রৈনীলের দিকে তাকিয়ে থাকাটা আমার সরল মনের পছন্দ হচ্ছে না। আমার মনের প্রত্যাশা, আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিই। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত শক্তিবলে আমি ওর দিকে চেয়ে আছি। একইসাথে অনুভব করছি, আমার সমস্ত রাগ জলে ভেসে গিয়েছে।
কখন যেন অন্যদিকে তাকিয়েছি বুঝতে পারিনি। এখন আমি দেখছি বাতির আলোয় ঝলমলে কিছু গাছের পাতা। সিগারেটের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে এক প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম। হাতের সিগারেট শেষ করে রৈনীল এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। জানতে চাইল, এটা কি গাছ জানো?
'না।'
'এটা হচ্ছে গন্ধরাজ।'
'গন্ধরাজ! সুন্দর তো নামটা।'
আমি বেশ কৌতুহলী হয়ে ওর দিকে তাকালাম। রৈনীল একটুও অবাক হলো না। বরং সপ্রতিভ ভাবেই উত্তর দিলো, 'গন্ধরাজ হচ্ছে একটা ফুলের গাছের নাম। তুমি গন্ধরাজ চেনো না?'
'না। সত্যি বলছি আমি এই ফুলের নাম আজকে প্রথম শুনলাম। কিন্তু ফুল কোথায়? এত বড় গাছে কোনো ফুল নেই। এর কি ফুল আসার কোনো মৌসুম আছে?'
'সাধারনত বসন্ত থেকে বর্ষা পর্যন্ত ফুল আসে। কোনো কোনো গাছে আবার সারা বছর ফুল ফোটে। খুবই সুঘ্রাণ। ফুল ফুটলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মন ভালো হয়ে যেতো। চারপাশ মুখরিত করে রাখে এই ফুলের ঘ্রাণ।'
'আমার এখন এই ফুল দেখতে ইচ্ছে করছে। গন্ধরাজ, কি সুন্দর নাম!'
'হয়তো দেখেছো। আবার কখনো দেখলে বুঝতে পারবে।'
আমি মুগ্ধ হয়ে গন্ধরাজ ফুলের গাছটার দিকে চেয়ে আছি। পৃথিবীতে এত এত ফুলের নাম, অথচ আমি এর কয়টাই বা জানি! আমার জানার পরিধি এত ক্ষুদ্র, মাঝেমাঝে নিজেরই নিজের জন্য লজ্জা হয়।
রৈনীল বলল, চলো ভেতরে যাই। আমি চলে যাবো এখনই।
'এখনই?'
'হুম। সরি, তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারছি না বলে।'
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, 'ইটস ওকে। আমার অত গল্প করার শখ ছিল না। আপনিও হই হুল্লোড় অপছন্দ করেন, আমিও করি। তাই ভেবেই কথাটা বলেছিলাম।'
রৈনীল এক পা, দু পা করে অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ালো। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকবো কিসের দুঃখে! আমিও চললাম ওর সঙ্গে। তবে দরজা অবধি এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। রৈনীল বললো, 'আমি সবাইকে বাই বলে আসি।'
আমি মাথা ঝাঁকালাম। রৈনীল ভেতরে গিয়ে মিনিট দুয়েকের মাথায় ফিরে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, 'ভালো থাকবে সরণী। তোমার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা থাকবে।'
'থ্যাংক ইউ। আপনিও ভালো থাকবেন।'
দ্রুতপদে গেটে দিয়ে বেরিয়ে গেল রৈনীল। আমার বুকের ভেতর হতে বড় একটি শ্বাস বেরিয়ে আসলো। আমি গেট পর্যন্ত এসে রৈনীলের চলে যাওয়া পথটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দ্রুতপদে হেঁটে মুহুর্তেই আড়ালে চলে গেছে সে। আমার মনে হচ্ছে, বহুদিন ধরে এই হাঁটার দৃশ্য আমার মনে থাকবে। হঠাৎ কাউকে হেঁটে আসতে দেখলে মনে হবে, ওই বুঝি রৈনীল আসছে। এই ক্ষণিকের পরিচয়ে মানুষটা আমার এত চেনা হয়ে উঠলো!
বাসার ভেতরে ঢুকে আমার আর কিছু ভালো লাগছিল না। সবাই গান গাইছে সুর বেঁধে। গান শেষ হওয়ার আগেই আরেকজন অন্য আরেকটা গান শুরু করে দিচ্ছে। কেউ একজন মাঝখানে ভুল করে কিছু গাইলেই তুমুল হাসির রোল পড়ে যায়। আমি একপ্রান্তে বসে ওদের এই দৃশ্য দেখতে লাগলাম।
সায়েম নামক লোকটা বারকয়েক আমার দিকে তাকিয়েছে। কোনো ইশারা বা কথা বলার চেষ্টা করেনি। একদম আড্ডা শেষ করে সবাই যখন চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হচ্ছে, তখন সায়েম আমার সামনে এসে বলল, 'আমি যোগাযোগ করবো। সি ইউ সুন।'
এইটুকু বলেই চলে গেলো সে। আশ্চর্য ধরনের মানুষ তো! আমার ছোট্ট জীবনে আমি কখনো এত আশ্চর্য হয়েছি বলে মনে পড়ছে না। আজ মা এখানে থাকলে হয়তো দৃশ্যটা ভিন্নরকম হতো। এইযে এত এত মুহুর্ত, এগুলোর কিছুই জমা হতো না আমার স্মৃতিতে। ভাগ্যিস আজকের দিনেই মায়ের ব্লাড প্রেশারটা একটু বেড়েছে।
সবাই চলে গেলে বাড়িটা একদম নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। জুবায়ের ভাই খানিকক্ষণ গল্প করে ঘুমাতে চলে গেলেন। স্বাগতা আপু আমার হাত ধরে বসে রইল। আমি ভাবছি ভাইয়াকে একটা ফোন করবো কিনা। আজ ফোন দিতে ইচ্ছে করছে না। ভাইয়া নিজের ইচ্ছেমতো থাকুক। যখন ইচ্ছে ফিরুক। আমি এখন চুপচাপ শুয়ে থাকবো। আজকের রাতটা আমি উপভোগ করে কাটাতে চাই।
স্বাগতা আপু বলল, 'সায়েম খুব সিরিয়াসলি তোকে প্রপোজ করেছে। ও আমাদের ক্লোজ ফ্রেন্ড।'
'আপু! আমি মানসিক চাপে আছি। তুমি জানো।'
'সেজন্য আমি তোকে ভালোমন্দ কিছু বলছি না। প্রেম তো জীবনেরই একটা অংশ। অবশ্য তোর জন্য প্রেম করা অসম্ভব ব্যাপার। কেউ একজন তোকে পছন্দ করছে এটা কি তোকে আন্দোলিত করছে না? আমি এটাই জানিয়ে রাখলাম। আমি তো তোকে বলছি না ওর সঙ্গে প্রেম কর।'
আমি রাগী রাগী স্বরে বললাম, 'ওই ষ্টুপিডটার কথা আমাকে আর কক্ষনো বলবা না।'
'আর রৈনীলের কথা?'
আমি স্বাগতা আপুর চোখের দিকে তাকালাম। আপু মুচকি হেসে বললো, 'মজা করেছি। দেখলাম দুজনে নাই হয়ে গেছিস।'
'মাকে বোলো না কিছু।'
'ধুর পাগলী। আমি কেন বলতে যাবো? আমাকে চিনিস না তুই? এখন যা, ঘুমিয়ে পড়। ভয় পাবি একা শুতে?'
'না।'
'আমি জেগেই আছি। ভয়ের কিছু নেই। লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাস। সীমান্তকে কল দিয়ে দেখবো আসবে কিনা?'
'তোমার ইচ্ছে। এখন যাও। আমি ঘুমাবো।'
'তুই ঘুমাবি কেন? জেগে জেগে একটা মুভি দেখ। দারুণ ফিলিংস। কোনোদিন তো বাসায় মুভি দেখতে দেয় না। আজ শান্তি মতো শুয়ে শুয়ে দেখ।'
'ভালো বলেছো। রিমোট রেখে যাও। আমি ইচ্ছে হলে দেখবো। এখন কিছুক্ষণ একা বসে থাকবো৷ তারপর যা ইচ্ছে হবে।'
স্বাগতা আপু চলে গেল নিজের রুমে। আমি যেন হঠাৎ করেই খাঁচার বন্ধ দরজা খুলে দেয়া মুক্ত পাখির মতো আবিষ্কার করলাম নিজেকে। এত আনন্দ হতে লাগলো আমার! কতক্ষণ হাত পা ঘুরিয়ে নাচলাম। কোনো নিয়মমাফিক নাচ নয়। আনন্দে দোল খাওয়া। চুল ছেড়ে দিয়ে এদিক সেদিক দোলা। একটু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ কাঁদলাম মন খুলে। উঠে আবারও ঘুরতে লাগলাম। আজকের রাতটা আমি নিজের মতো করে উপভোগ করবো।
বারান্দায় বসে বসে উদাস চোখে চেয়ে রইলাম বাইরের দিকে। নিস্তব্ধ চারপাশ। আমার নিজের কথা ভাবছি। কোথায় গেলে শান্তি আমার, কী হতে চাই, কেন চাই, সবকিছু এক বসাতেই ভেবে ফেললাম। এরপর মনটা ভীষণ স্থির হলো। নিশ্চল নদীর মতো স্থির।
বসেছিলাম মুভি দেখতে। কতক্ষণ দেখেছি জানিনা। ঘুমে দুচোখ বন্ধ হবে এলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।
শুনেছি সীমান্ত ভাইয়া ভোরবেলা এসেছে। সকাল দশটায় আপুর ডাকে বের হয়ে শুনি, মা বারবার ফোন করে অস্থির। আপু বলল, 'দ্রুত নাস্তা খেয়ে বাড়ি যা।'
'ভাইয়া ওঠেনি?'
'ফ্রেশ হচ্ছে। সারা রাত বাইরে ছিল জানাই নি মমকে। বলেছি সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে অনেক রাত হয়ে গেছে। তাই তোদেরকে জাগাচ্ছি না। ওমা তাতেই সে কী রাগ! কেন এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে দিচ্ছি। কেনই বা রাত জেগে আড্ডা দিয়েছি। তোরা নাহয় ছোট, আমি তো বড়। আমার উচিৎ হয়নি তোদেরকে জাগিয়ে রাখা, এসব।'
আমি বললাম, 'মা ভাবে আমরা দশটায় ঘুমিয়ে ভোরবেলা উঠে পড়লেই বোধহয় পৃথিবীর সবচাইতে ভালো মানুষ হতে পারবো। মনে শুন্যতা রেখে ভালো মানুষ হয়েই বা কি লাভ।'
'ছাড় না ওসব। নাস্তা খেয়ে একটু আরাম কর। বারান্দায় বসে একসঙ্গে চা খাই। তারপর তোরা রওনা দে। আমি দেখি রাতে হয়তো তোদের ওখানে যাবো। মা বলছিল জুবায়েরকে ডিনার করাবে।'
'বাসায়?'
'হুম। আমি বলেছিলাম তোমরা বাইরে এসো। রাতে আমরা কোনো রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে খাই। মম বললো অন্য একদিন।'
'তাও ভালো সরাসরি না করেনি। অন্য একদিন বলেছে।'
সীমান্ত ভাইয়া এসে নাস্তার টেবিলে বসলো। আমি জড়োসড়ো হয়ে বসলাম। ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি চোখ দুটো লাল। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, 'ফোন দিস নি কেন?'
'কখন?'
'বলেছিলাম না পার্টি শেষ হলে ফোন দিবি।'
'আমার কি ফোন আছে ভাইয়া?'
'বাসায় গেলে মা আবার চিল্লাচিল্লি শুরু করবে। আরেকটু সকালে ডাকোনি কেন আপু?'
ভাইয়া স্বাগতা আপুর দিকে তাকায়। আপু মুচকি হেসে বললো, 'এত সুন্দর করে ঘুমাচ্ছিলি তোরা। যেন অনেকদিন পর নিশ্চিন্তে আরাম করে ঘুমাচ্ছিস। তাই আর ডাকিনি।'
'বাসায় গেলে আরাম বের হবে।'
'মম কিছু বলবে না। আমিই সাত সকালে ঝাড়ি খেয়েছি। তোদেরকে আর ঝাড়ি দিবেনা। তোরা শান্তি করে নাস্তা খা।'
জুবায়ের ভাইয়া চলে এলো খাবার টেবিলে। আমাদেরকে একসঙ্গে শুভ সকাল জানালো। আমি সুন্দরভাবে হাসি দিয়ে বললাম, 'তোমাদেরকে থ্যাংকস। এত চমৎকার ঘুম হয়েছে আজ। মাঝেমাঝে এভাবে দাওয়াত দিও। শুধু আমাকে। মাকে সাথে করে আনতে বোলো না যেন।'
ভাইয়া হেসে বলল, 'আমি আর স্বাগতা মাঝেমাঝে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবো। এতদিন তো পড়াশোনার চাপে ছিলে তাই কখনো আসার কথা চিন্তাও করিনি। এখন তো চাপ কমে যাবে।'
'তাই যেন হয়।'
আমরা নাস্তা সেরে উঠতে উঠতে দেখি জুবায়ের ভাইয়া নিজে চা বসিয়েছেন। আপু বারান্দায় চেয়ার টানাটানি করছে। ভাইয়া চার কাপ চা নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। আমরাও চললাম।
রোদ ঝলমল একটা সকালে একসঙ্গে বসে চা খেলাম চারজন মিলে। ভাইয়া তাড়া দিতে লাগলো। আমিও আর দেরী করার সাহস করলাম না। জুবায়ের ভাইয়া ও স্বাগতা আপুকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে।
আমার মন আজ অসম্ভব শান্ত। বাসায় ফিরেই নিজের ঘরে ঢুকে বই নিয়ে বসলাম। আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। মনে হচ্ছে এবার পরীক্ষাটা ভালো হবে। আমার পরিবার ঢাকার বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে যেতে দেবে না। এ কারণে আমার ওপর চাপটা বেশী। বুয়েট, মেডিকেল কোথাও চান্স হয়নি। মা অতিরিক্ত ক্ষোভ নিয়ে আছেন। আর একটা ইউনিটের পরীক্ষা বাকি। এখানে না হলে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন করিয়ে দেবে। আর সারাজীবন শুনিয়ে যাবে বেদনার বার্তা। এত সুযোগ সুবিধা পেয়েও কেন ভালো কোথাও চান্স হলো না। এসব পরিবার কি কোনোদিন বুঝবে আমার ভেতরের যন্ত্রণাটুকু! ঠিক কতটা পরিশ্রম করেছি তা তো আমি জানি। সবসময় কি পরিশ্রমে সবকিছু মেলে? ভাগ্য বলেও একটা কথা থাকে। আমার ভাগ্যে হয়তো অন্যকিছু লেখা।
কিছুক্ষণ পর মা রুমে আসলো। আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মিনিট। আমি পড়ছি। মা বললো, 'এতগুলো সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়? এখনকার একটা সেকেন্ডও তুমি ফিরে পাবা না। সীমান্ত রাতে কই ছিল?'
আমি ঢোক গিলে উত্তর দিলাম, 'আপুর বাসায়। আর কই থাকবে।'
'অহ। ঠিক আছে। বাইরে থেকে আসছো। এখন আগে শাওয়ার নাও। হালকা নাস্তা খেয়ে পড়তে বসবা। একনাগাড়ে দুপুর দুইটা পর্যন্ত পড়বা। দুইটায় ভাত দিবো। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাইছো, আজকে আর দিনে ঘুমানোর দরকার নাই। ভাত খেয়ে আবার পড়তে বসবা।'
'ঠিক আছে।'
'চুলে শ্যাম্পু করার দরকার নেই আজ। অযথা সময় নষ্ট হবে।'
আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। মা বেরিয়ে গেলো। চোখ বুজে কয়েকটা শ্বাস নিলাম আমি। গত রাতের অসীম স্বাধীনতার স্বাদ মনে পড়ে যাচ্ছে। ইশ, পুরো জীবনটা যদি এমনভাবে কাটিয়ে দিতে পারতাম!
.
.
.
চলবে.........................................................................