বন্য প্রণয় - পর্ব ৪০ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


ঘরে নেই তৃষা! তবে কি বারান্দায় না-কি একা একাই ছাদে চলে গেলো আবার? ঘুমের বারোটা বাজিয়ে বিছানা থেকে উঠে বারান্দার দিকে এগোলো অনিক৷ ধীর পায়ে থামল বারান্দার দরজার সামনে। তৃষাকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ চমকানির আলোতে। অনিক ফ্লাশলাইট জ্বেলে তৃষার দিকে এগিয়ে গেলো। লাইটেট অস্তিত্ব টের পেয়ে তৃষা পেছন ফিরে তাকালো। 
" কী হলো? এখানে এলো যে?"
" ঘুম ভেঙে তোমাকে পাশে না পেয়ে অশান্তি লাগছিল। তুমি এখানে কেনো? কারেন্ট নেই, গরমে শেষ গো।"
অনিক কপালের ঘাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে তৃষার দিকে দৃষ্টিপাত করলো। তৃষার কপালেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তৃষা বাইরের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে বলে,
" গরমে ঘুম আসে না আমার। তারচে এখানে একটু একটু বাতাস আছে। "
" দেখি কালকে একটা চার্জার ফ্যান কিনবো। চার্জ দিয়ে রাখবে, কারেন্ট গেলেও চলবে।"
" ঠিক আছে। ছাদে যাবে? ওখানে ভালো বাতাস আছে হয়তো। একা একা যেতে পারছিলাম না এতক্ষণ। "
অনিক তৃষার ডান হাত নিজের বাম হাতের দখলে নিয়ে আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করছে।
" ঠিক আছে চলো। তবে একটা কাজ করি একটা চাদর আর দু'টো বালিশ সাথে নিয়ে যাই। "
" যদি বৃষ্টি হয়?"
" তা হবে বলে মনে হয় না। বিগত এক মাসেও বৃষ্টির দেখা মেলেনি এই শহরে। "
" আচ্ছা চলো তাহলে।"
তৃষা ঘরের দিকে এগোলো সাথে অনিকও। বিছানা থেকে একটা বালিশ নিজে নিয়ে আরেকটা বালিশ অনিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দু'জন ঘর থেকে ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরোলো ঘর থেকে। ছাদে পৌঁছে দু'জন ধরাধরি করে বিছানার চাদর বিছিয়ে নিলো ফ্লোরে। বিদ্যুৎ চমকানির আলোতে কিছু সময় পরপর সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। 
" ঘুম আসবে এই আবহাওয়ায়? "
অনিক বালিশে মাথা রেখে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে শুধালো। তৃষা বসে আছে চুপচাপ, আকাশ পর্যবেক্ষণ করছে হয়তো। একটু পর বললো সে,
" মনে হচ্ছে আজকে ঝড় হবে। চলো ঘরে যাই বরং।"
" আগে আসুক ঝড় তারপর। তুমি শো তো। "
অনিক তৃষার কোমর ধরে শুইয়ে দিলো তৃষাকে। অনিক তৃষার খোঁপা করা চুলগুলো আলগা করে মুখ গুঁজে দিলো চুলের মধ্যে। 
" কী করছো! খোলা আকাশের নিচে এসব করতে নেই। "
" হুর কী এমন করলাম? চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছি কেবল। চুপ করে শুয়ে থাকো তো।"
অনিকের কথায় তৃষা গাল ফুলিয়ে শুয়ে রইলো। এরমধ্যে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সেটা দেখে তৃষা অনিকের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। বোঝাল সত্যি বৃষ্টি হবে তাহলে। অনিক পাত্তা দিলো না সেসবে। আবহাওয়াটার সাথে বউকে আলিঙ্গন করা যেনো পারফেক্ট কম্বিনেশন মনে হচ্ছে তার কাছে। বৃষ্টির মাত্রা কিছুটা বাড়তেই অনিক শোয়া থেকে উঠে বসলো,তৃষাও উঠলো। 
" সত্যি বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসের তীব্রতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। "
" রুমে চলো তাড়াতাড়ি। ফোন ভিজে যাচ্ছে তোমার। "
" ফোন যে ওয়াটারপ্রুফ সেটা তুমি ভুলে যাও কেনো? "
অনিক তৃষার গাল টেনে দিলো। 
" হ্যাঁ হ্যাঁ ভুলে গেছিলাম। ফোন যখন ভিজলে সমস্যা নেই তবে আমিও একটু ভিজি।"
এই কথা বলে তৃষা উঠে গিয়ে ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড়ালো। আকাশের দিকে মুখ করে দু-হাত দুই দিকে প্রসারিত করে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির ছোঁয়া অনুভব করছে এখন। অনিক বসে বসে ওর পাগলামি দেখছে। কী স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছে তার স্ত্রী'কে! প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে গান ধরলো ডাক্তার সাহেব –

হু উ… উ উ উ উ উ উ

বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি

এ কোন অপরূপ সৃষ্টি

এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি

আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি 

এত মেঘের কোণে কোণে

এলো বাতাস হুহুসনে

রিম ঝিম ঝিম ঝিম রিম ঝিম বৃষ্টি

এ কি দুষ্টু অনাসৃষ্টি

বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি

ওগো বৃষ্টি তুমি মিষ্টি

বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি

এ কোন অপরূপ সৃষ্টি

এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি

আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি

তোমার অঝোর ধারায় ভিজে

আমি নতুন হলাম নিজে

মা মা পা ধা নি ধা নি

আজ হারিয়ে গেছি আমি.......

তপ্ত দুপুর। চারদিকে রোদ আর রোদ! রোদের তাপে অতিষ্ট পশুপাখি ও মানুষ। গরমে প্রাণ যা-ই যাই অবস্থা। আপাতত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের কারণে সেই গরম টের পাচ্ছে না আয়ান। অনিমাদের ড্রইং রুমে সোফায় বসে আছে সে। সামনে বসে আছেন অনিমার বাবা। আয়ান দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে এসেছে বাসা থেকেই। সত্তার শেখ সে নিয়ে একটু বকাঝকা করেছেন বটে। ভাত না খাওয়াতে পারলেও ফলমূলের ঝুড়ি সামনে এনে রেখেছেন কিছু একটা খাওয়ার জন্য। অনিমা এতক্ষণ বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো কিন্তু এখন পাশের সোফায় গিয়ে বসেছে। আয়ান দোনোমোনো করতে করতে একটা আপেল হাতে রেখে বাকি ফলগুলো সরিয়ে নিতে বললো। একজন মাঝবয়েসী লোক এসে ফলের ঝুড়ি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। 
" যাইহোক যে কথা বলার জন্য তোমাকে ডাকলাম সেসব বলি। মজার কথা হচ্ছে অনিমা নিজেও জানে না আজকে তোমাকে আমি কী বলতে ডেকেছি।"
বাবার কথায় অনিমা ও আয়ান চোখাচোখি করলো একবার। আয়ান শান্তভাবে বললো, " জি বলুন। "
" আয়ান আমি চাচ্ছি যে তুমি যদি আমার কোম্পানির কাজগুলো এখন থেকেই দেখাশোনা করতে তাহলে আমার বড়ো উপকার হতো। লোককে দিয়ে কাজ করিয়ে তো নিশ্চিত থাকা যায় না। তাছাড়া আমার তো ছেলে নেই, তুমিই ছেলে আবার তুমিই মেয়ের জামাই। সবকিছু তোমার আর অনিমারই।"
" আঙ্কেল এতকিছু সামলাতে আমি পারবো না। আমার সেই অভিজ্ঞতা নেই। "
" অভিজ্ঞতা এমনি এমনি হয় না। কাজ করতে করতে অভিজ্ঞতা আসে। শুরু না করলে অভিজ্ঞতা আসবে কীভাবে? এভাবে ভাবো তুমি হাল না ধরলে বাইরের লোকজনের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে এখনও। তাছাড়া আমি আর ক'দিন বাঁচবো বলো!"

" বাবা! এসব আর বলবে না।"
অনিমার ছোট্ট ধমকে মুচকি হাসেন সত্তার শেখ। জন্ম,মৃত্যু কি কারো ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায় হয়? মেয়েটা এখনও ছেলেমানুষ রয়ে গেলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। 
" আচ্ছা বাদ দে অনিমা। আয়ানের মতামত কী সেটা জানতে হবে। "
আয়ান চুপ থেকে সবকিছু ভাবছিল। টাকাপয়সা কিংবা সম্পত্তির প্রতি কোনো লোভ নেই ছেলেটার। কিন্তু জীবনধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অবশ্যই ইনকাম করতে চায় আয়ান৷ তাই সবকিছু ভেবে ইতিবাচক মন্তব্য করলো সে।
" ঠিক আছে আঙ্কেল। আপনি যেভাবে চান আমি সেভাবেই কাজ করবো।"
" যাক আলহামদুলিল্লাহ! এবার শান্তি। ঠিক আছে বাবা তুমি থাকো। আমি একটু বেরোব।"
বসা থেকে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বললেন সত্তার শেখ। আয়ানও উঠলো সাথে সাথে। অনিমা বসে রইলো একইভাবে। 
" আমিও বেরোবো আঙ্কেল। চলুন। অনিমা আসছি। "
" একটু পর যাও তুমি। বাবা তুমি যাও। "
" ঠিক আছে। "
অনিমার বাবা বেরিয়ে যেতেই আয়ান রেগে বলে,
" এভাবে আমাকে থাকতে বললে কেনো? লাজলজ্জা কবে হবে তোমার? কী ভাবছেন তোমার বাবা? নেহাৎ উনি তোমার বাবা বলে কিছু হয়তো ভাবছেন না। কিন্তু এসব যদি অন্য কারে সামনে বসে করে কেমন লাগবে? "
আয়ানের ক্রোধ দেখে অনিমা চুপ হয়ে গেছে। কী এমন করলো সে? কালকে কিছু নতুন শাড়ি কিনেছে অনিমা। সেখান থেকে একটা পছন্দ করে দিতে বলবে বলেই তো থাকতে বললো আয়ানকে।

" আমি তো এমনি বলেছিলাম। "
" ভেবেচিন্তে সবকিছু বলবা এরপর থেকে। "
" আচ্ছা। এসো তুমি। "
অনিমার অভিমান হয়েছে। শেষের কথাগুলো বলেই নিজের ঘরে চলে গেছে অনিমা। আয়ানের খারাপ লাগছে এখন। ওভাবে না বললেও তে হতো? ছোট্ট মেয়েটা কষ্ট পেলো তার জন্য। 
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন