বন্য প্রণয় - পর্ব ১৭ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


মার্চ প্রায় শেষের দিকে। চৈত্রের দুপুর! চারদিকে কড়া রোদ। রোদের মধ্যে ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। ফরিদা খান ছাদে জামাকাপড় শুকাতে দিয়েছেন। তেঁতুলের আচারের বয়াম গুলি রোদে শুকাতে দিয়েছিলেন ঘন্টাখানেক আগে। সেগুলো এদিকসেদিক ঘুরিয়ে রেখে দিয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেলেন। 
দীর্ঘ দিনের চিকিৎসার ফলে ওহির বাবা সবুজ সুস্থ হয়ে উঠেছে এখন৷ তবে চাকরিতে আর জয়েন করবেনা। নিজের এলাকায় থেকেই কোনো ব্যবসায় করার চিন্তাভাবনা করেছে সে। তাই গতকালই সপরিবারে বাসায় ফিরে এসেছেন। ওহি ফেরার খবর পেয়ে তৃষাও বেশ খুশি হয়েছে। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে তাই ওহিদের বাসার দিকে রওনা দিয়েছে তৃষা। সাদা,গোলাপি মিশেল রঙের থ্রিপিসের সাথে সাদা হিজাব পরেছে সে। হাতে ছোটো একটা ব্যাগ। অন্য হাত ফাঁকা। গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে তৃষা রাস্তার পাশে। এমন সময় একটা টয়োটা প্রিমিও এসে থামলো তৃষার সামনে। যাবে বলে প্রাইভেট গাড়ি! জানালার কাচ নেমে গেলো কিছুটা। তৃষা শান্তভাবে সেদিকে তাকাল। 
" গাড়িতে উঠে বসো।"
অনিককে দেখে চমকাল তৃষা। হঠাৎ করে এলেন তাই।
"আপনি! গাড়িতে উঠবো না বাসে আসবে এখুনি। "

  মেয়েটাকে সেধে লাভ হবে না বুঝে আর কিছু বলার আগেই অনিক হাত ধরে টেনে গাড়িতে উঠে বসালো তাকে । গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। 
" কথা না শুনলে বিয়ে করবো না বুঝলে?"
তৃষা ফিক করে হেসে উঠলো। 
" হু ম কি দিচ্ছেন? "
" তা বলতে পারো।"
" ঠিক আছে কথা শুনবো।"
অনিক এক হাত তৃষার হাতের উপর রেখেছে অন্য হাতে ড্রাইভ করছে। 
" বাহ! কত লক্ষ্মী বউ আমার।"
" আপনি ভালো করে গাড়ি চালান। আমার ভয় করছে কিন্তু! "
" কিছু হবে না। চুপ করে বসো তুমি । আমি আছি।"
চোখে চোখ রেখে কথাটা বললো অনিক। কী জানি ছিলো সেই চাহনিতে। তৃষা চুপ করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। ‘ আমি আছি’ শব্দটা যেমন ভরসা করার যোগ্য তেমনি কিছু কিছু হাত কেবল স্পর্শ করা নয় বরং ভরসার জায়গা।

রাতের আঁধারে ছেয়ে আছে গোটা শহর। বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। কালো মেঘ জমেছে। মেঘগুলো এদিকে ওদিকে সরে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাস মনে হচ্ছে তাহমির কাছে। জানালা দিয়ে বাইরের আবহাওয়া দেখছিল এতক্ষণ। সহন বিছানায় শুয়ে আছে কম্বল মুড়ি দিয়ে। সোজা হয়ে শুয়ে হাঁটু উঁচু করে ভেতরে বসেই ফোন টিপছে। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে আরো আগে। তাহমি এবার জানালা আঁটকে দিলো। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাতাসের গতি ও বিদ্যুৎ চমকানি। জানালা আঁটকে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মশারি টানাতে যাবে তখুনি কারেন্ট চলে গেলো। বিরক্তিতে "চ" জাতীয় শব্দ বের হয়ে এলো তাহমির মুখ থেকে। ফলে সহন কম্বল সরিয়ে বাইরে তাকাল। 
" এতক্ষণ যে কারেন্ট ছিলো সেটাই তো বোনাস। শালার আকাশে মেঘ দেখলেই কারেন্ট থাকে না!"
