তাহমি আশপাশে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলো। নিজের হাতের ব্যাগ দু'টোও সহনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
" তোর হাঁটতে সমস্যা হলে এখানে বস। আমি গিয়ে বাকি জিনিসগুলো কিনে নিয়ে আসছি।"
" আমি কি তোর চাকর? তোর ব্যাগ নিয়ে এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো!"
" চাকর হলে কি এভাবে আদর করে সাথে নিয়ে হাঁটতাম তোকে? "
সহন মুখ ভেংচি কেটে অন্য দিকে ফিরে নাক সিটকে বললো,
" তোর আদর তোর কাছেই রাখ। চল কোন দিক যাবি। কথায় কথা বাড়বে।"
ইফতারের বেশি সময় বাকি নেই বলে তাহমিও আর কথা বাড়ালো না।
ভোরের আলো উঁকি দিচ্ছে জানালার ফাঁক দিয়ে। রোদের আবছা আলোয় চোখ মেলে তাকালো তৃষা। গতকাল ইফতারের পরে আয়ান এসেছিল তৃষার ঘরে। তখন তৃষা নামাজ পড়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিল কেবল। ভাইকে দেখেই উঠে বসে তৃষা।
" বসতে হবে না। শুয়ে থাক।"
ভাইয়ের কথায় সত্যি শুয়ে পড়লো তৃষা। মৃদুস্বরে শুধালো,
" কিছু হয়েছে ভাইয়া? এই সময় তো কখনো ঘরে আসো না তুমি! "
" আমার হয়েছে? হয়েছে তো তোর। এখন কী হয়েছে সেটা খুলে বল। দু'দিন হলো একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছিস। "
তৃষার বুকটা কেমন হুহু করে উঠলো। ভাইটা কত্ত ভালোবাসে! কতটা খেয়াল রাখে ভাবতেই মনে আনন্দের দোলা লেগে যাচ্ছে।
" কী হলো বল! হ্যাঁ রে যেখানে টিউশনি পড়াতে যাস সেখানের কেউ কিচ্ছু বলেনি তো?"
বোনের নীরবতা দেখে ফের শুধালো আয়ান। তৃষা উঠে বসলো। ম্লান হেসে বললো,
" এতো চিন্তা কেনো করো ভাইয়া? আমার কিছু হয়নি। একটু মন খারাপ ছিলো ঠিক কিন্তু এখন ঠিক আছে। একটা বিষয় নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু হুট করে জানলাম সেটা কখনো আমার পাওয়া হবে না। "
আয়ান বোনের চোখে স্পষ্ট হারানোর শোক দেখতে পাচ্ছে। তৃষার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে রেখে আয়ান আস্তে ধীরে বলতে লাগলো,
" যখন আমরা কোনো কিছু নিয়ে খুব প্রত্যাশা করি এবং সেটা পাই না আমাদের ভীষণ মন খারাপ লাগে। কষ্ট হয়,রাগ হয়। কিন্তু এই কষ্টের কারণ কিন্তু আমরা নিজেই। বুঝলি না?"
তৃষা মাথা নেড়ে “না” বোধক উত্তর দিলো। আয়ান মুচকি হাসলো।
" মনে কর একটা নতুন বই এসেছে বাজারে। তুই তো উপন্যাস পড়তে ভালোবাসিস তাই এই উদাহরণ দিচ্ছি। এখন তুই মনে মনে নিরানব্বই ভাগ আশা করে বসে আছিস বইটা তুই কিনবি। তোর কাছে টাকাও আছে। কিন্তু দোকানে গিয়ে দেখলি কোনো কারণে বইটা আসেনি কিংবা স্টক আউট হয়ে গেছে। অর্থাৎ তুই বইটা পেলি না। টাকা থাকা সত্বেও বই কিনতে পারিসনি বলে তোর ভীষণ খারাপ লাগলো। এখন বই তো শেষ হয়ে যেতেই পারে কিংবা সমস্যার কারণে মার্কেটে না-ও আসতে পারে। তুই যদি প্রত্যাশার পরিমাণ ফিফটি ফিফটি রাখতি তাহলে কিন্তু এতটা কষ্ট পেতিস না। আর যদি বইটা কোনভাবে তুই পেয়ে যেতিস তাহলে তো কথাই নেই। "
তৃষা ভাইয়ের কথার অর্থ বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
" সুতরাং প্রত্যাশা যত কম করবো জীবন ততই সুন্দর। কোনো কিছুর জন্য অতিরিক্ত আশা করা যাবে না। যা আমার তা এমনি পাবো কিন্তু যা আমার নয় তা হাতের নাগালে থাকলেও পাবো না। যেমন টাকা থাকতে বই পেলাম না! আমাদের ধর্মানুসারে তকদীর বলে এটাকে। তকদীরে বিশ্বাস করা ঈমানের অংশ। ঠিক আছে এবার? "
" হ্যাঁ। আমার লক্ষ্মী বোন। আর মন খারাপ লাগবে? "
তৃষার হাত ছেড়ে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আয়ান। তৃষা সহাস্যমুখ করে বললো,
" না ভাইয়া। তুমি আমার সেরা ভাইয়া।"
খুশিতে গদগদ হয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে তৃষা। আয়ান মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় খানিকক্ষণ।
" হয়েছে। এবার বিশ্রাম নে, ভালো লাগবে। "
" হুহ্, পড়াতে বসবো। আর কাল থেকে পড়াতে যাবো। ওদের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। আমি গেলাম ফ্রেশ হতে। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসলে ভালো লাগে। "
তৃষা আবারও চঞ্চল হয়ে উঠলো। আয়ান চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে। তৃষা নিজের মনকে বোঝালো, ডাক্তার সাহেব তার জন্য নয়। হলে এমনিতেই পাবে কিংবা পেতো।
রাতের কথা ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হতে লাগলো তৃষা। আজকে পড়াতে যাবে ওহিকে। এমনিতেই অনিক চৌধুরীর তো দেখা পাবে না আজ! সে তো গতকালই চলে আসে।
" ও আল্লাহ গো! ছাঁদ ফুটো হয়ে গেছে মা! ও মা! ছাঁদ ফুটো হয়ে পানি পড়লো...."
ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ চোখেমুখে পানির ফোয়ারা বয়ে গেলো সহনের। ঘুম ভেঙে আঁতকে উঠে তাই আউলানো কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। সহনের অবস্থা দেখে সামনে দাঁড়িয়ে তাহমি ঠোঁট টিপে হাসছে। মিনিট দুয়েক লাগলো সহনের নিজেকে স্বাভাবিক করে সবকিছু বোঝার জন্য। তার পরেই লাগবে গৃহ যুদ্ধ! হাত দিয়ে দু-চোখ ঢলতে ঢলতে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সহন। একটা লাল রঙের মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে তাহমি। পরনে কালো রঙের শাড়ি। চোখে কালো কাজল,ঠোঁটে কোনো লিপস্টিক নেই। তবে এমনি হালকা গোলাপি সেই ঠোঁট! একমুহূর্তের জন্য সহন তাহমিকে দেখে পানির কথা ভুলে গেলো। কিন্তু পরক্ষনেই তাহমি চোখ টিপ্পনী দিতেই সবকিছু মনে পড়ে গেলো লোকটার। এই মেয়ের দিকে মোহিত হয়ে তাকিয়েছিল সে? ভাবতেই নিজের রুচির কী হাল সেই নিয়ে নিজেকেই গালাগালি করল মনে মনে।
" এটা কী হলো শাঁকচুন্নি? তুই সকাল সকাল আমার মাথায় পানি কেনো ঢাললি?"
সোফা থেকে নেমে তাহমির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত খিঁচিয়ে কথাটি বললো সহন। তাহমির হাসির মাত্রা দ্বিগুণ গতিতে বাড়লো দেখে সহন কিছুটা ভড়কে গেলো। নিশ্চিত এই মেয়ে অন্য কিছু ঘটাবে। ঘটলো তাই! মগের অবশিষ্ট পানিটুকু তাহমি সহনের চোখেমুখে ছুড়ে মারলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সহন। কীসের জন্য এই অত্যাচার কিচ্ছু বুঝে আসছে না তার।
" ফজরে নামাজ না পড়ে ফোনে কথা বলতে ছাদে গেছিলি কেন? কল দিয়ে কি জিজ্ঞেস করছিলি,‘ বাবু সেহরি খাইছো? ঠিকমতো খাইছ ত?’ এসব বলছিলি?"
নীলার সাথে কথা বলতে গতরাতে যে সহন ছাঁদে গিয়েছিল সেটাও তাহমি জানে, শুনতেই চুপসে গেলো সহন। কী এক ঝামেলা! নীলার সাথে কথা না বললে থাকা যায়? আর নীলার সাথে কথা বলেছে শুনলে ঘরে থাকা দ্বায়।
" আরে তুই এতো বেশি বুঝিস কেন? কথা বললাম এক বান্ধবীর সাথে। "
" আমি কি বলছি ওটা তোর বন্ধু? "
সহন বুঝতে পারছে তাহমির সামনে ভেজা বিড়াল হলে চলবে না। তাহলে আরো পেয়ে বসবে। ওদিকে নীলার কিছু টাকা লাগবে বলেছে। সেগুলো হাতে দিয়ে আসবে আর একসাথে একটু সময় কাটাবে বলে ভেবে রেখেছে সহন। কিন্তু সেসব যদি তাহমি টের পেয়ে যায়, তাহলে নিশ্চিত ঘরে বেঁধে তেলাপোকা ছেড়ে দিবে। এমনিতে তো সহনের সাথে শক্তিতে পারবে না তাহমি। কিন্তু কতক্ষণ না ঘুমিয়ে থাকবে? ঘুমোলে - ই তো তাহমি বাঁধবে! না,না এসব হতে দেওয়া যায় না। সহন উল্টো রাগ দেখিয়ে তাহমির হাত থেকে মগ কেড়ে নিয়ে বললো,
" ফাইজলামি কম করবি তাহমি। তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। দেখ তোকে আজ কী করি!"
তাহমি কিছু বুঝে উঠার আগেই সহন তাকে পাঁজা কোলা করে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। তাহমি সহনের বুকে এরমধ্যেই কয়েকটা কিল-ঘুষি মেরে দিয়েছে।
" ছাড় বেয়াদ্দপ। কী করবি? ওয়াশরুমে কেন যাচ্ছিস সহনননন......"
সহন থামলো না। সোজা ওয়াশরুমের ভেতর গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। তারপর ঝরনা ছেড়ে তাহমিকে জোর করে ধরে রাখলো। যাতে ঝরনার নিচ থেকে সরে যেতে না পারে তাহমি। এরমধ্যে পানিতে ভিজতে শুরু করেছে তাহমি। সহনের শরীরের কিছু অংশ আগেই তাহমির দেওয়া পানিতে ভেজানো ছিল বলে সে নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই তার।
" আরো ভেজাবি? এখন ভেজা কাকে বলে দেখ তুই। "
" সহন ছাড় বললাম। ভালো হবে না কিন্তু। "
তাহমি সহনের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য জোড়ে সরে নড়াচড়া করছে ঠিক। কিন্তু ছাড়া পাচ্ছে না। পুরুষ মানুষ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে নিজেকে মুক্ত করা যে কতটা কঠিন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তাহমি।
" কী খারাপ হবে শুনি? ছাড়বো না আমি। পারলে তুই যা। আজকে শিক্ষা দিয়ে দিবো।"
সহনের দুই হাত তাহমির পিঠে,কখনোসখনো আবার কোমরে। মোটকথা কিছুতেই আজ তাহমিকে ছাড়বে না সহন।
.
.
.
চলবে...........................