সহন কিছু বলতে যাবে কিন্তু নীলা দাঁড়াল না। কে নির্লজ্জ সেটা বলা দরকার ছিল। এজন্যই বলে নিজের মাথায় গোবরে ভরা সে অন্যের মাথার গোবর খোঁজে। নিজে যে কতটা নির্লজ্জ, বেহায়া সেটার দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই নীলার!
ঔষধ হাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বাসায় ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো সহন। তাহমি দরজা খুলে রেখেই বেডরুমে গেছে ভেবে সেদিকে এগোচ্ছে সহন। নীলাকে নিশ্চিত উল্টাপাল্টা বলেছে তাহমি। নয়তো বিছানার কথা কেন বললো? রুমে ঢুকতেই চমকাল সহন। সমস্ত বিছানা এলোমেলো। যেনো কেউ ধস্তাধস্তি করেছে। তাহমি সেগুলো গোছাতে ব্যস্ত।
" এসব কী? এমন এলোমেলো হলো কীভাবে? "
" তোর কল্লা! আমি নিজেই এমন করে রেখেছিলাম। যাতে নীলা রুমে ঢুকলে এসব দেখতো আর জ্বলতো।"
" তাহমি তুই এত্তো পাজি কেন? এই নে তোর ব্যথার ঔষধ। আজকে না লাগলেও পরে লাগবে এ বিষয় নিশ্চিত থাক।"
সহন বিছানার উপর ঔষধ রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সহন চোখের আড়াল হতেই তাহমি হাসলো। ইশ! পুরুষ মানুষ স্ত্রী পাশে থাকতেও আদর সোহাগ করতে পারছে না বলে কত্ত অভিমান!
বিকেল পাঁচটা। ওহিদের বাসায় এসেছে অনিক। সেখানেই আসতে বলেছে তৃষাকেও। ফোনে বললো মিনিট পাঁচেক লাগবে পৌঁছাতে। তৃষা প্রথম না বললেও পরে রাজি হয়েছে। আসলে খালি বাড়িতে অনিকের সাথে দেখা করতে যাওয়া অশোভন বলেই রাজি হচ্ছিল না মেয়েটা। অনিক বসার ঘরটা একটু গোছগাছ করে সেখানে বসেই অপেক্ষা করছে। তৃষা আসলে একসাথে বের হবে সামনের পার্কে যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে কলিংবেলটা বাজালো। তারমানে তৃষা এসে গেছে। অনিক দ্রুত দরজা খুলে দিলো। হাসিমুখে ভেতরে প্রবেশ করলো তৃষা। দরজা আঁটকে অনিক গিয়ে সোফায় বসলো আর পাশের সোফায় তৃষা। কেমন একটা ভয় ভয় লাগছে তার। বন্ধ ঘরে সাথে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ!
" কেমন আছো বলো? "
অনিক সামনে থাকা কফি মেকার থেকে কফি দিলো তৃষাকে।
" ভালো। ওদিকে সবাই কেমন আছেন? "
" আপাতত আছে ভালো। বিশ্রাম দরকার ওহির বাবার। আমি আবার রাতে ফিরবো বুঝলে। "
" আজকেই! আরেকদিন থাকা যায় না? "
অনিক মুচকি হেসে কফির কাপে চুমুক দিলো।
" থেকে কী করবো? কিছুদিন পর তো বিয়ে করে ঘরে নিয়ে যাবো। তখন না হয় কাজকর্ম রেখে সারাদিন তোমার সামনেই বসে রইলাম? "
দু'জনেই একসাথে হেসে উঠলো এবার।
" ঠিক আছে। "
" তুমি বসো একটু। আমি রেডি হয়ে আসি। আর দরজা খুলে বাইরেও দাঁড়াতে পারো। তোমার নার্ভাস লাগছে। "
বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অনিক। তৃষা চমকাল। কীভাবে তার মনের কথা বুঝলো মানুষটা? তৃষা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। কিছু বললো না উত্তরে। অনিক গেলো রেডি হতে। ফিরলো দশ মিনিট পরে। তৃষা তখনও এক জায়গায় বসে আছে।
" হয়েছে আপনার? "
তৃষা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। অনিক কালো রঙের শার্ট পরেছে সাথে জিন্সের প্যান্ট। তৃষা চোখ ফেরাতে পারছে না।
" হ্যাঁ। "
অনিক তৃষার দিকে এগিয়ে গেলো। তৃষা উঠে দাঁড়িয়েছে। সামনাসামনি দু'জন! দু’জোড়া চোখের দৃষ্টির মিলন হতেই লজ্জা পেলো তৃষা। মাথা নুইয়ে ফেললো সে।
" আমি কি তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?"
তৃষা চোখ বন্ধ করে ফেললো। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ করছে। মানুষটা এভাবে অনুমতি চাইলো? এতটা ভালো কেনো হতে হবে? হুট করে জড়িয়ে নিলেই তো হতো। কীভাবে বলবে, 'হ্যাঁ জড়িয়ে ধরো!' আবার কিছু না বললেও তো খারাপ দেখাবে। তৃষার নীরবতাকে সম্মতি ভেবেই বুকে জড়িয়ে নিলো অনিক। বুকে মুখ গুঁজে স্থির হয়ে হৃৎস্পন্দন শুনছে তৃষা।
অনেকদিন হলো কোথাও একসাথে ঘুরতে যায়নি তিন ভাইবোন। তাই গতকাল সবাই মিলে ঠিক করেছে সামনের শুক্রবার একসাথে পিকনিক করবে। লোকেশন কাছেই। তৃষাদের বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটা সুন্দর পার্ক আছে। সেখানেই তাহমি,সহন,তৃষা ও আয়ান মিলে পিকনিক করবে। অবশ্য বাবা-মাদের বলেছিল জয়েন হতে, কিন্তু উনারা রাজি হননি।
সকালবেলা চোখেমুখে পানির ছিটেফোঁটা লাগতেই ঘুম ভেঙে গেলো সহনের। আজ শুক্রবার। তাহমি আগেভাগে উঠে গোসল সেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে ব্যস্ত। সহন উঠে বসলো। তাহমির দিকে তাকাতেই বুঝলো পানি এসেছে কোথা থেকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে। তাহমির মনোযোগ অন্য দিকে। পেছন থেকে গিয়ে আলতো করে উদরে হাত রেখে জড়িয়ে ধরলো সহন। তাহমি হকচকিয়ে উঠলো।
" হুঁশ! এভাবে কেউ ধরে? "
সহন এরমধ্যে ঘাড়ে নাক ঘষতে শুরু করেছে। হাত দিয়ে স্লাইড করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাহমির অস্থির লাগছে।
" কীভাবে ধরবো? আরও গভীরভাবে? "
" ছাড় তুই। ফ্রেশ হয়ে রেডি হ। বেরোতে হবে আমাদের। "
তাহমি সহনকে ছাড়িয়ে অন্য দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সহনের অসহ্য লাগছে।
" কোথাও যাবো না বা*ল। ভাল্লাগে না বা*ল। ধুর!"
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা আঁটকে দিলো লোকটা। তাহমি হাসতে হাসতে চুলগুলো মেশিনের সাহায্যে শুকিয়ে নিচ্ছে।
প্রাইভেট গাড়িতে করে চারজন পার্কে পৌঁছল মাত্র। দুই বোন শাড়ি পরেছে সাথে ম্যাচিং হিজাব। সহন অফ হোয়াইট কালারের শার্ট আর আয়ান ব্লাক কালারের টি-শার্ট। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে এসেছে ওরা, সাথে বাসা থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছে। এখানে বসে রান্না করার কথা অবশ্য ছিলো তবে সেটা আর হয়নি। অনিক অবশ্য চেম্বার বন্ধ রেখে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তৃষা সুন্দর করে মনে করিয়ে দিয়েছে, বিয়েটা এখনো হয়নি! পার্কের উত্তর দিকে সবাই মাদুর পেতে বসেছে। সহনের মন মেজাজ বিশেষ ভালো না। কথা সবার সাথে হেসে হেসে বললেও তাহমি সেটা বুঝতে পারছে ঠিকই।
" তারপর আয়ান তোর পড়ালেখা, টিউশনি কেমন চলছে? "
তাহমি খাবারের প্যাকেট থেকে বিরিয়ানি প্লেটে পরিবেশন করছে। সহন ফোন নিয়ে ব্যস্ত। তৃষা সাহায্য করছে বোনকে।
" পড়াশোনা চলছে কিন্তু টিউশনি? নাউজুবিল্লাহ আপাই,পুরাই নাউজুবিল্লাহ! "
আয়ানের কথায় সহনও ফোন রেখে আগ্রহ সহিত তার দিকে দৃষ্টিপাত করলো। তাহমি কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে শুধালো, " কী হয়েছে রে? "
" আর কী বলবো? বড়লোক বাবার এক মেয়েকে পড়াচ্ছি প্রায় দিন পঁচিশে। সরি মেয়ে না বলে এটম বোম বললে ভালো হয়। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিবে সামনে। অথচ অকাল পক্ক! "
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো আয়ান। তৃষা সেটা দেখে হো হো করে জোরে হেসে উঠলো। আয়ান দিলো তাতে ছোটো করে একটা কিল। তৃষাও কম যায় না। সে-ও ভাইয়ের চুল ধরে টান দিয়ে সহনের পেছনে লুকিয়েছে।
" আহা! থাম তোরা দু'জন। আর তৃষা তুই ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছিস কেন? আমার ভাইটার সত্যি কষ্ট হচ্ছে মেয়েটাকে সামলাতে। "
" শালাবাবু মেয়েদের সামলানো মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। ভুলেও আবার ফেঁসে যেও না।"
সহনের কথায় তাহমি অন্য দিকে তাকিয়ে হেসে নিলো একটু। আয়ানও সমস্বরে বলে উঠে, " ওই মেয়ের সাথে আমি? আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন। কোনোভাবে একদিন রাতে পেলে আমাকে ধর্ষণ করে ছেড়ে দিবে!"
শেষের কথাগুলো আস্তে করে বললো আয়ান।
" বলা যায় না শালাবাবু, কখন কার সাথে কার কানেকশন হয়ে যায়। দেখছো না তোমার বোনের সাথে কেমন করে আমার ঘটে গেলো?"
" আহারে বেচারি দুলাভাই আমার! "
তৃষার সাথে তাহমিও উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। সারাদিন একসাথে সময় কাটিয়ে মাগরিবের আজানের আগে আগে যে যার বাসায় পৌঁছল। মাঝে মধ্যে দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে কিংবা ব্যস্ত জীবনকে ছুটি দিতে আমাদের এরকম সময় কাটানো উচিত। প্রকৃতির সান্নিধ্যে গেলে মন ও শরীর দুটোই ভালো থাকে।
.
.
.
চলবে.........................