সাকিনের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো সহন। তাহমি রেগে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। সারাদিন জ্বালিয়ে মারে এখন আবার বাবার কাছে নালিশ হচ্ছে!
" দেখছো ছেলে কত বিচ্ছু হয়েছে এখনই? "
তাহমি অভিযোগের সুরে বললো সহনকে। সহন সাকিনকে বিছানার একপাশে বসিয়ে নিজের শার্ট, টাই সব খুলতে লাগলো। বাইরে যা গরম প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
" ছেলে তো ভুল কিছু বলেনি তাহমি। ও বেচারা দেখে তুমি একা সাজুগুজু করো সব সময়। আমাকেও করাও না আর না তো ছেলেটাকে। সেজন্যই তো আজকে নিজে নিজে সাজার চেষ্টা করলো।"
সহনের কথায় গায়ে জ্বালা ধরে গেছে তাহমির। মেজাজ তুঙ্গে এখন। সবকিছু ঠিকঠাক মতো রেখে সাকিনকে কোলে তুলে নিলো সে।
" ঠিক আছে। ছেলে না হয় বোঝে না সে ছেলে বলে সাজুগুজু করতে পারে না। কিন্তু ছেলের বাবা বলদ হয়েও যে এমন কথা বললো এরজন্য রাতে তাকে মাশুল দিতে হবে। "
" কী মাশুল? কামড়ে দাগ বানাবে না-কি? "
সহন আলমারি থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে হেসে বললো। তাহমি মুখ ভেংচি কেটে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলে,
" সেটা দেখবে রাতে। "
আজ বৃহস্পতিবার। দুপুরে একসাথেই অনিক ও তৃষা বাসায় ফিরেছে। তবে সকালবেলা রান্না করে রেখেই বের হয় তৃষা। ব্যাংকে চাকরি করছে তৃষা। আর অনিক তো আগে থেকেই ডাক্তারি পেশায় নিযুক্ত। অনিক অবশ্য বলেছে বাচ্চাকাচ্চা হলে তখন তৃষা কেবল বাচ্চাকে সময় দিবে। চাকরি করতে হলে বাচ্চা বড়ো হলে করবে।
" তৃষা! এই তৃষা আর কতক্ষণ লাগবে তোমার? "
ডাইনিং টেবিলে বসে আছে অনিক। তৃষা খাবার গরম করতে গেলো রান্নাঘরে। ততক্ষণে অনিক ঘরদোর ঝাড় দিয়ে রেখেছে। তৃষা দু'হাতে তরকারির বাটি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে আসছে।
" এই তো হয়ে গেছে। ভাত বেড়ে রেখেছেন? ভালোই হয়েছে। আমি তরকারি দিয়ে দিচ্ছি, খাওয়া শুরু করুন।"
" হ্যাঁ তুমিও বসো তাড়াতাড়ি। "
তৃষা প্রথমে অনিকের প্লেটে তরকারি দিয়ে পরে নিজেও বসলো খেতে। খাওয়ার সময় অনিক কথা বলে না। তাই চুপচাপ খেয়ে নিলো দু'জন।
সময়ের আবর্তনে অনিক ও তৃষার সম্পর্কে কোনো চিড় ধরেনি। বরং দিন যতই এগিয়েছে ততই দুজনের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভালোবাসা কখনো মরে না। কেবল মরিচা ধরে তাতে। সঠিক মানুষের স্পর্শে সে ভালোবাসা পুনরায় জেগে উঠে। অনিকের হৃদয়েও তেমনি তৃষার আগমনে ভালোবাসা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট। অন্ধকার ঘরে মোমবাতি জ্বলছে কতগুলো। মোমের আলোতে দেয়ালে হাস্যোজ্জ্বল মানুষের ছবি দেখা যাচ্ছে। অষ্টাদশী অনিমার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে আছে ছবিতে। আয়ান সেই ছবির সামনে কেক নিয়ে বসে আছে নীরবে। আজকে অনিমার জন্মদিন। মানুষটা বেঁচে থাকলে কতটা রঙিন হতো আয়ানের জীবন! অথচ সে থাকবে বলেও আজ কোথাও নেই! ফোনের রিংটোনের আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো আয়ান। মা কল করেছেন। আয়ান কল রিসিভ করে কানে ধরলো।
" হ্যাঁ মা বলো।"
" সকালে সাবধানে গাড়ি চালিয়ে ফিরিস বাবা।"
" জি।"
" রাখছি।"
" হুম।"
কল কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন আমেনা ইসলাম। ছেলেটা প্রতি বছর এই তারিখের রাতে অনিমাদের বাসায় গিয়ে থাকে। আগের মতো কথা বলে না আয়ান। শুধু যতটুকু দরকার ততটুকু বলে। নিজের ছেলেকে নিজেই চিনতে পারেন না। অকারণে রেগে যায়। একেবারে লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে। তবে আমেনা জানেন ভেতর ভেতর আয়ানের মনটা কতটা নরম। মেয়েটা তো চলে গেলো কিন্তু সেই সাথে তার ছেলের জীবনের সমস্ত রঙ নিয়ে গেলো।
" আয়ানের মা! প্লিজ কেঁদো না এভাবে। দেখো আমরা তো চেষ্টা করছি আয়ানকে স্বাভাবিক করার।"
আয়ানের বাবা নিজের স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
" কিন্তু কাজ তো হচ্ছে না আয়ানের বাবা! আল্লাহ আমাদের ছেলেটার অন্তরে একটু শান্তি দিক। ছেলেটা ভেতর ভেতর শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ আমি কী করবো! মা হয়ে কিছু করতে পারছি না।"
আয়ানের বাবা কী বলে আমেনাকে স্বান্তনা দিবে বুঝতে পারছে না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। আর মনে মনে নিজের ছেলের জন্য প্রার্থনা করছেন।
" সাকিনের মা? এই তাহমি? শুনছো? সাকিন ঘুমিয়েছে? "
সহন পেছন দিক থেকে তাহমির ঘাড়ে থুতনি রেখে ফিসফিস করে শুধালো। তাহমি সাকিনকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে সাথে নিজেও ঘুমিয়ে গেছে। তাই সহনের ডাক টাক তার কানে যাচ্ছে না। বউয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সহন উঠে বসলো। তারপর ফোনের ফন্ট ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে সাকিন ঘুমিয়েছে কি-না চেক করতে লাগলো। যাহ বাবা! ছেলের সাথে তো ছেলের মা-ও ঘুমিয়ে গেছে। সহন ফোনটা বালিশের পাশে রেখে আলতো করে তাহমির উদরে হাত বুলিয়ে দিলো বারকয়েক। ফলে তাহমির ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ পিটপিট করে তাকাল তাহমি।
" কী করছো? ঘুমাচ্ছ না কেনো?"
" আমার চোখের ঘুম উড়িয়ে নিজে ছেলের সাথে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়লে। বাহ তাহমি বেগম বাহ!"
তাহমি সহনের মজা বুঝতে না পেরে সিরিয়াস কিছু ভেবে উঠে বসলো। চোখ ভালো করে হাত দিয়ে মুছে আগ্রহী হয়ে শুধালো,
" কী হয়েছে? "
" কিছু হয়নি বলেই তো এতো বিরহ।"
" কীসের বিরহ বলবে তো?"
" গরমে গরম বাড়াতে পারছি না বলে বিরহ, এই গরমের রাতে একবার গোসল করতে পারছি না বলে বিরহ।"
তাহমির আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছু। আস্তে করে দু'টো থাপ্পড় মারল সহনের পিঠে।
" শয়তান একটা! এমন করে বললে ভাবলাম কী হলো মাঝরাতে আবার। "
" এটা কিছু হয়নি? "
" ব এ আকারে বা* হয়েছে। "
" বউটা আমার আর ভদ্র হলো না। "
" ভদ্র দেখে বিয়ে করলে ভদ্র বউ থাকতো। এখন এসব কথা রেখে তাড়াতাড়ি আদর করো। আমি ঘুামবো তারপর। "
" এভাবে বলছো? থাক লাগবে না। উপোস দিলাম আমি। "
সহনের ঢং দেখে তাহমির মেজাজ খারাপ লাগে। এমনিতেই রাতে ছেলে ঘুমাতে দেয় না। এখন আবার বাপের ঢং এর জন্য জেগে থাকতে হচ্ছে।
" সহন! "
" কী সোনা?"
" কিছু না।"
" কেনো কিছু না বউ?"
" তোর কল্লা!"
" ওয়াও! কতদিন পরে সেই ডাক। আবার বল তো একবার। "
" তুই কিছু করবি? না-কি আমি করবো?"
" বউ আদর করলে বেশি আনন্দ। সুতরাং তুই আদর কর। আজকে বাসর রাত বাসর রাত ফিল হচ্ছে বুঝলি। এই যে আবারও তুইতোকারি করছিস,আমিও করছি মনে হচ্ছে অতীতের দিনগুলোতে ফিরে গেছি।"
তাহমি সহনকে শুইয়ে দিয়ে নিজে সহনের ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
" ছেলে ঘুমিয়েছে বলে এসব বললাম। সে তো এখন টেপরেকর্ডার হয়েছে। যা বলি তাই ঘ্যানঘ্যান করে। "
সহন ফিক করে হেসে উঠলো তাহমির কথায়। বেচারি বাচ্চা সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে আজকাল। অবশ্য সাকিনও কম দুষ্টমি করে না।
" আচ্ছা আচ্ছা। এখন আর রাগ করিস না। আয় বুকে আয়,এসে আমার বুকটা শান্ত কর।"
তাহমি মুচকি হাসলো। সময় পেরোলেও ভালোবাসা কমেনি লোকটার। সহন তাহমিকে বুকে জড়িয়ে নিলো। তাহমিও সহনকে আবদ্ধ করলো নিজের মায়াজালে। শরীরের প্রতিটি জায়গায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সহন। তাহমি থেকে থেকে কেঁপে উঠল কয়েকবার। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সহনের উষ্ণতায় উষ্ণ হয়ে উঠছে তাহমির শিরা-উপশিরা। ক্রমান্বয়ে ভারী হয়ে উঠছে দু'জন নরনারীর শ্বাস-প্রশ্বাস।
" আম্মু! আম্মু! আ্য আ্য.... টুমি কুটায়? আমাল ভয় লাকচে কিন্টু উউউ....."
হঠাৎ সাকিনের কান্নার আওয়াজে চমকে উঠলো দু'জন। তড়িৎ গতিতে সহনকে সরিয়ে সাকিনের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো তাহমি। ছেলেকে নিজের কাছে টেনে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
" এই তো আমি বাবা। ভয় পেও কীসের? ঘুমাও।"
মায়ের স্পর্শ পেয়ে ঘুম জড়ানো চোখে একবার আশেপাশে নজর বুলিয়ে ফের ঘুমানোর চেষ্টা করছে সাকিন। বেচারা সহন এক জায়গায় শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জীবনটা আর জীবন রইলো না। ধুরর! ভাল্লাগে না আআআআআআ........!!!
.
.
.
সমাপ্ত........................