সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। আয়ান ও অনিমার সম্পর্কের বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি তবে। কারণ অবশ্য আয়ান নিজেই। অনিমার মাধ্যমিক পরীক্ষা চলার ফলে আয়ান যথেষ্ট দূরত্ব মেইনটেইন করে চলেছে এতদিন। ভালো রেজাল্ট করতে হবে বলে অনিমাও সেটা মেনে নিয়েছিল বেশ সুন্দর করেই। তাহমির শরীরের অবস্থা এখন একেবারে ঠিকঠাক। আগের মতো স্কুলে চাকরিতে জয়েন করেছে সে। সহনও পুরোদমে অফিসের কাজে মনোনিবেশ করছে। তাহমির অসুস্থতার জন্য কাজে অনেক গ্যাপ গেছিল এতদিন । এতকিছুর মধ্যে তৃষার জীবনে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিয়ের পর চেনা অনিক কেমন জানি অচেনা হয়ে উঠেছে। প্রথম প্রথম তৃষা সেগুলোকে তার প্রতি অনিকের অতিরিক্ত ভালোবাসা মনে করলেও এখন সেগুলো অশান্তি মনে হচ্ছে। কালকের ঘটনা বলি-
ফাইনাল ইয়ারে আছে তৃষা। সামনেই পরীক্ষা। সেজন্য পড়াশোনার চাপ বেড়েছে। রাতে অনিক ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তৃষা পড়তে বসে। কিন্তু অনিক ঘুম থেকে উঠে তৃষাকে পাশে না পেয়েই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিল। তৃষা যখন বলে সে পড়তে বসেছিল,অনিক তখন অস্বাভাবিকভাবে কয়েকটা ছিঁড়ে ফেলে। তৃষার মেজাজ বিগড়ে যায় তখন। ফলে রাগ করে আর বিছানায় না শুয়ে সোফায় শোয়। সেখানেই বাঁধে আরেক বিপত্তি। পাগলা কুকুরের মতো ক্ষেপে যায় অনিক। তৃষাকে জোর করে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
" এসব কী ডাক্তার সাহেব? আপনি কি সুস্থ আছেন আদৌও! "
রাগে,দুঃখে চিৎকার করে বলে তৃষা। অনিক কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৃষার দিকে। সে তৃষার কথা শোনে না। ধীরে ধীরে কাছে এসে বসে।
" আমি পাগল? তোমার কি অন্য কাউকে ভালো লাগে তৃষা? তুমি আগের মতো আমাকে ভালোবাসো না? "
তৃষা কিছু বলার সুযোগ পায় না। অনিকের বলিষ্ঠ শরীর পিষে দেয় তৃষাকে। ঠোঁট, হাত সবকিছুই অনিক দখল করে নেয়। যার স্পর্শ প্রথম প্রথম শরীরে অন্য রকম সুখময় অনুভূতি সৃষ্টি করতো, আজ সেই মানুষটার কড়া স্পর্শে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয় তৃষা। অনিককে তখন জীবন্ত কোনো পিচাশ মনে হয় তার। এই নিয়ে চলছে তৃষার জীবন। বাবার বাড়ি যায় না তৃষা অনেকদিন। কারণ অনিক তাকে একা ছাড়বে না। অনিকের এই অদ্ভুত কর্মকাণ্ড তার বাবার বাড়ির লোকজনের সামনে আনতে চায় না তৃষা। আগামীকাল দিনা আসবে। দিনার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবে বলে ভেবেছে তৃষা।
" সহন ভাই কী খবর? বিয়ে-শাদি তো হলো বহুদিন, আমরা কবে চাচ্চু ডাক শুনবো হু?"
দুপুরের খাওয়ার সময় দিয়েছে। অফিসের ক্যান্টিনে একসাথে খেতে বসেছে সহন ও তার কয়েকজন সহকর্মী। তাদের মধ্যে থেকে ওসমান শেখ কথাটি বললো সবার মাঝে সম্প্রতি ওসমান বাবা হয়েছে। সহন খাবার খেতে খেতে বলে,
" আগে তোমার পুচকি বড়ো হোক তারপর না হয় চাচ্চু ডাক শুনো। তা আমাদের শাকিলের কী খবর? শাকিল কি চিরকুমার থাকার পণ করলে?"
সবাই হেসে উঠলো। শাকিল বেচারা চুপচাপ খাচ্ছে। ছেলেটা ভীষণ লাজুক। চাকরিতে নতুন জয়েন করেছে। তবে আগে অন্য কোম্পানিতে ছিল।
ওসমান সহাস্যমুখে বলে,
" আর বলো না সহন শাকিল লজ্জা পাচ্ছে দেখো।"
" তাই তো দেখছি ওসমান ভাই। বিয়ের কথা শুনতেই যে ছেলে এতো লজ্জা পাচ্ছে বিয়ের প্রথম রাতে হাহাহা! "
" আপনরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন ভাইয়েরা। আমার বিয়ে আরো পরে কিন্তু আপনাদের খাওয়ার সময় কিন্তু শেষের পথে। "
শাকিলের কথায় টনক নড়ে সবার। আসলেই সময় নেই। সবাই দ্রুত খাওয়া শেষ করে যার যার কেবিনে চলে যায়।
" কতদিন হলো মেয়েটাকে দেখি না। তুই একবার গিয়ে দেখে আসবি আয়ান? কেমন আছে জানি না। ফোনে তো বলে সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু কেনো জানি আমার মনটা খচখচ করছে। "
প্লেটে তরকারি দেওয়া শেষ করে উক্ত কথাটি বললেন আমেনা ইসলাম। আয়ান খেতে শুরু করেছে মাত্র। প্রচন্ড গরম আজকে। দিন দিন তাপমাত্রা বাড়ছে ঢাকা শহরে। তৃষার বাবা আগেভাগে খেয়ে বেরিয়ে গেছেন কী একটা কাজে।
" তৃষা তো সব সময় বলে ও ভালো আছে মা। তাহলে তুমি এতো চিন্তা করো কেনো?"
" তুই বুঝবি না বাবা। মায়ের মন সন্তানের জন্য এমন করে কেনো। আমার বিশ্বাস কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে ওর। মেয়েটা ভীষণ চাপা। তাহমির মতো না। তাই তৃষাকে নিয়ে চিন্তা বেশি হয়।"
চেয়ার টেনে বসলেন আমেনা। আয়ান মায়ের কথায় মনোযোগ দিলো এবার। কিছুটা ভেবে বললো,
" ঠিক আছে মা। আমি বরং কালকেই যাবো। তুমি আর টেনশন নিও না। খেয়ে নাও তুমিও। বেলা হলো ভালোই। "
" ঠিক আছে বাবা।"
আয়ান যে চিন্তা করছে না এমন কিন্তু নয়। তৃষার ব্যবহারে অস্বাভাবিকতা সে-ও লক্ষ্য করেছে। কিন্তু মায়ের সামনে সেগুলো বললে তিনি আরো বেশি চিন্তা করতেন বলেই বলেনি আয়ান।
রুমে ঢুকে সবকিছু অন্ধকার দেখে চমকাল সহন। এত তাড়াতাড়ি তো তাহমি ঘুমায় না কোনো দিন! মাত্র ন'টা নেজেছে। অফিস থেকে ফিরলো সহন। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তাহমিকে ডাকল সহন।
" তাহমি ঘর অন্ধকার কেন?"
বাতি জ্বেলে দিলো সহন। বিছানায়ও তো নেই মেয়েটা। সহন ব্যাগ,মানিব্যাগ, ফোন ও যাবতীয় জিনিসপত্র টেবিলের উপর রেখে ওয়াশরুমের দিকে এগোলো। কিন্তু সেখানেও তো তাহমি নেই! কিছু মাথায় আসছে না সহনের। তাহলে হয়তো রান্নাঘরে আছে ভেবে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখে তাহমি বিছানা ঠিক করছে। আবারও চমকাল সহন। বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
" এতক্ষণ কোথায় ছিলিস তাহমি?"
" রান্নাঘরে ছিলাম। চল খেয়ে নিবি। মাথা ব্যথা করছে খুব, তাড়াতাড়ি ঘুমবো। "
সহন তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছে নিলো। তাহমির পিছু পিছু ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোলো। তাহমির কথাবার্তা কেমন যেনো সন্দেহজনক লেগেছে সহনের। কিন্তু সেটা বলেনি আর। রাতের খাওয়াদাওয়া সবাই একসাথেই করলো আজ। আতাউল খান, ফরিদা, সহন ও তাহমি বেশ জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করে যে যার রুমে গিয়েছে। তাহমি কথামতো বিছানায় শুয়ে সোজা চোখ বন্ধ করে রেখেছে। সহন কখনো তাহমিকে ঘুমানোর জন্য এরকম তাড়াহুড়ো করতে দেখেনি। এমনকি ভীষণ অসুস্থ থাকাকালীন সময়েও না। তবুও নিজের মনের ভাবনায় লাগাম টেনে নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করলো সহন। অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যে সফলতা এলো।
সহন ঘুমিয়ে যেতেই বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে বারান্দার দিকে এগোলো। কিছু অসম্পূর্ণ কাজ ছিলো তার,সেগুলো দ্রুত কমপ্লিট করে তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো চুপিসারে!
পরীক্ষা শেষ হতেই অনিমা আয়ানকে পুরোদমে জ্বালাতন করা শুরু করে দিয়েছে। এই যেমন এখন রাত বারোটা এগারোটা পয়তাল্লিশ বেজেছে। এই মুহুর্তে আয়ানকে দেখবে বলে বায়না ধরেছে সে। আয়ান কতক্ষণ বুঝিয়েছে। কিন্তু এই মেয়ে ভীষণ ত্যাড়া। যা বলে তাই করতে হয়। না করলে আজকাল গাল ফুলিয়ে থাকে নয়তো বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করতে শুরু করে। যার একটাও আয়ানের ভালো লাগে না। ফলে বাধ্য হয়ে অনিমার রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে আয়ান। বাড়ির পেছন দিকের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে তারপর পাইপ বেয়ে রুমে ঢুকতে হয়েছে তাকে। বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ছিল অনিমা। হঠাৎ জানালা দিয়ে কিছু ভেতরে পড়ার আওয়াজে সেদিকে তাকাল। আয়ানকে দেখতেই খুশিতে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে জড়িয়ে ধরে,লাফিয়ে কোলে ওঠে। দুই পা দুইপাশে রেখে বাচ্চাদের মতো গলা আঁকড়ে ধরে ঝুলে আছে অনিমা। আয়ান বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেললো কয়েকটা। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,
" অনিমা! কেনো এরকম পাগলামি করো বলো তো? এখন যদি তোমার বাবা কোনোভাবে টের পেয়ে যান আমি তোমার রুমে আছি,কী হবে জানো?"
অনিমাকে ওভাবে নিয়েই বিছানায় গিয়ে বসলো আয়ান। অনিমা এখনও চুপ করে একইভাবে ধরে আছে আয়ানকে।
" কী হবে? আমি বলবো আমি তোমাকে ভালোবাসি। "
" হ্যাঁ তারপর তোমার বাবা বাংলা ছায়াছবির নায়িকাদের বাবার মতো বলবেন,আমার মেয়েকে ভুলে যেতে তুমি কতো টাকা নিবে? টাকা না নিলে তোমার পরিবারকে শেষ করে ফেলবো আমি। "
আয়ানের কথায় অনিমা ঠোঁট টিপে হাসছে। আয়ান মুখ গোমড়া করে বসেই আছে। বেচারার ভীষণ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তার জন্য। এটা অনিমা বুঝতে পেরে গাঢ় করে তার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আয়ান বরফের মতো জমে গেলো সেখানেই। সমস্ত বিরক্তি, চাপা রাগ গলে জল হয়ে গেছে।
.
.
.
চলবে............................