প্রেম নির্বাসন - নাবিলা ইষ্ক - অনু গল্প


মায়ার বিনানো চুলে টান পড়ল। অস্পষ্ট আওয়াজে আর্তনাদ সুরে বলে উঠল,

'চুল টানলেন কেন?' 

নবীন ভ্রুদ্বয় কুঁচকে রেখেছে। দৃষ্টি মায়ার লম্বা, মোটা বিনুনি গাঁথা চুলের মাঝে। অসন্তুষ্ট গলায় বলল,

'এভাবে চুল ঝুলিয়ে হাঁটলে একশোবার টানব। যাও না গিয়ে নালিশ করো তোমার বাপজানের কাছে। দেখি আমার কী বাল সে করে!'

মায়া এবারে ঘুরে দাঁড়াল। তার কাজলচোখ জোড়া আআড়ালে-আবডালে একটিবার চাইল। অভিমান ভরতি কণ্ঠে আওড়াল,

'কথাবার্তার এই কেমন দুর্গতি? আপনি আমার বাপজানের পেছনে পড়ে থাকেন কেন? সে আপনার কোন বাড়া ভাতে ছাই ফেলেছে, শুনি?'' 

নবীনের দু'হাত পিঠের পেছনে বাঁধা। অঙ্গে ধারণ করা সাদা পাঞ্জাবির শেষভাগটুকু মৃদু বাতাসে উড়ছে। চুলগুলো কাঁপছে বোধহয়? মায়া ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারল না। নিশাচর আঁধারে ঠাওর করা সম্ভবও নয়। নবীন গম্ভীরমুখের ডান ভ্রু তুলে অবলীলায় জানাল, 

'সে না হয় তোমার বাপজানরেই প্রশ্ন করো! সেই উত্তর দেক। আমার একেকটি শব্দ তো তোমার কাছে দুর্গতি বলে মনে হয়। আমি আর কিচ্ছুটি নাই বা বলি।'

মায়ার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল ততক্ষণে। 
চোখের পাপড়িযুক্ত কম্পিত হলো। নূপুর পরিহিত আলতারাঙা নিজ পদচারণ জোড়ায় চোখ রেখে স্পষ্ট এবং দৃঢ় গলায় বলল,

'তা কী আমি কখনো বলতে পারি? আপনার দেখা পাওয়ার জন্য, কণ্ঠ শোনার জন্য– এইযে মাসব্যাপী অপেক্ষা করি বুঝি এরজন্যে?'

'তাই নাকি? তোমার চালচলন, কথার ধরন তো তা বলছে না। কই, আমাকে দেখে তো উতলা হলে না। ডাকার পরেও তোমার চেহারা অবদি দেখবার নসিব হলো না। দূরে দূরে পালিয়ে বেরিয়েছ। এখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো! আমি কি বুঝে নেব ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু সি মি?'

মায়া টলমলে চোখ জোড়া তুলে চায়। সেই কী আদুরে দৃষ্টি! নবীনের মনে হলো ওই চোখজোড়াতে শুধু তারই বসবাস। ওই টলমলে নয়ন তারজন্যই অশ্রুসিক্ত। তারজন্যই ওই মায়াবী মুখটায় আঁধার নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে দু'পা এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে মুছে দিলো মায়ার ভেজা চোখ,

'কিছুই বলা যায় না দেখি! কী বললাম আমি? এতটুকুতেই কেঁদে ফেললে যে!'

মায়ার চোখজোড়া মুছিয়ে নবীন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে কাঠকাঠ কণ্ঠে বলে, 

'আমি তো আর মনোবিজ্ঞান নই। তুমি তোমার মনের কথা না বললে কীভাবে বুঝব? কীভাবে জানব?'

মায়া তোতলানো ভঙ্গিতে মিইয়ে যাওয়া গলায় জানায়, 'ল--লজ্জা করে।'
'আমার সামনে কীসের লজ্জা তোমার? সেই সুদূর ঢাকা থেকে মাসে দু-বার করে গ্রামে ফিরি। কার জন্য? এত ব্যস্ততার মধ্যেও কার টানে ফিরে আসি বলো? যার জন্য করি চুরি সেই যদি মূল্য না দেয় তাহলে কীসের প্রয়োজন আমার এত কষ্টের? না ফেরাই উত্তম। ভেবেছিলাম চারদিন থাকব। এখন আর থাকব না। কালই ফিরে যাব। পারলে এক্ষণ চলে যেতাম।'

মায়ার নাক ফুঁলেফেপে উঠছে। ভেজা চোখজোড়া বেয়ে এবারে টপটপ জল ঝরছে। ঝর্নার মতন গড়িয়ে চলেছে বিনাবাধাতে। প্রিয়তমার কান্নারত মুখ দেখে নিজ হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলেও নবীন চুপ থাকল। আগ বাড়িয়ে শান্ত করতে গেল না। মূর্তির মতন দু'দণ্ড দাঁড়িয়ে চলে যাবার জন্য উদ্যত হলো। মায়া তক্ষুনি দু'পা এগোয়। টেনে ধরে নবীনের পাঞ্জাবি। লজ্জাসংকোচ খুইয়ে ভেজা চোখে চেয়ে বলে ওঠে,

'আর হবে না এমন! চলে যাবেন না!'

নবীন যেন গলল না। পূর্বে চেয়েও কঠিন কণ্ঠে আদেশ ছুঁড়ল, 'তুমি করে বলো আমায়। নাম ধরে ডাকো। বলো–তুমি আমায় ভালোবাসো। বলো–তুমি আমায় ভালোবাসো।'

মায়ার শ্বাসপ্রশ্বাস থমকাল। দৃষ্টি বিমুঢ় হলো। এলোমেলো তবে লজ্জিত হৃদয় নুইয়ে উঠল। তবে ভীতু মন কী আর লজ্জায় চুপসে থাকলে হবে? নবীনের চেয়ে নিশ্চয়ই মায়ার লজ্জা বড়ো নয়? চোখজোড়া শক্ত করে বুঁজে নিলো। কম্পিত তবে স্পষ্ট গলায় কোনোরকমে জানাল,

'ভীষণ ভালোবাসি।'

এতেই যেন সন্তুষ্ট নবীন। গম্ভীরমুখ জুড়ে রশ্মি ছড়াল। সূর্য হয়ে দেখা দিল চওড়া হাসি। চোখমুখ উজ্জ্বল করে ঘুরে দাঁড়াল। জোরপূর্বক মায়াকে টেনে নিলো বুকের মধ্যিখানে। মায়ায় চমকাল, কেঁপে উঠল। তবে আজ আর সাহস দেখাল না সরে যাবার। চোখ বুঁজে পড়ে রইল শক্ত বুকে। নবীনের শরীর থেকে মিষ্টি একটি ঘ্রাণ আসছে। 
মায়া আরেকটু গাঢ়ভাবে শুঁকল। নবীন দুজনের মাঝে ফাঁক রেখে বলল,

'দেখি তাকাও তো। তোমার চোখ দেখি। কতদিন দেখি না!'

মায়া বাধ্য মেয়ের মতন মাথা তুলল। দৃষ্টি নবীনের বুক বরাবর। নবীন মাথাটা ঝুঁকিয়ে নতমুখে বলল,

'আমার চোখে তাকাও।'

রাত্রির জ্যোৎস্নাময়ী রশ্মি জুড়েছে মায়ার সরলমুখ জুড়ে। নতমুখী সে অস্পষ্ট স্বরে আওড়াল,

'এভাবেই দেখেন না! আমি পারি না তাকাতে।'
'আবার?'

মায়া ঢোক গিলল, 'এভাবেই দেখ!'

নবীন এযাত্রায় ক্ষীণ হাসল, 

'দুপুরে তো খুব দেখছিলে আড়ালে দাঁড়িয়ে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিলে।'

ক্ষণিকের জন্য বিস্ময় খেলা করল মায়ার সর্বমুখ জুড়ে। পরপরই লজ্জায় নুইয়ে এলো ঘাড়। আমতাআমতা করে কোনোরকমে কথা ঘোরাতে বলল,

'ঘরে নেই কেউ জানলে খারাপ হবে।'

নবীন ধমকাল রুঢ় গলায়,

'আমাকে বোকা মনে হয় তোমার? সবাই ঘুমাচ্ছে। কে যাবে শুনি তোমার ঘরে?'

মায়া চুপ করে থাকলেও তার হাত দুটো শান্ত নেই। শাড়ির আঁচল দৃঢ় ভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। নবীন ওর হাতজোড়া নিবিড় দৃষ্টিতে পরখ করে নিলো। দেখল কাটা দাগ পড়েছে দুটো নতুন। হাত দুটো ধরে নির্বিকার গলায় শুধাল শুধু,

'এবারে হাত কাটল কী করে?'
'পেয়াজ কাটতে গিয়ে।'

নবীন রাগ সংবরণ করল কোনোমতে,

 'বলেছিলাম না এসব করতে না? কাজের লোক বাড়িতে কী করতে রেখেছি?'

মায়ার মশকরা করতে ইচ্ছে হলো, 'আমাকে পাহারা দিতে!'
'পাহারা না দিলে পালাবে বুঝি? দেখি পালিয়ে দেখাও। নাকি আমার সঙ্গে পালাবে? একবার বলো, আজ আর এক্ষণ তোমায় নিয়ে যাব। আর ফিরব না এই গ্রামে।'

নবীন মজার সুরেই বলেছিল সবসময়ের মতন। মায়ার জবাবও নিত্যদিনের মত হবে বলেই জানতো। তবে তাকে আশ্চর্যের সপ্তমে পৌঁছে মায়া শুধাল,

'তারপর? তোমার কষ্ট হবে না? আমাকে রাখতে, আমাকে পালতে? আমি তো শহুরে ব্যাপারস্যাপার বুঝি না।'

নবীন চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল। আশা জাগল মনে। নিজেকে সামলে দৃঢ় গলায় জানাল,

'একটু কষ্ট হলেই বা কী? তুমি পাশে থাকলে সব কষ্টকে আমি সুখে পরিণত করব।'

মায়া চোখ তুলে চাইল। নবীনের চোখে নিজের সরল দৃষ্টি রেখে বলল,

'নিয়ে চলো। আমায় তোমার সাথে নিয়ে চলো। আমি তোমায় ছাড়া আর কাউকে চাই না। অন্যকাউকে বিয়ে করতে চাই না।'
'বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে আবার?'
'হুঁ। কাল দেখতে আসবে।'

নবীন আঁধারে আকাশের ফকফকে সাদা চাঁদটা একমুহূর্ত দেখল। ফিরে তাকাল মায়ার মুখপানে। শুধাল,

'আফসোস করবে না তো? কষ্ট পাবে না তো? আমার সাথে পালালে তোমার বাবা নাও মেনে নিতে পারে। বুঝেশুনে মতামত দাও মায়া। তুমি পড়ে আফসোস করলে আমি বাঁচব না।'

মায়া সময় নিলো না। না ভেবেই সহজসাবলীল গলায় বলে ফেলল, 'চলে যেতে চাই।'

নবীন আর একমুহূর্ত ভাবল না। সময় নেবার প্রয়োজন বোধ করল না। পকেটের ত্রিশ টাকা নিয়েই মায়ার হাত ধরে রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়ল শহরের উদ্দেশ্যে। 

___

১৯৯৭। জুন মাসের শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ জুড়ে আজ দুদলের মারামারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝামেলা হওয়া নতুন নয়। কিছুদিন পরপর পাওয়ারফুল পরিবারের ছেলেপেলে দল গঠন করে ঝামেলা পাকায়। বিদ্যালয়ে 'বড়ো ভাই' নামক ট্যাগ জুটিয়ে নেবার জন্য এসব কাণ্ডকারখানা! সফিক মারধর পছন্দ করে না। অন্য ভাবে বলা চলে ভয় পায় সে। সেবারে তো তার সামনেই খুনাখুনি শুরু হয়। ভাগ্যিস সফিকের কিছু হয়নি। শুধুমাত্র ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিল। ভাই, সফিকরা সাধারণ পরিবারের সন্তান। বাবার মেহনতের টাকায় পড়তে এসেছে। কিছু একটা জীবনে হতে এসেছে। এসব মারামারি করতে নয়। তাই আজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়নি। বাসায় ঘুমাচ্ছিল। গতকাল সারারাত পড়েছে সে। মস্তিষ্ক বড্ড ক্লান্ত। ওসময় দরজায় করাঘাত পড়ল। কে এলো? নবীন তো গ্রামে গিয়েছে। ওই শা লা তো চারদিনের আগে ফিরবে না! বুয়া এলো নাকি? সফিক ঘুমঘুম চোখে উঠল। উদোম শরীরেই গিয়ে ভাঙাচোরা কাঠের দরজাটা খুলে দিলো। খুলতেই তার দুচোখের ঘুম উবে গেল। নবীন তড়িঘড়ি মায়াকে রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা লাগাল। বিছানায় ওকে বসিয়ে তাকাল সফিকের পানে। সফিক অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে। ঠোঁট ফাঁক হচ্ছে তবে কণ্ঠ চলছে না। মায়া পরিষ্কার গলায় সালাম জানাল। রোবটের মতন সালাম নিলো সফিক। নবীন পরিচয় করাল,

'আমার গার্লফ্রেন্ড মায়া। ওকে নিয়ে আসছি। বিয়ে করব।'

সফিক উত্তেজিত হলো বড়ো, 'এই কী করলি? আর একটা বছর ছিল। বছরটা শেষ করে ভালো চাকরি পেয়ে তারপর নাহয়…. '
'ওকে তো পাব না। বিয়ে দিয়ে দিবে।'

সফিক থামল। চোখ বুঁজে শ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

 'আজই বিয়েটা করে ফেল। আসমান আর রুদ্রকে আসতে বলি। বিয়েটা করে নে তারপর রুম খুঁজব। এখানে তো আর থাকা সম্ভব না। টাকাপয়সা কত আছে?'

মায়া একফাঁকে জানাল, 'গলায় একটা চেইন আছে। এটা বিক্রি… '

নবীন কড়া চোখে তাকাতেই মায়া চুপসে গেল। নবীন কিছুক্ষণ ভেবে বলল, 'আছে কিছু। প্রয়োজন হলে বলব। যা আছে তাতে দেখি কতটুকু কী হয়!'

সেদিনই নবীন-মায়ার বিয়েটা হলো। বিয়ের পর দু'জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দিকটাতেই একটি রুম ভাড়া নিয়ে ফেলল। রুদ্র, সফিক বাজার করে নিয়ে এলো সবকিছু। আপাতত একটি সংসারের যা অত্যন্ত প্রয়োজন তাই আনা হলো। ঘুমানোর জন্য তোশক আর চাদর আর একটি বালিশ। ফ্যান কেনার টাকা হলো না। 
তবে সংসারের বাকি যাবতীয় সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। সেই রাতেই মায়া সকলের জন্য ভাত আর আলু দিয়ে মুরগির ঝোল করল। মেয়েটার রান্না এত সুস্বাদু যে সফিক প্রশংসা করার ভাষা হারিয়ে ফেলল। আসমান, রুদ্র, সফিক চেটেপুটে খেতে ব্যস্ত। নবীন খেতে বসে হাসছে। তার মিটিমিটি হাসি খেয়াল করলে মায়া পড়ল লজ্জায়। নতুন স্বামীস্ত্রীর লজ্জা কী আর বন্ধুদল বুঝে? তারা তো খেতে ব্যস্ত! খাওয়াদাওয়া শেষে বন্ধুবান্ধব বিদায় নিতেই শুরু হলো নবীন, মায়ার বিবাহিত জীবনের যাত্রা। এই যাত্রা এতদূর চলে এলো যে আগেরকার সব ঝাপসা স্মৃতি এখন শুধুমাত্র।
তখনকার অচেনা শহরে এখন তাদের তিনতলা বাড়ি। আরাধ্যনা তাদের একটিমাত্র কন্যা সন্তান।
এবারে সিক্সে পড়ছে। মেয়েটা দুরন্তপনায় শীর্ষতে। তবে বাবার আদুরে মেয়ে, বাধ্য মেয়ে বড়ো। বাবার কথা খুব মানে। যত ঝামেলা করে মায়ের সঙ্গে। মায়াকে এক মিনিট শান্তি দিলে তো। এইতো এভাবেই চলছে তাদের সংসার…।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন