দুই পরিবারের সবাই একসাথে বসে অনিমা ও আয়ানের বিয়ের দিন,তারিখ ঠিক করেছে। অনিমার বাবা বিয়েটা তাড়াহুড়ো করে দিতে চাইলেও শেষমেশ সেটা হলো না। কারণ অনিমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে আয়ান কোনোভাবে বিয়ে করতে রাজি না। বিয়ে করলে অবশ্যই অনিমার পড়ালেখার মন মানসিকতা একটু হলেও বিগড়ে যাবে। সেসব আয়ান চায় না। কেউ না জানুক আয়ান তো জানে না এখুনি বিয়ে হলে, অনিমা বই পড়ার বদলে সারাদিন তাকেই পড়ার চেষ্টা করবে! সেজন্য ঠিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই বিয়েটা হবে। তাই শেষমেশ সত্তার শেখও সেটাই মেনে নিয়েছেন। আয়ান সবকিছু সাইডে রেখে মনোযোগ দিতে বলেছে অনিমাকে। সংসার করাই একমাত্র লক্ষ্য না করে নিজের যোগ্যতা অর্জনের দিকেও মনোযোগী হতে হবে অনিমাকে।
দেখতে দেখতে মাস ছয়েক কেটে গেছে। তাহমির পেটটা আগের তুলনায় উঁচু হয়ে গেছে। সেই নিয়ে ভীষণ লজ্জা লাগে ওর। আগে যদিও তেমন লাজলজ্জা ছিলো না কিন্তু এই অবস্থায় কারো সামনে যেতে ভীষণ লজ্জা লাগে তাহমির। সেজন্য শ্বশুরের সামনে পরে না বললেই চলে। আর স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে। সহন তো বলছিল চাকরি ছেড়ে দিতে। কিন্তু স্কুলের সবাই তাহমিকে খুব ভালোবাসেন। তাই যতদিন ইচ্ছে ছুটিতে থাকলেও দিনশেষে তাদের সাথে তাহমিকে রাখতে চান স্কুল কমিটি। তাহমিও তাই চাকরি ছাড়েনি।
ভর দুপুরবেলা। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে ঘরে এসে বিছানায় বসলো তাহমি। আজ শুক্রবার হওয়ায় সহনও বাসায় আছে। সহনের খাওয়া শেষ হয়নি এখনো। শরীরটা কেমন অস্থির লাগছে তাহমির। শুয়ে,বসে কিংবা দাঁড়িয়ে কোনোভাবে শান্তি পাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে মেজাজ হুটহাট বিগড়ে যাচ্ছে। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে তাহমির। হঠাৎ হঠাৎ মুড সুইং হয়।
" কী রে? এভাবে বসে আছিস কেনো? অস্বস্তি লাগছে? "
সহনের প্রশ্নে ভাবনায় লাগাম টেনে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো তাহমি। সহন দাঁড়িয়ে আছে তাহমির একটু সামনেই। কিন্তু ভাবনার অতলে ডুবে থাকার জন্য সহনের উপস্থিতি টের পায়নি এতক্ষণ।
" একটু। "
" হুম বুঝলাম। মন খারাপ করিস না। এ-সময় এমন হয়। সমস্যা নেই তোর যখন যা মন চায় তাই কর। ইচ্ছে করলে আমার চুলগুলো উগড়ে দিস আবার ইচ্ছে হলে জিনিসপত্র ভাঙচুর করিস। "
সহন ভ্রু নাচিয়ে বললো। তাহমির কপালে বিরক্তি সূচক রেখা ফুটে উঠলো। এটাই সমস্যা! সামান্য সামান্য বিষয় বিরক্ত লাগে। মাঝে মধ্যে আবার খুব ভয় করে। যদি সবকিছু ঠিকঠাক মতো না হয়?
" এসব ইচ্ছে করে না। তুই সর এসব কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। "
সহন ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চিরুনি আর একটা চুল বাঁধার ক্লিপ নিয়ে এসে তাহমির পেছনে বসলো। এলোমেলো হয়ে আছে সব চুল। ঠিকমতো নিজের যত্ন নিচ্ছে না মেয়েটা। সহন আস্তে আস্তে চুলগুলো আঁচড়ে দিতে লাগলো।
" থাক রাগ করিস না। ঠান্ডা হয়ে বস। চুলগুলো বেঁধে দিচ্ছি তারপর শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা কর বরং।"
" এতো কেয়ার করিস কেনো হুহ্? শুধু বেবির জন্য? "
" নাহ। বেবি এবং বেবির মা দু'জনের জন্য। দুজনেই আমার কাছে ভীষণ ভীষণ প্রিয়।"
চুল বাঁধা শেষ করে ফের চিরুনি ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে আসলো সহন। তাহমি ততক্ষণে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে। সহনও তাহমির পাশে শুয়ে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
" বরটা আমার এতো ভালো আগে বুঝলে কলেজে থাকতেই বিয়ে করে নিতাম রে।"
" ভাই রে ভাই তুই তখন এসব নিয়ে ভাবতি? তুই তো ছেলেদের সাথে মারামারি করতেই বিজি থাকতি।"
সহনের ভ্যাবাচেকা মার্কা চেহারা দেখে তাহমি খিলখিল করে হেসে উঠলো।
" আমি তোর বউ। ভাই হই না। তুই আমাকে ভাই ডাকলে ছেলেমেয়েও কিন্তু মা রেখে মামা ডাকতে পারে! "
" হুঁশ! আমি তো এমনি বললাম। পুচকু সোনা এলে কি তখন এসব বলে ডাকবো?"
" কী জানি!"
" জানতে হবে না। বিশ্রাম নিয়ে নে সন্ধ্যায় আমার জন্য ফুচকা আর চটপটি আনতে হবে কিন্তু। "
সহন শুয়ে তাহমির একটা হাত নিজের বুকের উপর রেখে বললো,
" ঠিক আছে মহারাণী, আপনার আদেশ শিরোধার্য করা হলো।"
তাহমি মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করলো। দুপুরে খাওয়ার একটু না ঘুমালে শরীর কেমন ম্যাজম্যাজ করে।
বিকেলের ম্লান রোদে পার্কের বেঞ্চে বসে আছে আয়ান ও অনিমা। অনিমার হাতে এতগুলো শপিং ব্যাগ ছিলো কিন্তু সেগুলো আপাতত আয়ানের হাতে অবস্থান করছে। বিষয়টা আয়ানের জন্য বেশ কষ্টকর। অনিমা শপিং করতে এসে আয়ানের সাথে মিট করে কিন্তু শপিং করার টাকা বাবার কাছ থেকে আনে সে। আয়ান তো বেকার! চাইলেও প্রেয়সীর শখ,আহ্লাদ পূর্ণ করতে পারে না। এজন্য মন খারাপ লাগছে আয়ানের। অনিমার চোখমুখ দেখে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে তাকে। আয়ান নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। কারণ অনিমা যা বলার নিজে থেকেই বলবে সেটা আয়ান ভালো করে জানে।
" কালকে দুপুরে বাসায় চলে এসো।"
প্রফুল্লচিত্তে বললো অনিমা। মন তার বেশ উড়ুউড়ু, মেজাজ ফুরফুরে। আয়ান কৌতুহল বশত শুধালো, " কেনো?"
" আব্বু যেতে বলেছেন তাই। "
" তাহলে যাবো। "
" কেনো আমি বললে কি যেতে না? আগের মতো কি দুষ্টমি করি আমি? "
" সেটা নয়। আঙ্কেল যখন ডেকেছেন তখন জরুরি কিছু বলার জন্যই। তাই যাবোই সেটা বললাম। "
" হুম বুঝলাম। চলো এখন বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসো। এখন থেকেই বউয়ের ব্যাগ বইতে শেখো।"
বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অনিমা। সাথে আয়ানও ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
" সে আর বলতে? পুরুষ মানুষের অন্যতম ডিউটি তো শখের নারীর ব্যাগপত্র টানা। তো চলো আরকি!"
অনিমা হেসে সামনে এগোতে লাগলো। আয়ানের ভীষণ বিব্রত লাগে অনিমার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। সামনেই বিয়ে অথচ এখন পর্যন্ত একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি সে। কোন বাবা তার মেয়েকে এরকম একটা বেকার ছেলের হাতে তুলে দিতে চায়? নেহাৎ অনিমার বাবা ভালো মানুষ এবং নিজের অঢেল সম্পত্তি রয়েছে বলেই আয়ানের সাথে বিয়ে দিতে হয়তো রাজি হয়েছেন। নিজের সবকিছু মেয়ের বলে আয়ানের চাকরি নিয়ে হয়তো মাথা ঘামাচ্ছেন না তিনি। কিন্তু কালকে যদি হঠাৎ সেসব নিয়ে কিছু বলে? তাহলে কী বলবে আয়ান? চাকরির জন্য যে চেষ্টা করছে না তেমনটা নয়।
" কী হয়েছে? এভাবে হাঁটছ কেনো?"
অনিনার কথায় সংবিৎ ফিরে পেলো আয়ান। আনমনে হাঁটার ফলে অদ্ভুত মনে হয়েছে অনিমার কাছে।
" কিছু না। চলো।"
অনিমা আর ভাবল না আর আয়ানের অন্যমনস্কতার কারণ কী!
রাত হলে নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় গোটা পৃথিবী। নিশাচর পাখিরা উড়ে বেড়ায় যেখানে সেখানে। গ্রীষ্মের আগমনে উত্তপ্ত ধরণীর বুক। গরমে হাসফাস করছে প্রাণীকুল। এরমধ্যে আবার লোডশেডিং হয় প্রচুর। এমনও হয় যে ঘন্টায় দুই থেকে তিনবার বিদ্যুৎ যাওয়া আসা করে। সেই নিয়ে বিরক্ত তৃষা। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রাত একটার সময় সে। শর্ট টপসের সাথে প্লাজু পরেছে সে,চুলগুলো উপরে তুলে খোঁপা করা। আকাশে অল্পবিস্তর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৈশাখের কালবৈশাখী ঝড়ে প্রায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে এক একটা শহর কিংবা গ্রাম। কিন্তু তৃষাদের এদিকে বৃষ্টি হয় না তারপর ঝড়! ঘুমের ঘোরে পাশে হাত রাখতেই তৃষার উপস্থিতি টের না পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলো অনিকের। চোখ ঢ'লে ঢ'লে বিছানা থেকে উঠে বসলো অনিক। বিদ্যুৎ নেই! গরমে ঘামিয়ে গোসল করিয়ে দিয়েছে অনিককে। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতড়ে ফ্লাশলাইট জ্বেলে দিলো অনিক। না ঘরে নেই মেয়েটা! তবে কি বারান্দায় না-কি একা একাই ছাদে চলে গেলো আবার? ঘুমের বারোটা বাজিয়ে বিছানা থেকে উঠে বারান্দার দিকে এগোলো অনিক৷
.
.
.
চলবে.......................