#অতঃপর_তুমিহীনা_আমি
#শেষ_পর্ব
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
আসাদ আর নিহারীকা একটা পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। দুজনেই চুপচাপ!
কিছুক্ষণ পর নিহারীকাই বলতে শুরু করে,
"খুনি ধরা পরেছে।"
"হ্যাঁ নিউজে দেখলাম। তোমার অনেক সুখ্যাতি করছে সবাই। তবে তুমি কী করে বুঝলে উনিই কালপ্রিট? আর আমাকে ফাঁসাতেই বা কেনো চেয়েছিলো সে?"
নিহারীকা একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে,
"বলছি ,ঘটনাটার শুরু হয়েছিল যখন নাজমা খুব ছোটে। নাজমার বাবা রহিম আলি নাজমার মা শায়লা বেগমকে রেখে পরকীয়া করতেন । পরে শায়লা বেগমকে তালাক দেন। নাজমাকে সাথে করেই শায়লা বেগম খুব কষ্ট করে বেঁচে ছিলেন।কিন্তু একদিন রহমান আলি মাতাল অবস্থায় শায়লা বেগমকে খুন করে ফেলে। আর এইসব ঘটনাই নাজমার চোখের সামনেই ঘটেছিলো। ফলে সেই শকটা নাজমা ঠিক নিতে পারেনি তখন। বেশ কয়েক বছর রিহাবে থাকার পর যখন সুস্থ হন, তখন ঢাকা খালার বাসায় থাকতে শুরু করেন।তারপর অনেক সময় পেরিয়ে যায়। এস.আই সিফাতের সাথে বিয়েও হয়। ভালোই সংসার চলেছিল দুজনের। এরমধ্যেই ঘটে বিপত্তি!সিফাতের শার্টে একদিন লিপষ্টিকের দাগ দেখে নাজমা। ব্যাস,অতিতের স্মৃতি মাথা চারা দিয়ে ওঠে নাজমার। নাজমার মনে পড়ে যায় তার বাবার বিকৃত মস্তিষ্কের কাজের কথা। এক তো পরকীয়া করে তার মাকে ছেড়ে দেয়,তারপর তার মাকে মেরে ফেলে! এসব কথা মনে পড়তেই নাজমা ভিতর থেকে আবার অসুস্থ হতে শুরু করে। নাজমা সিফাতের ওপর নজর রাখতে শুরু করে। এক পর্যায়ে জানতে পারে সিফাত পতিতালয় যাতায়াত করে। নাজমা তখনি মানসিকভাবে আরও বিকারগ্রস্ত হয়ে পরে।"
আসাদ অবাক হয়ে বলে,
"তারপর?"
"তারপর ? তুমি যে ঐশির কথা বলেছিলে মানে তোমার প্রাক্তন,নাজমা হলো ঐশির বেস্ট ফ্রেন্ড।ঐশির সাথে তোমার ব্রেকআপের কারণটা মূলত ঐশির মিথ্যাচার ছিলো। কিন্তু নাজমার মানসিক প্রবলেমের কারণে তোমাকেই দোষী ভাবতে শুরু করে। তারপর যখন তোমার ব্যাপারে খোঁজ নিতে তোমার অফিসে যায়, তখনি রায়ানের সাথে দেখা হয় নাজমার। প্রথম দেখাতেই নাজমা বুঝে যায় লোকটার নজর ভালো না। কারণ,একটা ছেলে একটা মেয়ের দিকে ঠিক কোন নজরে দেখছে তা সেই মেয়েটা ভালো করেই বুঝতে পারে।"
"তুমি কী সেটা বুঝেই আমার সাথে এক বিছানায় থেকেছিলে? হঠাৎ তুমি করে বলছো যে?"
আসাদের প্রশ্নে একটু ইতস্ততবোধ করে নিহারীকা।
"এই প্রসঙ্গে পরে আসছি।আগে পুরোটা শোনো, তারপর নাজমা বিভিন্ন বিষয় সর্ম্পকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তোমার সব পার্টনারদের বিবাহিত থাকা সত্ত্বেও পরকীয়ায় অথবা খারাপ পল্লিতে চলাচল আছে। আর তোমার ক্ষেত্রেও তাই ! মানে পতিতালয় যেতে আরকি। এতসব পরকীয়ার ঘটনায় মুর্হূতেই নাজমার মাঝে এক সাইকো স্বত্তাকে জাগ্রত করে। নাজমা তখনই তোমার বিজনেস পার্টনারদের আর সিফাতকে খুন করার পরিকল্পনা করে ফেলে। আর এইসব খুনের দায় ফেলতে চায় তোমার কাঁধে!"
"আমাকে না মেরে ফাঁসাতে চাওয়ার কারণ?"
"কারণ তুমি যেহেতু অবিবাহিত তাই তোমাকে একটু কম অপরাধী মনে হয়েছে তার কাছে। নাজমা প্রথমে একজন পতিতাকে টাকা দিয়ে সেট করে প্রত্যেককে টোপে ফেলার জন্য। সবার ক্ষেত্রেই সেই পতিতার সাথে রাত কাটাতে গেছে আর ঠিক তখনি নাজমা ভিক্টিমদের ভারী লোহার রড দ্বারা আঘাত করেছে। আর ভিক্টিমদের গালে যে লাল রঙ ছিলো তা কোন লিপস্টিকের না। এক প্রকার ছবি আকার রঙ ছিলো। যাতে আমরা বিভ্রান্ত হই আরকি!"
"তাহলে আমাকে সেদিন রাতে কল উনি করেছিলেন?"
"হ্যাঁ খুনের আগেই খবরটা তোমাকে বলেছিলেন যাতে পুলিশ তোমাকে সন্দেহ করে। আর তোমার ঘড়ি,মোবাইল ,চুল এসবই নাজমা কৌশল করে মুনসুর চাচাকে দিয়ে চুরি করিয়েছিলো।"
"কী?"
মুনসুর চাচার নামটা শুনে আসাদ বিস্মিত হয়!
"হ্যাঁ ঠিকই শুনছো। মুনসর চাচাকে নাজমা টাকার লোভ দেখিয়ে কাজটা করিয়েছে। তুমি খুনের দায়ে ফাঁসিতে ঝুললে তো তোমার সব সম্পত্তি ভোগ করার মতো কেউ থাকবে না। তখন তিনি সবকিছুর অধিপতি হবেন। এই আশায় উনি নাজমার কথা মতো কাজ করেন।"
"আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে । চাচা! কী করে?ছোটো থেকে দেখছেন আমাকে।"
"মনুষ্য মন বড়ই বৈচিত্রময়! কখন যে কার মন ঠিক কী করতে চায়,তা সে নিজেই মাঝেমধ্যে বুঝতে পারেনা। সেখানে তুমি অন্যকারো মন কি করে বুঝতে চাও?"
"তারপর বলো।"
"তারপর আর কী! ওই পতিতাকে টোপ বানিয়ে একের পর এক ভিক্টিমকে শেষ করে। আর লাস্ট টার্গেট ছিলো এস.আই সিফাত। তবে তোমাকে ঠিকঠাকভাবে ফাঁসাতে পারেনি বলে আইনের হাত থেকে তুমি বেঁচে গেছো।"
আবারও নিহারীকা আর আসাদ চুপ করে আছে।অনেক কথা জমে আছে দুজনের। অথচ কেউই বলে উঠতে পারছে না। জীবনে অনেক সময় বলার সুযোগ থাকলেও বলবো বলবো করে বলা হয় না।সামনের মানুষটি ঠিক কীভাবে নিবে কথাগুলো সেইসব ভাবতে ভাবতেও অনেক মূল্যবান কথা আর বলা হয়ে ওঠেনা। আসাদ বুঝতে পারছে না আদৌ কি তার ভালোবাসার কথা বলবে নিহারীকাকে? নাকি চুপচাপ চলে যাবে!
নিরবতা ভেঙে নিহারীকাই আসাদের হাতের উপর হাত রেখে বলতে শুরু করে,
"বন্ধু হিসেবে আমি আজীবন তোমার পাশে থাকবো। তবে তোমার ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারবো না আমি।"
আসাদ স্পষ্ট খেয়াল করে কথাগুলো বলার সময় নিহারীকার চোখ ছলছল করছিলো। এর আগেও মেয়েটাকে ছলছল চোখে কথা বলতে দেখেছে।তাহলে কেন এই দূরত্ব! একরাশ অজানা প্রশ্ন ভর করেছে আসাদের মনে। কিন্তু ঠিক কিভাবে প্রশ্নগুলো করবে সেই নিয়েই ভাবছে আসাদ।
যদিও আসাদ জানে দু'দিন পরই রাজনের সাথে নিহারীকার বিয়ে। তবুও তাতে কী? বিয়ে হওয়ার কথা,হয়নি এখনো। ইচ্ছে করলে এখনো সব পসিবল। মনের ইচ্ছের বিরুব্দে জোর করে বিয়ে করলেও জোর করে অন্তত সংসার করা যায় না।এতো কথা মনে মনে একাই ভেবে যাচ্ছে আসাদ।কিন্তু কিছুই বলে উঠতে পারছে না। নিহারীকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আসাদের হাতটা ছেড়ে দাঁড়িয়ে আবার বলতে শুরু করে,
"আমি জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। হ্যাঁ ভালোবাসি তোমাকে!"
নিহারীকার একটা কথা যেন আসাদের সব বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। আসাদ দ্রুত নিহারীকার কাছে এসে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
"তবে কেন এই বিরহ? কেন এত দুরত্ব?"
"বলছি, রাজন আমার কলেজ লাইফের বন্ধু। বাবার একমাত্র ছেলে রাজন। ওদের যা টাকা পয়সা আছে তাতে সারাজীবন কাজ না করে বসে বসেও খেতে পারবে। তবু রাজন আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য জব করে। আমি যখন ইন্টার শেষ করলাম ঠিক তখনি আমার পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার! হঠাৎ করেই বাবা মারা যান। আমাদের মা আমাকে আর আমার ছোট ভাই ফাহিমকে নিয়ে কষ্ট করে দিন চালাতেন। যেহুতু বাবা মা ভালোবেসে ঘর ছেড়ে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন,তাই দাদাবাড়ি কিংবা নানাবাড়ি কেউই আমাদের ওপর খুশি ছিলেন না। এক পর্যায়ে আমার লেখাপড়া অফ হয়ে যায়। রাজন তখনই আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। রাজন সরাসরি মায়ের কাছে আমাকে বিয়ে করার কথা বলে। তখন ওই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রাজনের কথায় মা রাজিও হয়ে যায়। আর না হবার কারণও ছিলোনা। রাজন দেখতে ভালো,ভালো বংশ পরিচয়,বাবার একমাত্র ছেলে!আর রাজনের বাবা-মাও একমাত্র ছেলের পছন্দে রাজি হয়ে যান।"
"রাজি তো হবেই তারা, তুমিও যথেষ্ট সুন্দরী!"
নিহারীকা একটু লজ্জা পায় আসাদের কথায়।
"হুম। তবে রাজনের বাবা-মা একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। যতদিন আমরা দুজনেই আত্মনির্ভরশীল না হবো ততদিন বিয়ে করতে পারবো না। রাজনও শর্তে রাজি হয়ে যায়। তারপর থেকেই আমার পরিবারের যাবতীয় খরচা সব রাজন করেছে। ওর কাছে আমার পরিবার কেনা!"
"ভালোবাসো রাজনকে?"
"একজন ভালো বন্ধু হিসেবে যতটুকূ ভালোবাসা যায় ততটুকুই ভালোবাসি রাজনকে! তবে রাজনের কাছে আমি চির ঋণী। ও যদি চায় আমার জীবনটাও হাসতে হাসতে দিয়ে দিতে পারি।"
"দেখ নিহারীকা মানছি রাজন তোমাদের জন্য অনেক করেছে । তাই বলে এভাবে ঋণ পরিশোধ করতে হবে? তাছাড়া উনি তো জানেনা তুমি আমাকে ভালোবাসো! একবার বলে দেখতে পারতে তো।"
"নাহ, আসাদ আমি চাইনা রাজন এসব জানুক।আমি ভুলেও এ কথা ওকে বলতে পারবো না। জানো আসাদ এক জীবনে মানুষের সব চাওয়া পাওয়ার পূর্ণতা পায়না। আর সব ভালোবাসাও পরিণতি পায়না। ভালোবাসার চেয়ে আজ আমার কাছে দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।আবেগ দিয়ে আর যাইহোক জীবন চলেনা। বাস্তব জীবনের কঠিন পরিস্তিতি মোকাবেলা করতে বিবেকের প্রয়োজন পড়ে। তুমিও এখন আবেগ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছ।"
আসাদের মন খারাপের ভারী পাল্লা যেনো এত ভারী ভারী কথায় আরও ভারী লাগছে।
"তাহলে কী হবে আমার?"
"যেমন ছিলে তেমনই থাকবে। তুমিহীনা আমি কখনোই ভালো থাকবো না প্রিয় । তবু মেনে নিতে আর মানিয়ে নিতেই আমাদের জন্ম। আর অভিনয় তো শিখে গেছি! হ্যাঁ আমরা সবাই এক প্রকার অভিনেতা। ভালো থাকার অভিনয় করতে করতে না হয় একজীবন কাটিয়ে দিবো। ভালো থেকো।"
আসাদ নিহারীকার কথার কোনো প্রত্যুত্তর দিতে পারেনি। নিহারীকার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। দেখতে দেখতে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলো মেয়েটা। এরমধ্যেই ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আসাদের চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বৃষ্টির এই একটা গুণ আছে,চোখের পানি আড়াল করতে পারা যায় । এই তো ক'মাসের দেখা! এর মাঝেই মায়া হয়ে এসে জীবনের সবচেয়ে বড় মায়া হয়ে চলে গেলো। তবে নিহারীকার প্রতি কোনো ক্ষোভ কিংবা রাগ নেই আসাদের । কারণ নিহারীকার চোখে যে আসাদ অগাধ ভালোবাসা দেখেছে তা কখনো মিথ্যে ছিলো না। পরিস্তিতি মানুষকে অনেক কিছু করতে বাধ্য করে। যেখানে চাইলেও দুটো মানুষ এক হতে পারেনা। হৃদমাঝারে একগুচ্ছ নীলছে রঙের মেঘ নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে যেতে হয়। আর ভালোবাসর প্রদীপ সে তো তুষের অনলের মতো জ্বলতে থাকে।
সমাপ্ত..........................