তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ০৭ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


একদিন ভরদুপুরে স্বাগতা আপু এসে হাজির। ব্যাগ ভর্তি মোটা মোটা কয়েকটা বই। বইগুলো আমার টেবিলে রেখে বলল, 'রৈনীল পাঠিয়েছে। তুই নাকি ওর কাছে বই ধার চেয়েছিস?'

আমি হকচকিয়ে বললাম, 'ইশ, আস্তে বলো। মা শুনলে আমার পিঠের ছাল থাকবে না।'

আপু যথাসম্ভব গলা নামিয়ে বললো, 'খবরদার এগুলো এখন পড়বি না। এডমিশনের পর শুরু করবি।'
'তা নাহয় করবো। কিন্তু আমি তো মজার ছলে বলেছিলাম। এতটাও সিরিয়াসলি বলিনি যে সত্যি সত্যি বই পাঠাতে হবে।'
'এগুলো শেষ হলে আবার পাঠাবে বলেছে। যত্ন নিয়ে পড়বি। আর সময় মতো ফেরত দিবি।'
'মা দেখলে আমার কিন্তু খবর করবে আপু। কি বলবো মাকে?'
'আমি বলবো এগুলো আমার বই। রেখে গেলাম। ফ্রি হয়ে একদিন এসে নিয়ে যাবো।'
'যা ইচ্ছে বলো। আমাকে উদ্ধার করো। আমি একটা সেফটিপিন পর্যন্ত আমার রুমে নিয়ে এলে মা টের পেয়ে যায়। সেখানে এতগুলো বই!'

আপু মুচকি হেসে বলল, 'বইই তো। চুরি করে ফোন তো আর চালাচ্ছিস না। এত ভয় পাবার কিছু নাই। ভাবছি তোর ভর্তিটা হয়ে গেলে তোকে কিছুদিন আমার বাসায় নিয়ে গিয়ে রাখবো।'
'সত্যি?' 

আমি চোখ বড়বড় করে আপুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। আপুর বাড়িটা আমার অসম্ভব ভালো লাগার একটা জায়গা। তার ওপর মা'য়ের দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে কয়েকটা দিন কাটানো মানেই আমার জন্য স্বর্গীয় সুখ। আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম, 'আপুরে, কাল আমার রেজাল্ট। একটু দোয়া করে দাও।'
'যা দোয়া করার আগেই করেছি। এবার হয়ে যাবে দেখিস। চাপ নিস না।'

আপু চলে গেলে আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে বইগুলো নিয়ে বসলাম। সবগুলো বই উলটে পালটে দেখলাম। ঘ্রাণ শুঁকলাম। অন্য এক আনন্দ ভর করল আমার বুকে। মনে হচ্ছে যেন বই হতে রৈনীলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে আমার ঘরময়। এখানে মিশে আছে ওর আঙুলের স্পর্শ। আমি বইগুলো ধরে বারবার ঘ্রাণ শুঁকলাম। পুরনো বইয়ের মাদকতাময় ঘ্রাণে আমি যেন বুঁদ হয়ে যাই।

পরদিন যথাসময়ে বাড়িতে থমথমে পরিবেশ। আজ রেজাল্ট বের হবে। পরীক্ষা যথেষ্ট ভালো দেয়ার পরও আমি দুশ্চিন্তায় পাগলপ্রায়। এবার যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হয়, আমি কিভাবে মায়ের সামনে দাঁড়াবো! চিন্তায় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। 

এমনই কঠিন পরিস্থিতিতে আকাশ চিড়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। সে কী উন্মাদ বৃষ্টি! চারপাশে যেদিকে তাকাই, শুধু শুভ্র জলের ছিঁটে। আকাশ কাঁপিয়ে আওয়াজ হচ্ছে। আমি চুপচাপ আমার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে হাত ছোঁয়ানোর খেলা খেলছি। ভেতরে আমার আকাশের মতোই গুরুগুরু মেঘ। আজ ভালো কিছু না হলে আমি খুব চিৎকার করে কাঁদবো। বৃষ্টি এসে ভালোই করেছে। এই শো শো শব্দে আমার কান্নার আওয়াজ ঢাকা পড়ে যাবে। 

ঠিক মিনিট পাঁচেক পর সীমান্ত ভাইয়া এসে জানালো আমি অসম্ভব ভালো ফলাফল করেছি। মা, বাবা দুজনেই খুশিতে আত্মহারা। আমার কেন যেন বিশ্বাস হলো না। ভাইয়া মজা করছে বলে মনে হচ্ছে। দুচোখ টলটলে জলে ভরে গেল আমার। এই খবর যদি মিথ্যা হয়, আমি হাজার ফোঁটা অশ্রুজল ফেলবো। আর যদি সত্যি হয়, আমি তাও অশ্রুতে ভাসবো। আজ আমার কান্নার দিন। তা হোক দুঃখ কিংবা সুখের কান্না।

ভাইয়া হাতের ফোনটা উঁচিয়ে ধরে রেজাল্ট দেখালো। নিজের চোখে দেখলাম, স্নেহার্ত সরণী। মেধাস্থান ৪৩তম। আমার দুই নয়ন আর বাঁধ মানলো না। ভাইয়া চলে যাওয়া মাত্রই বারান্দায় আসা বৃষ্টির ঝাপটায় আমি মুখ তুলে দাঁড়ালাম। 

এরমধ্যে একবারও মা আমার সামনে এলো না। আমি চিৎকার করছি। তবে কাঁদছি না। খুশিতে চিৎকার করছি। পরিবারে আমার মান রক্ষা হলো৷ 

বাবা বারান্দার দরজায় উঁকি দিয়ে হাসলেন। আমি হাসিমুখে বাবার সামনে দাঁড়ালাম। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি খুবই ভালো করেছো মা। অনেক ভালো করেছো। 
আমি কোনোকিছু না ভেবেই ফট করে বলে ফেললাম, 'বাবা আমি কি একটু ছাদে যেতে পারি?'

বাবা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে উত্তর দিলেন, 'আচ্ছা যাও।'
আমি খুশিতে ঝলমল করতে করতে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। 'থ্যাংকিউ বাবা। আমি খুব খুশি হয়েছি।'

রুম থেকে বের হয়ে আশেপাশে মাকে খুঁজলাম। খুব সম্ভবত নিজের ঘরেই আছে। আমি দ্রুত পায়ে বের হয়ে চলে এলাম ছাদে। লিফটে উঠে টপ ফ্লোরে চাপ দিয়ে বুকটা আমার দুরুদুরু করে কাঁপছিল। ছাদের দরজা খুলতেই মন থেকে সমস্ত মেঘ কেটে গেলো। খুশির বর্ষণে ভিজে গেলাম আমি। দৌড়ে এসে দুই হাত মেলে আকাশের দিকে মুখ করে হা করে বৃষ্টির পানি মুখের ভেতর নিচ্ছিলাম। আহ আনন্দ! কী যে নির্মল আনন্দ। এই আনন্দের তুলনা হয়না জাগতিক কোনোকিছুর সঙ্গে। আমার বুক থেকে দুঃখের ভার মাটিতে নেমে গেছে। সেই ভার ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টির জলে৷ 

কতক্ষণ ভিজেছি খেয়াল নেই। ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি রীতিমতো। ছুটে এসে সিঁড়ি নিয়ে নামতে লাগলাম। ভেজা কাপড়ে লিফটে উঠতে ইচ্ছে করলো না। বাসায় ঢোকার পরে আজ অন্তত বকা শুনতে হবে না, সেই আনন্দে আমি তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছি। 

মায়ের সঙ্গে মুখোমুখি হলাম। মা কিছু বললেন না। চোখে কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস। আমি ওনাকে না জানিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছি তা বোধহয় হজম করতে কষ্ট হচ্ছে মায়ের। নিজের রুমে এসে জামাকাপড় বদলে কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়লাম। আরামে, আনন্দে, তৃপ্তিতে ভীষণ শান্তির ঘুম নেমে এলো চোখে। 

দিন কয়েক পরে একদিন স্বাগতা আপু বাসায় এলো। এরমধ্যে তেমন ঘটনাবহুল কিছুই ঘটেনি আমার জীবনে। আপু এসে মাকে রীতিমতো শাসন করে আমাকে ওর বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য জেদ করতে লাগলো। আমি দারুণ মজা পাচ্ছি। মা তেমন কিছু বলার সুযোগ পায়নি। আপু হড়বড় করে অনেক কিছু বলে এক পর্যায়ে মাকে রাজি করিয়ে ফেললো। আমাকে বলল, 'জামাকাপড় কয়েকটা নিয়ে ফেল। আর তেমন কিছু নিতে হবেনা।'

আমি জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে ঘামছিলাম। একা কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি তা নিজেরই বিশ্বাস হতে চাইছে না। তাও আবার কয়েক দিনের জন্য! আজকাল আমার সঙ্গে খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার ঘটছে। জীবনে নিত্যই যুক্ত হচ্ছে নতুনত্ব। 

আপুর বাসায় এসে নিজের জন্য চমৎকার একটা রুম পেয়ে গেলাম। সাজানো গোছানো বিশালাকার রুমটা কয়েকদিনের জন্য আমার। যেন বহুকাল পরে কোথাও ঘুরতে এসেছি আমি। ব্যাগ রেখেই আরাম করে শুয়ে পড়লাম। খানিকক্ষণ এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করে জানালা খুলে চেয়ে রইলাম বাইরের পানে। এরমধ্যেই আপু নাস্তা খেতে ডাক দিলো। 

পুরোটা বিকেল আমি আর আপু আড্ডা, দুষ্টুমি, খাওয়াদাওয়া আর আনন্দ করেই কাটালাম। রাত নয়টার দিকে আপু বললো, 'চল বাইরে যাই। রেডি হয়ে নে ঝটপট।'

বুকের ভেতর এক ঝাঁক আনন্দ ডানা ঝাপটালো। আমি একের পর এক এত আনন্দের জোয়ার সামলে উঠতে পারছিলাম না। অল্পতেই স্তব্ধ হয়ে পড়ছি। কোনোমত একটা কামিজ পরে হালকা সেজেগুজে বের হলাম। আপু একটা রিকশা ডাকলো।

রিকশায় বসেই আমার নিজেকে মুক্ত আকাশের পাখি বলে মনে হচ্ছিল। গত কিছুদিন আগে আপুর বাসায় কাটানো রাতটা এতটাই প্রশান্তির ছিল যে, আবারও কয়েকটা রাত সেরকমভাবে কাটাতে পারবো ভেবেই আমি আহ্লাদে আটখানা। তার ওপর আজ রাতে বাইরে ঘুরতে বের হওয়াটা আমার জন্য স্বপ্নের মতো। 

নান্দনিকভাবে সাজানো একটি রেস্তোরাঁয় চলে এলাম। রুফটপ রেস্টুরেন্ট। অসংখ্য গাছপালা, লতাপাতার সমারোহ। কিছুক্ষণ আমি একা একা ঘুরে দেখলাম। এসে দেখি জুবায়ের ভাইয়া চলে এসেছে। আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে ভাইয়া বললো, 'কেমন আছে আমার লক্ষী বোনটা?'
'খুবই ভালো। আমার মনে হচ্ছে আমি ঠিক স্বর্গে আছি।'
'তোমার স্বর্গ দীর্ঘস্থায়ী হোক।'
'থ্যাংকিউ ভাইয়া।' 

আমাকে নিজের পছন্দের খাবার অর্ডার দিতে বলা হলো। ইতস্তত বোধ করছিলাম। আপু বললো, 'আজ তোর যা যা পছন্দ সব অর্ডার দে। আইসক্রিম, কোল্ড কফি যা ইচ্ছে খা।'
আমি অর্ডার দিয়ে আরও একবার হাঁটতে বের হলাম। সবসময় মা বাবার সঙ্গে এসে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা আমিটা আজ নিজের মতো এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে শ্বাস নিচ্ছি। কোথাও বসে চুপ করে নিজের কথা ভাবার অবকাশ পাচ্ছি। এটুকুই আমার জন্য বিশাল আনন্দের। 

গুণগুণ করে গান গাইছিলাম। স্বাগতা আপু এসে বলল, 'তোর কয়েকটা ছবি তুলে দেই দাড়া।'

অনেক গুলো সুন্দর ছবি তুলে ফেললো আপু। দেখে আনন্দ হলো। কিন্তু এই ছবি দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই। আমার একটা পিসি আছে। তাতে হয়তো জমা করে রাখতে পারবো। ভবিষ্যতে গিয়ে দেখতে পারবো আজকের দিনের এইসব রঙিন স্মৃতি। 

আজ রাতেও খুব ভালো ঘুম হলো আমার। আরাম করে ঘুমিয়েছি। সকাল সকাল আপু একসঙ্গে চা খাওয়ার জন্য ডেকে দিলো। চা খেতে উঠে দেখি রৈনীল এসেছে! চোখেমুখে ঘুম লেগে থাকা উশকো খুশকো আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। 
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp