বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। চারদিক মেঘে অন্ধকার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সন্ধ্যা নেমেছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তাহমি এলো। সহন কিছু না বলে মুচকি হেসে তাহমিকে কোলে তুলে নিয়ে ছাদের দিকে এগোচ্ছে। তাহমির অন্য রকম কিছু অনুভব হচ্ছে। দীর্ঘদিন সহনের উষ্ণ ছোঁয়া থেকে দূরে ছিল সে। খানিক বাদে ছাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল সহন। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে দু'জনের গায়ে। তাহমি সহনের মুখশ্রীর দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির পানি সহনের নাকের ডগা দিয়ে বেয়ে তাহমির ঠোঁট ছুঁইয়ে যাচ্ছে। বাজ পড়লো আশেপাশে কোথাও। সেই সাথে আঁতকে উঠলো তাহমি। খানিকটা ভয় পেয়েছে মেয়েটা। সহন তাহমিকে নামিয়ে দিলো কোল থেকে। তারপর শক্ত করে জড়াল বক্ষে।
" তাহমি এভাবে বাইরে থাকা ঠিক হবে না এখন। দেশের সব জায়গায় কমবেশি কালবৈশাখী হচ্ছে। "
" হ্যাঁ ঠিক বলেছো। চলো বাসায় চলো। পরে একদিন ভিজবো আবার। এখন শুধু বৃষ্টি না বেশ ঝড় হচ্ছে। "
দু'জনের সম্মতিতে ছাদ থেকে নেমে গেলো দু'জন। প্রথমে তাহমি ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেড়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোলো। তারপর সহন গোসল করতে ঢুকলো। তাহমিকে ডাইনিং টেবিলের দিকে আসতে দেখে ফরিদা উদগ্রীব হয়ে বললেন,
" কী রে এতক্ষণ ডাকলাম কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না কেন? "
" ছাদে ছিলাম মামুনি। তুমি এখানও খাওনি?"
তাহমি চেয়ার টেনে বসলো। ফরিদা আগে থেকেই ছেলে ও বউয়ের জন্য প্লেটে ভাত,তরকারি বেড়ে রেখেছেন। সহনের বাবা অফিসে খাবে দুপুরে। কীসের একটা জরুরি মিটিং আছে শুক্রবারেও! বিদেশি কোম্পানির সাথে কোনো একটা চুক্তি হওয়ার কথা।
" তোদের রেখে একা একা খেতে কি ভালো লাগে! "
" আচ্ছা তোমার ছেলেও আসবে এখুনি। ততক্ষণে তুমি শুরু করো বরং। "
তাহমির কথার মধ্যেই সহন এসে পৌঁছল সেখানে।
" এইতো আমিও এসে গেছি। মা খাওয়া শুরু করো এখন। "
ফরিদা খান খেতে শুরু করলেন সাথে তাহমি ও সহনও।
" মি.চৌধুরী আপনার বোনকে বিয়ে দিবেন না?"
আকস্মিক এ ধরনের প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল তৃষা। আজকে অনিকের সাথে তার চেম্বারে এসেছে তৃষা। এতদিন বিয়ে হলেও নিজের স্বামী কোথায় কাজ করে সেসব দেখা হয়নি বলেই আজকে অনিক তৃষাকে সাথে করে নিয়ে এসেছিল। হসপিটালের অন্য একজন ডক্টর তৃষাকে দেখেই হুট করে প্রশ্নটি করলো। অনিক মৃদু হেসে বললো,
" এমবিবিএস ভালো ডাক্তার পেলেই বিয়ে দিয়ে দিবো।"
তৃষা চমকাল। অনিকের হাবভাব বুঝতে পারছে না। তবে সামনে থাকা লোকটার মনে যে লাড্ডু ফুটছে সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই তৃষার। লোকটা আগ্রহসহকারে এবার চেয়ার টেনে অনিকের সামনাসামনি বসলো।
" তাই? আজকালকার যুগে এরকম বোরকা পরে পর্দা করা মেয়ে পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। "
" তা ঠিক বলেছেন ডা. সৌরভ। বাই দ্য ওয়ে, আলাপ করিয়ে দেই উনি ডাক্তার সৌরভ হাওলাদার,আমার কলিগ। আর সৌরভ এই মেয়েটি আমার বোন নয়,স্ত্রী। আবারও বিয়ে করেছি,তবে সেটা তেমন একটা জানানো হয়নি কাউকে। "
ডাক্তার সৌরভ হাওলাদার বিষম খেলো। অনিক টেবিলে থাকা পানির বোতল সৌরভের দিকে এগিয়ে দিয়ে ফের বললো,
" আরে নিন নিন খেয়ে নিন মশাই। "
সৌরভ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা হাতে পানির বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করতে লাগলো। তৃষা ঠোঁট টিপে হাসছে। অনিক যে এরকম রসিকতা করতে পারে সেটা তৃষা আজকেই আবিষ্কার করলো প্রথম। কিন্তু কোথাও গিয়ে ভয় লাগছে তৃষার। বাড়ি গিয়ে এটা নিয়ে আবার ঝামেলা করবে না তো? অনিকের ঔষধ চলছে নিয়মিত। তৃষা নিজে উদ্যোগ নিয়ে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সৌরভ পানির বোতল টেবিলে রেখে দিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে বললো,
" সরি ড. অনিক। ভাবী কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। তো যাইহোক, বিয়ের দাওয়াত পেলাম না একদিন ট্রিট কিন্তু চাই। "
অনিক জোরে হাসলো, তৃষা মুচকি মুচকি হাসছে।
" আরে আমিও মজা করেছি একটু। ইট’স ওকে। নেক্সট শুক্রবার আমাদের বাসায় তোমার ইনভাইট রইলো। রিমি,খায়রুল ও সবুজকেও বলেছি।"
" ঠিক আছে। তাহলে এলাম এখন। দেখা হবে ভাবী আল্লাহ হাফেজ। "
তৃষা জবাবে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। কিন্তু কথা বললো না। অনিক যদি রেগে যায় সেই ভয়ে চুপ করে থাকে। ডাক্তার ছয় মাসের ঔষধ খেতে দিয়েছেন। সেই সাথে এই ক'মাস অনিকের মনমতো সবকিছু করতেও বলেছে। তৃষা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সবকিছু তাই মেনে নিয়েছে। ফোনের রিংটোনের আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো তৃষা। অনিক টেবিলের রাখা ফাইলের দিকে নজর বুলিয়ে দেখছে। আয়ান কল করেছে। দ্রুত কল রিসিভ করলো তৃষা।
" আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছো তোমরা?"
বোনের আওয়াজে হৃদয় শীতল হয়ে গেছে আয়ানের। আসবে আসবে করেও এতদিন বিভিন্ন কারণে আসা হচ্ছিল না এদিকে। আজকে না বলেই চলে এসেছে তৃষাদের বাড়ি।
" আলহামদুলিল্লাহ। তোরা কেমন আছিস? আর তোরা কোথায়? আমি তো তোদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। "
তৃষা চমকাল। ভাই এসেছে তার বাড়ি! বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তৃষা। সেটা দেখে অনিকও বুঝল গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়েছে।
" আমি উনার সাথে হসপিটালে এসেছি ভাইয়া। তুমি থাকো, আমি ত্রিশ মিনিটের মধ্যে আসছি।"
" ঠিক আছে। সাবধানে আয়।"
কল কেটে দিতেই তৃষা দেখে অনিক উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
" ভাইয়া এসেছে আমাদের বাসায়। "
" বাহ! চলো তাহলে বাসায় যাই। এমনিতেই রোগী কম আজকে৷ তাছাড়া অন্য ডাক্তাররা আছে। "
" যাবে তুমি? "
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো অনিক।
" বারোটা চল্লিশ বেজে গেছে। জোহরের আজান দিতে তো বেশি সময় বাকি নেই। তোমাকে গিয়ে রান্না করতে হবে আবার। বাসায় তো শুধু ডাল,মাছ আর ভাত রান্না করে রেখে এসেছো। আয়ানের জন্য মাংস রান্না করবে তো।"
" আগে বাসায় যাই তারপর সেসব দেখা যাবে। ভাইয়া তো চলে যাবে না এখুনি। বিকেলে না হয় মাংস রান্না করবো।"
" ঠিক আছে। চলো। তুমি যা ভালো মনে করো তাই হবে। "
অনিকের পিছনে পিছনে তৃষাও বাড়ির পথে এগোচ্ছে। মানুষটা এখন যেমন আছে সব সময় যদি তেমন থাকতো! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়িতে উঠে বসলো তৃষা।
ডাইনিং রুম থেকে নিজের রুমে এই নিয়ে তিন বার গেলো এলো সহন। তাহমির খাওয়া শেষ হচ্ছে না কেনো সেই নিয়ে বহুত রাগ হচ্ছে নিজের উপর। অথচ এতে নিজের সাথে রাগ করার কোনো কারণ আছে? রাগ করলে করবে তাহমির সাথে, তা না করে নিজেকে গালিগালাজ করে যাচ্ছে লোকটা। নাহ তিনবার গেলো আর একবার গিয়ে দেখবে। তাহমির কাজ শেষ হলে ভালো নয়তো সোজা ঘরে গিয়ে আজকে নিজেই বিছানা গুছিয়ে মশারী টানানোর কাজও করবে হুহ্। কপাল খারাপ লোকটার। তাহমি খাওয়া শেষ করে শ্বাশুড়ির সাথে গল্প জুড়ে বসেছে। দুপুরের অধরা রোমান্স তো পূর্ণ করতে হবে রাতে! সেসব কি মেয়েটার মাথায় নেই? সহন বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরেই চলে গেলো। প্রথমে ভালো করে ঝেড়ে ঝেড়ে বিছানা পরিষ্কার করলো। এতো জোরে ঝাড়ছিল বিছানা মনে হচ্ছিল বিছানায় ময়লার অভাব নেই। তারপর গেলো মশারী টানাতে। মশারী টানিয়ে বালিশে মাথা রেখে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো সে। এরমধ্যে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ ভেসে এলো কানে। তাহমি ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো। বিছানার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই হাসলো একটু। এগিয়ে গিয়ে বসলো একপাশে।
" আজকে সব নিজে থেকেই করে ফেললে?"
" কথা কম, কাজ বেশি। "
সহন তাহমিকে মশারীর বাইরে থেকে ভেতরে নিয়ে শুইয়ে দিলো। নিজে তাহমির একহাত সোজা করে তাতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। তাহমি ঠোঁট টিপে হাসছে।
" কীসের কাজ এখন?"
" কর কর ঢঙ কর। মেয়েদের কাজ তো ঢঙ করাই। তোরা বুঝবি তোদের জামাই জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে তবুও জিজ্ঞেস করবি, কী হয়েছে?
.
.
.
চলবে.............................