সহন বিছানা থেকে উঠে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ড্রয়ার থেকে মোমবাতি বের করলো। তাহমি এগিয়ে গিয়ে দিয়াশলাই দিলো।
" এই কথাটা ঠিক বলেছিস তুই। "
" তাহলে চুমু দে! "
" কথা ঠিক বলেছিস তাতে চুমু দিবো কেন?"
তাহমির হাতে মোমবাতি। দু'জন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মোমের আলোতে অপরূপ লাগছে দুজনের মুখশ্রী। বাইরে জোরে জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জানালা খুলে গিয়ে দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে জানালার পর্দা। মোমবাতি প্রায় নিভু নিভু! সহন গিয়ে এবার ভালো করে আটকে দিলো জানালা। টেবিলের উপর মোমবাতি রেখেছে তাহমি। 
" চুমু দেওয়ার কোনো কারণ লাগে না। বর চাইলেই বউ চুমু দিবে।"
তাহমিকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো সহন। সবকিছু মিলিয়ে কেমন একটা ঘোরলাগা পরিবেশ মনে হচ্ছে তাহমির কাছে। কেনো জানি মনে হচ্ছে এই আবহাওয়ায় প্রিয় পুরুষের আহবান অগ্রাহ্য করতে পারবে না সে। শুকনো ঢোক গিলে সহনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো সে। সহন সামনাসামনি বসে তাহমির হাত নিজের হাতের মধ্যে আগলে ধরে আছে। ডান হাত দিয়ে তাহমির বামহাতের আঙুল নিয়ে খেলছে। আর তাতেই অজানা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তাহমির শরীরে।
" বরকে চাইতে হবে কেনো? "
" সেটাই তো! বরকে কেনো চাইতে হবে? বউয়ের উচিত না চাইতেই বরকে চুমু খাওয়া, আদর করা। বিশেষ করে এমন রোমান্টিক ওয়েদারে তো...."
তাহমি সহনের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিলো। এরমধ্যেই অনেক জোরে কোথাও বাজ পড়েছে। একটু আঁতকে উঠলো তাহমি। সহন কী ভেবে হুট করে জড়িয়ে নিলো বুকে। তাহমি বাঁধা দিলো না। কিংবা নড়াচড়াও করলোনা। চুপটি করে রইলো। তাহমির নীরবতা সহনকে আশকারা দিচ্ছে। অধৈর্য মন আর ধৈর্য ধরতে নারাজ তার। দু'জনার উষ্ণ নিঃশ্বাস দু'জনের ঘাড়ে আছড়ে পড়ছে। সহন পিঠে কিছুটা ব্যথা অনুভব করছে। তাহমি এতটা জোরে ধরেছে যে নখের আঁচড় লেগে যাচ্ছে। সহন মুচকি হেসে হাত দিয়ে তাহমির পিঠে স্লাইড করতে লাগলো। একটু পর নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো তাহমি। সহন হতাশ হলো ফের। মাথা নত করে বসে আছে লোকটা। তাহমি সহনের থুতনিতে হাত দিয়ে মাথা উঁচিয়ে ধরে শুধালো, 
" কী হয়েছে? "
" কিছু না। ঘুমাও তুমি। "
সহনের বেচারা টাইপের মুখটা দেখে এই মুহুর্তে তাহমির জোরেসোরে হাসতে ইচ্ছে করলেও সে ইচ্ছে দমিয়ে রাখলো সে। দুজনের দৃষ্টি দুজনাতে আবদ্ধ। তাহমি থুতনি থেকে হাত সরিয়ে একটা আঙুল সহনের ঠোঁটে স্পর্শ করালো। সহন থমকে গেলো। বড়ো বড়ো চোখ দিয়ে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে তাহমির দিকে। তাহমি মিষ্টি করে একটু হাসলো। তারপর ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে নিজের মুখে পুড়ে নিলো সেই আঙুল। সহন শক খেলো! তাহমির ঠোঁটে, মুখে,চোখে কামনার অনল দেখতে পাচ্ছে সে। আর অপেক্ষা নয়। সহন এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে সেই অনলে ঝাপ দিলো। উন্মাদের মতো ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো তাহমির ওষ্ঠে। প্রণয়ের অনলে পোড়াবে আজ তাকে। বন্ধ ঘরের চারদেয়াল সাক্ষ্যি হলো দু'টি মানব-মানবীর উষ্ণ নিঃশ্বাসের শব্দে। 

বৃষ্টির তোপ কমেছে। কিন্তু এখনো অল্পস্বল্প বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বটে। আয়ান ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো রাত আড়াইটা বাজে। কিছুতেই আজ ঘুম আসছে না তার। বিকেলে একটু বেশি বকে ফেলেছিল অনিমাকে। একমাস শেষ হওয়ার পরেও অনিমার বাবার রিকোয়েস্টে আরেক মাস পড়াতে হচ্ছে। সেই জন্যও আয়ানের মেজাজ বিগড়ে থাকে। তার উপর অনিমার অদ্ভুত কান্ডকারখানা তো আছেই। ঘটনা হয়েছে কী, আয়ান যথারীতি পড়াচ্ছিল অনিমাকে। অনিমার মনোযোগ বরাবরের মতোই অন্য কোথাও ছিলো। তবুও আয়ান কিছু বলেনি আজ। এক কথা বলতে বলতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার যোগাড় বলে আরকিছুই বলবে না বলে ঠিক করেছে আয়ান। মানেমানে এই মাস শেষ হলে এই ঝামেলার হাত থেকে সে বাঁচবে। তো পড়ানো শেষ হলো। আয়ান উঠে দাঁড়াতেই অনিমা কেমন করে যেনো তার দিয়ে লাফ দিলো। সাথে সাথে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো আয়ান। আর আয়ানের উপর অনিমা! সমস্যা সেটাও নয়। আয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে আছে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আর অনিমা তাকিয়ে আছে অসহায়ভাবে। পড়ে যাওয়ার ফলে দূর্ঘটনাবশতঃ দু'জনের ঠোঁট একত্র হয়ে গেছে। আয়ান বিদ্যুৎতের গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে জোরে একটা ধমক দিলো অনিমাকে। অনিমা তখনও ফ্লোরে বসা।
" অনিমা! মিনিমাম ভদ্রতা শেখোনি তুমি? বাবা-মা এতটুকু শেখায়নি? একজন পুরুষের সাথে এতো মাখামাখি কোনো ভালো মেয়ের চরিত্র হতে পারে না। "
" স্যার আমি ইচ্ছে করে করিনি। আসলে তেলাপোকা... "
" চুপ করো। অসহ্য একটা মেয়ে। "
আয়ান অনিমাকে ওভাবে ফেলে রেখেই চলে এসেছিল। তখন অনিমাকে খেয়াল না করলেও এখন বারবার ওর ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা মনে পড়ছে। মেয়েটা মজা করে করলে নিশ্চয়ই ওর চোখ ভেজা থাকতো না? তাছাড়া ওর তো মা নেই। বাবা-মা তুলে কথা বলাটাও ঠিক হয়নি নিশ্চয়ই। কিন্তু ওই মুহুর্তে এতকিছু খেয়াল ছিলো না। রাগের মাথায় কী যে বলেছে বুঝতে পারেনি। রাগের মাথায় যে ব্যক্তি নিজের মুখের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে সেই প্রকৃত যোদ্ধা। অনিমাকে একবার সরি বলতে না পারলে শান্তি লাগবে না। কিন্তু এতরাতে কীভাবে বলবে আয়ান? নম্বর নেই কিন্তু ফেইসবুক আইডিতে এড আছে। এখন নক করা কি ঠিক হবে? নাহ এতো ভাবলে সকাল হয়ে যাবে। আয়ান তড়িঘড়ি করে মেসেঞ্জারে ঢুকে সার্চ অপশনে গিয়ে অনিমার নামটা টাইপ করতেই অনিমার আইডি শো করছে। মেয়েটা অফলাইনে। এটাই তো স্বাভাবিক। এতো রাতে নিশ্চয়ই অতটুকু মেয়ের জেগে থাকার কথা নয়? ইনবক্সে ঢুকে মেসেজ টাইপ করতে লাগলো আয়ান।
" অনিমা আমি দুঃখিত বিকেলের আচরণের জন্য। আমার আসলে মাথা ঠিক ছিলো না। তুমি প্লিজ কষ্ট পেও না!"
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন