সাকিনকে গোসল করিয়ে বিছানায় এসে শোয়াল তাহমি। চার হাতপা নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত সে। শরীরে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। নিজের গায়ের ওড়না দিয়ে ছেলের শরীর মুছে দিল তাহমি। ছেলেটার পানি ভীষণ পছন্দ। পানির ছিটেফোঁটা লাগলেও হেসে উঠে নিঃশব্দে। ছেলেকে জামাকাপড় পরিয়ে কোলে নিয়ে শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে এগোলো তাহমি। ঘরে একা রেখে গোসল করতে তো যেতে পারে না। তাই ফরিদা খানের কাছে সাকিনকে রেখে তারপর গোসল করবে তাহমি। সহন অফিসে। ফিরবে একেবারে রাতে। দুপুরে একটা জরুরি মিটিং থাকায় আজকে আর বাসায় ফেরা হলোনা। ও বাড়িতে কাজকর্মের ব্যস্ততায় দিন কাটছে তৃষা,অনিক,আয়ানের। আত্মীয়স্বজন এসেছে কয়েকজন। বিয়ের এখনও বাকি তিন দিন। তাহমি আগামীকাল যাবে বাবার বাড়ি। সাকিনকে নজর ছাড়া করতে চান না ফরিদা। নইলে আরও দু'দিন আগেই বাবার বাড়ি চলে যেতো তাহমি।
তপ্ত দুপুর। বৈশাখের উত্তাপে অতিষ্ঠ শহরের মানুষজন থেকে শুরু করে পশুপতি ও গাছপালা। বৃষ্টি নেই বললেই চলে। তাই গরম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া না করেই বান্ধবী ইকরার সাথে শপিং করতে এসেছিল অনিমা। আয়ানকে বলেনি অবশ্য। বললে আয়ান নিজেও আসতে চাইত সাথে। সামনেই আয়ানের জন্মদিন। বিয়ের ঠিক দু'দিন পর। তখন তো বাড়ি থেকে চুপিচুপি বের হওয়া সম্ভব হবে না, তাই এখনই কিছু উপহার কিনে রাখলো অনিমা।
" আচ্ছা অনিমা গেলাম আমি। সাবধানে যাস।"
ইকরাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিলো অনিমা। আজকে অনিমা নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। ড্রাইভ করতে আগে থেকেই পারে সে।
" ওকে দোস্ত। টাটা!"
" টাটা।"
ইকরাকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরাল অনিমা। ইশ ভাবতেই ভীষণ এক্সাইটেড লাগছে অনিমার। সামনে বিয়ে তারপর আবার আয়ানের জন্মদিন! কীভাবে আয়ানকে সারপ্রাইজ দিবে সবকিছুই ভেবে রেখেছে সে। প্রায় পনেরো দিন ধরে ইউটিউবে কেক বানানোর ভিডিও দেখে তিনবার চেষ্টা করে অবশেষে ঠিকঠাক মতো কেক বানাতে শিখেছে মেয়েটা। নিজের হাতে কেক বানিয়ে দিলে আয়ান একটু বেশি খুশি হবে বলেই এই সামান্য কষ্ট করা অনিমার। হঠাৎ ট্রাকের কর্কশ হর্ণ দেওয়ার আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো অনিমা। ভাবনার জগত পেরিয়ে বাস্তবে ফিরতেই আঁতকে উঠলো সে। প্রাণপণে চেষ্টা করলো গাড়িটা পাশ কাটিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ট্রাকের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা খেয়ে গাড়ির অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেছে। মাথায় তীব্র আঘাত পেয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছে অনিমা। শেষ বারের মতো আয়ান ও বাবার চেহারা ভেসে উঠেছে অনিমার চোখের সামনে। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ! কী মারাত্মক কষ্ট তা বলে বোঝানো যাবে না। আয়ানের বলা কত-শত কথা কানে বাজছে। ইশ! বউ হয়ে আয়ানের সাথে সংসার করা আর হলোনা তার। আয়ানকে নিজের করে কাছে পাওয়াও হলো না। দম বন্ধ হয়ে আসছে অনিমার। পানির তৃষ্ণা পাচ্ছে। রক্তে ভেসে গেছে গাড়ির ভেতর। আশেপাশের লোকজন ছুটে এসেছে স্পটে। অনিমার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ থমকে গেলো মেয়েটার। চিরদিনের জন্য!
" কী হয়েছে রে আয়ান? এরকম অস্থির হয়ে আছিস কেনো? ঠিকমতো খাবার খেলি না। "
মায়ের প্রশ্নের জবাবে কিছু বললো না আয়ান। ড্রইং রুমে চুপচাপ বসে আছে সে। সেই দুপুর একটা থেকে এখন পর্যন্ত অনিমার কোনো মেসেজ আসেনি তার ফোনে। মেয়েটা নিয়ম করে তিন বেলা খাবার খেয়ে নিতে বলে আয়ানকে। আজকে অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ একেবারে বিয়ের জন্য ছুটি নিয়ে বাসায় এসেছে আয়ান। অনিমা শুনলে বিকেলে ঘুরতে যেতে চাইবে ভেবে তখন থেকে কল করে যাচ্ছে্িল আয়ান। কিন্তু না কল রিসিভ তো দূর নম্বর বন্ধ বলছে অনবরত। মনটা তাই ভীষণ আনচান করছে আয়ানের। আয়ানের নীরবতায় তৃষা ভেংচি কেটে বললো,
" বুঝলে মা, ভাবীর চিন্তা করছে। "
" আহ তৃষা চুপ করো। দেখছ না আয়ানের চোখমুখ কেমন শুকিয়ে গেছে?"
পাশ থেকে অনিক বললো। আয়ানের কানে কারো কথা যেনো কথা ঢুকছে না। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে।
" আসলেই ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। তোমরা থাকো আমি বারং অনিমার বাসা থেকে একটু ঘুরে আসি। আড়াই ঘন্টা হলো এখনও নাই কল আসলো না ওর নম্বর থেকে, বিষয়টা অস্বাভাবিক। "
" হয়তো সত্তার ভাইয়ের শরীরটা খারাপ করেছে। উনার তো শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল। "
আমেনা ইসলাম ছেলেকে কিছুটা স্বান্তনার বাণী শেনালেন৷ কিন্তু আয়ান দাঁড়াল না। নিজেই ড্রাইভ করতে লাগলো। আয়ানের চিন্তিত ভাবভঙ্গি দেখে বাসার সবাইও চিন্তায় পড়ে গেলো। এমনিতেই সকাল থেকে ভীষণ অশান্তি অশান্তি লাগছিল আমেনার।
কিছু কিছু মানুষের জীবনে প্রিয় মানুষকে পাওয়া খুব সহজ বিষয় আবার কিছু কিছু মানুষের জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলা দুষ্প্রাপ্য! আয়ানের জীবনেও তাই হলো। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেললো সে। হন্তদন্ত হয়ে প্রেয়সীর বাড়িতে ছুটে গিয়ে জানতে পারল,অনিমা এক্সিডেন্ট করেছে। এক্সিডেন্ট স্পটেই মৃত্যু হয়েছে অনিমার। মেয়েটাকে নিয়ে যখন সত্তার শেখ হসপিটালে যখন পৌঁছেছিলেন তখন অলরেডি মৃত। মাথা কাজ করছিল না উনার। আয়ানকে কল করে খবর দেওয়ার কথা তখন মাথায় ছিলো না। আয়ান চুপচাপ অনিমার নিথর দেহের পাশে বসে আছে বসার ঘরে। আশেপাশে আরও লোকজন। সত্তার শেখ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কথা বলতেও পারছেন না। সাদা কাপড়ে আবৃত শরীরটা আর নড়াচড়া করবে না কখনো। হুটহাট লাফিয়ে কেউ আর কোলে চড়ে আদর করার বায়না ধরবে না। রাতবিরেতে কেউ আর দেখবো বলে জ্বালাবে না। ছেলেমানুষী, পাগলামিও কেউ আর করবে না আয়ানের সাথে। বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কোনো খোঁজখবর না পাওয়ায় অনিক শেষমেশ অনিমাদের বাসায় এসেছে আয়ানের খোঁজ নিতে। আর এসেই এই দুঃসংবাদ শুনে থমকে গেছে অনিকও।
" ছেলেটাকে কেউ ধরে বসাও ফ্যানের নিচে। এই রুমের এসিটা নষ্ট হয়ে গেছে। "
আশেপাশ থেকে কেউ একজন আয়নকে সরানোর কথা বললো। একটানা প্রায় দেড় ঘন্টা বসে আছে একজায়গায়। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। অনিক এরমধ্যে বাসায় কল দিয়ে সবকিছু জানিয়েছে। তৃষা আমেনা ইসলামকে নিয়ে রওনা হয়েছে। অনিক আয়ানের পাশে গিয়ে বসলো। আয়ান নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার লাশের দিকে। আসরের নামাজের পরে জানাজার নামাজ আদায় করা হবে এবং তারপর পারিবারিক গোরস্থানে কবর দেওয়া হবে তাকে।
" আয়ান! আয়ান, ভাই আমার। একটু এদিকে এসে বসবে? "
অনিক নম্র স্বরে আয়ানকে ডাকল বেশ কয়েকবার। কিন্তু আয়ান যেনো বোবা হয়ে গেছে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ নড়াচড়াও করছে না, কথা বলা তো দূর। অনিক মনে মনে ভয় পাচ্ছে। এরকম চুপ করে থাকা মোটেও ভালো বিষয় নয়।
" আয়ান? উঠো। অনিমার বাবা ভীষণ অসুস্থ। তুমি যদি এখন শক্ত না থাকো তাহলে উনাকে কে স্বান্তনা দিবে বলো?"
না! আয়ান কোনো কথার উত্তর দিচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে অনিক আয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো আয়ান। চমকাল অনিক। উপস্থিত সবাইও চমকাল। কেউ কেউ তো বলাবলি করতে শুরু করলো,
“ ছেলেটা অনিমাকে কতটা ভালোবাসত! মেয়েটার মৃত্যুতে আয়ান শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেখানে বিয়ে করে সংসার করার স্বপ্ন বুনছিল দু'জন, সেখানে সাদা কাফনে আবৃত হয়ে চির নিদ্রায় শায়িত হলো মেয়েটা।"
অনিক আশেপাশে থাকা দু'জন লোকের সাহায্যে আয়ানকে উঠিয়ে নিয়ে সোফায় শুইয়ে একটা টেবিল ফ্যান ছেড়ে দিলো। এরমধ্যে আমেনা ও তৃষাও উপস্থিত হলো অনিমাদের বাসায়। ঘরে প্রবেশ করেই হবু পুত্র বধূর এমন অবস্থা দেখে বুকটা কেঁপে উঠল আমেনা ইসলামের। পরক্ষণেই মেয়ে জামাইয়ের পাশে নিজের ছেলেকে অচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ছুটে গেলেন সেখানে। তৃষাও ভাইয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
" অনিক কী হয়েছে আমার আয়ানের? ও এরকম পড়ে আছে কেনো বাবা?"
আমেনা ইসলাম হুহু করে কেঁদে উঠলেন। অনিক তৃষাকে ইশারা করে সামলাতে বলছে মা'কে।
" জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে মা। এতবড় শক সহ্য করতে পারেনি। এসে থেকে একটা কথাও বলেনি আর না তো কেঁদেছে। এভাবে চুপচাপ থাকলে ভয়ের বিষয়। "
.
.
.
চলবে..........................