সারাদিন অনেক ধকল গেছে তাহমির ওপর দিয়ে। শরীর তো পুরোপুরি ঠিক হয়নি। বেশ দূর্বলতা আছে এখনও। এরমধ্যে আবার রক্তশূণ্যতা দেখা দিয়েছিল। ফলে প্রায়শই প্রেশাল লো হয়ে যায়। আত্মীয়স্বজন প্রায় সবাই চলে গেছে খাওয়াদাওয়ার পড়েই। আয়ান আর সহন সবকিছু দেখেশুনে রাখছে। ডেকোরেশনের জিনিসপত্র থেকে শুরু করে রান্নাবান্নার সমস্ত কিছু। তাহমির বাবা তৃষার বিদায়ীর পরে সন্ধ্যায় বেরিয়েছেন। ফিরবেন আগামীকাল। মানুষটা কোনো আহাজারি কিংবা টুঁশব্দ না করলেও সবাই জানে তৃষাকে কতটা ভালোবাসেন উনি। ছোটো মেয়ের প্রতি অন্য রকম ভালোবাসা থাকে বাবাদের। হয়তো নিজের কষ্ট কাউকে দেখাতে চাননা বলেই কাজের অযুহাত দিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। আমেনা ইসলাম রাতের খাবার খাননি। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছেন তিনি। তাহমি মায়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা ভীষণ পুড়ছে। বাড়িটা খালি হয়ে গেলো একেবারে। দু'টো মেয়েই পরের বাড়ি চলে গেলো!
" মা আসবো?"
মেয়ের কন্ঠস্বরের আওয়াজে শোয়া থেকে উঠে বসলেন আমেনা।
" আয় তাহমি। মায়ের ঘরে ঢুকতে আবার কবে থেকে অনুমতি লাগে তোর?"
তাহমি ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বেলে দিলো।
" ভাবছিলাম তোমার একটু একা থাকার ইচ্ছে করছে কি-না তাই জিজ্ঞেস করলাম। চলো মা ডিনার করবে।"
" তোরা খেয়ে নে। আমি পরে খাবো।"
তাহমি মায়ের পাশে বসে হাত ধরে বায়না ধরে বললো,
" না না এখুনি চলো তুমি। তৃষা কল করেছিলো। "
" কী বললো? ওরা পৌঁছে গেছে? "
উচ্ছসিত কন্ঠে শুধালেন আমেনা। তাহমি শান্তভাবে বলে,
" হ্যাঁ মাত্র গাড়ি থেমেছে বললো। তোমাকে কল দিয়েছিল কিন্তু তোমার ফোন তো চার্জ আউট। ওখানে তো অনিকের বোন আর বোনের স্বামী ছাড়া কেউ নেই। বলতে গেলে নিজেরাই। আর পাঁচটা বাড়ির মতো গিয়ে লোকজনের অস্বস্তি হবে না বোনের। একা বাড়ি সবকিছুই ওকে গুছিয়ে নিতে হবে। "
" তা ঠিক বলেছিস।"
" বেশ তাহলে চলো। আয়ান আর সহন ডাইনিং টেবিলে বসে আছে তোমার জন্য। আমরা গেলে সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া শুরু করবে।"
আমেনা ইসলাম নিজেকে আর আটকাতে পারলেন না। বড়ো মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলেন। তাহমি মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। বারণ করলো না কাঁদতে। একটু কাঁদুক! মন হালকা হবে তাহলে।
দিনাজপুর শহরে অনিকের ফ্ল্যাট। চারতলা বিল্ডিংয়ের উপরে পাঁচ তলায় তাদের ঘর। বসার ঘর,রান্নাঘর আর তিনটে রুম। দুটোতে বারান্দা আছে। একটা সিঙ্গেল। ছাদে যেতে হলে আরও দুইতলা ছাড়িয়ে যেতে হয়। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বসার ঘরের দিকে এগোলো তৃষা। দিনা সবকিছু আগে থেকেই রান্নাবান্না করে রেখেছিল। সেগুলো পরিবেশন করছে ডাইনিং টেবিলে। ওহির বাবা টিভিতে খবর দেখছেন। ওহি আর অনিক খেলা করছে সোফায় বসে। তৃষা এসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে। এটা যে ওর শ্বশুর বাড়ি সেটা মনেই হচ্ছে না। তবুও বাবা-মায়ের কথা মনে পড়তেই বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ওহি তৃষাকে দেখতেই জোরে বলে উঠলো,
" মামী! এদিকে এসো। "
ওহির কথায় দিনা ও অনিকও তৃষার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। দিনা বললো,
" ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো তৃষা? এদিকে ভাইয়ার পাশে সোফায় এসে বসো। আমার হয়ে গেছে এখুনি খেতে দিবো।"
তৃষা গিয়ে ওহির পাশে বসলো। ওহির গালদুটো আস্তে করে টেনে দিলো হেসে।
" এমনি দেখছিলাম আপু। আপনারা এতো ভালো দেখে ভাবছিলাম সত্যি সত্যি আমি শ্বশুর বাড়িতে এলাম কি-না! "
ওহির বাবা হেসে বললেন, " তাহলে ভাবী মিথ্যা মিথ্যা শ্বশুর বাড়িতে আছেন আপনি। "
" তাই হয়তো! "
তৃষাও বদলে হেসে বললো । অনিকের বিষয়টা ভালো লাগলো না। তৃষা কেনো তার সাথে হেসে হেসে কথা বলবে?
" হয়েছে অনেক কথা। চলো সবাই খেয়ে নিবে। ওহির বাবা তো খাবে না। উনি তৃষাদের বাড়ি থেকেই পেটভরে খেয়ে এসেছেন। আমিও খেয়েছি। তৃষা আর ভাইয়া আসো। তোমরা খেয়ে নিলে আমি ঘুমাতে যাবো। "
অনিক কিছু একটা ভেবে খাবে না বললো। তৃষার একা একাই খেতে হলো শেষমেষ। সারাদিন ঠিকঠাক মতো খেতে পারেনি বলে পেটে ক্ষুধা লেগেছিল মেয়েটার।
রজনীগন্ধা ফুলে সেজে উঠেছে তৃষা ও অনিকের বাসর ঘর। দিনা তৃষাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। তবে একেবারে সাদামাটা সাজগোছ। মেরুন রঙের সিল্ক কাতান শাড়ি পরেছে তৃষা। সাথে হালকা ফুলের সাজ,ঠোঁটে লাইট লিপস্টিক।
" দেখো তো সাজ পছন্দ হলো?"
" জি আপু। খুব সুন্দর সাজানো হয়েছে। "
" বেশ তুমি থাকো তাহলে। ভাইয়া আসবে আমি গেলেই। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ আমি আসছি। শুভকামনা নতুন জীবনের জন্য। "
দিনা হেসে বললো। তৃষাও বদলে হাসলো মৃদু।
" ঠিক আছে আপু। শুভ রাত্রি। "
" শুভ রাত্রি। "
দিনা চলে গেলো রুম থেকে। তৃষা আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিলো। ইশ! ভীষণ লজ্জা লাগছে হঠাৎ। মানুষটার সাথে আজ তার প্রথম রাত। ভাবতেই সমস্ত শরীর জুড়ে কেমন একটা ভালোলাগার রেশ বয়ে যাচ্ছে। ভাবনা আরেকটু প্রসারিত করে বিছানায় উঠে বসলো তৃষা। এরমধ্যেই দরজা খোলার ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ করে ভেতরে ঢুকল অনিক। সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরেছে লোকটা। তৃষার দিকে একপলক তাকালো সে। অতঃপর দরজা আঁটকে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। তৃষা উঠলো সালাম করার তাগিদে। অনিক সালাম করতে দিলো না। বুকে জড়িয়ে নিলো তৃষাকে। তৃষার তলপেটে কেমন শিরশির অনুভব করছে। কেমন যেনো ঘোরের মতো লাগছে সবকিছুই।
" তোমার জায়গা আমার বুকে,পায়ে নয় তৃষা।"
" তবুও! আপনি আমার স্বামী। "
" তুমিও তো আমার স্ত্রী। "
তৃষা চুপ করে রইলো। অনিক তৃষাকে হাত ধরে বসালো বিছানায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নিজের সদ্য বিবাহিত বউকে। মনটা অশান্ত হয়ে আছে। তৃষাকে বলবে কিছু কথা। তৃষা অনিকের নীরবতা ভাঙতে বলে,
" আপনার শরীর ঠিক আছে? কেমন লাগছে! "
" আমি ঠিক আছি।"
" তবে ভালো করে খেলেন না কেনো? বাসায় এসেও না খেয়ে রইলেন।"
" ইচ্ছে করেনি। যথেষ্ট খেয়েছিলাম আমি। "
" বুঝলাম। "
" কিছু বোঝনি তুমি। "
তৃষা চমকাল অনিকের গাম্ভীর্যের কারণে। আগে কখনো এরকম করে কথা বলেনি মানুষটা। ভয়ে ভয়ে তৃষা জিজ্ঞেস করলো,
" কী বুঝিনি? বুঝিয়ে বলুন তাহলে।"
অনিক আচমকা শক্ত করে কাঁধ চেপে ধরলো তৃষার। দ্বিতীয় বারের মতো চমকাল মেয়েটা। ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করছে কাঁধে। কিন্তু সেটা বললো না তৃষা। চুপ করে রইলো অনিকের কথা শোনার জন্য।
" তুমি আমি ছাড়া আর কোনো পুরুষের সাথে হেসে কথা বলবে না। ওহির বাবার সাথেও না। আমার ভালোলাগে না। অশান্তি লাগে বুকে। "
তৃষা চুপ করে ভাবছে মানুষটা এতো ভালোবাসে ওকে? তৃষার চেহারার দিকে তাকিয়েই ছিলো অনিক। তৃষাকে এরকম করে থাকতে দেখে ছেড়ে দিলো। ফের বললো,
" ব্যথা পাচ্ছিলে? সরি! আমি বুঝতে পারিনি তৃষা।"
" তেমন না। ভাবছি ডাক্তার সাহেব আমাকে এতো ভালোবাসে?"
অনিক হাসলো মৃদু। তৃষার দু-হাত নিজের হাতের মধ্যে এনে রাখলো।
" ভীষণ! ভীষণ রকমের ভালোবাসি। আমি ভীষণ জেলাস তোমার বিষয়। "
" সমস্যা নেই। এরপর থেকে আর কারো সাথে হেসে কথা বলবো না। "
" হাসবে কিন্তু অল্প।"
" অল্প?"
" হুম অল্প। বেশি হাসবে আমার সাথে। "
অনিকের পাগলামি মার্কা কথায় তৃষা জোরে হেসে উঠলো। অনিকও জড়িয়ে নিলো তাকে বুকে। একেবারে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে। এই মানুষটাকেও সে হারাতে চায় না কিংবা হারাতে পারবে না। এবং সেটা কিছুতেই না!
" তাহমি? এই তাহমি! আরে সর না। বিছানা ঠিক করতে দে।"
বিছানার মধ্যে চার হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে তাহমি। আশেপাশে সব জামাকাপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। নিজে তো গোছাচ্ছে না আর না তো সহনকে গোছাতে দিচ্ছে। একটু আগে সহন বলেছিল তাহমি বড্ড অগোছালো মানুষ। সেজন্য এই কর্মকাণ্ড তার! ঘড়িতে রাত বারোটার ঘন্টা বেজে গেছে এরমধ্যেই।
" তুই পাশে এসে শুয়ে পড়লেই হয়।"
" তুই কি ঝামেলা করার জন্য এগুলো করছিস? আজকে মাফ কর প্লিজ! সারাদিন বহুত কাজকর্ম করছি। বাড়ি ফিরে তোর এই পরিকল্পনা করে ঝগড়া করার সিস্টেমগুলো অ্যাপ্লাই করিস।"
আসলেই তো! সারাদিন অনেক ব্যস্ত ছিলো মানুষটা। এখন ঝামেলা করা ঠিক হবে না। তাহমির মন গললো একটু।
.
.
.
চলবে..........................