প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে ডুবে আছি। এরমধ্যে স্বাগতা আপুর ফোন। ভাইয়ার জন্মদিনে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য একটা পার্টির আয়োজন করেছে, সেখানে যেতে হবে। আমি কিছুতেই যাওয়ার অবস্থায় নেই। কিন্তু আপু নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। সাজগোজ করতে একদমই ইচ্ছে করছে না। হালকা ভ্যাসলিন ঠোঁটে লাগিয়ে বের হলাম আপুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বাড়ি থেকে একা বের হওয়ার অনুমতি নেই। খুব জরুরি কাজ ছাড়া আমি এমনিতেও বাইরে যাই না। সেই জরুরি কাজটাও হয় আম্মুর সঙ্গে নয়তো ভাইয়া সঙ্গে করে নিয়ে যায়। ভার্সিটির এডমিশন যুদ্ধে ভাগ্য এখনো সুপ্রসন্ন হয়নি। হলে হয়তোবা কিছুটা ছাড়া মিলবে।
আজকেও ভাইয়া সঙ্গে নিয়ে বের হয়েছে। আমাদের ড্রাইভার অনেক বছরের পুরনো। তবুও মা আমাকে ড্রাইভারকে নিয়ে গাড়ি বের করতে দেয় না। আমার মায়ের সন্দেহ হিমালয়ের উচ্চতাকেও হার মানায়।
স্বাগতা আপুর বাসাটা আমার ভালো লাগে। খোলামেলা, নিশ্বাস নেয়ার মতো স্পেস আছে। ঢাকা শহরের গতানুগতিক বাড়ির মতো নয়। আপুর রুচিশীল হাতের ছোঁয়ায় বাড়ির রূপ আরো বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। সবসময় এ জায়গাটায় এলে শান্তি শান্তি লাগে। তবুও আজ একদমই আসার ইচ্ছে ছিল না। এমন প্রচণ্ড মন খারাপের মুহুর্তে কোনো কোলাহল মানানসই নয়। একগাদা ছেলেমেয়েরা ধেই ধেই করে গান বাজনা, হাসাহাসি করবে আর আমি সিগারেটের অ্যাস্ট্রের মতো সবার অবশিষ্ট ছাইটুকু নিয়ে পড়ে থাকবো তা তো হয় না।
বাড়ির গেটে নামিয়ে দিয়ে ভাইয়া বলল, 'সরণী, আমি একটা কাজে যাচ্ছি। পার্টি শেষ হলে আমাকে ফোন দিতে পারবি না? আমি তখন এসে তোকে নিয়ে যাবো।'
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এমন ঘটনা আমার সঙ্গে অতীতে কখনো ঘটেনি। স্বাগতা আপুর বাসাতেও আম্মু অথবা ভাইয়া ছাড়া আমি কখনো আসিনি। তার ওপর আজকে পার্টি, অনেকেই আসবে। এরমধ্যে ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে এটা নিছক স্বপ্নের মতো। পুরো পরিবার আমার দিকে সবসময় গুলির মতো নজর তাক করে রাখে কেবল আমার কোনো দোষের অপেক্ষায়। এই বুঝি আমি কিছু করবো অমনি টুপ করে গুলির মতো বুলি ছুড়বে। অথচ আজকের দৃশ্য একেবারেই ভিন্ন। আমি আশ্চর্য হওয়ার ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখে উত্তর দিলাম, 'ঠিক আছে।'
ভেবেছিলাম ভাইয়া গাড়ি রেখে যাবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে সীমান্ত ভাইয়া গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। শরীরে এক ধরনের আনন্দ ঢেউ খেলে গেলো। আজ কিছুটা সময় একান্তই নিজের মতো কাটাতে পারবো ভেবে আমার স্বস্তিতে বুক ভরে যাচ্ছে। কয়েকবার বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে আমি ছোট্ট সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম। হঠাৎ করেই টের পেলাম, বুকের ভেতর থেকে দুঃখের ভার খানিকটা হালকা অনুভূত হচ্ছে।
কলিং বেল চাপ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় পাশ থেকে একজন বলে উঠলো, 'আমিও কয়েকবার চেপেছি। কেউ খুলছে না। নাম্বার থাকলে কল দিন।'
চমকে উঠলাম আমি। পুরুষ মানুষের গলা শুনে চমকানোই তো স্বাভাবিক। আশেপাশে আর কেউ নেই। দূরে দাঁড়িয়ে আছে দাড়োয়ান। তাও অন্যমনস্ক হয়ে।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, 'আপনি কি স্বাগতা আপুর গেস্ট?'
'হুম।'
'আপু দরজা খুলছে না?'
'এটা দরজা না গেট?'
'বাড়ির মেইন গেট।'
'কয়েকবার বেল টিপলাম। কেউ তো এলো না। দাড়োয়ানও কিছু বলতে পারলো না। এজন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি।'
আমি ইতস্তত বোধ করলাম। আমার পরিবারে সিগারেট খাওয়া বারণ। ভাইয়াও কখনো সিগারেট খায়নি। সিগারেট থেকে উৎসারিত উৎকট গন্ধটার সঙ্গে আমি তেমন একটা পরিচিত নই। এ কারণেই বোধহয় কয়েক সেকেন্ডেই আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। তড়িঘড়ি করে বললাম, 'প্লিজ এটা বন্ধ করুন।'
'সরি, কি বন্ধ করবো?'
'আপনার সিগারেটটা খাওয়া বন্ধ করুন। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।'
'ওহ হো। সরি।'
ছেলেটা ঝটপট সিগারেট হাত থেকে ফেলে দিয়ে পায়ের এক ডলায় নিভিয়ে ফেললো আগুন। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না।
ছেলেটা বা লোকটা যা ই বলিনা কেন, সে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কাছে কোনো ফোন নেই। আমার পরিবারে অনার্সে ভর্তি হবার আগে ফোন ইউজ করা নিষেধ। জরুরি সমস্ত কল আম্মুর ফোন দিয়েই সারতে হয়। আজ স্বাগতা আপু আম্মুর ফোনেই কল দিয়েছে। এরকম যেকোনো কাজে আমাকে আম্মুর মাধ্যমে দাওয়াত পাঠানো হয়। আজকালকার যুগে, ঊনিশ বছর বয়সী একটা মেয়ের ফোন নেই; এটা কেউই বিশ্বাস করবে না। কিন্তু সত্যিই আমার কোনো ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নেই।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্তবোধ করলাম। আপুর কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই! আমাকে আসতে বলে এভাবে দরজা বন্ধ করে বসে থাকার কোনো মানে হয়!
আমি দাড়োয়ানের কাছে এসে বললাম আপুকে একবার কল দিতে। সে দাঁত কেলিয়ে উত্তর দিলো, আপায় কইছে কল না দিতে। কল দিলে ভাইজান টের পাইয়া যাইবো আমনেরা আইছেন। এইজন্য সবাইরে এইখানে খাড়ায়া থাকতে কইছে।
'মানে!'
আমি অসহায় অনুভব করলাম। ভাইয়া আমাকে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করিয়ে তবেই যেতে পারতো। এ কারণেই বোধহয় আম্মু আমাকে কোথাও একা ছাড়ে না।
তবে মুহুর্তেই এই ভয়টা কেটে গিয়ে আনন্দে রূপ নিলো। আজীবন পরিবারের সঙ্গে চলাফেরা করতে করতে আমি যেন নিজের স্বকীয়তা টুকুও হারিয়ে ফেলেছি। আমার নিজের বলতে আছেটা কি! এইযে সাধারণ একটা ঘটনাতেও আমি অসহায় অনুভব করছি, এর কোনো মানে হয়?
এটা এক ধরনের এডভেঞ্চারাস ব্যাপার ভেবে পুলকিত হলাম। দাঁড়িয়ে রইলাম দাড়োয়ানেরই পাশে। আমার মা সবসময় বলেন, "কোনো কোনো সিচুয়েশনে অপরিচিত ভদ্রলোকের চাইতে পরিচিত অভদ্রলোক ভালো।"
সেখানে এই দাড়োয়ান ঢের ভদ্রগোছের মানুষ।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ দরজার সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের ইশারা চোখে পড়লো। সে হাতের ইশারায় আমাকে ডাকছে। প্রথমে কয়েকবার মনে হলো যাবো না। পরক্ষণে কী মনে করে এগিয়ে এলাম।
সে জানতে চাইল, 'দাড়োয়ান কি বললো?'
'আপু ফোন করতে নিষেধ করেছে। আপনি কি আপুকে ফোন করেননি?'
'আমার ফোন সঙ্গে নেই। বাসায় চার্জে দিয়ে এসেছি। ও দরজা খুলবে না সেটা তো আর জানতাম না।'
'এখন কয়টা বাজে?'
'জানিনা। ঘড়িও নেই।'
'আমার যতদূর মনে হয় আপু বারোটার আগমুহূর্তে দরজা খুলবে। এর আগেও এরকমই করেছিল। মানে ঠিক রাত বারোটায় সবাইকে আসতে বলেছিল।'
ভদ্রলোক মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, 'ওহ আচ্ছা। স্বাগতা আপনার কেমন আপু?'
'কাজিন। তবে আপন বোনের মতোই আমরা। একসঙ্গে বড় হয়েছি। আপুর তো মা নেই, আমার মাকে মা বলে ডাকে।'
'স্বাগতা তো বিদেশে বড় হয়েছে। আপনিও?'
'না, না। আমি কখনো বিদেশে যাইই নি।'
কথাটা বলতেই আমার বড্ড হাসি পেলো। ফিক করে হেসেও ফেললাম। ছেলেটা আমার দেখাদেখি হেসে বলল, 'আমি জোবায়েরের কলিগ। তবে খুব ভালো বন্ধু আমরা। স্বাগতাকে ছোট বোনের চোখেই দেখি। ও একটু আগে ফোন করে বললো ভাইয়া আপনাকে আসতেই হবে। কী আর করার..'
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে শুধু উত্তর দিলাম, 'ওহ আচ্ছা।'
স্বাগতা আপুর স্বামীর নাম জোবায়ের। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চ পদে চাকরি করেন। বাবা মা দুজনেই আছেন দেশের বাইরে। বিদেশে থাকা অবস্থাতেই আপুর সঙ্গে ভাইয়ার পরিচয় হয়। দুজনেই কী ভেবে যেন দেশে বসবাসের পরিকল্পনা করে ফেললো। এরপর দেশে এসে বিয়ে, একসঙ্গে থাকা। ভাইয়ার এত বড় বাড়িটাতে শুধু ওরা দুজনই থাকে। জোবায়ের ভাইয়া ভীষণ ভালো মনের মানুষ। স্বাগতা আপুও মানুষ হিসেবে দারুণ। আর দুজনেই দারুণ বলে হয়তো উন্নত দেশ ছেড়ে নিজের জন্মভূমিতে ফিরে এসেছে।
আমি এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বলে ফেললাম, 'আমার কখনো বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।'
ভাইয়ার বন্ধু চমকে উঠে জানতে চাইল, 'ঘুরতে নাকি থাকতে?'
'থাকতে। আমি কখনো বিদেশে গিয়ে বসবাস করবো না। আমি দেশে থাকবো।'
'ভালো। সুন্দর সিদ্ধান্ত।'
ছেলেটা অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। আমি বিরক্ত বোধ করলাম। এমন চমৎকার একটা বিষয় নিয়ে কথা শুরু করলাম অথচ কোনো আগ্রহই দেখালো না! কী অদ্ভুত। আমিও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলাম।
খানিকক্ষণ পর ছেলেটা দাড়োয়ানের কাছে জানতে চাইল, 'কয়টা বাজে ভাই?'
'পৌনে এগারোটা।'
'আর কেউ আসবে না নাকি!'
সে এদিক সেদিক মুখ ঘুরিয়ে আমাকে বলল, 'চলুন ওদিকটায় যাই?'
তার দেখিয়ে দেয়া দিকটা নিঃসন্দেহে সুন্দর জায়গা। এ বাড়িটার সামনে প্রচুর গাছগাছালি। লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু আমার মনের ভেতর মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সন্দেহের বীজ রয়ে গেছে। এখানে আম্মু থাকলে ওদিকে যাওয়া তো দূরের কথা, লোকটার সঙ্গে কথাই বলতে দিতো না।
আমাকে উদভ্রান্তের মতো চেয়ে থাকতে দেখে সে আবারও প্রশ্ন করে বসলো, 'কোনো সমস্যা?'
'না না।'
চক্ষুলজ্জা এড়াতে আমি 'না' বললাম ঠিকই। কিন্তু আমার মনে বিস্তর সন্দেহের মাঠ। তা সত্ত্বেও আমি পা বাড়ালাম। আমার কেন যেন এই ভদ্রলোকের সঙ্গে ওদিকে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। লোকটার বিশ্বাসী চেহারা, জোবায়ের ভাইয়ের কলিগ হতে পারার মতো সৌভাগ্য আর অসাধারণ কথা বলার ভঙ্গীমাই বোধহয় আমার মনে এই ইচ্ছার জন্ম দিয়েছে। ভদ্রলোকের পাশাপাশি চলতে চলতে খুবই আত্মবিশ্বাসী চেহারা ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। সে যেন কোনোভাবেই বুঝতে না পারে, আমি নার্ভাস বোধ করছি।
.
.
.
চলবে........................................................................