রৈনীলের পাশের চেয়ারটায় বসতে আমি ভীষণ বিব্রতবোধ করছিলাম। ওনার সাথে আমার শত্রুতা নেই, বন্ধুত্বও নেই। মাত্র অল্পসময়ের পরিচয়েই ওনার ওপর ভয়ংকর রাগ করে থাকতে ইচ্ছে করছে আমার। এমন স্বভাব আমার কোনোদিন ছিল না। আমি খুব ভীতু মেয়ে। মায়ের কথায় উঠবস করি। দুঃখ পেলে কাঁদি, মন দিয়ে পড়াশোনা করি। মা খেতে ডাকলে চুপচাপ খেয়ে আসি। এই তরকারিটা খাবোনা, এভাবে কখনো বলিনি। এমনকি মায়ের কিনে আনা জামাকাপড় গুলোও চোখ বন্ধ করে পরে ফেলি। কোনোদিন পছন্দ হয়নি বলে ভ্রু কুঁচকাই নি। পরিবারের বাইরে আমার পরিচিত মানুষ তেমন একটা নেই। সেই আমারই কিনা নিতান্তই অপরিচিত, শুধু নাম জানা একটা মানুষের ওপর রাগ হচ্ছে। এর কোনো মানে হয়!
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্বাগতা আপু জিজ্ঞেস করলো, 'কিরে, বস। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?'
আমি অগত্যা বসে পড়লাম। বসা ছাড়া উপায় ছিল না। সকলে কেমন ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। জুবায়ের ভাই বলল, 'ও হচ্ছে সরণী। আমার ছোট বোন। স্বাগতার কলিজার টুকরো।'
সবাই সৌজন্যতা দেখিয়ে হাসলো। আমি প্লেটে খাবার তুলে নিতে গিয়ে টুং করে আওয়াজ হলো। আমি নার্ভাস বোধ করলাম। সামান্য খাবার নিয়ে মুখে দিয়েছি এমন সময় ভাইয়ার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করল, 'ইয়াং লেডি, ডু ইউ হ্যাভ অ্যানি বয়ফ্রেন্ড?'
আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম ওনার দিকে। আমার শ্বাস পড়ছিল না। ক্ষণিকের জন্য খাবার খেতেও ভুলে গেলাম আমি। কোনোমত ঢোক গিলে উত্তর দিলাম, 'নো। আই নেভার হ্যাড এনি বয়ফ্রেন্ড।'
সে সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি করে হাসি দিয়ে উত্তর দিলো, 'আমাকে পছন্দ হয়?'
এমন পরিস্থিতির সঙ্গে আমি মোটেও পরিচিত নই। হতবাক হয়ে রইলাম। সে আবারও বলল, 'হোয়াট ডু ইউ থিংক এবাউট মি? হ্যান্ডসাম না?'
স্বাগতা আপু আমার দিকে হাত উঁচিয়ে বলল, 'ও ফান করছে সরণী। তুই ঘাবড়াস না।'
ভাইয়ার বন্ধুটি সঙ্গে সঙ্গে স্বাগতা আপুর দিকে তাকিয়ে বলল, 'নো, নো স্বাগতা। আমি একচুলও ফান করছি না। ইয়োর সিস্টার ইজ সো প্রিটি। আমি এই ভরা মজলিশে ওকে প্রপোজ করতে চাই। তোমরা সবাই সাক্ষী হয়ে থাকবা আমার প্রেমের।'
ক্ষণিকের জন্য নীরবতা নেমে এলো। পরক্ষণেই ভাইয়ার বন্ধু বান্ধব'রা একসঙ্গে অদ্ভুত আওয়াজ করে উঠলো, 'হোওওওও, সায়েম? সিরিয়াসলি!'
ভদ্রলোক অথবা অভদ্রলোক, তার নাম তাহলে সায়েম। আমি আমার ঊনিশ বছরের জীবনে কক্ষনো এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি। আমি সত্যি বলতে নিশ্বাস নেবারও অবস্থায় নেই। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার দম বন্ধ হয়ে এসেছে। নিষ্পলক চোখে আমি সায়েম নামক মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি।
সায়েম বলল, 'আমরা হট্টগোল না করি। সবাই ধীরেসুস্থে খেয়ে উঠি। তারপর আমরা এই বিষয় নিয়ে আলাপ করবো। যদি কন্যার সম্মতি থাকে।'
খাবার টেবিলে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কেউ কিছু বলল না। আমার কেমন যেন কান্না এসে গেল। হয়তো এই যুগে এমনই হয়। ছেলেমেয়েরা খুব সহজে কঠিন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলে ফেলে। আমার মতো যারা এখনও পুরোনোতে বাস করে, তাদের এটা হজম করতে অসুবিধা হয়। এই যেমন এখন আমি খাবার খেতেও ভুলে গেছি।
আমার পাশ থেকে রৈনীল মৃদু স্বরে বললো, 'কংগ্রেটস।'
এতক্ষণে সংবিত ফিরে পেলাম আমি। চমকে উঠে নড়েচড়ে বসলাম। মাথা নিচু করে একটু একটু করে খাবার মুখে দিতে লাগলাম। হঠাৎ স্বাগতা আপু বলল, 'এভ্রিওয়ান, আমার বোনটা অনেক ছোট এখনো। ওকে দেখে বড় হতে পারে কিন্তু ও সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেছে। এখন ওর এডমিশনের টাফ সময় যাচ্ছে।'
সায়েম উত্তর দিলো, 'সো হোয়াট? এডমিশন নেয়ার পর প্রেম করার অজস্র সময় পাওয়া যাবে। তোরা আমাকে চিনিস। আমাকে কখনো কোনো মেয়ের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে দেখেছিস? এ জিন্দেগীতে আমি কাউকে নিয়ে এ ধরনের তামাশা করেছি? বল, বল তোরা।'
কয়েকজন একসঙ্গে মাথা নাড়লো, 'না দেখিনি। তুই অনেক ভালো ছেলে।'
'তাহলে? আমি ওর প্রিটি ফেসটার প্রেমে পড়েছি। শি ইজ এডোরেবল। খাবারটা খাচ্ছে কিভাবে দেখ? হাউ কিউট!'
আমি বিব্রতবোধ করলাম। যেটুকু খাচ্ছিলাম তাও আর গিলতে পারলাম না। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছি। পাশ থেকে রৈনীল নিচু গলায় বলল, 'খাও। খাওয়া শেষে তোমাকে বাগানের একটা সুন্দর জিনিস দেখাতে নিয়ে যাবো।'
আমি খানিকটা স্বস্তি পাইনি, তা বলবো না। বরং অনেকটা আরাম পেলাম। মনে হলো রৈনীল আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবে। আর কোনোদিকে মনযোগ না দিয়ে আমি খাবার খেতে আরম্ভ করলাম।
টেবিলে এ নিয়ে আর তেমন কথা হলো না। খাওয়া শেষ করে অন্যদিকে এসে দাঁড়াতেই রৈনীল আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। আমি ওকে অনুসরণ করে ওর পিছনে বের হয়ে এলাম।
এতক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। স্বস্তিতে বুকটা ভরে গেল আমার। বের হয়েই হাঁটতে হাঁটতে বাগানের ভেতর চলে এলাম আমরা। রৈনীল দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো। আমি বললাম, 'আমি না আগেই বলেছি আমার সামনে এটা বন্ধ রাখবেন।'
'বা: রে, এত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করে আনলাম। ধন্যবাদ স্বরূপ একটা সিগারেট খেতেই পারি।'
আমি মুচকি হেসে বললাম, 'থ্যাংকস। আমি অনেক আতংকে ছিলাম এতক্ষণ।'
'বুঝতে পেরেছি।'
খানিক্ষন নীরবে কেটে যাওয়ার পর আমি রৈনীলের চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলাম, 'কী করে বুঝলেন এতকিছু?'
সে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলো, 'আমার শুধু মনে হচ্ছিল তোমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তোমার কারো হেল্প দরকার।'
আমি মুহুর্তেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ভীষণ আবেগে আমার চোখ ভিজে আসলো। এই দীর্ঘ জীবনে আমার শোনা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কথা এটাই। 'তোমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, তোমার কারো হেল্প দরকার।' আহ, বুকের ভেতরটা নির্মল খুশিতে ভরে উঠলো আমার।
আমি অন্যদিকে ফিরে বড় বড় শ্বাস নিলাম। আমি জানিনা এই অদ্ভুত ভালো মানুষটা কোথা থেকে এসেছে। এই রাতটা নিছক স্বপ্ন কিনা। কিন্তু আজকের রাতটা, এই ছোট ছোট মুহুর্তগুলো নিঃসন্দেহে আজীবন মনে রাখবো।
রৈনীল বললো, 'এত অবাক হওয়ার কিছু নেই সরণী। আমি অনেক বই পড়েছি। এখন মুখ দেখেই মানুষের ভেতরটা পড়তে পারি। তোমার সিচুয়েশন বুঝতে আমার এক ন্যানো সেকেন্ডও সময় লাগেনি। যাইহোক, ছেলেটাও ভালো। ওকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি।'
'উফফ ওনার কথা বলবেন না তো। আমি না এরকম বিব্রত আর কক্ষনো হইনি।'
'কখনো কেউ তোমার প্রেমে পড়েনি?'
'জানিনা। কেউ প্রকাশ তো করেনি। আমার কোনো বন্ধু নেই। ক্লাসমেট দু একজনের সঙ্গে খুব প্রয়োজনে কথা হতো। আমি মানুষের সাথে মিশতে পারি না।'
'তাহলে কি আমি মানুষ না?'
রৈনীল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। আমি হেসে ফেললাম।
বললাম, 'আপনি মানুষ না, অনেক বেশী ভালো মানুষ। জানেন আমার মা মনে করে এই দুনিয়ার সব পুরুষ মানুষ খারাপ। কখনো নাকি দুনিয়াতে ভালো পুরুষ মানুষের জন্মই হয়নি। আমি জানিনা কেন মায়ের এমন ধারণা। কিন্তু সে আমাকে খুবই শাসনে রাখে। আপনার সঙ্গে এইযে এভাবে সময় কাটিয়েছি জানলে আমার মা আমাকে কী যে করবে!'
রৈনীল কয়েক সেকেন্ড থমকে আমার কথা শুনলো। তারপর বলল, 'আপনার মায়ের এই ধারণার কারণটা আমি জানেন না?'
'না। জানিনা তো।'
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে রৈনীল বললো, 'কত বড় দুঃখ উনি বয়ে বেড়াচ্ছেন তা জানলে আপনার আর মাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকতো না।'
আমি রৈনীলের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। শুধু একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম।
রৈনীল বলল, 'কখনো জানার চেষ্টা করে দেখবেন। তাহলে আপনার আর কোনো দুঃখ থাকবে না। তখন মনে হবে আপনার মা আরো বেশী দুঃখী।'
'আমি না আসলেই বুঝতে পারছি না।'
'আপনি অনেক নিষ্পাপ সরণী। এজন্য বুঝতে পারছেন না। এই পৃথিবীর কিছুই আপনার এখনো দেখা হয়নি। কখনো দেখা হলে বুঝবেন।'
'তা ঠিক। আমি আমার মায়ের শাসন ছাড়া আর কিছুই দেখিনি জীবনে।'
'মায়ের সঙ্গে গল্প করেছেন কখনো? মন খুলে কথা?'
'না। আমার মা আমার সঙ্গে খুব একটা ক্লোজ হয় না। সবসময় রাগী রাগী স্বরে কথা বলে।'
'আপনি জড়িয়ে ধরে থাকবেন মাকে। আস্তে আস্তে ওনার কাছের মানুষ হোন। তারপর ওনার মনের ভেতরটা পড়ে দেখতে চেষ্টা করুন। একদিন হয়তো আপনার ভুল ভাংবে।'
রৈনীলের কথাগুলো আমার মস্তিষ্কে ঝড় তুলে দিয়েছে। আমি সবকিছু গুলিয়ে ফেলছি। আবার গোছানোর চেষ্টা করছি। আবার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। রৈনীল কী করে শুধু একটা বাক্য শুনেই মানুষের সম্পর্কে এতকিছু বুঝে ফেলতে পারে, জানতে ইচ্ছে করছে আমার।
রৈনীল বলল, 'আমি আরেকটা সিগারেট ধরালে কি আপনি রাগ করবেন?'
'না। ধরাতে পারেন। কিন্তু আপনি আমাকে একবার তুমি, একবার আপনি বলছেন। আমার মজা লাগছে ব্যাপারটা।'
'হুম।'
রৈনীল আরো একটা সিগারেট ধরালো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য দেখছি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সিগারেট খাওয়াটাও একটা শিল্প। কী অদ্ভুত!
.
.
.
চলবে.........................................................................