শেখ বাড়ির ড্রইং রুমে বসে আছে আয়ানের বাবা-মা ও বোন তাহমি। তাহমির স্বামী আয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের উত্তর কোণে। অনিমা নিজের ঘরে আছে। এতগুলো মানুষের সামনে আসার মতো মুখ তার নেই। বদ্ধ ঘরে যেমনই থাকুক দু'জন, বাইরের লোকজন কখনো এটা বিশ্বাস করবে না তারা কোনো অন্যায় করেনি। সত্তার শেখ আয়ানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে একবার দৃষ্টিপাত করলো তার দিকে। তারপর তাহমির বাবা-মায়ের সামনাসামনি সোফায় বসলেন । আয়ান চুপচাপ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা-মায়ের সামনে এভাবে দাঁড়াতে হবে ভুলেও কখনো ভাবেনি। লজ্জায় মাটিতে মিইয়ে যেতে ইচ্ছে করছে আয়ানের।
" ঘটনা কী সেটা আশা করি আপনারাও বুঝতে পারছেন এবং আমিও বুঝতে পারছি। কিন্তু বুঝতে একটু দেরি করে ফেলেছি আমি। আমার বোঝা উচিত ছিল। "
অনিমার বাবার স্পষ্ট কথায় আয়ানের বাবা-মা নড়েচড়ে বসলেন। আয়ানের বাবা বললেন,
" আমরা ভীষণ লজ্জিত। আসলে আমরাই আমাদের ছেলেকে ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারিনি। পারলে মাঝরাতে অন্য মেয়ের ঘরে এভাবে আসতে পারতো না।"
বাবার মুখে এরকম কথা শুনে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আয়ানের৷ সহন আয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাহমি নিশ্চুপ, এখানে তার বলাট মতো কিছু নেই। সত্তার শেখ একটু ভেবে নিলেন তারপর বললেন,
" তাহলে বলতে চাচ্ছেন আমারও শিক্ষার অভাব ছিলো? "
অনিমার বাবার কথার মানে কেউ বুঝতে পারলো না। ইতস্ততভাবে আমেনা ইসলাম বলেন,
" না ভাইজান,আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে। আয়ানের কথা বললেন উনি।"
" সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি বললাম আমার কথা। আয়ানের মতো বয়সে তো আমিও এরকম ঘটনা ঘটাতাম। অনিমার মায়ের সাথে দেখা করতে বাড়ির পেছনে আসতে বলতাম রাতে। সেজন্যই বললাম আমারও তাহলে শিক্ষার অভাব ছিলো আরকি।"
ভদ্রলোকের কথায় হকচকিয়ে গেল সবাই। কেবল সহন মিটমিট করে হাসছে। আয়ানের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
" শালাবাবু ভয় পেও না। ঘটনা ঘটে যাবে।"
আয়ান সন্দিহান সে বিষয়। ভদ্রলোকের মতিগতি বোঝা দ্বায়। গতকাল রাত থেকে একেবারে গুরু গম্ভীর হয়ে ছিলেন। একটা কথাও বলেননি। অনিমাকে শুধু নিজের ঘরে থাকতে বলেছিলেন আর আয়ান ছিলো গেস্ট রুমে।
" আসলে আপনার কথার মানে বুঝতে পারছি না মিস্টার শেখ।"
" আমার মেয়ে বয়সে ছোটো। প্রেম করার বয়স হলেও বিয়ে করে সংসার সামলানোর দায়িত্ব সে নিতে পারবে না হয়তো। সেজন্য আপাতত বিয়েটা স্থগিত রাখলাম। অনিমা এইচএসসি পরীক্ষাটা দিক তারপর না হয় আমরা ওদের বিয়েটা দিয়ে দিবো। আয়ানকে অনেক আগে থেকেই দেখছি তো, ছেলেটা আমার পছন্দের। "
ড্রইং রুমে উপস্থিত সবাই চমকাল অনিমার বাবার কথায়। আয়ান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার বাবার দিকে। তিনি মুচকি হাসছেন আয়ানের দিকে তাকিয়েই। সবাই একসাথে হেসে উঠলো এবার। এতক্ষণে যেনো সবাই প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আয়ানের বাবা অনিমার বাবার সামনে এসে হাত ধরে বলেন,
" আপনার মতো মানুষ খুব কম দেখেছি ভাই। এতো প্রতিপত্তি থাকা স্বত্বেও আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেকে মেনে নিলেন অনায়াসে! "
" মানুষটা কেমন সেটা মূখ্য বিষয় ভাই। স্টাটাস দেখে আমি মানুষ বিচার করি না। আজ যা-ই থাকুক আমার, একটা সময় আমিও বেকার ছিলাম। মানুষ চেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম করলে অবশ্যই উন্নতি লাভ করবে। তাছাড়া আমার মেয়ে যাকে ভালোবাসে আমিও তাকে ভালোবাসব। আমার মেয়ে আমার পৃথিবী। আমি শুধু চাইবো অনিমা সুখী হোক। আপনাদের কাছে শুধু এটুকুই চাওয়া। "
অনিমা ও আয়ানের বাবা দু'জন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন খুশিতে। এদিকে সহনও জড়িয়ে ধরলো আয়ানকে।
" শালাবাবু হেহে ঘটনা ঘটে গেলো কিন্তু! "
আয়ান হাসছে সহনের কথায়। অন্য দিকে অনিমা বেচারি ঘরে বসে আছে ভয় ভয়। বাইরে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। আয়ানের পরিবারের লোকজনের সামনে কীভাবে যাবে? অনিমার ভাবনার ছেদ ঘটে দরজা খোলার ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজে। দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করতে দেখল পঁচিশ কিংবা ছাব্বিশ বছর বয়সী এক সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে। অপরিচিতা কাউকে নিজের ঘরে দেখে স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী হয়ে গেলো অনিমা। ততক্ষণে তাহমি ঘরের মধ্যে ঢুকে বিছানায় অনিমার পাশেই বসলো।
" আপনি কে? মানে আমার ঘরে কীভাবে এলেন?"
অনিমার প্রশ্নে তাহমি মৃদু হেসে বললো,
" আমি তোমার বড়ো ননদী। আয়ান আমার ভাই। "
চমকাল অনিমা। নড়েচড়ে উঠলো একটু। বোকা বোকা হেসে বললো,
" আপু বাবা যদি আপনাদের কিছু বলে থাকেন তার জন্য আমি দুঃখিত। আপনার ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। "
" চাপ নিও না। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। ভালো করে এইচএসসি পরীক্ষাটা দাও তারপর আমাদের বাড়ি বউ করে নিয়ে যাবো। কিন্তু হ্যাঁ এই রাতে ঘরে বসে প্রেম করা বন্ধ করবে ঠিক আছে? এখন তো লুকোচুরির কিছু নেই। দিনের বেলাতেই না হয় বাইরে বেরিয়ে প্রেম করবে। "
তাহমি হেসে হেসে বললো। অনিমা একটু লজ্জা পেলো বটে। ইশ রাতে ঘরে আসাটাকে সবাই কীভাবে নিলো! আয়ান ঠিক বলতো। কেনো যে জোরাজোরি করে মানুষটাকে আসতে বলতো। তবে আয়ানের বোন কী বললো? সত্যি ওদের বিয়ে হবে? বাবা সব মেনে নিয়েছে?
" আপু বাবা কী এসব বলেছেন? "
" হ্যাঁ। উনার কোনো আপত্তি নেই তোমাদের বিয়েতে।"
অনিমা এতক্ষণে যেনো নিঃশ্বাস ফেললো। রাত থেকে মনে হচ্ছিল দম আঁটকে যাবে। তাহমি অনিমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। তাহমি বের হতেই বিছানার উপর উঠে উড়া ধুরা নাচতে লাগলো মেয়েটা৷ গান ছাড়াই সেই ভয়ংকর নাচ দেখার মতোই হচ্ছিল!
ভাইয়ের বিষয় সবকিছুই ফোনে বড়ো বোনের কাছ থেকে শুনেছে তৃষা। বেশ শান্তি লাগছে। সবকিছু ভালো ভালো হলেই শান্তি। অনিমা কলেজে ভর্তি হয়েছে। লেখাপড়ার দিকেও মনোযোগী হয়েছে মেয়েটা। আয়ানের কড়া নির্দেশ, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা চাই। সবাই যাতে এটা না বলতে পারে, প্রেম করতে গিয়ে রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। সেই মতো লেখাপড়া করছে অনিমা।
ভরসন্ধ্যা বেলা। রান্নাঘরে চা তৈরি করছে তাহমি। চুলোয় পানি বসিয়েছে চায়ের। পানি ফুটছে। হাতে চাপাতি নিয়ে অপেক্ষা করছে তাহমি। সহন ডাইনিং টেবিলে বসে একটু পর পর নজর রাখছে স্ত্রী’র দিকে। রান্নাঘরে ঢুকলেই সহনের মনে কেমন একটা ভয় কাজ করে। তাই যখন নিজে বাড়িতে না থাকে মা'কে বলে যায় খেয়াল রাখতে। ফোনের দিকে তাকিয়ে একটা নিউজ দেখছে সহন। তার ফাঁকে ফাঁকেই তাহমির দিকে দৃষ্টিপাত করছে। তাহমি বলেছে রাতে একটা নিউজ দিবে। কী নিউজ সেটা জানতে চাইলে বললো গুড নিউজ। সহন এসব ভেবে একটু বেখেয়ালি হয়ে গেল। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে ধুপধাপ শব্দ ভেসে আসতেই সহন চমকে উঠে। রান্নাঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করতে দেখে তাহমি ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চাপাতি সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। দৌড়ে রান্নাঘরে গেলো সহন। তাহমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
" মা! মা! এদিকে এসো। তাহমি সেন্সলেস হয়ে গেছে।"
সহনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে জায়নামাজ থেকে উঠে দাঁড়ালেন ফরিদা। মাগরিবের নামাজ শেষে জিকির করছিলেন তিনি। তসবিহ ও জায়নামাজ জায়গামতো রেখে একপ্রকার ছুটে রান্নাঘরের দিকে এগোতে লাগলেন তিনি। সহন তাহমিকে কোলে তুলে নিয়েছে ততক্ষণে। ফরিদা খান গ্যাসের চুলো বন্ধ করে দিলেন।
" কী হয়েছে? তাহমির কী হয়েছে সহন? হঠাৎ জ্ঞান হারালো কেনো?"
" মনে হয় আগুন থেকে এমন হয়েছে। ডাক্তার বলেছিল না ওর মনে আগুনের প্রতি চাপা একটা ভয় কাজ করছে। "
সহন কোলে নিয়ে বেডরুমে নিয়ে গেলো তাহমিকে। ফরিদাও ছেলের পেছন পেছন এসেছেন। সহন বিছানায় শুইয়ে দিলো তাহমিকে। টেবিলের উপর থেকে গ্লাস নিয়ে হাতে পানি ঢেলে তাহমির চোখমুখে ছিটিয়ে দিচ্ছেন সহনের মা। সহন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চোখমুখ কেমন শুকনো শুকনো লাগছে মেয়েটার।
" সহন ওর তো জ্ঞান ফিরছে না। তুই বরং ডাক্তার ডাক। "
" আমি ডাক্তার আঙ্কেলকে ইমার্জেন্সি বলে টেক্সট করেছি আসতে। পানি দিলে তো একটু অপেক্ষা করো জ্ঞান ফিরবে।"
" আমারই ভুল! আমার উচিত তাহমিকে রান্নাঘরের কোনো কাজই না করতে দেওয়া। "
ফরিদা খান নিজেকে অপরাধী ভাবছেন। সহন মাকে স্বান্তনা দিতে বলে,
" মা তাহমি তো কারো কথা শোনে না৷ তোমার কোনো দোষ নেই। ডাক্তার আসছে তো, সব ঠিক হয়ে যাবে। "
.
.
.
চলবে............................