বন্য প্রণয় - পর্ব ২০ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


সন্ধা হয়ে গেছে। বাইরে অন্ধকার নেমেছে। পাখিরা যে যার নীড়ে ফিরেছে ইতিমধ্যে। ড্রইং রুমে বসে আছে তিন ভাইবোন। তাহমি বিকেলে চলে এসেছে বাবার বাড়ি। কথামতো সহনের অফিস থেকে রাতে আসার কথা এ বাড়িতে। তাহমিকে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছে সবাই। আমেনা বেগমের তো খুশি ধরে না! আয়ান আর তৃষা তাহমিকে নিয়ে ছোটখাটো ঝগড়াও শুরু করে ফেলেছিলনএরমধ্যেই। আয়ান বলছিল তাহমি ওকে বেশি ভালোবাসে তো তৃষাও বলছিল আপাই তাকে বেশি ভালোবাসে। শেষমেশ আমেনা এসে ছেলেমেয়েদের থামিয়েছেন।

" আপাই আজ মা এলো বলে আমি চুপ করলাম। তুমি কিন্তু বললে না কাকে বেশি ভালোবাসো।"

তৃষা মুখটা হুতুমপেঁচার মতো করে বসে আছে। আয়ান তাহমিকে ফের বললো কথাটা। আমেনা ইসলাম রান্নাঘরে চা তৈরি করতে গিয়েছিলেন। চা নিয়ে এদিকে এলেন। 
" এই আয়ান! তোদের না চুপ করতে বললাম? এক একটা বুড়ো হলো তবুও ছেলেমানুষী গেলোনা তোদের। তাহমি চা নে, তৃষা তুইও।"
দুবোন মায়ের থেকে চা নিয়ে চুমুক দিলো তাতে। আয়ান বসে রইলো। আমেনা ইসলাম বিরক্তি নিয়ে বললেন, " তোকে কি দাওয়াত করে চা নিতে বলবো বাবা? "
" আমাকে তো নিতে বললেও না। তাই নেইনি এতক্ষণ। এবার নিচ্ছি! "
আয়ান চায়ের কাপটা নিজের হাতে তুলে নিলো। তৃষা আড়ালে ভেংচি কাটলো ভাইয়ের কথায়। তবে আয়ান সেসব দেখেনি। তাহমি দেখেছে ঠিকই। এখন ট্রে-তে বাকি আছে একটা চায়ের কাপ শুধু। ওটা তাহমির বাবার জন্য নিয়ে গেলেন আমেনা। তাহমির বাবা এ সময় টিভিতে খবর দেখেন। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় শুয়ে অনিকের নম্বরে কল দিলো তৃষা। অনিক কল কেটে দিয়ে ব্যাক করলো। তৃষা এক সেকেন্ড বিলম্ব করলোনা কল রিসিভ করতে।
" হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। "
" ওয়া আলাইকুম আসসালাম। কী খবর আমার হবু বউয়ের? "
" আপনি জানেন না? আপনি না বলেছিলেন আমরা এক মন, এক প্রাণ? তাহলে আপনি জানেন না কেনো?"
" মনের খবর তো জানি! বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছো কিন্তু শরীরের খবর তো জানি না। কারণ এখনও তো এক মন,এক প্রাণ হলেও এক দেহ হয়নি।"
তৃষা লজ্জায় থতমত খেলো। লোকটা তো ভালোই বেকায়দায় ফেলতে পারে! 
" কাল কয়টার দিকে আসবেন? "
" পারলে তো সূর্য উঠলেই চলে যেতাম। কিন্তু সেটা বড্ড বেমানান না? এজন্য ভাবছি সকাল দশটার দিকে আসবো।"
" বেশ। আমি তাহলে আম্মুকে সেটাই বলছি।"
" তৃষা!"
" জি বলুন। "
" আমাকে তোমার পরিবারের সবার পছন্দ হবে? "
" অবশ্যই হবে। আচ্ছা ডাক্তার সাহেব, আপনি কিন্তু বেশি ভালোমানুষি করে অতীতের কথা বর্তমানে টানবেন না। অতীত বর্তমানকে নষ্ট করে, ঝামেলা সৃষ্টি করে। "
" না আনবো না। যার সাথে সংসার করবো সে জানলেই হবে। আমি তো আমার দিক থেকে পরিষ্কার। "
" হুম হুম বুঝলাম। রাখছি এখন।"
" ঠিক আছে। কাল দেখা হচ্ছে তাহলে? "
" ইনশাআল্লাহ! "
" ইনশাআল্লাহ। শুভ রাত্রি। "
" শুভ রাত্রি "
তৃষা কল কেটে ফোনটা বুকে চেপে ধরে বিড়বিড় করে বললো,
" রাতটা আর শুভ হবে না আজ। সারা রাত অপেক্ষা করতে করতে ছটফট করবো,কখন সকাল হবে সেই আশায়!"

ঘরের এদিক থেকে ওদিকে পায়চারি করে যাচ্ছে তাহমি। এই নিয়ে পাঁচ বার কল দিলো সহনকে। কিন্তু রিসিভ করলোনা আর না তো কেটে দিলো। চিন্তা হয় না বুঝি? তাহমি ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো আরেকবার। এগারোটা ছুঁইছুঁই! অফিস থেকে তো সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরে সহন। তাহমিট সাতপাঁচ ভাবনার ছেদ করে ফোনের নোটিফিকেশন টোন বেজে উঠলো। মেসেজ এসেছে সহনের নম্বর থেকে, 
❝ কালকে সকাল সকাল যাবো বাসায়, এখন ঘুমালাম। শুভ রাত্রি। ❞
তাহমির মেজাজ খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করে এমন করলো মিচকে শয়তানটা। কী করবে এখন? পারলে এখুনি সহনের কাছে গিয়ে তুমুল ঝগড়াঝাটি করতো। ইশ ঝগড়া করার এই সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে ভাবতেই ডিপ্রেসড লাগছে তাহমির। অগত্যা সারা রাত বিছানায় এদিক-সেদিক করতে করতে শেষ রাতের দিকে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো। 

সকালের মৃদু রোদের আলোর সাথে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে কিশোরী অনিমা। স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে সে। একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অর্না এগিয়ে গেলো ওর দিকে। 
" কী রে অনিমা, এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কী করছিস?"
পেছন থেকে অর্নার কন্ঠ শুনে ফিরে তাকাল অনিমা। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে হেসে বললো, " কিছু না রে। "
" ইদানীং কেমন লাগছে তোকে। কেমন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিস!"
" কই? আমি তো ঠিকই আছি।"
" বুঝি না যেনো আমি। আচ্ছা তোর টিউটর কি ভেগেছে? "
আয়ানের কথা উঠতেই অনিমার হৃৎস্পন্দনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ নিয়ে অবশ্য কিশোরী মন আপাতত ভাবছে না।
" না। লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ দিয়েছি। তাই আর চাইছি না আয়ান স্যার ভেগে যাক।"
অনিমার কথা শুনে অর্না চমকাল,থমকাল। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো বান্ধবীর পানে। এ যেনো ভুতের মুখে রামনাম! 
" অনিমা তুই কি কোনোভাবে তোর টিউটরকে ভালোটালো-বেসে ফেলেছিস?"
" ধ্যাৎ! কীসের ভালোবাসা? বাবার মুখের দিকে চেয়েই এই সিন্ধান্ত নিলাম। জীবনে ভালো কিছু করতে হবে। এভাবে লেখাপড়া করলে তো কিচ্ছু হবে না। "
" বেশ। তাহলে ঠিক আছে। "
দু'জনের কথোপকথনের মধ্যে ক্লাসের ঘন্টা বেজে উঠলো। অনিমা ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বললো, 
" চল চল ক্লাস শুরু হয়ে যাবে এখুনি। "
" ওহ হ্যাঁ চল।"

রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত আমেনা,তাহমি। তৃষা সাথে টুকটাক সাহায্য করছে অবশ্য। বিভিন্ন ধরনের নাস্তা তৈরি করছে। নুডলস, ডিম, মিষ্টি, শরবত, পাঁচ রকমের ফলমূল, সেমাই, ফালুদা, আরও কয়েকপ্রকার আইটেম থাকছে। হবু জামাইকে আপ্যায়নে কোনো ক্রটি রাখতে চাননা আমেনা ইসলাম। 
" তৃষা তুই এখন ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। দশটা প্রায় বেজে গেছে। আমাদেরও তো কাজ শেষ প্রায়।"
তাহমি বোনকে বললো। তৃষা মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলো একবার। আমেনা ইসলামও মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। 
" ঠিক আছে আপাই।"
তৃষা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বেডরুমে গেলো নিজেকে পরিপাটি করতে। এদিকে তাহমি আর তাহমির মা সব খাবারগুলো গুছিয়ে রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো বসার ঘরে। তাহমির মেজাজ খারাপ। এখনো সহনের আসার কোনো নামগন্ধ নেই! আয়ান সোফায় বসে ফোন ঘাঁটতে ব্যস্ত। এরমধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে এলো। ন'টা পয়তাল্লিশ বেজেছে। অনিক নিশ্চয়ই আগে আগে আসবে না? তাহলে সহন এসেছে। তাহমি গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সহন দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। 
" দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে ভেতরে ঢুকবো কীভাবে? "
" তাহমি জামাইকে ঢুকতে দে।"
মায়ের কথায় ভেতরে সরে দাঁড়াল তাহমি। সহন বাসার ভেতরে ঢুকে আয়ানের পাশের সোফায় বসলো। দরজা আঁটকে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাহমি।
" কেমন আছেন মা?"
" এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো? বেয়াই আর বেয়ান কেমন আছেন? "
টি-টেবিলের ওপর শরবত,ফলমূল রেখে জিজ্ঞেস করলেন আমেনা ইসলাম। সহন হাসিমুখে উত্তর দিলো,
" সবাই আলহামদুলিল্লাহ। এগুলো লাগবে না এখন মা। আমার ভায়রাভাই আসুক দু'জন একসাথেই খাবো।"
" তাহলে শরবতটুকু অন্তত পান করো। গরম থেকে আসলে!"
" ঠিক আছে মা।"
সহন শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিলো। আমেনা ইসলাম ফলমূলের বাটি নিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে রাখলেন। তাহমির বাবা নিজের ঘরের বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছেন। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মাঝে মধ্যে ব্যস্ত সড়কে যানবাহনের চলাচলের দিকেও দৃষ্টিপাত করছেন। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলেন একবার। ছেলেটার আসার সময় হয়ে এসেছে। বসা থেকে উঠলেন তিনি। হাতের পত্রিকা ঠিক জায়গায় রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরের উদ্দেশ্যে বেরুলেন তিনি। মেয়ের পছন্দের উপর যথেষ্ট ভরসা আছে উনার। ছেলেমেয়েদের সব সময় ভালো কিছু শেখানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন বাবা-মা। তাহমির বাবা-মাও তার ব্যতিক্রম নয়।
.
.
.
চলবে.......................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন