আবছা আলোয় আমি ভদ্রলোকের পাশাপাশি হাঁটছি। এই দৃশ্য যদি আমার আম্মু দেখতো, তবে নির্ঘাত দম বন্ধ হয়ে মরে যেতো। তবে আমার ভেতর তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। আমি নার্ভাস না হওয়ার ভান ধরতে ব্যস্ত।
এই বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর দিক হচ্ছে এর সামনের জায়গাটুকু। অনেকখানি জায়গা জুড়ে গাছের সাড়ি। দূর হতে আসা মৃদু আলোয় সবকিছু কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
ভদ্রলোকের প্রশ্নে আমি চমকে উঠলাম, 'আপনি কি করেন?'
'পড়াশোনা।'
'তা তো বুঝলাম। কোন ইউনিভার্সিটি?'
'এখনো এই পরিচয় দেয়ার মতো কিছু হয়নি। আমি এডমিশন দিচ্ছি এখনো।'
ভদ্রলোক বেশ ভড়কে গেলো। চমকে তাকিয়ে রইলো সে আমার দিকে। অবিশ্বাসের সুরে বলল, 'যা! আপনি তো দেখি অনেক ছোট।'
আমি হাসতে হাসতে বললাম, 'আমাকে দেখে বোঝা যায়নি তাইনা?'
'উহু। আমি অতকিছু ভাবিনি। একা একা আসতে ভয় করেনি আপনার? নাকি রাতে প্রায়ই বের হওয়া হয়?'
'একা আসিনি। আমার ভাই সঙ্গে এসেছিল। আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। আগে কক্ষনো এমন হয়নি। আজকেই প্রথম ভাইয়া আমাকে একা রেখে গেল। আর আজই আপু দরজা বন্ধ করে রেখেছে।'
ভদ্রলোক হাসলো কিনা আমি বুঝতে পারলাম না। ওনার দিকে তাকাতে সংকোচ লাগছিল। উনি নিজেই বলল, 'তাহলে আপনার কাছে কোনো ফোন নেই? এতক্ষণে বুঝলাম।'
'সত্যি বলতে আমার ফ্যামিলিটাই এমন। ফোন ইউজ করা যাবে না, একা কোথাও যাওয়া যাবে না, বন্ধুবান্ধব রাখা যাবে না, টিভি দেখা যাবে না। অথচ আমার ক্লাসের প্রত্যেকের ফেসবুক আছে, হোয়াটসঅ্যাপ আছে, ইন্সটাগ্রাম আছে।'
ছেলেটা খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলো। বোধহয় বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ দুটো অদ্ভুত আকৃতিতে ছোট করে ফেলে জিজ্ঞেস করল, 'কী বলেন! এই যুগে এসেও এমন ফ্যামিলি আছে?'
'হুম। তার অবশ্য কারণ আছে। আচ্ছা আমার কথা বাদ দিন। আপনি আপনার কথা বলুন। জানেন আমার মানুষের সাথে পরিচিত হতে ভালো লাগে। যদিও জানিনা ঠিকমতো মিশতে পারি কিনা। মেশার তো সুযোগই কম। তারপরও কখনো কারো সঙ্গে পরিচিত হলে আমি খুব হ্যাপি ফিল করি। আপনার নাম কি?'
আমার প্রশ্নে ভদ্রলোক হাসলেন। সম্ভবত এত ছোট বয়সী কেউ কখনো তাকে নাম জিজ্ঞেস করেনি। কিংবা আমার বলার ধরণটাই ছিল হাসি পাওয়ার মতো। সে মুচকি হাসি সমেত উত্তর দিলো, 'আমার নাম রৈনীল।'
'কী সুন্দর নাম! আমি সরণী।'
'বিজয় সরণী?'
'না। স্নেহার্ত সরণী।'
'ওহ আচ্ছা।'
ওনার জোকস বুঝতে পারলাম এতক্ষণে। আমি রাগ করার বদলে হেসে ফেললাম। তারপর বললাম, 'আমি বিজয় সরণী হতে যাবো কোন দুঃখে? হলে তো বিজয়ী সরণী হতাম।'
'আপনার বয়স কম। সেটা কথা শুনলেই বোঝা যায়।'
'কেউ এভাবে বললে আমার মন খারাপ হয়।'
'কেন?'
'আমি জানি আমার বয়স কত। সেটা বারবার মনে করিয়ে দেবার কি আছে?'
'তা ঠিক, তা ঠিক। আমি অবশ্য মানুষকে বয়স দিয়ে বিচার করিনা। আমার কাছে প্রত্যেকটা মানুষ সম্মানীত। অল্প বয়সী মানুষরাও আজকাল অনেক বড় বড় কাজ করে ফেলছে। সাকসেসফুল হচ্ছে। বয়স কোনো ফ্যাক্ট না।'
ভদ্রলোকের কথাগুলো আমাকে আনন্দিত করলো। আমি দোলনায় বসে মৃদু দোল দিতে দিতে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ মুক্তির স্বাদ পাচ্ছি। খাঁচায় বন্দী কোনো পাখিকে ছেড়ে দিলে হঠাৎ, সে কতটুকু আনন্দিত হয় তা আমাকে জিজ্ঞেস করলেই ব্যাখ্যা দিতে পারবো। এইযে চারপাশটাকে রঙিন মনে হচ্ছে, এই ছোট্ট গাছপালায় ঘেরা জায়গাটাকেই মনে হচ্ছে স্বর্গ, এর কারণ তো ওই স্বাধীনতা। স্কুল থেকে কিভাবে বাসায় ফিরতে হয়, কিভাবে রিকশার সঙ্গে দর কষাকষি করতে হয় আমি আজও জানিনা। আমি এমনকি এও জানিনা কিভাবে মুদি দোকান থেকে কেনাকাটা করতে হয়। আমার আপন গণ্ডি এতটাই ক্ষুদ্র যে, সেখানে আমার ঘরের পোষা কুকুর মাইলো ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু নেই।
ছেলেটা জানতে চাইলো, 'দোল দিবো?'
'না না। আই এম ফাইন।'
আমি বিব্রত বোধ করছি। অচেনা একটা মানুষ কেন আমায় দোল দেবে! আমি শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে ওনার সাথে আলাপ করছি। চুপচাপ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া ওইমুহুর্তে আর কোনো কাজ ছিল না। তারচেয়ে রৈনীল নামক মানুষটার সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা ঢের সুন্দর সময়ের।
রৈনীল বললো, 'স্বাগতা যদি দরজা খুলে দেখে কেউ নেই তাহলে কিন্তু ভাববে আমরা আসিই নি।'
'ওহ মাই গড! আপু যদি আবার ভাইয়াকে ফোন করে তাহলে তো সর্বনাশ। আচ্ছা চলুন দরজায় গিয়ে অপেক্ষা করি।'
রৈনীল হকচকিয়ে গেল। হাসি চেপে রেখে বলল, 'হুম চলুন।'
গেটের কাছে এসে দাড়োয়ানকে সে বলল, 'যদি স্বাগতা দরজা খুলে, বলবে আমরা দুইজন এসেছি। ঠিক আছে?'
'ঠিক আছে ছার।'
'সরণী, রাস্তায় বের হবেন?'
আমি চমকে উঠলাম। আমার জীবনে এমন আশ্চর্য হওয়ার ঘটনা খুব কম। আমি কক্ষনো এত রাতে বাড়ির বাইরে একা বের হইনি। অপরিচিত কারো সঙ্গে বের হওয়ার ব্যাপারটা নিতান্তই স্বপ্ন ছাড়া কিছু না। আমার ইচ্ছে করছে একবার বের হই। এত রাতের নির্জন রাস্তাটা দেখতে কেমন হয়, সেই কল্পনা আমার বহুদিনের। রাস্তার পাশের কুকুরদের ঘেউঘেউ শুনলে আমার বাসা থেকে সবসময় মনে হতো, ইশ! ল্যাম্পপোস্টের আলোয় না জানি কতটা সুন্দর এই রাতের নির্জন রাস্তাঘাট। যদি একবার বের হতে পারতাম। আজ সেই সুযোগটুকু পেয়ে হেলা করতে সাহস হলো না। আমার কোনো ভয় করছে না। রৈনীল জুবায়ের ভাইয়ার বন্ধু, এরচেয়ে বড় শক্তি আর কি হতে পারে!
আমি সানন্দে বললাম, 'হ্যাঁ, যাবো।'
রৈনীল বোধহয় খানিকটা চমকে উঠেছে। সে নিশ্চয়ই আশা করেনি আমি তার সঙ্গে বের হবো।
এক অদ্ভুত মায়াময় পথে এসে দাঁড়ালাম আমরা। আশেপাশের সবগুলো বাড়ির গেট বন্ধ। কোথাও কোনো মানুষ নেই। দূরে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান ঘিরে দু একজন লোকের আনাগোনা। খানিকক্ষণ পরপর একটা দুটো গাড়ি চলে যাচ্ছে। তারই মাঝে আমরা পথ হাঁটছি। আমার মনে হচ্ছে যেন আজকের রাতের এইসব অভিজ্ঞতা একেবারেই বইয়ের পাতা উঠে আসা। আমি অনেক বইতে এমন পড়েছি। বাসায় আমার বাবার বেশ বড় একটা ব্যক্তিগত লাইব্রেরি আছে। টিভি দেখার সুযোগ না পেলেও এ জীবনে অনেক বই পড়া হয়েছে আমার। সেই অর্থে আমার কাছে এই অনুভূতি গুলো নিছক কোনো বইয়ের সূচনার গল্প। আবার কেন যেন মনে হচ্ছে এটা একটা স্বপ্ন। আমার মতো কোণঠাসা মেয়েরা কী করে এমন সুন্দর স্বপ্নে প্রবেশ করে! সারাটা দিন প্রচণ্ড কষ্টে কাটানোর পর এই রাতটুকু বোধহয় আমার উপহার।
আমি হাঁটছি নীরবে। তবে আমার বুকের ভেতর কী যে অসীম আনন্দের ছড়াছড়ি। আমার প্রতিটা মুহূর্ত ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে। যেন এই মুহুর্ত জীবনে আর কক্ষনো আসবে না। সত্যিই তো আসবে না। আজকের এই রাত আমার আজীবন মনে থাকবে। এই রাতে আমি প্রথম পেয়েছি মুক্তির স্বাদ।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা চায়ের দোকানের কাছে চলে এলাম। রৈনীল দোকানীকে জিজ্ঞেস করল, 'কয়টা বাজে মামা?'
দোকানী ছোট্ট বাটন ফোন বের করে সময়টা দেখে উত্তর দিলো, 'সাড়ে এগারোটা মামা।'
আমার যেন হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। মুহুর্ত কত দ্রুত চলে যাচ্ছে। আর একটু পরেই রাত বারোটা বাজবে। আপু দরজা খুলবে। অথচ একটু আগেও আমি ছিলাম আতংকিত। আমি চেয়েছিলাম এই সময়টা দ্রুত ফুরিয়ে যাক। অথচ সেই আমিই এখন চাইছি রাতটা ধীরেধীরে চলুক। সময়টা থমকে থাক এখানেই।
রৈনীল দুই কাপ চা নিয়ে এগিয়ে এলো। আমার হাতে এক কাপ দিয়ে বললো, 'দুধ চা শেষ হয়ে গেছে।'
'আমার রং চা ই ভালো লাগে।'
চায়ে চুমুক দিয়ে বড্ড খুশি খুশি লাগছিল। টং দোকানে এবারই প্রথম চা খাওয়া আমার। একদিন সীমান্ত ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'ফুটপাতের ওই দোকানগুলোর চা কেমন খেতে ভাইয়া?'
'মজা আছে। কিন্তু তোর মজা লাগবে না।'
'কেন?'
'তুই জীবনে কোনোদিন বুয়া আর মা'র হাতের চা ছাড়া আর কারো হাতে চা খাস নাই। এজন্য ভালো লাগবে না। মনে হবে বিশ্রী। যেন গরম পানি খাচ্ছিস।'
ভাইয়ার বলা কথার সঙ্গে কোনো মিল পেলাম না। একদমই গরম পানির মতো লাগছে না। বরং চা'টা খুব রিফ্রেশিং এনার্জি দিলো আমাকে। আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
রাস্তাটা নীরব। কোথাও কোনো কোলাহল নেই। কিছুটা দূরে দূরে একটা করে ল্যাম্প জ্বলছে। হলুদ আলো নয়, সাদা আলো। তবুও ভালো লাগছে। মন চাইছে খালি পায়ে হাঁটি। সেদিকে তাকিয়ে মনেমনে কত কিছুই না করে ফেললাম আমি। হঠাৎ রৈনীল বললো, 'কোনো সমস্যা?'
'না, না।'
আমি এক টানে বাকি চা শেষ করলাম। আমার সবকিছু কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে। চায়ের কাপ ফেরত দিয়ে রৈনীল বিল দিলো। তারপর হাঁটা ধরলো বাড়ির দিকে। সবকিছু যেন ভ্রমের ভেতর ঘটছে। খানিকটা এগিয়ে এসে সে বলল, 'বসবেন এখানে?'
ফুটপাত দেখিয়ে দিলো রৈনীল। আমার বলতে ইচ্ছে করল, অবশ্যই বসবো। কিন্তু কিছু না বলে শুধু মাথা ঝাঁকালাম। ভেতরের আনন্দটুকু শুধু আমার নিজেরই থাক। ফুটপাতে বসে কয়েক সেকেন্ড বড় বড় শ্বাস নিলাম। চারপাশ মুক্ত, কোথাও কেউ নেই আমার ভুল ধরার। কেউ এসে বকা দিয়ে বলবে না, 'এটা কেন করছো? কি দরকার এখানে বসে থাকার? বা এত রাতে বাইরে কেন বের হয়েছিস?' আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। হাতে আর মিনিট বিশেক আছে। এই বিশটা মিনিট আমি মনের মতো করে উপভোগ করতে চাই। যেন আজীবন এই রাতটা আমার মনে থাকে।
.
.
.
চলবে.........................................................................