তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ০৪ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


ঠিক রাত বারোটায় আমরা রাস্তায় বের হয়ে স্লোগান শুরু করলাম, 'শুভ শুভ শুভদিন, জুবায়ের ভাইয়ের জন্মদিন।' 
স্বাগতা আপুর বেডরুমের একটা জানালা খট করে খুলে গেলো। দোতলার সেই জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন জুবায়ের ভাই। তারপর বের হয়ে এলেন বারান্দায়। আমাদের দিকে তাকিয়ে নেতাদের মতো হাত উঁচিয়ে বললেন, 'ঠিক আছে। ঠিক আছে। তোরা সব ভেতরে আয়।'

জুবায়ের ভাইয়ের মুখ ভর্তি হাসি। আনন্দ ঝলমল করছে পুরো মুখ জুড়ে। আমরা বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে 'ইফ ইউ হ্যাপি' গানটা গাইতে শুরু করলাম। সেই সঙ্গে সবার হাততালি। পুরো প্লান সাকসেসফুল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিছিল করার আইডিয়াটা অবশ্য রৈনীলের। স্বাগতা আপু আগেই দরজা খুলে রেখেছিল। ফোনে মেসেজ দিয়ে জানিয়েছিল, আমরা যেন চুপিসারে ভেতরে প্রবেশ করি। কিন্তু আমরা আপুর প্লানের অংশ হতে চাইনি। নিজেরা প্লান করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিছিল শুরু করেছি। শেষ পর্যন্ত আপু নিজেও দারুণ সারপ্রাইজড হয়েছে আমাদের এই কাণ্ডে। 

ভেতরে ঢুকে সবাই জুবায়ের ভাইকে ঘিরে বসলো। আমি বসে রইলাম দূরের একটা সোফায়। ওখানে সবাই সিনিয়র। ভাইয়া আর আপুর বিশেষ বন্ধুবান্ধব। আমি সবার চাইতে বয়সে ছোট; শুধু তাই না। আমি আবার ওদের বন্ধুদের দলেও পড়িনা। যখন বন্ধুবান্ধব মিলে আড্ডা দেয়, সেখানে ছোটদের না থাকাই শ্রেয়।

কিছুক্ষণ পর রৈনীল এসে আমার পাশে বসলো। জানতে চাইল, 'আপনি কি রাতে এখানে থাকবেন?'
'না। ভাইয়া আসবে আমাকে নিতে। বলেছে পার্টি শেষ হলে কল দিতে।'
'আমি চলে যাবো একটু পর।'

রৈনীলের শেষ কথাটা শুনে আমি আচমকা ওর দিকে তাকালাম। যেন ওর চলে যাওয়াটা নীতিগত নয়। বললাম, 'কেন? আপনি না থাকলে মজাই হবেনা।'
'এসেছি, উইশ করেছি, কেক খেয়ে চলে যাবো। আর থেকে কি হবে?'
'আপনার কি আড্ডা, হই হুল্লোড় এসব পছন্দ না?'
'খুব একটা পছন্দ না।'

আমি কোনোকিছু না ভেবেই হঠাৎ বলে ফেললাম, 'তাহলে আমরা আলাদা হয়ে বসে গল্প করতে পারি। আমারও গ্যাঞ্জাম পছন্দ না।'
রৈনীল চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বেশ বুঝতে পারলাম আমার এই কথাটা বলা উচিত হয়নি। কিন্তু আমি তো বিষয়টাকে এত জটিল করে ভাবিনি। বরং রৈনীলের হৈ হুল্লোড় অপছন্দ বলেই আমার ওকে এটা বলা।
রৈনীল এখনো তাকিয়ে আছে। আমি গা বাঁচাতে স্বাগতা আপুকে ডাকলাম।
স্বাগতা আপু ছুটে এলো। আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু ডেকেছি যখন, কিছু একটা তো বলতে হবে। ঝটপট চিন্তা করে আমি বললাম, 'রাতে তোমার আর কি প্লান আছে?'
'এইতো সবাই মিলে গান টান গাইবো, একটু আড্ডা হবে। এই তো।'
'আমি কখন বাসায় যাবো?'
'তুই বাসায় যাবি কেন? রাতে থেকে যাবি। আমি মমের সঙ্গে কথা বলে নেবো।'
'কিন্তু ভাইয়া তো আসবে বলেছে।'
'ওর সঙ্গেও কথা বলে নেবো। এলে এখানেই থেকে যাবে। আমার বাসায় তো ঘুমানোর জায়গার অভাব নেই। এত চিন্তা করছিস কেন?'

আমি মাথা ঝাঁকালাম। আপু চলে গেলো। রৈনীল একটা বই হাতে নিয়ে পড়ছে। কতটা বইপাগল মানুষ হলে এরকম ঘরভর্তি আড্ডায় এসেও বই নিয়ে বসে! ভাবতে লাগলাম আমি।

খানিকক্ষণ পর রৈনীল উঠে বারান্দার দিকে চলে গেলো। আমি বসে রইলাম থ হয়ে। আমাকে পাত্তাই দিলো না ভেবে খানিকটা মন খারাপও হয়েছে। তবে এত ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কষ্ট পেয়ে বসে থাকার মেয়ে আমি নই। আমার জীবনে দুঃখী হওয়ার মতো আরো বড় বড় অনেক বিষয় আছে। আমি উঠে গিয়ে বাড়িটা ঘুরতে লাগলাম নিজের মতো। 

বিশাল এই দোতলা বাড়িটার নিচতলা জুড়ে বসার ও খাবারঘর। অতিথিদের জন্য বরাদ্দ রুমগুলোও নীচতলাতেই। আর দোতলায় আছে বেশ কয়েকটা কক্ষ। তারমধ্যে একটা ছোট্ট মিউজিক রুম আছে। মিউজিক ভাইয়ার পছন্দ। খুব ভালো পিয়ানো বাজাতে পারেন উনি। রুমের সাজসজ্জাটাও চোখে পড়ার মতো। এর আগে কখনো আমার এই রুমটাতে এসে বসা হয়নি। আজ এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। দেয়ালের শেলফজুড়ে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন জিনিস ধরে ধরে দেখছি। ওরা দুজনেই দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। শেলফ জুড়ে বিভিন্ন দেশের ট্রেডিশনাল জিনিসপত্র জায়গা পেয়েছে। 

হঠাৎ শুনতে পেলাম রৈনীলের গলা, 'এই রুমে কি আছে?'
'ভাইয়ার শখের রুম এটা।'
'অন্যেরন্যের শখ দেখতে ভালো লাগে আপনার?'
'হ্যাঁ। মানুষের ভালো ভালো সবকিছুই আমার ভালো লাগে।'
'খুব চমৎকার সংগ্রহ। ধনী পরিবারে জন্ম নেয়ার অনেক রকম সুযোগ সুবিধার মধ্যে একটা হচ্ছে, নিজের সব শখ পূরণ করার জন্য প্রচুর টাকা পাওয়া যায়।' 

আমি বাঁকা চোখে তাকালাম রৈনীলের দিকে। আমার চোখে একইসাথে প্রকাশ পেয়েছে তাচ্ছিল্য ও ক্ষোভ। বললাম, 'আমিও ধনী পরিবারের মেয়ে। কিন্তু এ জীবনে আমার কোনো শখ নেই। সব শখ মরে গেছে।'
রৈনীল কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইলো। যথাযথ কোনো উত্তর দিতে না পারায় ওর মধ্যে কিঞ্চিৎ অপরাধবোধ দেখতে পেলাম। আমি কিছু বললাম না। এমনিতেই রৈনীলের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। তখন তার ওভাবে উঠে যাওয়াটায় আমার রাগ হয়েছে। 

রৈনীল কয়েক কদম হাঁটাহাঁটি করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। আমার আবারও রাগ হলো। আমি কখনো মানুষদের সাথে মেশার সুযোগ পাইনি। তাই হয়তো বুঝতে পারছি না ওনার এই আচরণটা আদৌ স্বাভাবিক কি না। আমার অতি সাধারণ মন বলছে, এটা সৌজন্যতার মধ্যে পড়ে না। কারো সাথে কথা বলার সময় তাকে না জানিয়ে চলে যাওয়াটা নিতান্তই অভদ্রতা।

পুরো ঘরটা ঘুরে দেখা শেষ করে বের হলাম। লিভিংরুম থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। রাতের নির্জনতা ভেঙে খলখলিয়ে আসা হাসি বাড়ি জুড়ে প্রতিফলিত হতে লাগলো।

আমি লিভিংরুমে গেলাম না। একটা খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। পাশেই বেতের সোফা রাখা। আমার বসতে ইচ্ছে করছে না। এই যে নিজের মতো এই রুম থেকে সেই রুমে হাঁটাহাঁটি, কিছুটা সময় একান্তে কাটানো- এটুকুই আমি পাইনি এ জীবনে। সারাজীবন মায়ের কথায় উঠবস করতে করতে কখনো বুঝতেও পারিনি কবে বড় হয়ে গেলাম। আমার মা হয়তো বুঝেছেন আমি বড় হয়েছি। তাই তো ছেড়ে দেয়ার বদলে আরো শক্ত করে বেঁধে রাখার চেষ্টাটা সবসময় করেছেন তিনি। 
তবে স্বাগতা আপুর বেলায় এই রুলস খাটেনি। আপু বেড়ে উঠেছে মুক্ত পাখির মতো। মা না থাকায় বাবার অসীম স্বাধীনতা আর আহ্লাদে আপুর জীবনটা হয়েছে অন্যরকম সুন্দর। আমাদের সঙ্গে কিছুদিন থাকার সময়টাতেও সে কখনো মাকে ভয় পায়নি। বরং মা স্বাগতা আপুকে কোনো নির্দেশনা দিতে দুইবার ভাবতেন। মায়ের সবসময় মনে হতো, স্বাগতা আপু এই দুনিয়ায় একা টিকে থাকতে পারবে। যেটা আমি পারবো না। আমার চলার জন্য সবসময় মাকে লাগবে। এমনটাই ধারণা ওনার। 

স্বাগতা আপু কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, 'একা বসে আছিস? এত কেঁদেছিস কেন?'
'কই, কাঁদিনি তো।'
'মিথ্যা বলবি না। চোখ দুইটা ফুলিয়ে ঢোল বানিয়েছিস। কি হয়েছে?'
'যা হয় সবসময়।' 
আমি ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আপু জানে আমার জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে গেছে মায়ের অতিরিক্ত শাসনে। কোথাও চান্স হচ্ছে না কেন তাই নিয়ে আজ সকালে আরেক দফা ঝড় চলে গিয়েছে আমার ওপর দিয়ে। আমি মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিধ্বস্ত। 

স্বাগতা আপু বলল, 'তোর এরপরের এক্সাম কবে?'
'আগামী শুক্রবার।'
'এবার হয়ে যাবে। টেনশন করিস না।'
'আমি চাইনা আমার কোথাও চান্স হোক। তারপর বাবা মা আমাকে অকর্মা ভেবে বিয়ে দিয়ে দেবে। আমি অন্তত এই জেলখানা থেকে মুক্তি পাবো।'
 হো হো করে হেসে উঠলো আপু। অনেক্ষণ ধরে হাসলো। আমি ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছি। হাসার মতো কিছু তো বলিনি। আমার জায়গায় থাকলে বুঝতো সে। 

আপুর হাসি ফুরালে আমি বললাম, 'থামলা কেন? আরো হাসো।'
আপু আবারও হাসতে শুরু করলো। আশ্চর্য! আমি দ্বিতীয় দফায় হাসতে বলেছি বলে সত্যি সত্যি হাসতে হবে নাকি? মনের দুঃখ থেকে একটা কথা বলেছি অথচ সে পাত্তাই দিচ্ছে না।

আপুর দ্বিতীয় দফার হাসিটা ফুরালো৷ আমি এবার আর তাকে হাসতে বললাম না। চুপ করে রইলাম। আপু বলল, 'খুব মজার একটা কথা বলেছিস সরণী। আমি মমকে বলবো। তোর তো বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে। বিয়েটা হয়ে গেলে মমেরও শান্তি, তোরও শান্তি।'

আমি দুঃখী দুঃখী গলায় বললাম, 'তা কি করে বুঝবা! বনের পাখিরা কি কখনো বোঝে, খাঁচায় আবদ্ধ পাখিটা দিনে কতবার ডানা ঝাপটায়!' 

আপু বলল, 'তুই খুব ভালো একটা মেয়ে। তোর জীবনটা অনেক সুখের হবে দেখিস। বাকি জীবন তুই খুব ভালো থাকবি। এবার সত্যি তোর চান্স হয়ে যাবে। মন খারাপ করিস না।'

আপু আমার হাতের ওপর হাত রাখলো। আমি ছোট্ট শ্বাস ফেললাম। আপু বলল, 'চল খাবার খাবিবি। সবাই বসে আছে।'।'

উঠে পড়লাম আপুর সঙ্গে। । টেবিলে বাহারী পদের খাবার সাজানো। খুব কাকতালীয় ভাবে আমার জন্য যে চেয়ারটা ফাঁকা ছিল, সেটা ঠিক রৈনীলের পাশেই। 
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp