বন্য প্রণয় - পর্ব ১৮ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


ঘুম ঘুম চোখে আধোঘুমে জানালার দিকে তাকাচ্ছে অনিমা। রোদের আলো এসে চোখের উপর পড়ছে। ফলে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। চোখ ঢলে উঠে বসলো মেয়েটা। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে ফের শুয়ে পড়লো। কিশোরীর মন বড্ড চঞ্চল। এদিকে ওদিকে ফিরিয়েও আর ঘুম আসলোনা। তাই ফোন হাতে নিয়ে ডাটা অন করলো অনিমা। ফেইসবুকে ঢুকে নিউজফিড স্ক্রল করতে লাগলো। কিন্তু আয়ান স্যার নামক আইডি থেকে মেসেজ আসাতে একটু চমকাল সে। মেসেঞ্জার ওপেন করে মেসেজটা দেখলো।
"অনিমা আমি দুঃখিত বিকেলের আচরণের জন্য। আমার আসলে মাথা ঠিক ছিলো না। তুমি প্লিজ কষ্ট পেও না!"
মেসেজ পড়ে ভেংচি কেটে একা একাই বলতে লাগলো মেয়েটা,
" কষ্ট পেও না! কষ্ট দিয়ে তারপর বলতেছে কষ্ট পেও না। আদিখ্যেতা কতো হুহ্। "
অনিমা কী লিখে উত্তর দিবে ভাবতে থাকে। কিশোরী মন গতকাল খারাপ থাকলেও সেই বিষয়টা রাতে ঘুমানোর সাথে সাথে ভুলে গেছে। 
" ইট’স ওকে। "
এতটুকু লিখলো জবাবে। আজকে থেকে একেবারে চুপ হয়ে যাবে সে। আর বেশি কথা বলবে না। কালকের বিষয়টা ভুলে গেলেও তার রেশ কাটাতে পারেনি অনিমা।
" মামুনি! গুড মর্নিং। "
বাবার আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো অনিমা। নিজ হাতে দুই কাপ কফি নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন অনিমার বাবা। অনিমাও উঠে বসে বিছানা থেকে নামলো । ফোন বিছানায় রেখে দিলো।
" গুড মর্নিং বাবা। তুমি বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি দুই মিনিটে। "
" ওকে মাই প্রিন্সেস। আই এম ওয়েটিং ফর ইউ।"
" ওকে বাবা।"
ঠিক দুমিনিট পরেই দৌড়ে বাবার পাশে এসে বসলো অনিমা। জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে বাবার পাশে বসলো সে। চোখমুখ দিয়ে পানির ফোঁটা পড়ছে। অনিমার বাবা তোয়ালে নিয়ে এসে মেয়ের চোখমুখ মুছে দিলেন। দু'জনে কফির কাপে চুমুক দিলো। 
" ভালো করে এসএসসি পরীক্ষাটা দাও অনিমা। আমি চাই তোমাকে নিয়ে আমার গর্ব হোক। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বলো? লোকে যেনো এটা না বলে বড়োলোকের বিগড়ে যাওয়া মেয়ে তুমি। "
" আমি মন দিয়ে পড়াশোনা করবো বাবা। "
" তুমি খুব ছোটো। পড়াশোনা করো। সামনে কী করবে সেটা তখন ভেবো। তোমার বন্ধু, বান্ধবীদের খোঁজ আমি রাখি। ওদের সাথে মিশো না। ওরা নেশা করে। মাদকের নেশা ভয়াবহ অনিমা।"
মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত অনিমার বাবা। অনিমা সেটা বেশ বুঝতে পারছে। 
" আমি তেমন কিছু করবো না। তুমি এতো চিন্তা করো না বাবা। "
" বেশ। লক্ষ্মী মায়ের মতো কথা। আয়ান ছেলেটা ভালো। আমার অনুরোধে তোমাকে পড়াচ্ছে। তুমি ওর সাথে প্লিজ সহযোগিতা করো। লেখাপড়ার দিকে মন দাও।"
" আজকের পর থেকে আর দুষ্টমি করবোনা আমি। তুমি ভেবোনা এতো।"
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কক্ষ ত্যাগ করলেন ভদ্রলোক। অনিমা ভাবুক হয়ে গেলো। সত্যি সত্যি আজ থেকে নিজেকে খোলসের মধ্যে আঁটকে রাখবে। 

" আজকে আমার দুষ্ট মেয়েটাকে একটু বেশি-ই হাসিখুশি লাগছে! কাহিনী কী রে তাহমি? সহনের সাথে সবকিছু ঠিক হলো?"
দুপুরের জন্য রান্না চলছে হেঁসেলে। শাশুড়ী, বউমা মিলে রাঁধছে। কড়াইয়ে তেল দিয়ে তাতে পেঁয়াজ কুচো,রসুনবাটা,হলুদ,মরিচ আর অল্প পানি দিয়ে কষিয়ে নিচ্ছে তাহমি।
" হ্যাঁ মামুনি। তোমার ছেলে তো সেই কবেই সোজা হয়ে গেছে, আমি একটু নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছিলাম।"
আলু গুলো দিয়ে আবারও কষাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সে। ফরিদা খান ইলিশ মাছ ভাজার জন্য কড়াইয়ে তেল দিলেন। পাশেই অন্য পাত্রে মাছগুলো নুন,হলুদ দিয়ে মাখিয়ে রাখা। 
" তুই এতো দুষ্ট না জানি আমার নাতিনাতকুর কতটা দুষ্ট হয়! ছেলেটাকে আমার আর জ্বালাতন করিস না। সুখে-শান্তিতে এখন দু'জন মিলে সংসার কর। আর তাড়াতাড়ি সুখবর দেওয়ার ব্যবস্থা কর।"
" মামুনি তেল তেতে যাচ্ছে তো!"
তেল বেশি গরম হয়ে যাওয়ায় চুলো বন্ধ করে মাছগুলো তাতে ছাড়লেন ফরিদা। মেয়েটা একটু লজ্জা পেলো। সেজন্যই কথা ঘুরিয়ে ফেলেছে। 

গতকাল অনিকের সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে তৃষার। অনিক আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছে না বিয়েতে। প্রয়োজনে বিয়ে করার পরেও তৃষা বাবার বাড়ি থেকেই লেখাপড়া করবে। তবুও বিয়েটা এখুনি করতে চায় সে। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে দুপুরের খাওয়াদাওয়া না করেই ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা। আমেনা এসে মেয়েকে এভাবে অসময়ে ঘুমাতে দেখে কিছুটা বিচলিত হলেন। কপালে,গলায় হাত ছুঁইয়ে দেখলেন। না! শরীর ঠিকঠাক আছে। তিনি মৃদু ধাক্কা দিলেন তৃষাকে।
" তৃষা! এই তৃষা? দুপুরে খাবি না? "
এরমধ্যেই আয়ানও তৃষার ঘরে এসে উপস্থিত হলো। খাওয়ার টেবিলে আদরের বোনটিকে না দেখে এসেছিল ডাকতে। তৃষাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে সে-ও চমকে উঠে। 
" মা তৃষার কী হয়েছে? তৃষা! এই তৃষা?"
" আরে অসময়ে ঘুমিয়ে গেছে। কিচ্ছু হয়নি। আমি গেলাম। তুই ওকে ডেকে তুলে নিয়ে খেতে আয়।"
আমেনা ছেলেকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভাই আর মায়ের হাঁক-ডাকে তৃষার ঘুম ছুটে গেছে এতক্ষণে। পিটপিট করে তাকাল আয়ানের দিকে। 
" শুনেছি মানুষ বিয়ের বছর অনেক ঘুমায়। তোর কি এ বছরই বিয়ে নাকি রে?"
আয়ান সবগুলো দাঁত বের করে তৃষাকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তৃষা শান্তভাবে উঠে বসলো। চিন্তিত সুরে বললো, " ভাইয়া অনিক বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে চাচ্ছে। "
" সমস্যা কী? আসবে! আমি আর আপা আছি না আমরা আব্বু আর আম্মুকে বুঝিয়ে বলবো। "
" তুমি কথা বলবে উনার সাথে? "
" রাতে কথা বলিয়ে দিস বরং। এখন খেয়েদেয়ে পড়াতে যেতে হবে আমাকে।"
" ঠিক আছে। চলো তাহলে খেয়ে নিতে।"
" তুইও আয় চোখেমুখে পানি দিয়ে। চুলগুলো ভালো করে শুকিয়ে নে। ভেজা চুল নিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলি!"
তৃষা তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছছে। 
" তুমি যাও আমি আসতেছি। "
" ওকে।"
ভাই চলে যাওয়ার পরে চোখেমুখে পানি দিয়ে চুলগুলো তোয়ালে পেঁচিয়ে তৃষাও ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোলো। 

আকাশে মেঘ জমেছে। দুপুরের রোদের তেজ কমে এসেছে কিছুটা। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে বাইরে। ঘরে বসে বই পড়ছে। সহন আজকে বাসায় আসেনি দুপুরে। কাজের চাপ বেড়েছে। অবসরে বই পড়ে সময় কাটাতে পছন্দ করে মেয়েটা। সহনের সাথে ঝামেলা না হওয়ায় হাসফাস লাগে তাহমির। আজকে রাতে ফিরলে নিজে থেকেই ঝামেলা শুরু করবে বলে ঠিক করেছে সে। ফোনের রিংটোনে ধ্যান ভঙ্গ হলো তাহমির। নম্বরটা দেখেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে তার।
" হ্যালো! "
" হ্যাঁ বল।"
" এরকম তেঁতো করে কথা বলছিস কেনো তাহমি?"
" কারণ আমি করলা,নিম গাছ।"
" সেধে সেধে ঝগড়া করবি?"
" ইচ্ছে নেই। "
" তা হঠাৎ মহারাণীর কী হলো? "
" কিছু না। এদিকে আয় তো।"
সহন ফোনের ওপাশে বসে হকচকিয়ে গেল। কীভাবে দূরে থেকে কাছে আসবে? তবুও বললো,
" আসলাম।"
" চোখ বন্ধ করে ফিল কর একটা টসটসে চুমু খেলাম তোর গালে।"
" হট কিস? "
" উঁহু। তাহলে ঠোঁটে দিতাম। "
" আর বলিস না। বাসায় ছুটে আসতে হবে এখন তাহলে। "
" থাক আসতে হবে না এখন। রাখলাম।"
তাহমি কল কেটে দিলো। ইচ্ছে করে সহনের মনে ছটফটানি ঢুকিয়ে দিলো। বেচারা সহন কাজের দিকে মন না দিয়ে, এখন বউয়ের দেওয়া টসটসে চুমু সামনে থাকলে কীভাবে খেতো সেসব ভাবতে শুরু করেছে। তাহমি এদিকে ঠোঁট টিপে হাসছে। 

আধঘন্টা ধরে চুপচাপ মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে অনিমা। ফলে আয়ান ভুত দেখার মতো চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। এই অনিমাকে তো সে চেনে না। যা বলছে তাই করছে! না বেশি কথা বলছে আর না তো অন্যমনস্ক হচ্ছে। মেয়েটা কি খুব কষ্ট পেলো? কীভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত আয়ানের? 
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন