বন্য প্রণয় - পর্ব ০৩ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


" তাহমি আসলে আমরা কিছু জানতাম না। জানলে এভাবে হুট করে বিয়েটা হতো না। যাইহোক, আমি সহনের সামনে কথা বলবো।"
" দরকার নেই। আমি আর সময় মিলে সবকিছুই ঠিক করে নিবো। আপাতত তুমি নাস্তা দাওও ক্ষুধা লেগেছে খুউব।"
আহ্লাদী স্বরে কথাগুলো বলেই একটা চেয়ার টেনে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলো তাহমি। ফরিদা খানও একেবারে আদর্শ শ্বাশুড়ির মতো ছেলের বউয়ের সামনে নাস্তা পরিবেশন করে দিলেন। 
" খেয়ে নে তাহলে। "
" উঁহু সবাই একসাথেই খাবো। তোমার ছেলে তো আসছে গোসল সেড়ে, আঙ্কেল এখনও ঘুমিয়ে? "
" না,উঠেছে। এখুনি হয়তো চলে আসবে। অফিস আছে তো। শোন তাহমি আঙ্কেল বলে ডাকবি না একদম। আব্বু বলে ডাকবি ঠিক আছে? "
" ওকে মামুনি ঠিক্কাচ্চে। "
" তুই আর বড়ো হলি না তাহমি। আগের মতোই পাগলাটে রয়ে গেলি!"
তাহমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন সহনের মা। তাহমি কখনো চায়নি ব্যক্তিত্বের অজুহাত দিয়ে প্রিয়জনের সামনেও নিজেকে গুটিয়ে রাখতে। ওসব বাইরের লোকজনের সামনে ঠিক আছে। বাঁচবে কয়দিন? কী লাভ এতো গম্ভীর হয়ে?

ঘড়িতে সময় রাত তিনটা বেজে ত্রিশ মিনিট। ফোনের এলার্মের শব্দে ঘুমে যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটছে আয়ানের। আজকে প্রথম রমজান বলে একটু আগেভাগেই উঠার জন্য সময় বাড়িয়ে এলার্ম সেট করেছিল সে। কিন্তু ঘুম চোখে কিছুই খেয়াল থাকে না আয়ানের। তাই এলার্ম বন্ধ করে ফোনটা বালিশের নিচে ঢুকিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো সে। কিন্তু না সেটা আর হলো না। মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো আয়ানের। রমজান এলেই মায়েরা এমন করেই সন্তানের ডেকে দেন। রাতে দরজা খুলে রেখেই ঘুমায় আয়ান। তাই ঘরে ঢুকতে কোনো প্রকার বেগ পেতে হলো না আমেনা ইসলামের।
" আয়ান! আয়ান ওঠ সেহেরির সময় হয়ে গেছে। আয়ান?"
আয়ান না ঘুমিয়েও বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুমকাতুরে ভান করে বললো,
" মা আরেকটু পরে উঠি? তোমরা খাও গিয়ে। "
" অলরেডি চারটা বাজবে প্রায়। তুই এই কথা বলতে বলতে পাঁচটা বাজিয়ে ফেলবি তবুও তোর আরেকটু পর আর হবে না বাপ। তুই এখুনি ওঠ নয়তো তৃষাকে এখানে পাঠিয়ে দিবো। ও আসলে তোর চুল টেনে ওঠাবে। "
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো আয়ান। তৃষা আসলে আবার মারামারি করবে। তারচে মায়ের কথামতো উঠলেই ভালো হবে। 
" না মা। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি এখুনি। ওই শাঁকচুন্নিকে আর পাঠাতে হবে না। "
" ঠিক আছে। "
ছেলেকে ডেকে দিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে চেয়ার টেনে বসলেন আমেনা ইসলাম। আয়ানের বাবা ব্যাবসার কাজে রাজশাহী গেছেন তিন দিন আগে। সেখানেই থাকবেন আরো দু'দিন। তাই আপাতত দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়েই রমাদানের প্রথম সেহরি সম্পন্ন করবেন আমেনা। গতবছরও বড়ো মেয়েটা সেহরির সময় সাথে সাথে কাজকর্ম করেছিল, একসাথে খেয়েছিল। এ বছর সে তার শ্বশুর বাড়ি! চোখ দু'টো ঝাপসা হয়ে এলো আমেনার। হাতের পিঠ দিয়ে দু-চোখ মুছে সহসাই মেয়ের নম্বরে ডায়াল করলেন। বার দুয়েক আওয়াজ হতেই কল রিসিভ করলো তাহমি। শান্তভাবে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। 
" আসসালামু আলাইকুম আম্মু। কেমন আছো তোমরা?"
" ওয়া আলাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, তোমরা কেমন আছো? "
" জি আলহামদুলিল্লাহ। সেহেরি খেতে সবাই উঠেছে? তৃষা কোথায়?"
" তৃষা ঘরে আছে। আয়ান আসছে ফ্রেশ হয়ে। তারপর একসাথে সবাই খাবো। তুমি খেয়েছো? সহন খেয়েছে?"
" আমরা খেতে বসলাম মাত্র! তবে সহন আগেই খেয়ে চলে গেছে রুমে। "
" তাহলে রাখলাম এখন। আল্লাহ হাফেজ তাহমি।"
" আল্লাহ হাফেজ আম্মু।"

টুট টুট......

কল কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তাহমি। দু'টো দিনের ব্যবধানে কতটা পর হয়ে গেছে সে? একেবারে তুই থেকে তুমি তুমি করে ডাকলেন মা!
" কী হলো তাহমি? অমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলি যে! সবকিছু ঠিক আছে? "
শ্বাশুড়ির প্রশ্নে হকচকিয়ে উঠলো তাহমি। সামনে ভাতের প্লেট তার। সহন এরমধ্যে খেয়ে রুমে চলে গেছে। আতাউল খান আর ফরিদা খানও প্রায় শেষের দিকে। শুধু তাহমির দেরি! 
" না মামুনি। আমিও খাচ্ছি। "
তাহমি খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। এদিকে রুমে এসে বিছানায় বসে নীলার নম্বরে আবারও কল দিলো সহন। সকাল হতেই নীলার নম্বরটা বন্ধ বলছে। নীলা কি তার বিয়ের বিষয় কিছু জানতে পেরেই নম্বর পরিবর্তন করলো? নাহ বাসায় বসে কিছু জানা যাবে না। তাহমির ভয়ে সারাদিন বাসায় বেড়ালের মতোই শুয়ে-বসে কাটিয়েছে সহন। কিন্তু না! ওকে ভয় পেলে নীলাকে হারাতে হবে। তাই আগামীকাল নীলার বাসায় গিয়ে দেখা করার জন্য মনঃস্থির করলো সহন। ভাবনার অতলে এতটা তলিয়ে ছিলো সে তাহমির ঘরে আসার বিষয়টা অবধি টের অবধি পায়নি। আজান হতে এখনো আধঘন্টা বাকি। তাই এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে বিছানার পাশের ছোটো টেবিলের উপর রাখলো তাহমি। আর তাতেই টনক নড়ল সহনের। তাহমি তার পাশে বসার আগেই প্রায় চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, 
" দূরে সরে বস প্লিজ। রোজার একমাস আমার আশেপাশেও আসিস না ভাই। "
তাহমি চুপ করে রইলো। নেহাৎ রোজার কথা বললো বলেই এই নীরবতা। বিছানায় বসলো না। একটা চেয়ার টেনে একটু সামনে এগিয়ে বসলো। 
" হয়েছে? "
" হু।"
ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ সহনের। তাহমির হাতেও ফোন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগানোর সময় হয়েছে এখন। তাহমি ক্যামেরা অন করে ফ্ল্যাশ লাইট না জ্বেলে সহনের একটা ছবি তুললো। যাতে সহন বুঝতে না পারে তার ছবি তোলা হয়েছে। গতকাল ফেইসবুকে এরকমই একটা ভিডিও দেখেছিল তাহমি। সেই মোতাবেক নিজেও ছবিটা জুম করতে লাগলো সে। জুম করতে করতে এতটা বড়ো করলো যে সহনের চোখের মধ্যে অন্য একটা মেয়ের অবয়ব দেখতে পেলো। ব্যাস! চেয়ার পাশে সরিয়ে এক ঝটকায় সহনের পাশে বসলো তাহমি। সহন চমকাল,থমকাল তাহমির কর্মকান্ডে। তাহমি চিলের মতো ছোঁ মেরে সহনের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বড়ো বড়ো চোখ দিয়ে স্ক্রিনে ভেসে থাকা মেয়েটার ছবি দেখলো। না তাহমির চেয়ে মেয়েটা মোটেও সুন্দরী নয়। ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসির রেখা ফুটে উঠেছে তাহমির। সহন চটে গেল উল্টো! 
" এই তুই এভাবে আমার ফোনটা হাত থেকে কেনো নিয়েছিস?"
তাহমি তড়িৎ গতিতে সহনের বুকের উপর উঠে বসে গলা চেপে ধরার ভঙ্গিতে রেগেমেগে বললো,
" একটু আগে কী বললি? রমজান মাসে আমি যেনো দূরে সরে থাকি। আমি তোর স্ত্রী আমার সাথে দূরত্ব, আর এই পরনারীর ছবি দেখছিস তার বেলায় কিছু না? "
" তাহমি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। এভাবে বুকের উপর উঠে বসলি কেন? এতো বেহায়া কেউ হয়!"
" কীসের বেহায়া? তুই আমার স্বামী। তোর সবখানেই উঠে গড়াগড়ি খাবো আমি। "
সহন বলপ্রয়োগ করে তাহমিকে পাশে সরিয়ে দিয়ে নিজের ফোন হাতে নিলো।
" এতো গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছে করলে সামনের মাঠে যা। "
" তুই যদি ওই মেয়ের সাথে আর যোগাযোগ রাখিস আর সেটা যদি আমি টের পাই সহন তাহলে পুরো ঘরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিবো। আর শোন তোকে তুই করেই ডাকবো। যেদিন তুই তুমির যোগ্য হবি সেদিন তুমি করে বলবো।"
সহন প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে। বিরক্তির পর্যায় এতটা বাড়ন্ত লাগছে খাট থেকে নেমে চেয়ারে বসেছে ছেলেটা। 
" তুই তুমি ডাকলে মনে হয় আমি ধন্য হয়ে যাবো! আগুন তুই তোর মাথায় লাগা। নয়তো পাবনা যা। একটা পাগল বিয়ে করিয়ে দিয়েছে আমাকে। ধ্যাৎ! "
তাহমি ওভাবেই বিছানায় বসে রইলো। সহন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো কথা শেষ করেই। আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে চারদিক থেকে। তাহমি অসহায় দৃষ্টিতে টেবিলে রাখা পানির গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশ লোকটার সাথে ঝামেলা করতে গিয়ে আরেক গ্লাস পানি খাওয়া হলো না! ভাল্লাগে না ধ্যাৎ! 
.
.
.
চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন