বন্য প্রণয় - পর্ব ১৪ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে তৃষা। কখনো ডানে ফিরে শোয় তো কখনো বামে। আবার সোজা হয়ে শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মোটামুটি গরম পড়ে আজকাল। তাই মাঝে মধ্যে ফ্যান চলে। এখনও চলছে। গরমের মধ্যে কম্বল মুড়ি দিয়ে বাতাস খাওয়া তৃষার স্বভাব। সেই ঘন্টাখানেক আগে কল দিয়েছিল অনিককে। এখনো কল ব্যাক করলোনা না মানুষটা। আছে তো ওহিদের বাসায়। তাহলে কীসের এতো ব্যস্ততা? সারারাত অপেক্ষা করতে করতে ফজরের পরে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটা। 
কল আসার অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অনুভূতিরা বিশ্রী। 
সকালবেলা শরীরের উপর ওজন ওজন ফিল হতে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো তাহমি। গতকাল রাতে নিজে সোফায় শুয়ে সহনকে বিছানায় শুতে বলেছিল মেয়েটা। তাহলে কি অসভ্য ছেলেটা তার উপর শুয়েছে? না,না ওর ওজন নিশ্চয়ই এতটা কম নয়! তাহমি বুকের উপর তাকিয়ে দেখলো মিলু শুয়ে আছে। মিলু এ বাড়ির নতুন পোষা বিড়াল। ধবধবে সাদা গায়ের রঙ, বয়স অল্প। তাহমি তার দিকে তাকাতেই সে হাই তুলে মৃদু স্বরে ‘মিউ’ বলে ডাকলো।
" শালার বিড়ালের কী ভাগ্য! কোথায় বউয়ের বুকে মাথা রেখে আমি ঘুমবো, তা না উনি বুকের উপর বসে আছে। "
সহন হাতে দুই কাপ চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকে দাঁড়াল। টি-টেবিলের ওপর কাপ দু'টো রেখে মিলুকে তাহমির উপর থেকে সরিয়ে ফ্লোরে ছেড়ে দিলো।
" তুই সরালি কেন ওকে?"
" কারণ ওই জায়গা আমার মিলুর না।"
সহনের ইশারায় লজ্জা পেলো তাহমি। পরক্ষণেই পূর্বের ঘটনা মনে পড়তে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। হুড়মুড় করে উঠে বসলো সে। কিছুটা রাগ প্রদর্শন করে বললো,
" একটা দিয়ে হচ্ছে না? না-কি ঠিকমতো দেয় না? নেহাৎ বাসায় কিছু বলতে পারিনি। তাই তোকে সহ্য করতে হচ্ছে। "
সহন তাহমির পাশে হুট করে বসলো। হঠাৎ করে তাহমিকে ধরে নিজের কোলের উপরে তুলে বসালো। তাতে তাহমি দ্বিগুণ ক্ষেপে গেলো। 
" সহন! বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।"
" উফ! আমার বউটা কত্ত হট,সুন্দরী। আগে কেনো চোখে পড়েনি বল তো? বাই দ্য ওয়ে,ঠোঁটের বাম দিকের তিলটা কিন্তু জোশ। "
তাহমি না চাইতেও লজ্জা পাচ্ছে। এই লোকটা ভেতর ভেতর এতো অসভ্য কল্পনাও করেনি। 
" ভালো করে কথা বল। চোখে পড়বে কীভাবে? চোখ তো নীলার দিকে ছিলো।"
" চুপ! আর একবারও ওর নাম নিবি না। আমি ওর কথা শুনতেও চাই না তাহমি।"
সহন তাহমির ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে চুপ করাতে বললো। তাহমি যেনো সহনের কথা শুনবে না বলেই প্রতিজ্ঞা করেছে। 
" একশোবার বলবো,হাজারবার বলবো। তুই নীলার কাছে যা। নীলাকে হট বল। নীলাকে জড়িয়ে ধরর। নীলার সাথে সেক্.....!
তাহমি আরকিছুই বলতে পারে না। সহন রেগে গিয়ে তাহমির দুই হাত পেছনে চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়েছে। তাহমি চেষ্টা করেও নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে ঠোঁটে। মিনিট দুয়েক পরে তাহমি মুক্তি পেলো। দ্রুত কোল থেকে নেমে সামনে দাঁড়াল তাহমি। আঙুল ছুঁইয়ে দেখলো ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে গেছে। তাহমির যেনো হঠাৎ করে কী হলো। সহনকে কষিয়ে চড় বসিয়ে দিলো একটা। সহন অবাক হলো কিছুটা। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো তাহমির দিকে। যে মেয়েটা তাকে নিজে থেকেই আদরে সিক্ত করতো সে আজ এতটুকুর জন্য এমন আচরণ করলো? 
" তুই খবরদার আমাকে স্পর্শ করবি না আরর।"
তাহমি দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। চা টেবিলেই রইলো। তাহমিকে আর দেওয়া হলোনা সহনের। সকাল সকাল রান্নাঘরে গিয়ে শ্বাশুড়ির সাহায্য নিয়ে বউয়ের জন্য নিজের হাতে চা তৈরি করেছিল বেচারা। 
তপ্ত দুপুরের রোদ উপেক্ষা করে হেঁটে চলেছে আয়ান। আজকে সন্ধ্যায় বাসায় সবাই একসাথে একটু আনন্দ করবে। তাই তাড়াতাড়ি টিউশন পড়াতে এসেছে। কিছুটা পথ এগিয়েই বড়লোক বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। মাত্র সপ্তাহ হয়েছে এ বাড়িতে পড়াতে শুরু করেছে সে। তবে বাড়ির মানুষগুলো খুব ভালো শুধু ছাত্রীটি বেশি পাকা!
" হাই ইয়াং ম্যান! হাউ আর ইউ?"
বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন তমাল আহমেদ। উনারই একমাত্র মেয়ে অনিমা আহমেদকে পড়াতে আসে আয়ান। এই নিয়ে দশজন শিক্ষক পরিবর্তন করা হয়েছে। মেয়ের কিছুতেই পড়ালেখায় মন বসে না। এবার এসএসসি দিবে। কিন্তু বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত বুঝে মেয়েটি। সাথে ঠোঁটকাটা তো বটেই। মা মরা মেয়ে বলে ছোটো থেকে আদরে আদরে বাঁদর তৈরি হয়েছে একেবারে। 
" আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন আঙ্কেল? "
" এইতো ভালোই। যাও যাও অনিমা রুমেই আছে। দেখো গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানাতে পারো কি-না! "
" আমি চেষ্টা করবো আঙ্কেল। "
আয়ান দ্রুত পায়ে এগিয়ে অনিমার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। খাটের উপর দাঁড়িয়ে একা একাই গান ছাড়া নাচছে মেয়েটা। আয়ান ভড়কে গেলো কিছুটা। তবে মেয়েটা যে নরমাল না সেটা সে জানে।
" অনিমা! কী করছো এসব?"
আয়ান কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে ধমকের গলায় বললো। অনিমা ধুপ ধাপ করে খাট থেকে নেমে আয়ানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাত ধরে টেনে বিছানায় বসালো। আয়ানের রাগ যেনো তার কাছে কোনো বিষয় না।
" হেই আয়ান স্যার আমরা কাপল ডান্স করতে পারি? আপনি যদি পাঁচ মিনিট আমার সাথে ডান্স করেন তাহলেই আজকে আমি মন দিয়ে পড়তে বসবো।"
অনিমার কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলো আয়ান। জীবনে কোনো মেয়ের হাত অবধি ধরলো না যে ছেলে আজ তাকে মেয়েদের সাথে কাপল ডান্স করতে হবে? আয়ানের ভ্যাবলা চেহারা দেখে অনিমা চোখ টিপ্পনী দিলো। ফলে আয়ানের কাশি শুরু হয়ে গেছে। অনিমা পানি দিলো আয়ানকে। পানি খেয়ে অনিমার দিকে দৃষ্টিপাত করলো আয়ান।
" অনিমা আমি তোমার টিচার তবে ডান্স টিচার নই।"
" সমস্যা কী? শিক্ষক তো বটে! আসুন আসুন।"
" অনিমা...."
অনিমা কোনো মানা না শুনে আয়ানকে দাঁড় করিয়ে নিজের হাত রাখলো তার কাঁধে ও পিঠে। এবার আয়ানের ধরার পালা। কিন্তু এভাবে মেয়েদের স্পর্শ করা তার ধাঁচে নেই। ফলে বিব্রত হলো কিছুটা। কিন্তু কিছু করার নেই। এই মেয়ে যে কতটা ত্যাড়া সেটা হাড়েহাড়ে টের পেয়ে গেছে আয়ান। এই মাসটা পড়ানোর পরে এমনিতেই এখানে আর পড়াতে আসবে না বলে ঠিক করলো আয়ান। 
" আরে ধরুন তো! দাঁড়ান গান প্লে করি।"
অনিমা ফোন বের করে একটা হিন্দি গান প্লে করে আবারও আয়ানকে ধরে। আয়ানও শেষমেশ অনিমার কোমরে ও কাঁধে হাত রেখে ওর তালে তাল মেলাতে থাকে। নেহাৎ টিউশনির টাকাটা অগ্রিম নিয়ে ফেলেছে আয়ান। নইলে কখনও এই পাগলের পাগলামি সহ্য করতে হতোনা তাকে।
সারাদিন তাহমি নিজের ঘরে আসেনি। দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষে তৃষার ঘরে গিয়ে দুবোন কথাবার্তা বলেছে। তৃষার অবশ্য মনটা ভালো না। বোন আসাতে ওহিদের বাসায় যাওয়া হয়নি দু'দিন। অনিকের কী হয়েছে বুঝতে পারছে না তৃষা। 
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কীভাবে বউয়ের রাগ ভাঙাতে পারবে সেসব ভাবছিল সহন। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। সন্ধ্যা হওয়ার আগ মুহুর্ত। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে ভাবনার ছেদ ঘটে তার। কলার আইডি দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। দ্রুত কল কেটে দিলো সে। ভুলবশত চাপ লেগে নীলার নম্বরের ডিটেইলস সামনে এলো। চমকে উঠল সহন। লাস্ট কল তো ওইদিন রাতের ছিলো, যেদিন তাহমির সাথে ছিলো! কিন্তু সহন তো কল রিসিভ করেনি। সহন কিছু একটা ভেবে কল রেকর্ড চেক করতে লাগলো। সৌভাগ্যক্রমে সহনের কল রেকর্ড অপশন চালু করা। তাই খুব একটা সময় লাগলো না সেদিন রাতে ঠিক কী বলেছিল তাহমি। যা ভেবেছিল তাই! নীলার শেষ কথাগুলো শুনেই ভুল বুঝেছে তাহমি। 

" আপু আমি একটু কল রিসিভ করে কথা বলি?"
দুই বোন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্য অস্ত যাওয়া দেখতে দেখতে টুকটাক কথা বলছিল। এমন সময় অনিকের কল এলো। 
" অবশ্যই! তুই কথা বল আমি আসছি।"
তাহমি বারান্দা থেকে সরে যেতেই কল রিসিভ করলো তৃষা। লম্বা শ্বাস নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো। নিজের অস্থিরতা প্রকাশ করতে চায় না সে।
" আসসালামু আলাইকুম। "
" ওয়া আলাইকুম আসসালাম। তৃষা একটা খারাপ সংবাদ আছে। "
" কী হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন? বাসার সবাই ঠিক আছে তো!"
" ওহির বাবা গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। খুবই বাজে অবস্থা। আমরা সবাই সেখানে আছি। গতকাল দুপুরে ঘটেছে এই ঘটনা। "
" ইন্না-লিল্লাহ! আপনি দিনা আপু আর ওহির দিকে খেয়াল রাখবেন। আর নিজের দিকেও।"
" চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। কল না পেলেও মন খারাপ করো না। কথা হোক বা না হোক প্রতিদিন আমি আছি। "
" আমি জানি। অনুভব করতে পারি সেটা। শুধু বিপদ-আপদের ভয় হচ্ছিল। তাই হলো।"
" দোয়া করো। আপাতত রাখছি। বুঝতেই পারছো ওহিকে সামলাতে হচ্ছে সাথে দিনাকেও।"
" আচ্ছা। সময় পেলে আপডেট জানাবেন। "
" ওকে। টাটা।"
" আল্লাহ হাফেজ।"
মনটা খারাপ হয়ে গেলো তৃষার। ওহির মতো ছোটো মেয়েটা কতটা কষ্ট পাচ্ছে? আর দিনা আপুও কতো ভালো মানুষ। 
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন