অতঃপর তুমিহীনা আমি - পর্ব ০২ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


#অতঃপর_তুমিহীনা_আমি 
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া 
#পর্ব_২ 



" কী কইতাছেন বাবু?"
" যা শুনেছো তাই বলেছি। আচ্ছা কত বছর ধরে আছো এ পেশায়? আর এত অল্প বয়সে এসবের সাথে কী করে জড়ালে?"
মায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
"সে ম্যালা কথা!"
"অল্প বিস্তর বলো।"
"মানে?"
"বলছি ছোট করে বলো।"
"ওহ আইচ্ছা।"
মায়া বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে,
“যহন আমার বয়স দশ বছর তহন আমার মা পাশের বাড়ির করিম চাচার লগে পলাইয়া যায়।"
"পালিয়ে যায় মানে!"
আসাদ বিছানা থেকে উঠে সোফায় বসতে বসতে জিঙ্গেস করে। মায়া আসাদের কথায় ভ্রু নাচিয়ে বলে,
"পলাইয়া যায়, কথাডা কি নতুন হুনছেন?"

আসাদ একটু ইতস্তত হয়ে বললো,
"না। তবে বিবাহিতা মহিলা সন্তান রেখে অন্য পুরুষের সাথে পালিয়ে গেছে! ব্যাপারটা আমার মানতে একটু টাইম লাগলো আর কিছুনা। তারপর বলো।"
"তারপর আর কী ! রহিম চাচা মায়রে বিয়া করলো।রহিম চাচার আগের বউডাও ম্যালা কষ্ট পাইছিলো।আর আমার আব্বাও ঘরে সৎ মা আনলো। মাঝখান থেইকা আমি আর আমার ছোট ভাইডা অসহায় হইয়া গেলাম।" 
"তারমানে রহিম মিয়াও বিবাহিত ছিলেন?"
"হয়। "
"কী একটা অবস্থা! মহিলারা কী এরকমই স্বার্থপর হয়?"
কথাটা বলার সময় আসাদের চোখে নারী জাতির প্রতি তীব্র আক্রোশ ফুটে ওঠে।
"এরহমের স্বার্থপর মানে?"
আসাদ একটু নিজেকে সামলে মায়ার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে বলে,
"কিছুনা। তারপর কী হয়েছিলো বলো!"
"তারপর আর কী? আমি আর ভাই দাদা-দাদির কাছে থাকতাম। লেহাপড়ায় ম্যালা খরচা বইলা আমারে আর পড়াইলো না বাবা। বয়স যহন ষোল তহন বিয়া দিয়া দেয় আমারে।
"বিয়ে? তাহলে তোমার স্বামি কোথায়?"
আসাদ মায়ার কথা শুনে বেশ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো। মায়া একটা মেকি হাসি দিয়ে প্রত্যুত্তরে বললো,
"আসলে ওইডা কোন বিয়া ছিলো না। আমারে বিক্রি করার একটা ফাঁদ ছিলো। পরে জানতে পারি আমার বাবাই তারে ঠিক করছিল। আমারে বিয়া করছে এরকম দেখাইয়া সমাজের চোখে ধূলা দিছে!"
আসাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মায়ার মাথায় হাত রেখে বলে,
"যা হয়েছে তাতে তোমার কোন ভুল নেই। কখনোই নিজেকে ছোট মনে করবে না। যাও খাটে শুয়ে পড়ো। আমি সোফায় শুয়ে পরছি।"
মায়া অবাক হয়ে এক পলক আসাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ জিবনে কোনো পুরুষ এত সম্মান দেইনি মায়াকে। আসাদ একটা বালিশ নিয়ে সোফায় রাখতেই মায়া বলে,
"সোফায় শুইবেন ক্যান? বেশ্যার লগে ঘুমাইলে কি জাত যাইবো?"
মায়ার কথায় আসাদের খুব ইগোতে লাগে। আসাদ বালিশ নিয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে।
মায়া মনে মনে হাসে। আসাদ একটু রেগে বলে,
'ঘুমাবে ? নাকি সারারাত দাঁড়িয়েই কাটাবে?"

মায়া চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে।
পরেরদিন সকালে, আসাদ ঘুম থেকে উঠে দেখে মায়া পাশে শোয়া নেই। আসাদের কেনো জানি মায়ার উপর রাগ হলো। কিছু না বলেই এভাবে চলে গেলো মেয়েটা! মনে মনে আসাদ রাগে ফোস ফোস করতে করতে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে যায়। মনসুর চাচা সকাল সকালই সব নাস্তা রেডি করে রাখেন।আসাদ নাস্তার টেবিলে বসেও নাস্তা না করে উঠে যায়। মনসুর আলী তখন বলেন,
"স্যার ওই আপা অনেক সকালে উঠে চলে গেছেন।আপনি ঘুমাচ্ছিলেন তাই ডাকেনি! আপনাকে বলতে বলছিলো। "
আসাদ একটু ভেবে বলে,
"ঠিক আছে।"

"সিফাত শহরে এসব কি হচ্ছে বলো তো!"
সিফাত কফিতে চুমুক দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রত্যুত্তরে বললেন,
"বুঝতে পারছি না নাজমা। দেখতে দেখতে দুইটা খুন হয়ে গেলো, এখনো কোন কূল কিনারা করতে পারলাম না!"
"খুনি খুবই চালাক।"
সিফাত কফির কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললো,
"হুম। দেখা যাক, গোয়েন্দারা কি করতে পারে!"

নাজমা আক্তার স্বামীর কথায় মাথা নাড়িয়ে কফির কাপটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যান।

তিন দিন ধরে মায়ার খুব জ্বর! শরীরটা আর কাজ করছে না মায়ার। এ নিয়ে চুমকি মাসির সাথে মায়ার বেশ অশান্তি চলছে। চুমকি মায়ার কুঠির মালিক। প্রায় শতাধিক মেয়ে আছে চুমকির আন্ডারে। মায়া নিজের ঘরে শুয়ে আছে। এরমধ্যেই চুমকি মাসি ঘরে ঢোকে। বিশাল বড় শরীর তার।পড়নে কালো শাড়ি। হাতে কানে গলায় রুপার গয়না। মুখে পান চিবতে চিবতে মায়া কে বললো,

"কী রে ঔষধ খাওয়ার পরও সুস্থ হইতাছিস না ক্যান?"
চুমকি বেশ চোখ পাঁকিয়ে বললো কথাগুলো। মায়া সাবলিলভাবেই প্রত্যুত্তরে বললো,
"দেখতাছো তো ঔষধ তো খাইতাছি! ডাক্তার সাহেব কইলো ভাইরাল না যেন ভাইটাল জ্বর। কমতে সময় লাগবো।"
মায়ার কথায় চুমকি রাগে অগ্নির্শমা হয়ে বলে,
" কী! আর কতদিন টাইম লাগবো তর? তিন দিন বইসা আছিস। খদ্দেররা তোরে চাইতেছে! আইজকা থাক। তয় কাইল থেইক্কা কাজ শুরু করবি।"
চুমকি মায়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে হনহন করে বের হয়ে গেলো। মায়া কিছু বলতে গিয়েও আর বলতে পারেনি। সহসায় দু'চোখ ঝাপসা হয়ে যায় মায়ার। চোখ থেকে গড়িয়ে পরে অশ্রুমালা! মায়ার ঝাপসা চোখে ভেসে ওঠে ওর ছোট ভাই আরহানের মুখটা। মনে মনে ভাবে মায়া কোথায় আছে ওর ভাই? কেমন আছে! কত বড় হয়েছে এখন আরহান? এসব ভাবতেই ঘুমিয়ে পরে মায়া। পরেরদিন থেকেই শুরু হয় মায়ার অসহ্য জীবনের একগেয়ে কাজ।কত মানুষ আসে যায় তার হিসাবও রাখতে পারে না মায়া।

গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। আশেপাশের দালানগুলোতে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। মায়া জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের পরিবেশ দেখছে। মায়ার খুব ইচ্ছে করে বাইরের জগতের আলো বাতাসের নিঃশ্বাস নিতে। চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো বাইরের দিকে দেখতে থাকে সে। এরমধ্যেই দরজা খোলার ক্যাচ ক্যাচ শব্দে পিছন ফিরে তাকায় মায়া। চুমকির চ্যালা কালু এসেছে। কালু একটা ফোকলা হাসি দিয়ে বললো,
"মায়া তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে চল। একজন তরে আইজ রাইতের জন্য বাড়ি নিয়া যাইবো।"

মায়া একটু ভ্রু কুঁচকে কালুর উদ্দেশ্যে বললো,
"বাড়ি নিয়া যাইবো?কিডা লোকটা!"
"কী যেন সাদ না কি নাম কইলো!"
মায়া মনে মনে ভাবে,
"সেদিন যে লোকটা বাড়ি নিয়েছিলো এই কি সেই?নামটাও তো জানে না মায়া! কালু আর কিছু না বলেই নিচে চলে যায়। মায়াও পিছুপিছু যায়। নিচে যেতেই আসাদকে দেখতে পায় মায়া। আসাদ মায়াকে একবার দেখে বললো,
"হ্যাঁ এই মেয়েটির কথাই বলেছিলাম।"
চুমকি মাসি এবার মায়ার দিকে পান চিবোতে চিবোতে তাকালো।তারপর বললো,
"ওই মায়া! যা আইজ এই বাবুর লগে ওনার বাড়ি যা। দেখিস বাবুর যেন কোনো অসুবিধা না হয়। যান বাবু।"
চুমকির কথায় মাথা কাঁত করে সম্মত জানায় মায়া।আসাদ মায়াকে ইশারা করে সাথে যেতে বলে।

রাত প্রায় আটটা বেজেছে। মাসুদ রানা একজন পতিতাকে সাথে করে উনার বাগান বাড়ি এসেছেন।নির্জন জায়গায় বাড়িটা। সহজে কেউ বাড়ির আশেপাশে আসেনা। মাসুদ রানা আজ বড্ড খুশি।অনেক দিন পর নিজের বাগান বাড়িতে এসেছেন।রুমটা বেশ রোমান্টিকভাবে সাজিয়েছে রানা সাহেব। বকুল(পতিতা) সেজেগুজে বসে আছে। রানা সাহেব বকুলকে ধাক্কা মেরে বিছানায় শুইয়ে দেয়। এক টানে খুলে ফেলে বকুলের পরনের পোষাক। হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বকুলের উপর। রানা সাহেব যখন পৈশাচিক আনন্দে বিভোর তখনি ঘরের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। রানা সাহেব একটু থেমে হতচকিত হয়ে আধো আধো গলায় জিজ্ঞাসা করে,
" দরজার বাইরে কে?"
বকুল এরমধ্যে নিজের পোশাক ঠিক করে খাঁটে চুপচাপ বসেছে। অদ্ভুতভাবে রানা সাহেবের ভর্য়াত মুখটা দেখে মনে মনে মুচকি হাসছে বকুল।

আসাদ মায়াকে নিয়ে এরমধ্যেই বাড়ি চলে এসেছে। মায়া এখন আসাদের রুমে বসে আছে। আর আসাদ বাথরুমে ফ্রেশ হতে গেছে। মায়াকে আজ কিছুটা খুশি লাগছে। আজকের রাতটাও এই মানুষটার সাথে কাটাবে। মায়া মনে মনে এসব ভেবে আনমনে হেসে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই মায়ার মুখের হাসিটা উবে যায়। মায়া এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিলো যে তার জিবনে কোন পুরুষকে নিয়ে ভালালাগার স্থান নেই। সে যে একজন পতিতা!
আসাদ বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে মায়া মুখ মলিন করে বসে আছে। তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে মায়াকে বললো,
"তারপর বলো কেমন আছো? এখন কি শরীর সুস্থ আছে?"
মায়া একটু গম্ভীর গলায় বললো,
"আমাদের আর শরীর বাবু!আছে ভালোই।"
"কোনো কষ্ট হলে আমাকে বলবা মাসিকে বলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।"
মায়া আসাদের কথায় ভ্রু নাচিয়ে বলে,
"আমার জন্য এত ভাবতে হইবো না । আপনি কি আইজও কথা বইলা সময় শ্যাষ করবেন?"
"কেন? তোমার কি আমার সাথে শুতে ইচ্ছে করছে নাকি? হাহাহা।"
আসাদের কথায় মায়া যেন একটু লজ্জা পেলো।বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলো মায়া।আসাদ মায়াকে অবাক হয়ে দেখছে। লজ্জা পেলে মনে হয় পৃথিবীর সব নারীকেই অন্য রকম সুন্দর লাগে। মায়াকে ও তার ব্যাতিক্রম লাগছে না।
হঠাৎ ফোনের শব্দে আসাদের ভাবনার ছেদ ঘটে। আসাদ কল রিসিভ করে কথা বলদ শেষ করে মায়ার উদ্দেশ্যে বলে,
 "তুমি বিশ্রাম নিয়ে নাও বরং। আমার একজন বিজনেস পার্টনার খুন হয়েছে। ঘন্টা দু-এক এ-র মধ্যে ফিরে আসবো।"
আসাদের কথায় মায়া চমকে উঠে বললো,
"কী! খুন!"
"আরে সেটা নিশ্চিত না আমি। আগে দেখি ওখানে গিয়ে। মাত্র সাড়ে আটটা বাজে! রাত এখনো অনেক বাকি। "
আসাদ মুচকি হেসে চলে যায়। 

"শহরের আরো একজন বিজনেস ম্যান খুন হলো তার নিজের বাগানবাড়িতে। ভিক্টিমের নাম মাসুদ রানা। এ নিয়ে খুনের সংখ্যা দাড়ালো তিনজন।"
খবরটা টিভিতে দেখে আঁতকে ওঠেন নাজমা আক্তার।



চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন