মাগরিবের আজান দিতে বেশি দেরি নেই। মিনিট পঁচিশে বাকি। আয়ান নিজে সাথে করে ওহিদের বাসার সামনে নিয়ে এসেছে বোনকে। তৃষার মা একটু দোনোমোনো করলেও আয়ানের কথায় আর না করেনি তৃষাকে,ওহিদের বাসায় আসতে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে দিনা। আয়ানকে দেখা মাত্রই দিনা কিছুটা মুখ আড়াল করে সহাস্যমুখে বলে,
" ভাইয়া আপনিও আসন তৃষার সাথে। একসাথে ইফতার করবেন।"
আয়ান কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
" ধন্যবাদ আপু। আমি বাইরে ইফতার করবো আজ। আপনারা ঘরে বসে একসাথে ইফতারি করুন বরং।"
" বেশ তাহলে আরেকদিন আসবেন অবশ্যই। "
" চেষ্টা করবো বোন। তৃষা আমি গেলাম। তোর হলে আমাকে কল দিস। "
তৃষাকে উদ্দেশ্য করে শেষের কথাগুলো বললো আয়ান। দিনা আগবাড়িয়ে বললো,
" আপনি বাসায় চলে যান ভাইয়া। আমার নিজস্ব গাড়িতেই তৃষাকে পাঠিয়ে দিবো। চিন্তা করবেন না।"
" অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার বোনের জন্য এতটা ভাবার জন্য। কিন্তু আপু তৃষাকে সাথে নিয়েই বাসায় ফিরবো আমি। মায়ের আদেশ বলতে পারেন।"
" বেশ ঠিক আছে তাহলে।"
" হ্যাঁ আসছি আমি। "
আয়ান উল্টো পথে পা বাড়াল। তৃষা ও দিনা ঢুকলো বাড়ির ভেতর। বসার ঘরে ঢুকতেই ওহিকে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো তৃষার। ওহি দাঁড়িয়ে আছে তার জন্যই।
" চলো খাবার টেবিলেই বসি গিয়ে। সবকিছু রেডি করে রেখেছি।"
তৃষা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। সবাই ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোলো। চেয়ার টেনে বসলো তিনজন। এরমধ্যেই গলা খাঁকারি দিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো অনিক। তৃষা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে অনিকের দিকে। ওহি খিলখিল করে হাসছে। অনিক ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করতেই তৃষা দৃষ্টি নত করে ফেললো। মনে মনে এতশত প্রশ্নরা তাড়া করতে লাগলো তাকে। লোকটা আজকে কীভাবে এখানে? তাহলে কি এ সপ্তাহে এখানেই থেকে গেছে? কিন্তু কেনো! আগে জানলে কখনো ইফতারের দাওয়াত কবুল করতো না তৃষা। এখন কিছু বলাও যাবে না। তৃষা চোখ বন্ধ করে কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেললো। নাহ,ভাইয়ার কথামতো মনে করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো তৃষা।
" আর কিছু বাকি আছে দিনা? থাকলে বল এখনও সময় আছে। আমি ঝটপট তৈরি করে আনবো। "
অনিক হাসি হাসি মুখে বোনকে জিজ্ঞেস করলো। দিনা আনন্দে আটখানা হয়ে বলে," আরকিছুই লাগবে না। এতকিছু তো তৈরি তুমিই করলে। আমি শুধু সাহায্য করেছি। এখন ওজু করে এসে বসো আমাদের সাথে। "
তৃষা দ্বিতীয় বারের মতো চমকাল। টেবিলে সাজিয়ে রাখা সব খাবারের আসলে রাঁধুনি ডাক্তার সাহেব? এবার ভালো করে টেবিলে রাখা খাবারের দিকে দৃষ্টিপাত করলো তৃষা। বুট, মুড়ি, চার রকমের শরবত, ডিম সেদ্ধ, তরমুজ, ফেলুদা, কয়েক পদের ফল, পাটিসাপটা পিঠা, খেজুর, বেগুনি, আলুর চপসহ নানান প্রকার খাবারের সমোরোহ। একজন পুরুষ মানুষ এতকিছু ধৈর্য ধরে কীভাবে রান্না করলো তা-ও রোজা রেখে সেসব ভাবছে তৃষা। দিনার কথামতো অনিক ওজু করে এসে একটা চেয়ার টেনে বসলো। ওহির পাশের চেয়ারেই। লোকটার মতিগতি বোঝা দ্বায়। এমন করে তৃষার দিকে তাকাচ্ছে মনে হয় কত ভালো সম্পর্ক দু'জনার!
মাগরিবের নামাজ শেষে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিল তাহমি। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলেন সহনের মা। শ্বাশুড়িকে দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো মেয়েটা।
" আহা এভাবে উঠে বসলি কেনো? শুয়ে থাক। আমি বসে কথা বলছি।"
তাহমির পাশে বসে বললেন ফরিদা খান। উনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তাহমি বিষয়টা বুঝতে পেরে ভালো করে উনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
" কী হয়েছে মা? তোমাকে এরকম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছে! "
" আমার কিছু হয়নি রে তাহমি। তোর কী হবে সেসব ভাবছি। আমি বেশ বুঝতে পারছি তোদের মধ্যে কিছু ঠিকঠাক হয়নি এখনো। নিজেদের কেমন অপরাধী লাগে। আমাদের উচিত ছিলো না ওভাবে বিয়েটা দেওয়ার। তোর বিয়ে না হলে না হতো। বিয়ে ভাঙলে পরে আর বিয়ে হতোনা এমনটা তো নয়।"
হতাশাগ্রস্ত হয়ে বললেন সহনের মা। তাহমি বুক চিঁড়েও দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। যতই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করুক না কেনো দিনশেষে তো সে একজন মানুষ! প্রতিটি মানুষের ভেতরই একজন শিশু বসবাস করে। আর সেই শিশুসুলভ মন নীলার অস্তিত্ব মানতে পারে না। তবুও সবকিছু ঠিক হবে ভেবে এগিয়ে যাচ্ছে জীবন নামক পথে। বিয়ে যেভাবেই হোক কোনো স্ত্রী তার স্বামীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক মানতে পারে না।
" উঁহু এসব কেন বলছো? হ্যাঁ এটা ঠিক আমার বিয়ে পরে হতো। কিন্তু মনে করো তখন যদি তোমার ছেলের থেকেও ঝামেলার কোনো মানুষ আমার জীবনে আসতো? তোমার ছেলের তো কোনো বদঅভ্যেস নেই। শুধু একটা প্রেমিকা আছে এই যা। আসলে বিয়েটা তো মানতে পারেনি এজন্য বউ আছে এটাও মনে করছে না সহন। তাই বাইরের প্রেমিকা ছাড়তে পারছে না। একসাথে থাকতে থাকতে ঠিক বউয়ের অস্তিত্ব টের পাবে। আমি সোজা করে ফেলবো তোমার ছেলেকে।"
তাহমির কথায় কিছুটা প্রশান্তি লাভ করেন ফরিদা। তাহমির হাতে হাত রেখে বললেন,
" তুই সারাজীবন এরকমই থাকিস তাহমি। তুই আগে আমার মেয়ে, ছেলের বউ পরে। "
" ঠিক আছে আম্মাজান। এভাবেই থাকবো।"
উচ্ছসিত কন্ঠে হেসে বলে তাহমি। এমন সময় সহন চলে আসে। সন্ধ্যায় বাইরে ছিলো আজ সে। ছেলেকে দেখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন ফরিদা।
" আমি আসছি বরং তাহমি। দেখ সহনের কিছু লাগবে কি-না। "
মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সহন তাহমির দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বলে,
" পেত্নী আবার দেখবে প্রয়োজন!"
তাহমি কিছু বললো না। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সহনের দিকে। বুকে মুখ গুঁজে শুঁকতে লাগলো। সহন চুলের মুঠি ধরে তাহমিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ফের বললো,
" জানতাম তো কুত্তার মতো আসবি শুঁকতে। কত্ত খারাপ রে তুই! "
" ওই হুলোবেড়াল আমি খারাপ আর তুই কি দুধে ধোঁয়া তুলসীপাতা? তোর গায়ে তো গন্ধ পেলাম না কিন্তু কপালে অস্পষ্ট লিপস্টিকের দাগও কি দেখিনি?"
চকিতে কপালে হাত দিয়ে ঘষতে শুরু করলো সহন। শরীরের পারফিউমের ঘ্রাণ সরাতে নতুন একটা পারফিউম মেখে আসলো। কিন্তু কপালের কথা খেয়াল নেই! ইশ কেন যে নীলা ঠোঁটে লিপস্টিক ব্যবহার করে? তাহমির মতো লিপস্টিক না দিলে তো আজ এই ঝামেলা পোহাতে হতোনা! তাহমি ততক্ষণে সহনের কপালে চিরুনী দিয়ে ঘষতে শুরু করেছে।
" কী করছিস তাহমি? ছিঁলে যাবে তো কপাল! উহ লাগছে। "
" চোপ এক্কেবারে চুপ। তোকে আমি খু*ন করবো আজকে। আমি কিস করলে তোর অসহ্য লাগে আর ওই লীলা করলে ভাল্লাগে? "
সহন কোনোরকমে তাহমির দুই হাত ধরে আঁটকে রেখেছে। নইলে কপালের দফারফা করে দিবে।
" তাহমি এমন করিস না। তোর কি ডাক্তার লাগবে? এরকম পাগলামি কেউ করে? তোর চোখমুখ কেমন লাগছে। "
তাহমির মেজাজ এখন তুঙ্গে। মন ও মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে যেনো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলছে। সহনের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের ওড়না ভিজিয়ে আবারও সহনের কাছে ফিরে আসে। সহন বরাবরই অবাক নয়নে তার পাগলি বউয়ের কর্মকাণ্ড দেখে।
" দাঁড়া। "
তাহমি এ কথা বলেই ওড়না দিয়ে সহনের কপাল মুছে নিলো কয়েকবার। সহনের বেশ মজা লাগছে। তবে সেটা বাইরে প্রকাশ করছে না। গায়ের অর্ধ ভেজা ওড়না ফ্লোরে ফেলে সহনের হাত ধরে হেঁচকা টানে বিছানায় ফেলে তাহমি। সহন খাটের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো বলে কাজটা সহজ হলো। সহন থমকাল তাহমির পাগলামো দেখে। এ তো সাই*কো বউ!
" চুমু লাগবে? কয়টা লাগবে?"
তাহমি সহনের পেটের উপর উঠে বসে দুপাশে পা রেখে বসেছে। সহন তাহমিকে দেখে রীতিমতো ভয় পাচ্ছে। নেহাৎ তাহমি মেয়ে বলে সহনের এই অত্যাচারিত হওয়া কারো কাছে অন্যায় বলে মনেই হচ্ছে না। যদি সহন এগুলো তাহমির সাথে করতো তাহলে নির্ঘাত কত-শত মামলা হতো! এসব ভেবেই নিজেকে আপাতত ভীষণ অসহায় লাগছে সহনের।
" তাহমি তুই থাম প্লিজ। আমি আর কখনো নীলাকে স্পর্শ করতে দিবো না "
"এক কথা কতদিন বলবি? যে-ই আমি এরকম ঝামেলা করি তখুনি আমাকে স্বান্তনার বাণী শোনায়। "
তাহমি সহনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দেয় সহনের ঠোঁটে। চোখগুলো সহনের কোটর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম!
.
.
.
চলবে.............................