বন্য প্রণয় - পর্ব ৩৭ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


বেশ কিছুক্ষণ হলো তাহমির জ্ঞান ফিরেছে। এরমধ্যে ডাক্তারও এসে গেছে। ডাক্তার ফারুক আহমেদ সহনদের পূর্ব পরিচিত। মধ্যবয়স্ক ফারুক আহমেদ দেখতে লম্বাচওড়া, চুলগুলো হালকা সোনালী রঙের। সহনকে ছোটো থেকে উনি দেখেছেন। তাহমি দূর্বল কন্ঠে বারবার সহনকে বলছিল ডাক্তার লাগবে না। কিন্তু শাশুড়ী এবং স্বামী কেউ তাহমির কথায় পাত্তা দিলো না। অগত্যা চুপ করে রইলো তাহমি। ডাক্তার তাহমির প্রেশার মেপে দেখলেন। সাথে চোখ ও জিহ্বা দেখলেন একবার। সহন দাঁড়িয়ে আছে ঘরের একপাশে। ফরিদা তাহমির পাশে বসে আছেন। 
" আপাতত যতটুকু বুঝতে পারছি উনার প্রেশার ভীষণ লো। আর খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না ইদানীং। সেজন্য শরীর দূর্বল হয়ে গেছে। বাদবাকি যা বোঝার কিছু টেস্ট করতে দিলাম। সেগুলো করালে শিওর হয়ে বলতে পারবো। "
ডাক্তারের কথায় চোখমুখ ম্লান হয়ে গেছে সহনের। মেয়েটা কেনো যে এরকম অনিয়ম করে! 
" আঙ্কেল সিরিয়াস কিছু আশংকা করছেন? "
সহন কিছুটা ভীতি প্রদর্শন করে বললো কথাটা। তাহমি ততক্ষণে কটমট করে সহনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। কতক্ষণ ধরে চোখ টিপ্পনী দিচ্ছে কিন্তু সেদিকে হাঁদাটার খেয়ালই নেই! 
" না। চিন্তার কিছু নেই। আমি আসছি সহন। আগামীকাল তুমি বরং হসপিটালে যেও তাহমিকে নিয়ে। "
" ঠিক আছে আঙ্কেল। চলুন এগিয়ে দিয়ে আসি। মা তুমি বসো ওর কাছে। "
" ঠিক আছে যা তুই। আমি আছি।"
সহন ডাক্তার ফারুক আহমেদকে নিয়ে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেলো। রাতে ফরিদা খান নিজে বসে খাইয়ে দিলো তাহমিকে। ফলশ্রুতিতে আজকে পেট বেশি ভরে গেছে মনে হচ্ছে তাহমির। মায়েরা কখনো সন্তানদের কম খাওয়াতে পারেন না। তাহমিকে আজকে আর বিছানা ঠিক করতেও দেয়নি সহন। নিজে থেকে সবকিছু গুছিয়েছে। মশারী টানানো শেষ করে তাহমির পাশে এসে মাত্র শরীর এলিয়ে দিলো সহন। তাহমি সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। গরম ভালোই ঝাঁকিয়ে বসেছে। সহন তাহমির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। তাহমি সহনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সহন ভড়কে গেছে কিছুটা। সে তো কিছু করলোনা, তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো তার বউ?
" তাহমি কিছু হয়েছে? আমি কী কিছু করেছি? কই না তো আজকে তো কিছু করিনি আমি।"
" চুপ কর। মাঝে মধ্যে এমন আহম্মকের মতো করিস কেন? তখন কতবার ইশারা করলাম! "
" আহাম্মক তো আগে ছিলাম না, বিয়ের পর হয়েছি। আর আমি তখন চিন্তিত ছিলাম তাই খেয়াল করিনি। "
" হুম বুঝলাম। একটা কথা শোন।"
তাহমি দৃষ্টি অন্য দিকে সরাল। সহন আগ্রহী হয়ে শুধালো, " কী?"
" তোকে কেউ ডাকছে। "
" কে ডাকছে! "
অবাক হলো সহন। কারো আওয়াজ তো তার কানে আসছে না। তাহমি সহনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ডান হাতের আঙুল উঁচিয়ে নিজের পেটের দিকে ইশারা করলো। সহন ঠিকমতো বিষয়টা বুঝতে না পারলেও শোয়া থেকে উঠে তাহমির পেটের কাছে গিয়ে বসলো। 
" সে আসছে! আমাদের ঘরের নতুন অতিথি। "
সহনের কাছে এক মুহুর্তের জন্য সবকিছু থমকে গেলো। তাহমি অন্য দিকে তাকিয়ে হাসছে। সহন দ্রুত নিজের কান তাহমির তলপেটে ঠেকিয়ে উৎসাহী হয়ে প্রশ্ন করলো, " এটা কি সত্যি তাহমি?"
তাহমি বললো, " হ্যাঁ। "
সহন আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো পেটের উপর। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কোলে তুলে নিলো তাহমিকে। বিছানা থেকে নেমে তাহমিকে কোলে নিয়ে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগলো,
" কী খবর শোনালি তাহমি! আমি তো খুশিতে পাগল হয়ে যাবো। আমি বাবা হবো? সিরিয়াসলি! তুই আমার সন্তানের মা হবি? "
" যা পাগল হয়ে ছাগল হয়ে মাঠে ঘাস খা তুই। আর হ্যাঁ মজা করেছি। মিছিমিছি বাবা হবি তুই। "
তাহমি মুখ ভেংচি কেটে বললো। সহন হাসছে শুধু। আজকে আর কোনো কথাতেই ঝগড়া করবে না সে। এতো খুশি এক জীবনে সে হয়নি আর। বিছানায় খুব আস্তে করে বসাল তাহমিকে৷ তারপর নিজেও বসলো স্ত্রী'র পাশে। দু'হাতে দুহাত রাখল।
" তাহমি তুই নিজেও জানিস না তুই কী সুখ দিলি আমাকে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার আমার সন্তান। ইচ্ছে করছে তোকে মাথায় তুলে নাচি।"
" আসলেই সহন আমাদের বেবি হবে! মামুনি আর আব্বু শুনলে কতো খুশি হবে বল তো?"
" ভীষণ ভীষণ ভীষণ খুশি হবে। ইশ আমার তো আর তর সইছে না। কবে আসবে আমার ছোট্ট পাখিটা!"
তাহমিকে বুকে জড়িয়ে নিলো সহন। তাহমিও সহনকে আঁকড়ে ধরে আছে দু'হাতে। 
" অপেক্ষা কর। দেখবি মাসগুলো দেখতে দেখতে যাবে। "
" ইশ অপেক্ষা এতো তিক্ত কেনো? তবে এই মধুর অপেক্ষা করতেও শান্তি। কারণ অপেক্ষার ফল যে সুমিষ্ট হবে। "
" ইয়েস মাই ডিয়ার বর। বেবি আসবে ঘরে এখন থেকে আরও বেশি সহনশীল হতে হবে তোকে।"
" তাহমি! খবরদার আর বলবি না সহনশীল হুহ্। আমাদের বেবি যেনো না জানতে পারে তার মা তার বাবাকে কীরকম বেইজ্জতি করে। "
তাহমি হাসতে হাসতে শেষ। বেচারা সহনশীল চৌধুরী! 

সকাল থেকে রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আমেনা ইসলাম। আজকে মেয়ে, জামাই আসার কথা। গতকাল গিয়েছিল বড়ো মেয়ের বাসায়। এতো বড়ো খুশির সংবাদ পেয়ে দুই বাড়ির সবার মহাখুশি। আর সেই সংবাদ শুনেই আসছে তৃষা ও অনিক। যদিও এমনিতেই আসার কথা ছিলো ওদের। কিন্তু এই খবরটা শুনে দু'দিন আগেই আসছে ওরা। আয়ান বেরিয়েছে অনিমাকে আনতে। দুপুরে আয়ানদের বাসায় খাওয়াদাওয়া করবে অনিমা। শেখ সাহেবের থেকে আগেই অনুমতি নিয়েছেন আয়ানের বাবা। ভদ্রলোক আপত্তি করেননি। আয়ানের মাঝে মধ্যে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হয় নিজেকে। মনের মানুষটাকে এতো সহজে সবাই পায় না। যদিও বিয়েটা হতে দেরি,কিন্তু সবাই তো রাজি। আমেনা ইসলাম কড়াইয়ে পানি ঢেলে ঢাকনা দিয়ে বসার ঘরে এগিয়ে গেলো। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। সকাল দশটা বিশ বেজেছে। এগারোটার মধ্যে তো ওদের আসার কথা। ওরা আসলে যেনো ভালো করে কথাবার্তা বলতে পারে সেজন্য আগেভাগে দুপুরের রান্না সেড়ে রাখছেন উনি। অনিক ও তৃষা এলে সবাইকে নিয়ে তাহমিকে দেখতে যাবে। তারপর সেখান থেকে তাহমি ও সহনকেও দুপুরে লাঞ্চের জন্য নিয়ে আসবে। সহন যদিও অফিসে তাই তাহমি একাই আসবে। পরে সহন অফিস থেকে চলে আসবে শ্বশুর বাড়ি। তাহমিকে সহন সকালবেলা দিয়ে আসতে চেয়েছিল বাবার বাড়ি কিন্তু অনিক আর তৃষা চাচ্ছিল বোনের শ্বশুর বাড়িতে গিয়েই দেখবে তাকে। 

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার নিজেকে দেখে নিচ্ছে অনিমা। এরমধ্যে দু'টো পোশাক চেঞ্জ করে দেখা হয়ে গেছে। প্রথমে বেবি পিংক কালারের থ্রিপিস পরেছিল পরে সেটা বদলে আবার সাদা রঙের গাউন পরেছে। কোন পোশাকে যে সুন্দর লাগবে সেই নিয়ে সন্দিহান সে। আয়ানের চলে আসার সময়ও আগত। উঁহু এরমধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে এলো অনিমার কর্ণকুহরে। অনিমা রুদ্ধশ্বাসে ছুটলো দরজা খুলে দিতে এবং খুলেও দিলো। আয়ান একবার আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে নিলো অনিমার দিকে। 
" এসো এসো। "
" সাজগোছ কমপ্লিট? "
" দেখো তো ঠিকঠাক লাগছে আমাকে?"
" হ্যাঁ। খুব সুন্দর। এরচেয়ে বেশি ঠিকঠাক দেখালে বাইরের লোকজনের নজর পড়বে আমার পিচ্চি বউয়ের উপর। "
" আমি মোটেও পিচ্চি নই হুহ্। "
" থাক এসব। এখন চলো বের হই। "
" তুমি দাঁড়াও একটু আমি হ্যান্ডব্যাগ ও ফোন নিয়ে আসছি। "
অনিমা আয়ানের জবাবের অপেক্ষা না করেই আবারও নিজের ঘরের দিকে ছুট লাগালো। মিনিট দুয়েকের মধ্যে আবার ফিরেও এলো। আয়ান হাসলো ঠোঁট কামড়ে। মেয়েটা এখনো ছেলেমানুষী ছাড়তে পারেনি। 
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন