বন্য প্রণয় - পর্ব ১৩ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


ড্রয়িং রুমে সবাই মিলে সমবেত হয়েছে। তাহমির বাবা বেশিরভাগ সময় কাজের সূত্রে শহরের বাইরে থাকেন। আজকেও তেমনই বাড়িতে নেই উনি। হঠাৎ শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে আসায়, গতকাল কেউ কোনো প্রশ্ন না করলেও আজকে সবাই একসাথে বসেছে আলোচনা করতে। তৃষা বসেছে তাহমির পাশে,আয়ান দাঁড়িয়ে আছে এককোনায়। সামনাসামনি বসেছেন তাহমির মা। সহন যা-ই অন্যায় করুক বাবার বাড়িতে কীভাবে বলবে সেসব? তাতে যে নিজেরই মানসম্মান খোয়া যাবে। 
" কী চুপচাপ বসে রইলি কেনো তাহমি?"
মায়ের প্রশ্নে নড়েচড়ে উঠলো তাহমি। তৃষা তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। তাহমি খানিকটা সময় নিয়ে বলতে লাগলো। 
" মা আমি কিছুদিন সহনের থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছি। মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য বোঝে না। আমাদের পূর্ব পরিচয় থাকলেও বিয়েটা হয়েছিল হুট করে। তাই স্বাভাবিক সম্পর্কে নেই আমরা। আমার অনুপস্থিতিতে যদি সে আমার মূল্য বোঝে তবেই আমি তার সংসারে ফিরবো। ভালোবাসাহীন সম্পর্কে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"
মেয়ের কথায় কোন ভুল খুঁজে পেলেন না আমেনা। 
" তুমি ঠিক করেছো আপু। তবে আমার বিশ্বাস সে আসবে।"
আয়ান পাশ থেকে বললো। তৃষা জবাবে বলে,
 " আসলে আসবে। ঠিকঠাক মতো টাইট দিবা আপু।"
" চুপ কর তোরা দু'টো। শোন মা তাহমি, তোর সাথে আমি একমত। কিন্তু ছেলেটা তোর কাছে এলে ফিরিয়ে দিবি না। সম্পর্ক হলো একটা গাছের মতো। খেয়াল রাখতে হবে, পরিচর্যা করতে হবে। এবং সেটা দু'জনকেই করতে হবে। তুই নিয়মিত স্কুলে যা আর বাসায় ওদের সাথে সময় কাটাবি। তাহলে আর খারাপ লাগবে না।"
" ঠিক আছে মা।"
" হ্যাঁ হ্যাঁ! জানিস তৃষু আবার প্রে..."
মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে অনিকের কথাটা বলতেই যাচ্ছিল আয়ান। কিন্তু তৃষা ইশারা করতে চুপ করে গেলো। তৃষার গ্রাজুয়েশন শেষ হলে একেবারে পারিবারিক ভাবেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে অনিক।
" তৃষা আবার কী করলো আয়ান?"
তাহমির প্রশ্নে থতমত খেলো আয়ান। কী বলবে এবার? আমেনা ইসলাম উঠে দাঁড়ালেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, " ওদের কথা বাদ দে তুই। আমি গেলাম ঘুমুতে। ঔষধ খেয়েছি তো ঘুম পাচ্ছে। "
" আচ্ছা মা যা-ও। "
আমেনা ইসলাম চলে যেতেই দুই ভাইবোনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো তাহমি।
" এই তৃষা আয়ান কী বলছিল রে? প্রেমটেম করছিস বুঝি? আয়ান সেটা জানিস? তাহলে কি তোরও বউ ঠিক হয়ে গেছে? "
" আরে এ আপা না না! আমি ওসব প্রেমটেম করি না। সোজা বিয়ে করবো। আগে একটা চাকরি পাই তারপর। তৃষা করছে প্রেম। তা-ও ডাক্তার সাহেবের সাথে। "
আয়ান এগিয়ে এসে সোফায় বসেছে। তৃষা পাশেই ছিলো। গোপন তথ্য ফাঁস করার অপরাধে ভাইয়ের হাতে চিমটি কাটলো সে। ব্যথায় 'আহহ' করে উঠলো আয়ান। কিন্তু শুধু চোখ পাকিয়ে তাকিয়েই ক্ষান্ত হলো আজ। কারণ বড়ো বোন সামনে আছে। তাহমি কিছুটা গম্ভীর হলো। তা দেখে তৃষা মোটামুটি চিন্তায় পড়ে গেছে। বোন কি তাহলে রাগারাগি করবে তার সাথে? 

গতকাল থেকে ছটফট করছে সহন। বারবার কল করেও ফোন বন্ধ পেয়েছে। নিজের মা-ও তাহমির হয়ে কথা বলছে। গতকাল সকালে সারা বাড়িতে তাহমিকে না পেয়ে মায়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল সহন। তিনি তখন নিজের ঘর পরিষ্কার করছিলেন। 
" মা তাহমি গেলো কই?"
" দরকার কী?"
" দেখছি না তাই জিজ্ঞেস করলাম।"
" সে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে। তুই এবার যাকে ইচ্ছে বিয়ে করিস।"
রাগে গজগজ করতে করতে সহনকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন সহনের মা।
নীলার কথা মনের ভুলেও ভাবতে চায় না সহন। তাহমির সাথে যতই ঝামেলা ডাকুক সবকিছুর আড়ালে একটা সফট অনুভূতি আছে ওর জন্য। তারচে বড়ো কথা তাহমি তার স্ত্রী! মেয়েটা যে কেনো রাগ করে চলে গেলো সেটাও বোধগম্য হচ্ছে না। যদি কাছে আসার জন্য রাগ করতো তবে নিজে আশকারা দিতো না। নিশ্চিত অন্য কিছু ঘটেছে। নাহ! ঘরে বসে এসব ভাবলে চলবে না। সহন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত ন'টা বাজে। তাড়াতাড়ি গায়ের টি-শার্ট পরিবর্তন করে কালো রঙের একটা শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরে রেডি হলো সহন। মায়ের কাছে আর না গিয়ে বাবাকে বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায় সে।

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় শরীর এলিয়ে অনিকের নম্বরে কল দিলো তৃষা। তাহমি আসার পর থেকে তেমন কথা বলা হয়নি। কিন্তু পরপর দু'বার কল বেজে গেলো। অনিক রিসিভ করেনি। এরমধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে এলো তার কর্ণকুহরে। তৃষা বালিশের পাশে ফোন রেখে দরজা খোলার উদ্দেশ্য বসার ঘরের দিকে এগোলো। আয়ান বসার ঘরেই টিভি দেখছিল। তাই তৃষা পৌঁছুনোর আগেই আয়ান দরজা খুলে দিলো। সহনকে দেখে আয়ানের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। বিয়ের পর এই প্রথম সহন এ বাড়িতে এলো।
" কী অবস্থা শালাবাবু? কেমন আছো? "
" আলহামদুলিল্লাহ দুলাভাই। আগে ভেতরে আসুন। তারপর বলুন, আপনি কেমন আছেন? "
সহন ভিতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। আয়ান দরজা আঁটকে ততক্ষণে সহনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তৃষাও এরমধ্যে সেখানে উপস্থিত হয়েছে। 
" আছি কোনো প্রকার। বউ রেগে বাবার বাড়ি গেলে যেমন থাকা যায় তেমনই। "
তিনজন একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো। তৃষা ভেংচি কেটে বললো, " হয়েছে হয়েছে। এখন গিয়ে রাগ ভাঙান আপুর। আপু ঘরেই আছে। " 

" আমার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি কোথায়?"
" আব্বু বাসায় না। আম্মু ঘুমিয়ে গেছেন। কালকে দেখা করে নিবেন বরং। "
" তাহলে তোমার আপুর ঘরটা দেখিয়ে দাও।"
" চলুন।"
তৃষার পেছন পেছন তাহমির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সহন। তৃষা ওকে রেখে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। 
শুয়ে শুয়ে ফেইসবুকে রিলস দেখছে তাহমি। হঠাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে কেউ প্রবেশ করার শব্দে সেদিকে তাকাল। এমনিতে দরজা লক করে রাখে না তাহমি। সহনকে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো মেয়েটার। কিন্তু শোয়া থেকে উঠলো না তবুও। সহন হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এলো তার দিকে। 
" কেমন আছিস তাহমি? এভাবে না বলেকয়ে কেউ চলে আসে? "
" তুই এখানে এসেছিস কেনো? "
সহন আস্তে করে তাহমির পাশে বসলো। 
" তোকে বড্ড মিস করছিলাম তাই। "
" আজাইরা কথা বলবি না।"
" সত্যি! "
" তুই চলে যা। নইলে কিন্তু! "
সহন তাহমির দিকে ঝুঁকে বললো, " নইলে কি কামড়ে দিবি? নাকি কিস করবি?"
তাহমি হাত দিয়ে সহনকে দূরে সরিয়ে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, " তোকে স্পর্শ করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। "
" এহহ! একদিন আমিই বলেছিলাম এই কথাটা। তাই আজকে আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিলি?"
" হুম দিলাম। "
তাহমির বিরক্তি উপেক্ষা করে সহন তাহমির দিকে আবারও ঝুঁকে থুতনিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। তড়িৎ গতিতে শোয়া থেকে উঠে বসলো তাহমি। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
" এসব গিয়ে নীলাকে করবি। লাগলে খাট ভেঙে ফেলিস। চরিত্রহীন একটা! "
সহনের হাসে পাচ্ছে ভীষণ। ঠোঁট টিপে হাসছে সে। তাহমির জেলাস হওয়া দেখে যেমন ভালো লাগছে তেমনি আবার কৌতুহল জাগছে। নীলা কথা তো প্রথম দিন থেকেই জানে তাহমি। তাহলে কী এমন হলো যে বাড়ি ঘর ছাড়লো? 
" খাট ভেঙে ফেললে শোবো কোথায়? তারচে চল ফ্লোর করি।"
সহনের কথায় তাহমির অক্ষিকোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ছেলেটাকে দেখে মনে হয় ভদ্র। আচরণেও এতদিন মনে হয়েছে তাই। কিন্তু এটা যে এতটা বজ্জাত তা তো জানতোই না! 
" চুপপপ! অশালীন কথা। এসেছিস কেনো? "
" তোকে বাড়ি নিয়ে যাবো তাই। "
" আমি আর ফিরবো না। আর তুই আমাকে খবরদার স্পর্শ করবি না। তোর গায়ে পরনারীর স্পর্শ! "
" তাহলে আমিই এখানে থেকে যাবো। আর সব সময় করবো লাগলে চৌদ্দ বার করবো মানে স্পর্শ করবো আরকি। নীলার সাথে আমার কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না তাহমি।"
" তুই যাবি নাকি আমি বেরিয়ে যাবো ঘর থেকে? "
" আচ্ছা তুই যা!"
তাহমির রাগে নিজের চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। পারলে তো সহনের সারা গায়ে কামড়ে দিতো। কিন্তু এসব কিছুই না করে বিছানা থেকে উঠে দরজার দিকে এগোলো সে। সহনও উঠলো দ্রুত। হাত ধরে হেঁচকা টানে সোজা দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো সহন। দু'জনের নাকে নাক রেখে ঠোঁট প্রায় ছুঁইছুঁই অবস্থা। তাহমির অস্থির লাগছে। তাহমি কিছু বলার আগেই সহন তাকে আঁটকে দিলো। গাঢ় চুম্বনে আবিষ্ট হলো দু'টো ঠোঁট। একটু পর ছাড়লো সহন। এতক্ষণ ছটফট করছিল তাহমি। গায়ের জোরে সহনের সাথে সে পেরে ওঠেনি। 
" নীলার সাথে এসব করা শেষ তাই মজা না পেয়ে আমার সাথে করছিস না? জোর করে তুই এসব করলেও আমার মনে তোর জন্য শুধু ঘৃণা অবশিষ্ট আছে। "
" তাতেই হবে বউ। ভালোবাসা না থাকলেও কিছু তো একটা আছে! আমি এবার সহনশীল হয়ে বউকে সামলাবো। যতদিন না তুই নিজে থেকে আমার সাথে ফিরে না যাবি, ততদিন আমিও এখানে থাকবো। "
" আগে হাত ছাড় তারপর কথা বল। গায়েপড়া বেডা মানুষ। "
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন