তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ০৩ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


ঘড়িতে রাত সারে এগারোটা। অথচ এখনো এ শহর জাগ্রত। হয়তো কখনোই ঘুমায় না। আমি তো কভু রাত্রিবেলা বাইরে বের হইনি। তাই আমার জানা নেই। রৈনীল রাস্তার পাশেই ফুটপাতে ধূলা ঝেড়ে আমাকে বসার আহবান জানালো। প্রথমে সংকোচ হচ্ছিল। তবে পরক্ষণেই মন থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তা মুছে আমি ওনার পাশে বসলাম। 

দূরত্ব বজায় রেখেই বসেছি আমরা। আমার ভেতর একইসাথে ভয়, উত্তেজনা আর আনন্দ ঢেউ খেলে যাচ্ছে। বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না আমি। রৈনীল নিজেও খানিকক্ষণ চুপ থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, 'আপনি কখনো রাতের শহরে ঘুরতে বের হয়েছেন?'
আমি ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, 'নাহ। এরকম সুযোগ হয়নি।'
'কখনো সুযোগ পেলে বের হবেন। আপনার ফ্যামিলি কি অনেক রেস্ট্রিকটেড?'
'হুম। অনেক বেশীই রেস্ট্রিকটেড। আমার মতো একটা মেয়ের কোনো মোবাইল ফোন নেই, এটা শুনেও বুঝতে পারছেন না?'
'হ্যাঁ, আন্দাজ করেছি। আপনারা কয় ভাই বোন?'
'দুই ভাই, এক বোন। আমি সবার ছোট।'
'আপনার ভাইদেরও কি ফোন নেই?'
'ওদের থাকবে না কেন? ওরা তো ছেলে। এই সমাজে ছেলেরা সব করতে পারে।'
'সোসাইটি আর আপনার ফ্যামিলি কিন্তু এক নয়। এই সমাজে ক্লাস টেন পড়ুয়া মেয়েদেরও ফোন আছে। এজন্য আলাদা করে ভাইদের কথা বললাম।'

আমি বেশ ক্ষোভের সঙ্গে উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু নিজের পরিবারের বদনাম করতে একেবারেই ইচ্ছে হলো না। রৈনীল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো কিছু শোনার আশায়। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। ওই সাধারণ দৃষ্টিটাও আমার মনে আতংক তৈরি করছে।
 পরিস্থিতি ভালোর দিকে নিয়ে যেতে আমি শুধালাম, 'আপনি বই পড়তে পছন্দ করেন?'
সে ঝটপট কিন্তু টেনে উত্তর দিলো, 'হ্যাঁ। খুউউউব।'
'কি ধরনের বই বেশী পড়া হয়?'
সে কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো, 'সব ধরনের।'
'স্পেসিফিক কোনো জনরা?'
'উমমম, এখন তো ওভাবে জনরা হিসাব করে পড়িনা। যখন যা পড়া দরকার হয় বা যেটা জানতে ইচ্ছে করে, সেটাই পড়ি।'
'শুধু জানার জন্য বই পড়েন! বিনোদনের জন্য পড়েন না?' আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম।

রৈনীল ফিক করে হেসে বললো, 'ওই সময়টা অনেক আগেই পার করে এসেছি। আমার বইয়ের কালেকশন দেখবেন?'

সে পকেট হাতড়াতে লাগলো। তারপর আবারও হেসে বলল, 'ফোনটাই তো আনিনি। আমার কাছে কমপক্ষে দশ হাজার বইয়ের কালেকশন আছে।'
'সিরিয়াসলি!' 

আমি বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলাম রৈনীলের দিকে। আমি আগে ভাবতাম আমার বাবার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিটাই বিশাল বড়। অথচ সেখানে সর্বসাকুল্যে হাজার দুয়েক বই হবে। দশ হাজার বই মানে তো একেবারে বিশাল ব্যাপার! 

বললাম, 'এগুলো কোথায়? আপনার বাসায়?'
'সে আরেক গল্প। ব্যাচেলর থাকি, এত বই নিয়ে বারবার তো টানাটানি করা যায় না। আমার বাড়িতে মানে মায়ের ওখানে লাইব্রেরি আছে। আমি যে রুমে থাকতাম এখন ওটা পুরোটা বইয়ে ঠাসা। আমি যখন যাই, সঙ্গে করে কিছু নিয়ে আসি। অবশ্য বেশিরভাগ বইই আমার পড়া। এখন নতুন করে যা কিনি তা আমার ব্যাচেলর বাসায় থাকে।'

আমি এখনো আশ্চর্য হবার ঘোর কাটাতে পারছি না। কোনোমত ঢোক গিলে বললাম, 'আমিও বইয়ের পোকা। আমাকে কিছু বই ধার দিবেন? পড়বো। বড্ড লোভ হচ্ছে আপনার বইগুলো পড়তে।'
'অবশ্যই দেবো৷'
'বলার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন? অনেকে তো কাউকে বই ধার দিতে চায় না। ফেরত না পাবার আশায়।'
'আমার এত সংখ্যক বইয়ের মধ্যে এক দুইশ বই যদি কেউ পড়তে পড়তে নিজের ভেবে রেখেও দেয়, আমার তাতে বইয়ের অভাব হবেনা। আমি চাই সবাই বইয়ের সঙ্গে থাকুক। বাড়িতে আশেপাশের বাড়ি থেকে ছেলেমেয়েরা এসে বই নিয়ে পড়ে। কয়েকদিন ধরে রেখে রেখে পড়ে। আমার মা আবার এসবে ওস্তাদ। আমার জিনিস উনি খুব যত্ন করে রাখে।' 

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওনার কথা শুনছিলাম। মানুষ বোধহয় বেশী জ্ঞানী হয়ে গেলে এত সুন্দর হয় তার বাচনভঙ্গি! 
রৈনীল বললো, 'চলুন উঠি। বারোটা বাজতে চলল।'

আমি উঠে দাঁড়ালাম। গেট দিয়ে ঢোকার আগে আরেকবার পিছনে ফিরে রাস্তাটা দেখে নিলাম। আমার ইচ্ছে করছে আরো কিছুক্ষণ বাইরে থাকি। কিন্তু সবসময় সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হবার কথা থাকে না। 

রৈনীল দাড়োয়ানের কাছে জানতে চাইল স্বাগতা আপু বের হয়েছিল কিনা। দাড়োয়ান মাথা নেড়ে উত্তর দিলো, 'না। এখনো বের হয় নাই।'
বলেই হেসে ফেলল দাড়োয়ান। যেন আপুর বের না হওয়াটা খুব মজার একটা ঘটনা। আমি তাকিয়ে দেখি আরও পাঁচ ছ জন দাঁড়িয়ে আছেন দূরে। রৈনীলকে বলতেই সে ওদিকে এগিয়ে গেলো।

এখানকার দুজনকে আমি চিনি। স্বাগতা আপুর বান্ধবী। বাকিরা বোধহয় ভাইয়ার বন্ধু হবেন। রৈনীল যাদেরকে চেনে, তাদের সঙ্গে আলাপ করছিল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ। আমার কাউকে কিছু বলার নেই। হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল আমার আজকের ডিপ্রেশনের মুহুর্তগুলো। আহা, কত কান্নাকাটিই না করেছি সারাদিন। অথচ আজ রাতটা এত চমৎকার কাটবে তা কে জানতো! জানলে বোধহয় আমিই আর কান্নাকাটি করতাম না।

অতিথিদের মধ্য হতে একজন বলে উঠলেন, 'আমরা সবাই একসঙ্গে একটা গান গেয়ে ওকে সারপ্রাইজ দিতে পারি। কোন গানটা ভালো হবে?'

অন্য আরেকজন বলল, 'আমার গান শুনলে রাস্তার কুত্তাগুলো বাড়ির ভেতর ঢোকার জন্য ঘেউঘেউ করবে।'
'করলে করবে। আমার মনে হয় সবাই মিলে একসঙ্গে গান গাইলে জুবায়েরের খুব ভালো লাগবে। সবসময় তো সবাই হ্যাপি বার্থডে বলে সারপ্রাইজ দেয়। আমরা একটু ইউনিক কিছু করলাম।'

স্বাগতা আপুর বান্ধবী বললো, 'তুমি রবে নীরবে, এই গানটা করলে ভালো হবে না?'
'ও কি মরে গেছে যে ওকে আমরা এই গান শোনাবো? ও বেঁচে আছে এমন গান শোনাতে হবে।'
আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, 'ইফ ইউ হ্যাপি এন্ড ইউ নো ইট ক্ল্যাপ ইয়োর হ্যান্ডস, এটা কেমন হয়?'

সকলে সম্মতি জানালো আমার কথায়, 'এটা ভালো হবে। সবাই একসাথে হাততালি দিবা। হা হা হা।'

শেষ পর্যন্ত আমার কথাই রইলো। ওরা যখন সকলে কথা বলছিল, রৈনীল আমাকে বললো, 'তোমার গান সিলেকশন ভালো হয়েছে।'
'থ্যাংকস। আমি তো ভেবেছি সবাই হাসবে আমার কথা শুনে। ভাববে বাচ্চাদের মতো বলছি।'
'বাচ্চাদের মতো কথা বলছো, বাচ্চাদের মতো কাজ করছো- এসব বলে আমরা হয়তো হাসাহাসি করি। কিন্তু মাঝেমাঝে আমরা বড় হতে হতে যখন জীবনটাকে তিক্ত মনে হয়, তখন সবাই আবার বাচ্চা হতে চাই। আক্ষেপ করে বলি, আবার যদি ছোট হতে পারতাম! আমাদের কারো কারো ক্ষেত্রে ভেতরের শিশুসুলভ সত্তাটা মাঝেমাঝে বের হয়ে আসলে তাতে দোষের কিছু নেই। বরং তাতেও যদি জীবনের কোনো অংশে একটু আনন্দ মিশে থাকে, সেটাই তো ভালো।'

আমি মুগ্ধ হলাম রৈনীলের কথা শুনে। সে খুব সুন্দর করে কথা বলে। যখন কথা শুরু করে, ইচ্ছে হয় পুরো পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার বিচ্ছিন্ন মনযোগটা টেনে নিয়ে এসে ওর কথার ভেতর রাখি। 
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp