বন্য প্রণয় - পর্ব ৪২ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


"হ্যাঁ। সত্তার ভাই একেবারে মাটির মানুষ। আজকাল বড়লোকদের যে অহম, সেখানে অনিমার পরিবার একশোটার মধ্যে একটা।"
" সেটাই বললাম আয়ানের মা। মানেমানে বিয়েটা হলে নিশ্চিন্ত হই। অনিমার মতো মেয়ে ঘরে এলে তোমার আর একাকীত্ব বলে কিছু থাকবে না।"
আয়ানের বাবা মুচকি হেসে বললেন। আমেনা ইসলামও হাসলেন। 
" সে তো বটেই। ভীষণ কথা বলে অনিমা। কিছুটা তাহমির মতো চঞ্চল। ওদের মনে হয় দুই বোন,তৃষা আর আয়ানের সাথে তো তাহমির মিল নেই। "
" ভালোই বললে। "
আয়ানের বাবা দু-হাত বুকে সমানভাবে রেখে চোখ বন্ধ করলেন ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। 

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে অনিমা আয়ানকে বাড়ির অন্য একটা রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আয়ান দ্বিমত পোষণ করেনি। চুপচাপ খেয়েদেয়ে নিজের জন্য বরাদ্দ করা ঘরে দশটার মধ্যে চলে গেছে। অনিমাও নিজের ঘরে এসেছে অনেকক্ষণ। আয়ানের মতিগতি কিছু বুঝতে পারছে না সে। এভাবে তো কখনো আসেনি আয়ান! আজ কীসের জন্য এলো? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই ওর কাছে। তা-ও আবার যখন সত্তার শেখ বাড়িতে নেই তখন এলো আয়ান? ভাবনার অতলে তলিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে অনিমা। 
ঘড়িতে সময় ঠিক রাত বারোটা। দেয়ালঘড়ির আওয়াজ ভেসে এলো বসার ঘর থেকে। সেই সাথে আয়ানের কন্ঠে নিজের নাম কিছুটা উচ্চস্বরে শুনে ঘুম ভেঙে গেলো অনিমার। আচমকা আয়ান কেনো চেঁচিয়ে উঠলো সেই নিয়ে ভয় হচ্ছে অনিমার। কী হলো! চোখমুখ হাতের তালু দিয়ে ঢলে বিছানা থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো অনিমা। সমস্ত ঘর অন্ধকার! তাড়াহুড়ায় ফোনটাই আনতে মনে নেই অনিমার। অন্ধকারে হাতড়ে ঘরের লাইট জ্বালাতে যাবে তখুনি একটা হাত এসে আঁটকে দিলো অনিমাকে। চমকাল অনিমা!
" কে? কে! আয়ান তুমি কোথায়? আমার কিন্তু ভয় করছে।"
ভীতি প্রদর্শন করে বললো অনিমা। আয়ান অনিমাকে শান্ত করতে অন্ধকারে জড়িয়ে নিলো বুকে। 
" আমি অনিমা। শান্ত হও প্লিজ। কিছু হয়নি, সবকিছু ঠিক আছে। "
" তুমি? এভাবে ঘর অন্ধকার কেনো? 
" তুমি দাঁড়াও। আমি এখুনি লাইট জ্বেলে দিচ্ছি। "
" আচ্ছা। "
অনিমাকে ছেড়ে দিয়ে আয়ান অন্ধকারে হারিয়ে গেলো কিছু সময়ের জন্য। অনিমা বুঝতে পারছে না কিছু। হঠাৎ ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। আয়ান,রাহিমা ও অনিমার বাবা সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,
" হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ডিয়ার অনিমা।"
অনিমা দু-হাত দিয়ে মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু কল্পনার বাইরে ছিল তার। বসার ঘরের মাঝখানে টেবিলের উপর ইয়া বড়ো একটা সুন্দর কেক রাখা আর সমস্ত ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। অনিমা এগিয়ে গেলো সত্তার শেখের দিকে। জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে তিনি। অনিমা আহ্লাদী স্বরে বললো, 
" এজন্য তুমি মিছিমিছি বাইরে যাবে বলেছিলে? "
" ইয়েস মাই প্রিন্সেস। সবকিছু আয়ান একাই করেছে। আমরা শুধু সাথে ছিলাম। চলো কেক কাটি।"
আয়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন অনিমার বাবা। অনিমা বাবাকে ছেড়ে কেকের সামনে এসে দাঁড়াল। 
" তোমরা এতো ভালোবাসো আমায়! আজীবন যেনো এই ভালোবাসাটুকু অটুট থাকে। "
" ইনশাআল্লাহ থাকবে। আঙ্কেল ঘুমাবেন, সারাদিন আমার সাথে এসবকিছু ব্যবস্থা করেছেন তো। তুমি বরং কেক কেটে নাও আগে। তারপর আমরা কথা বলবো।"
" হ আপা কাটেন কেক। "
আয়ান ও রাহিমার কথামতো কেক কাটতে শুরু করলো অনিমা। প্রথমে ক্যান্ডেল গুলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে তারপর ছুরি দিয়ে কেক কাটলো। সবাই আবারও একসাথে জন্মদিনের গান গাইল। প্রিয় মানুষদের সাথে জন্মদিনের সময়টুকু কাটানোই অনিমার কাছে বেস্ট গিফট মনে হচ্ছে। কেক কাটা শেষে সত্তার শেখ নিজের ঘরে চলে গেলেন। রাহিমাও মনমতো কেক টেক খেয়ে তারপর ঘুমুতে চলে গেছে। শুধু বসার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে অনিমা ও আয়ান। 
" তুমিও ঘুমাতে যাও বরং।"
অনিমা আয়ানের হাত থেকে কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাসটা নিজের হাতে নিলো। 
" কেমন লাগলো সারপ্রাইজ? "
" ভীষণ ভালো। ধন্যবাদ দেওয়া দরকার বাট দিচ্ছি না হুহ্। "
" দিতে হবে না। তারচে বরং একটু ঠোঁট ছুঁইয়ে দাও বুকের মাঝখানে। "
আয়ানের নির্লজ্জ মার্কা কথায় কিছুটা অবাক হয়েছে অনিমা। তবে লজ্জাও লাগছে একটু-আধটু। কেশে উঠল অনিমা।
" সেসব বিয়ের পর। "
" এহহ! এমনিতে তো বলো কাছাকাছি আসি না, রোমান্স করি না! তাহলে এখন আসছ না কেনো তুমি? "
" তুমি যেমন পালাই পালাই করো তেমনটাতেই তোমাকে ভালো লাগে। ঠোঁটকাটা, নির্লজ্জ হলে ভীষণ বেমানান লাগবে। সামনেই তো বিয়ে! তারপর তুমি আমার হুহ্। "
" তাহলে এখন আমি কার?"
" এখনও আমার। তখনও আমারই হবা। পার্থক্য একটাই তখন হালাল ভাবে হবে। "
আয়ান অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো একবার। এমনিতে মেয়েটাকে থতটা পাগলি মনে হয় আসলে সেরকম নয়। বেশ উন্নতি হয়েছে তার মধ্যে। 
" ঠিক আছে। তাহলে যাও তুমিও ঘুমাও। আমিও যাচ্ছি। "
" হুম। শুভ রাত্রি। "
" আহা! শুভ আর রাত্রি,এখানেও কাপল।"
আয়ান হেসে বলে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। অনিমাও নিজের ঘরের দিকে এগোলো ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে। 

ইদানীং তাহমির হাঁটাচলা করতে সমস্যা হচ্ছে। আগের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে এই ঘর থেকে ওই ঘরে তো আর যেতে পারে না। সারাদিন বাড়িতে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগে আজকাল। ডাক্তারের তারিখ অনুযায়ী মাত্র দশ দিন বাকি আছে ডেলিভারির। ভয় লাগে। মনে হয় সবকিছু ঠিকঠাক মতো হবে তো?
" কী ব্যাপার? এই ভরসন্ধ্যায় ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছিস কেনো তাহমি? শরীর ঠিক আছে তো?"
ঘরে প্রবেশ করে বাতি জ্বেলে দিলো সহন। বিকেলে একটু বের হয়েছিল সে। মাত্র বাসায় ফিরলো। তাহমি এতক্ষণ শুয়ে ছিলো, সহনকে দেখে উঠতে চাইল ঠিক, কিন্তু একা উঠতে পারছে না। কোমরে ভীষণ ব্যথা। শুয়ে থাকলে আর নিজে থেকে একা একা উঠতে পারে না সে। শরীরের গঠন পরিবর্তনের ফলেই এই সমস্যা হয়। তাহমির কষ্ট হচ্ছে দেখে সহন ধরে উঠিয়ে বসায় তাহমিকে। তাহমি ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ লাগলো তার নিজেকে স্বাভাবিক করতে। 
" সব ঠিক আছে সহন। কিন্তু ভয় লাগছে, সবকিছু ঠিক থাকবে তো?"
" বোকা মেয়ে! কিছু হবে না। সবকিছু ভালো হবে। "
" তাই যেনো হয়। আচ্ছা শোনো,এখন থেকে তোকে তুই করে ডাকলে সাড়া দিবি না। মামুনি বলছে ক'দিন পর আমাদের বেবি আসবে,সে যদি শোনে আমরা তুইতোকারি করি তাহলে সে-ও সেটাই শিখবে। অথবা বিষয়টা কেমন লাগবে না? "
সহন একটু সময় নিলো বিষয়টা নিয়ে ভাবতে। মিনিট পাঁচেক ভেবেচিন্তে তারপর বললো,
" তাহলে আমিও তুমি বলার চেষ্টা করবো। বাবা তার মা'কে তুই বলে ডাকলেও তো পুচকুর মনটা খচখচ করতে পারে। তাই না? "
" বেশ। এখন থেকে আমরা একে অপরকে তুমি বলে সম্মোধন করবো। ওকে?"
" ঠিক আছে। "
সহন তাহমির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে টেবিলের উপর রাখা প্রয়োজনীয় জামাকাপড় ওয়াশরুমে গেছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। তাহমি বসে আছে একা। জীবনে খারাপ সময় তেমন করে কখনো আসেনি। তাই বলেই ভীষণ ভয় লাগছে তাহমির। 

আগামীকাল আবারও বাবার বাড়ি যাবে তৃষা,সাথে অনিকও যাবে৷ তাহমির সময় হয়ে গেছে জেনেই চলে আসবে তৃষা। সেই জন্য জামাকাপড় গোছগাছ করছে ব্যস্ত আপাতত। কিন্তু কাজের মধ্যে এসে অনিক পেছন থেকে তৃষাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। 
" কী করছো! ছাড়ো বলছি। জামাকাপড় না গোছালে সকাল সকাল কীভাবে রওনা হবো?"
" আমি গুছিয়ে দিবো৷ আসো একটু ভালোবাসি।"
তৃষা নিজেকে অনিকের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। খিলখিল করে হেসে বললো,
" এসব পরে মশাই। আগে ঠিক করুন নতুন অতিথির জন্য কী কিনবো? এখন তো কিছু পড়তে পারব না বেবি। মানে ও তো এতটুকু থাকবে।"
.
.
.
চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন