বন্য প্রণয় - পর্ব ৩৩ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


বসন্ত যাই যাই করছে। গ্রীষ্মকাল সামনে। রোদের তেজ বেড়েছে আজকাল। আবার মাঝে মাঝেই হঠাৎ করে আকাশে ঘনকাল মেঘের আনাগোনা দেখা যায়। সময়টা কালবৈশাখীর। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এরমধ্যে সিলেট শহরে প্রচুর শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক মানুষজন। ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখি,মানুষ ও যানবাহনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেই ঝড়ের শিলাবৃষ্টিতে। 
তৃষার বাবার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে আজকাল। ছেলেমেয়েদের জন্য চিন্তা বেড়েছে। সবকিছু নিয়ে তৃষার মায়ের মন মেজাজ খারাপ থাকে। আয়ানের মাস্টার্স কমপ্লিট হলো দেখতে দেখতে। তৃষারও গ্রাজুয়েশন শেষ। আয়ান চেষ্টা করছে একটা মোটামুটি ভালো চাকরি পাওয়ার। কিন্তু এ শহরে চাকরি যে সোনার হরিণ! পেতে কপাল লাগে তারচে বেশি যেটা হলো সেটা হচ্ছে মামার জোর অর্থাৎ টাকা। অনিমাকে নিজের করে পেতে হলে নিজেকে ভালো একটা পজিশনে নিতে হবে। সেই সাথে পরিবারের দায়িত্বও নিতে হবে আয়ানকে। তাহমি আর সহনের সম্পর্ক চলছে সমান্তরালভাবে। কিন্তু তৃষা ভালো নেই! ঔষধ পত্র খেয়েদেয়ে সুস্থ হলেও মাঝে মধ্যে অদ্ভুত আচরণ করে অনিক। এই যেমন বাসায় মেহমান এলে সাবধানে চলাফেরা করতে বলে অথবা বাইরে গেলে ভয় পায় যদি কেউ তৃষাকে পছন্দ করে ফেলে। সত্যি বলতে সেগুলো হয়তো তেমন কিছু না কিন্তু তৃষার ধৈর্য শক্তি ফুরিয়ে গেছে। এই টক্সিক রিলেশনশিপ আর ভালো লাগছে না তার। নিজেকে জেলখানার কয়েদি মনে হয়। সেইবার বাবার বাড়ি গিয়েছিল অনিককে নিয়ে। মোটামুটি দু'দিন ঠিকঠাক ছিলো সব কিন্তু তৃতীয় দিন ঝামেলা হলো সহনের এক বন্ধুকে নিয়ে। বেচারা শাকিল এসেছিল বন্ধুর সাথে তার শ্বশুর বাড়ি। কিন্তু অনিক তার সাথে খারাপ আচরণ করে। ফলশ্রুতিতে তৃষার নাক কাটা গিয়েছিল বাবার বাড়ির লোকজনের সামনে। এই অশান্তি নিয়ে দিন অতিবাহিত হচ্ছে মেয়েটার। অনিক রাত হলে শিশুদের মতো কাঁদে মাঝে মধ্যে। কিন্তু তৃষার সেসবেও অসহ্য লাগে । অন্য ঘরে গিয়ে ঘুমায় সে। অনিক একা ঘরে চিৎকার করে আবার মাঝে মধ্যে চুপচাপ সারারাত বসে থাকে। তবে তৃষা তার বাবার বাড়িতে এখনও জানায়নি এসব অনিকের মেন্টাল ডিসঅর্ডার। উনারা ভেবেছিলেন তৃষাকে নিয়ে ওভার পজেসিভ বলেই শাকিলের সাথে ওরকম আচরণ করেছিল অনিক।

গোধূলির আলোয় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে তাহমি। আজকের আকাশটা যেনো অন্য রকম সুন্দর লাগছে। লাল আভায় ছেয়ে গেছে আকাশ। মৃদুমন্দ বাতাস এসে ছুঁইয়ে যাচ্ছে শরীর। সহনকে ভীষণ মিস করছে। দুদিন হলো শহরের বাইরে গেছে মানুষটা। যদিও অফিসের কাজের জন্য গেছে তবুও মনটা অস্থির লাগছে তাহমির। ইশ দু'দিন ধরে মানুষটার সাথে ঝগড়া, খুনসুটি কিছু করা হয়নি! আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘাড়ে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাসে চমকে উঠলো তাহমি। তড়িৎ গতিতে পেছনে তাকিয়ে দেখলো সহন দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে তার দুষ্ট হাসি। তাহমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেনো। বাড়িতে তো সহন ছাড়া অন্য কেউ আসার কথাই নয় তবুও ঘাবড়ে গিয়েছিল সে।
" কেমন দিলাম বল তো?"
" ছাই দিয়েছিস,কচু দিয়েছিস! ভয় পেয়ে গেছিলাম। "
তাহমি ভেংচি কেটে বললো। সহন ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে জড়িয়ে ধরল তাহমিকে। তাহমি মুখ গুঁজে দিলো তার বুকে। যেন শান্তির নীড় খুঁজে পেলো বহুদিন পরে। 
" ইশ! আমার রণচণ্ডী বউটা এতটুকুতে ভয় পেয়ে গেলো কীভাবে? "
তাহমি আস্তে কয়েকটা ঘুষি মারল সহনের বুকে। সহন খিলখিল করে হাসছে। কতটা জার্নি করে এসেও কোনো ক্লান্তি নেই তার। তাহমিকে কাছে পেয়ে তার সমস্ত বিষাদ মুছে গেছে। 
" শয়তান লোক একটা। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি গিয়ে খাবার দিচ্ছি। "
" ঠিক আছে। "
 তাহমিকে নিজেকে সহনের থেকে সরিয়ে তোয়ালে আর লুঙ্গি বের করলো তাহমি। সহন সেগুলো নিয়ে এগোল ওয়াশরুমের দিকে। 

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় শুয়ে ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে ব্যস্ত আয়ান। হঠাৎ অনিমার বাবার নম্বর থেকে কল আসায় শোয়া থেকে উঠে বসলো ছেলেটা৷ রীতিমতো ভড়কে গেছে সে। অনিমার সাথে তার সম্পর্কের বিষয় কিছু জেনে গেলোনা তো? কীভাবে জানলো? গত ছয় মাস ধরে রাতে অনিমার কাছে যায় না আয়ান। একদিকে ধরা পরার ভয় অন্য দিকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশংকায় অনিমার কাছে যাওয়া বন্ধ করেছিল আয়ান। তবে দিনে প্রায় ঘুরাঘুরি করে। রাস্তায় বসে তো আর অনিমা ওরকম পাগলামি করতে পারে না আর। একটু-আধটু অভিমান করে তবে সেটা মানিয়ে নিয়েছে আয়ান। কল বেজে যাচ্ছে। এখুনি রিসিভ না করলে কল কেটে যাবে! তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করে ফোন কানে ধরলো আয়ান।
" আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন? "
" ওয়া আলাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি,তুমি কেমন আছো? "
আয়ান দম নিলো একটু। ভদ্রলোকের গলা শুনে ভয়ের কিছু মনে হচ্ছে না। 
" আলহামদুলিল্লাহ। তবে বাবার শরীরটা মাঝে মধ্যে খারাপ হচ্ছে ইদানীং। "
" ডাক্তার দেখিয়েছো?"
" জি।"
" বেশ তাহলে ঠিকমতো খেয়াল রেখো উনার। আচ্ছা শোনো তোমাকে যে কারণে কল দিলাম!"
" জি বলুন আঙ্কেল। "
" তুমি অনিমাকে পড়িয়েছিলে বলেই মেয়েটা এসএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছিল। তাই তোমার যদি সমস্যা না হয় এখনও যদি পড়াতে ভালো হতো। মা মরা মেয়েটা লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হোক এটাই চাওয়া বাবা।"
অনিমার বাবাকে সব সময় ভালো লাগে আয়ানের। ভদ্রলোকের টাকাপয়সা থাকলেও কোনো অহংকার নেই। মোটেও সিনেমার নায়িকাদের বাবাদের মতো হম্বিতম্বি করেন না। কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়! অনিমাকে পড়াতে গেলেই তো জ্বালিয়ে মারবে আবার। মেয়েটা বড্ড জ্বালাতন করে। বিয়ের পর যে কীভাবে সামলাবে সেই নিয়ে মাঝে মধ্যে চিন্তায় পড়ে যায় আয়ান। আয়ানের নীরবতায় অনিমার বাবা ফের বললেন,
" কিছু বলছো না যে বাবা?"
" জি আঙ্কেল সমস্যা নেই আমার। "
" যাক আলহামদুলিল্লাহ। তবে কাল থেকে পড়াতে এসো। বিকেলের দিকেই। আমি তো তখন বাসায় থাকবো না। তাই দেখা হবে না কাল।"
" ঠিক আছে সমস্যা নেই। "
" বেশ। তাহলে রাখছি আমি। "
" আল্লাহ হাফেজ। "

অপরপ্রান্ত থেকে কল কেটে দিলেন ভদ্রলোক। মধুর জ্বালায় পড়েছে আয়ান। তবে এবার অনিমা বেশি পাগলামি করলে একেবারে আদরের সাধ ঘুচিয়ে দিবে আয়ান। একদিন আদর করলে বুঝবে মজা! এই ভেবে আনমনে হাসলো আয়ান।

" এই সহন শোন।"
" হ্যাঁ বল।"
" বলছিলাম যে আমাদের একটা বেবি হলে কেমন হতো?"
সহন ফোনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাহমির দিকে দৃষ্টিপাত করলো। তাহমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সহন সময় নিলো একটু। তারপর তাহমির মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
" তুই নিজে আগে বড়ো হ তারপর বেবির কথা বলিস।"
তাহমিও তো চুপ থাকার মেয়ে না। যে হাত দিয়ে গাট্টা মেরেছিল সহন,সেই হাত উঁচিয়ে ধরে দিলো এক কামড় বসিয়ে। সহন উঁহু করে উঠলো। হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে বললো,
" দেখ তোর অবস্থা! এজন্যই তো বললাম তুই নিজে আগে বড়ো হ। নিজেই তো দাঁত ওঠা বাচ্চাদের মতো কামড়ে দিস।"
" ভালো হচ্ছে না কিন্তু সহন।"
সহন তাহমির নাকে নাক ঘষে দিলো। পুলকিত চিত্তে শুধালো, " খারাপের কী হচ্ছে? "
" এখন হবে! "
" কী হবে? "
" তোর বাচ্চা হবে। "
সহন জোরে হেসে উঠলো। তাহমি এক ধাক্কায় সোজা করে শুইয়ে দিলো সহনকে। তারপর গায়ের উপর চড়ে বসলো। সহনের মন তো উড়ুউড়ু করছে এখন। মেয়েটা ক্ষেপে গেলেই এমন দুষ্ট মিষ্টি আদর পাওয়া যায়। 
" সিজার করবি? এজন্য পেটের উপর বসলি?"
" অন্য কিছু করবো।"
শুকনো ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিলো তাহমি। সহন থমকে গেলো সেটা দেখে। হৃদয়ে আনচান করতে লাগলো। কীসের একটা তাড়া অনুভব করলো সমস্ত শরীরে। তাহমি ঝুঁকে ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সহনের। সহন সময় নিলো না। নিজে থেকেই ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো তাহমির ঠোঁটে। আবেশিত হয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো অনেকক্ষণ। 
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন