বন্য প্রণয় - পর্ব ২৫ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


বাড়িতে বিয়ে লেগেছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের আনাগোনায় মুখরিত হচ্ছে তাহমিদের বাড়ি। সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে। আসরের নামাজের পরে বিয়ে। বরপক্ষ নামাজের পরে আসবে। হাতেগোনা একঘন্টা সময় বাকি আছে মাত্র। শেষ মুহূর্তে বউকে সাজানোর প্রস্তুতি চলছে। তাহমি নিজেই সাজাচ্ছে তৃষাকে। সাথে তৃষার বান্ধবী তামান্না ও ফাতেমা সাহায্য করছে।
" তামান্না দেখ তো ঠিকঠাক হলো সব?"
তাহমি তৃষার থুতনিতে হাত রেখে ভালো করে দৃষ্টিপাত করলো চেহারার দিকে। পিংক কালারের বেনারসি সাথে ম্যাচিং লিপস্টিক। হালকা মেকআপ, কাজল,আইশ্যাডো, আইলাইনার,মাশকারা সবকিছুই ঠিকঠাক মতো দেওয়া হয়েছে। তামান্না নিজেও একবার ভালো করে পরখ করে বললো,
" ঠিকই লাগছে আপু। তুই দেখ তো ফাতেমা।"
" সুন্দর লাগছে। "
ফাতেমা হেসে বললো। তৃষা লজ্জা পাচ্ছে। আজকে যেনো পৃথিবীর সব লজ্জা এসে ভড় করেছে তার উপর। একটু আগেই আবার ডাক্তার সাহেব কল করেছিলেন। তামান্না কল রিসিভ করে কথা বললো। কী লজ্জা! বিয়ের একটু আগেও বর বউয়ের সাথে কথা বলার জন্য আকুপাকু করছিলো। 
" যাক তাহলে,আমার বোনটা রেডি। মাশা-আল্লাহ! কারো নজর না লাগুক। "
তৃষা ঠুকরে কেঁদে উঠে তাহমিকে আলগোছে জড়িয়ে ধরে। তাহমি মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বোনকে শান্ত করতে বলে, 
" বোকা মেয়ে মন খারাপ কেনো করছিস? আমাকেও তো শ্বশুর বাড়ি থাকতে হয়। মেয়ে মানেই পরের ঘরে যেতে হবে। তবে তোর তো একার সংসার। অনিক ছুটি পেলেই দু'জনে চলে আসবি। "
" সবাইকে খুব মিস করবো আপাই।"
" আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। কান্না করিস না! সব ঘেঁটে যাবে তো। লক্ষ্মী বোন এরকম করিস না।"
তৃষাকে শান্ত করার জন্য চেষ্টা করছে তাহমি। ঘরের বাইরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সহন। কখন থেকে উঁকি দিচ্ছে বউকে দেখার জন্য। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে লক করা। বোনের বিয়েতে কেমন সাজল সেই নিয়ে লোকটার ভাবনার শেষ নেই। তবে অনেক কষ্ট করে তাহমিকে সাজার জন্য মানিয়েছিল সহন। চেহারার একপাশে পোড়া দাগ থাকার কারণে আয়নার দিকে তাকায় না তাহমি। যদিও দাগ হালকা হয়ে আসছে। তবে মন খারাপ তো লাগবেই। 

সারা বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে লাইব্রেরিতে ঢুকে বসেছে অনিমা। ল্যাভেন্ডার কালারের লেহেঙ্গা পরেছে সে। খোলাচুল, হালকা লিপস্টিক ঠোঁটে। সাজগোছ কম করে এই মেয়েটা। একা একা ভালো লাগছিল না বলে আয়ানদের বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল এতক্ষণ। হঠাৎ লাইব্রেরি লেখা দেখে সেখানে ঢুকল। ভেতরে দাঁড়িয়ে চারপাশে নজর বুলিয়ে নিলো সে। অনেক রকমের বইয়ের সমাহার এখানে। যেমন কালজয়ী লেখকদের বই আছে এখানে তেমনি নতুন লেখকদের বই-ও আছে। হঠাৎ দরজার বাইরে কারো জুতার খসখস আওয়াজে চমকে উঠলো অনিমা। কোনো পুরুষ মানুষ হঠাৎ এখানে চলে এলে অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হবে নিশ্চিত। অনিমা এসব ভাবছিল তখুনি রুমে ঢুকল আয়ান৷ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো অনিমা। যেনো আয়ানের কাছে সে ভীষণ নিরাপদ। আয়ান অনিমাকে এখানে দেখবে বলে আশা করেনি। সে উল্টো সারা বাড়ি খুঁজছিল মেয়েটাকে। 
" অনিমা! তুমি এখানে একা একা কী করছো?"
" লাইব্রেরি লেখা দেখে এলাম। বইটই দেখতে ভালো লাগে আমার। বর তো এখনো আসতে একটু বাকি তাই ঘুরছিলাম বাড়িময় জুড়ে।"
অনিমা আয়ানের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। উচ্চতায় আয়ানের ঠিক বুক বরাবর সে। আয়ানের সামনে যেনো সে কিছু না। আয়ানের হৃৎস্পন্দনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অস্বাভাবিকতার কারণ সে বুঝতে পারছে না। অনিমাকে কি বলবে কিছু? না! অতটুকু মেয়েকে কী বলবে সে? 
" ভালো করেছো। চলো তাহলে নিচে যাই।"
" আপনি যান আমি আসছি আয়ান স্যার। "
আয়ান গেলো না। তাহমিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না আয়ান। ইচ্ছে করছে এতটুকু মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিতে। তবেই বুঝি তার এই অস্থিরতা কমবে। অনিমা চোখ বন্ধ করে নিঃশাস ফেলে আয়ানকে চমকে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। হুট করে কী হলো সেটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো আয়ানের। অনিমা কিছু ভাবছে না আপাতত। বুকে মুখ গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরকার হলে আয়ান স্যার সরিয়ে দিবে। তবে যতক্ষণ না সরায় ততক্ষণ তো ধরে থাকাই যায়! আয়ান আর কিছু ভাবল না। সে বুঝে গেছে তাদের দু'জনার ভাবনা এক ও অভিন্ন। অনিমাকে চমকে দিয়ে আয়ানও দু'হাতে আঁকড়ে ধরলো ছোট্ট শরীরটাকে। অনিমার কিছু একটা হলো। ভীষণ সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। কতকাল পরে যেনো একটা নিরাপদ, শান্তির স্থানের খোঁজ পেলো সে। পরম তৃপ্তিতে বুকে মাথা ঠেকিয়ে রইলো যতক্ষণ না তাদের কেউ খোঁজ করে। 

পর্দার অপরপ্রান্তে বসে কাজী সাহেব তৃষাকে কবুল বলতে বলছেন। তৃষা বসে আছে সাথে আছে তার বোন,অনিমা,বান্ধবীরা। সবকিছু কেমন ঘোরের মতো লাগছে। শুধুমাত্র তিন কবুল বলার অপেক্ষা! তারপর সে ডাক্তার সাহেবের বিবাহিতা স্ত্রী হয়ে যাবে। ওপাশ থেকে তাড়া এলো। তাহমি বোনকে ফিসফিস করে কবুল বলতে বলছে। সবাই চুপ করে আছে। অতঃপর থেমে থেমে তিন কবুল বললো নববধূ। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। অনিকের হৃদয়ে বয়ে গেলো নতুন জীবনের আগমনী বার্তার সুর। যখন আমাদের জীবন থেকে ভালোবাসার মানুষগুলো আঘাত দিয়ে কিংবা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে হারিয়ে যায়, তখন আমরা একা হয়ে পড়ি। আমাদের সমস্ত অনুভূতি তবুও জমিয়ে রাখি সেই ভুল মানুষদের জন্যই। কখনো ভুলেও ভাবতে পারিনা আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো। যখন দ্বিতীয় বার ভালোবাসার কথা-ই আমরা ভুলে যাই তখনই এমন কোনো মানুষ আসে জীবনে যাদেরকে না ভালোবেসে পারা যায় না। এরা আমাদের হৃদয়ে নতুন করে ভালোবাসা সঞ্চার করে। নতুন করে বাঁচতে শেখায়,রঙিন স্বপ্ন দেখায় নতুন করে। অনিকের জীবনে তৃষা সেই দ্বিতীয় মানুষ। এই মানুষটাকে ঘিরেই এখন অনিকের আগামী দিনের পরিকল্পনা ও স্বপ্ন। বিয়ে শেষে খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে বউ নিয়ে বেরোনোর সময় আগত। এই সময়টা ভীষণ কঠিন। তৃষার মা আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছেন। তাহমি চলে যাওয়ার পরে তৃষা ছিলো তার ছায়া সঙ্গী। এখন ছোটো মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেলো। তৃষার বাবা চুপচাপ মানুষ। এককোণ বসে আছেন নিশ্চুপ। উনাকে দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না ভেতরে কতটা দহন হচ্ছে। মেয়ের বিয়েতে বাবাদের এভাবেই কলিজা পোড়ে। এতকিছুর পরেও নববধূকে বিদায় দিতে হলো সবাইকে। চিরচেনা পরিবেশ, মানুষগুলো ছেড়ে বরের হাত ধরে নতুন গন্তব্যে এগিয়ে গেলো তৃষা। এই জীবনে অনিক তার একমাত্র ভরসা। 
বিকেলের ঘটনার আয়ান কিংবা অনিমা কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা বেজেছে। পাশাপাশি খোলা আকাশের নিচে শহরের রাস্তায় হাঁটছে অনিমা ও আয়ান। সামনেই গাড়ি পার্ক করা অনিমার। ড্রাইভার ছিলো সর্বক্ষণ। একটু আগেই উনি আয়ানদের বাসা থেকে। 
" আমি ড্রাইভার মামার সাথে চলে যাবো স্যার। আপনি বরং আসুন। "
অনিমা দৃষ্টি রাস্তায় রেখেই বললো কথাটা। আয়ান সময় নিলো উত্তর দিতে। সাহস করে হাত ধরলো অনিমার। অনিমা কিছু বললো না। আঙুল ধরে এগোতে লাগলো সামনের দিকে। কেমন অদ্ভুত ফিল হচ্ছে অনিমার। এই হাতে আর মানুষটার বুকে এতো প্রশান্তি কীসের? ছুঁয়ে দিলেই মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ হচ্ছে তার আয়ান স্যার। 
" এখন থেকে কম কম বুঝবে। আমি বাসা পর্যন্ত যাবো তোমার সাথে। দিনকাল ভালো না। এই রাতে ড্রাইভারের সাথে একা আমি তোমাকে ছাড়তে পারিনা। তোমার বাবার কাছ থেকে বলে নিয়ে এসেছিলাম তোমাকে। আমার দায়িত্ব নিজের সঙ্গে করে তোমাকে তার কাছে পৌঁছে। "
" ঠিক আছে। "
অনিমা কথা বাড়াল না। কেনো জানি চুপচাপ এভাবে হাঁটতেই বেশি ভালো লাগছে তার। নতুন নতুন অনুভূতিরা তার চিত্তকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আয়ানের এখন আর কোনো সংশয় নেই। নিজের মনকে বুঝতে না পারলেও অনিমার চোখের ভাষা পড়তে তার সমস্যা হয়নি। অনুভূতিরা দোল খাচ্ছে ছোট্ট অনিমার মনেও। তবে আয়ানের ভয় হয়। এই বয়সের ভালোলাগা যদি ভবিষ্যতে গিয়ে না থাকে অনিমার? তখন!
.
.
.
চলবে........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন