনপতন নীরবতা ঘিরে ধরল ঘরটাকে। রুদ্র-প্রিয়তা দুজনেই সোজা হয়ে শুয়ে আছে দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে স্থির। সময় কেটে যাচ্ছিল এভাবেই। একমিনিট, দুইমিনিট করে করে দশমিনিট কেটে গেল। ঘুরল প্রিয়তা। রুদ্রর দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আলতো গলায় ডাকল, 'রুদ্র?'

' বলো?'

প্রিয়তা মাথা তুলে একপলক তাকাল রুদ্রর দিক। অতঃপর রুদ্রর বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল, ' অনেকদিন হলো কাছে টানেন না আপনি আমাকে। ভালোও বাসেন না।'

রুদ্র এক হাতে প্রিয়তার চুলগুলো নেড়ে দিতে দিতে বলল, 'তোমারতো সেরকমই চাওয়া ছিল।'

' চাওয়া বদলের কথাতো আপনাকে অনেকবার, অনেকভাবে বুঝিয়েছি আমি।'

' ঘুমাও!'

কিন্তু প্রিয়তা ঘুমোনোর চেষ্টাও করল না। মাথা তুলে উঁচু হল। চুমু খেল রুদ্রর গালে। আলতো করে মাথায় হাত বুলাল। রুদ্র আবারও গম্ভীর বলল, 'ঘুমিয়ে পড়ো, রাত হয়েছে অনেক।'

রুদ্রর কথা কানে তুলল না প্রিয়তা। আলতো করে নাক ঘষতে শুরু করল রুদ্রর বুকে। প্রথমে কিছুক্ষণ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না রুদ্র। কিন্তু প্রিয়তার বেসামাল স্পর্শ বেশিক্ষণ স্থির থাকতে দিলোনা ওকে। রুদ্র প্রিয়তার দু বাহু আকড়ে ধরল। উল্টো ঘুরিয়ে শুইয়ে দিলো ওকে। প্রিয়তার দুপাশে দুহাতের ভর দিয়ে ঝুঁকল। ঘন ঘন শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। অস্থির চোখে তাকাল রুদ্রর চোখে। রুদ্রর তীক্ষ্ম চোখদুটোও প্রিয়তার চোখের দিকে স্থির। বেশ অনেকটা সময় ধরেই চলল এই দৃষ্টি বিনিময়। রুদ্র নিজের তামাটে, শুস্ক ঠোঁটজোড়া এগিয়ে আনলো প্রিয়তার ভেজা, কমলাটে ঠোঁটের দিকে। রুদ্র যখন প্রিয়তার অধরোষ্ঠ স্পর্শের খুব সন্নিকটে; চোখজোড়া ধীরগতিতে বন্ধ করে নিল প্রিয়তা। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই নিজেকে থামিয়ে ফেলল রুদ্র। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকাল প্রিয়তা। দুচোখে প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর দিলোনা রুদ্র। সরে আসতে নিল। দুহাতে ওর গেঞ্জিটা আকড়ে ধরল প্রিয়তা। বিস্মিত কন্ঠে বলল, ' কী হলো?'

' কিছুদিন আগেই তোমার মিসক্যারেজ হয়েছে। তাও খুব বাজেভাবে। ইউ নিড টাইম।'

' কিচ্ছু হবেনা। আমি ঠিক আছি।'

' সেটা তোমার মনে হচ্ছে। ঘুমাও।'

রুদ্র সরে আসতে চাইলে আরও শক্ত করে ওকে আকড়ে ধরল প্রিয়তা। আকুতিভরা কন্ঠে বলল, 'প্লিজ রুদ্র।'

' বাচ্চামো করোনা। ঘুমাও!' 

' রুদ্র!'

এবার খানিকটা ধমকে উঠল রুদ্র, ' আমার কাছে তোমার জেদ সবক্ষেত্রে খাটেনা প্রিয়তা। এর প্রমাণ তুমি আগেও পেয়েছো। রাত হয়েছে। ঘুমাও!'

অনেকেটা জোর করেই প্রিয়তার হাত নিজের গেঞ্জি থেকে সরাল রুদ্র। উঠে বসল হাত বাড়িয়ে তুলে নিল ফুলহাতা একটা গেঞ্জি। হনহনে পায়ে বেরিয়ে গেল নিজের রুম থেকে।ও জানে প্রিয়তা এখন কাঁদবে। সেই কান্না দেখার ধৈর্য্য বা ইচ্ছা কোনটাই নেই রুদ্রর।
প্রিয়তা নড়ল না। ঠিক ওভাবেই শুয়ে রইল বিছানা চোখদিয়ে গড়িয়ে পড়ল দু ফোঁটা জল।

ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা সেই স্টোররুমটাতে এলো রুদ্র। অস্থিরভাবে পায়চারী করল ঘরজুড়ে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। পারলে সবকিছু এক্ষুনি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিতো ও। ভেতর জমা তীব্র ক্ষোভ, যন্ত্রণা, হাহাকার যেন দাবানল হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রচন্ড রাগে টেবিলটাই ধাক্কা দিয়ে ফেলি দিল ও। তক্ষুনি নিচে পরল ছোট্ট দোলনাটা। নিজের অনাগত সন্তানের জন্যে অনেক শখ করে কিনেছিল রুদ্র। এতো, বিষাদ এতো যন্ত্রণার মাঝেও ঐসময় এই দোলনাটাই অবর্ণণীয় এক সুখ দিতো ওকে। নিজের অংশের আগমনের শীতলতা শান্ত করতো ওর অশান্ত হৃদয়কে। কিন্তু ওদের সন্তানের মৃত্যুর পর এটার জায়গা হয়েছে এই স্টোররুমের বড় টেবিলটাল ওপর।

হাঁটু ভেঙ্গে বসল রুদ্র। দুহাতে সোজাকরে বসাল দোলনাটা। আলতো করে হাত বুলিয়ে তাকিয়ে রইল ওটার দিকে। ছলছল করে উঠল রুদ্রর চোখ। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর হলো হৃদয়। ভেতরটা যেন ঝলসে গেল। কম্পিত কন্ঠে বলল, 'তোকে বাঁচাতে পারিনি আমি। এতো সুন্দর পৃথিবীটা তোর বাবা তোকে দেখাতে পারেনি সোনা। ক্ষমা করিস না। তোর এই ব্যর্থ বাবাকে কোনদিন ক্ষমা করিস না।'
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন