ঘড়ির কাঁটায় রাত এখন ঠিক বারোটা বাজতে দুই মিনিট বাকি। হঠাৎ তাহমির মৃদু আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো সহনের। এমনিতে ঘুম পাতলা ছিল। চোখ মেলে তাকিয়ে পাশে তাহমিকে না দেখতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সে। বাতি জ্বেলে দেখল পুরো ঘরে তাহমি নেই । আওয়াজটা তবে বেলকনি থেকে এসেছিল ভেবে সেদিকে এগিয়ে গেলো সহন। সামনে নজর বুলিয়ে দেখার আগেই রুমে অন্ধকার নেমে এলো। চমকাল সহন। কী হচ্ছে তার সাথে? আর তাহমি কোথায়? সবাই ঠিক আছে তো! এরমধ্যেই দেয়ালঘড়ির টিকটিক আওয়াজে কান খাড়া হয়ে যায় সহনের। রাত বারোটা বেজেছে,ঘড়িটা তেমনই জানান দিলো। সহসা চোখের সামনে একটা মোমবাতি জ্বলে উঠলো সহনের। তারপর দুটো থেকে তিনটে, তিনটে থেকে চারটে! বেলকনিতে মোমবাতির আলোর সৌন্দর্যে এবার সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো সহনের সামনে। তাহমি ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে চলেছে,
" হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার সহন..."
সহন থমকে গেছে তাহমির পাগলামিতে। ছোটো টেবিলের উপর রাখা আছে সহনের ফেভারিট চকলেট ফ্লেভারের কেক। সাথে কিছু লাল রঙের বেলুন আছে সাজানো। বেলকনির ফ্লোরেও সাদা ও নীল রঙের বেলুনের ছড়াছড়ি। কেকটার উপর সুন্দর করে লেখা আছে,
❝ তোমার প্রতিটি জন্মদিন যেনো তোমার বউয়ের হাতের কেক খেয়েই কাটে!❞
" তাহমি! ভাই রে ভাই তুই এসব করেছিস! "
সহন কিছু বলতে পারলো না। তাহমিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
" ভাই না বউ হবে! যাগগে এসব পরে করবি চল আগে কেক কেটে নিবি। খেয়ে বল কেমন হয়েছে। "
সহন ছাড়লো না। জড়িয়ে ধরে রেখেই শুধালো,
" তুই বানিয়েছিস কেক?"
" হুম। "
তাহমি মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। সহন আঁতকে উঠলো তাতে। পুরনো দূর্ঘটনাটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার।
" তুই একা একা আবারও রান্নাঘরে গিয়েছিলি? যদি আবারও কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেতো!"
" শান্ত হ প্লিজ। একবার অঘটন ঘটেছে বলে কী বারবার ঘটবে? তাছাড়া আমি ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি। ওড়না সাবধানে পেচিয়ে রেখে কাজ করেছি। এখন ছাড় আমাকে। কেক কাটতে হবে না? "
তাহমি একপ্রকার সহনকে সরিয়ে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। সহনের ভীষণ খুশি লাগছে। প্রিয় মানুষটি জন্মদিনে এভাবে সারপ্রাইজ দিলে সবারই ভালো লাগে। তাহমি সহনকে নিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড় করলো। সহন ফু দিয়ে একে একে সবগুলো মোমবাতি নিভিয়ে ফেলেছে। তাহমি আস্তে আস্তে হাতে তালি দিয়ে উইশ করে যাচ্ছে। এরমধ্যেই ইলেকট্রিক রঙিন লাইট জ্বলতে শুরু করেছে বারান্দায়। কী সুন্দর একটা পরিবেশ!
" এতকিছু কখন করলি! আমি কিছু টের পেলামও না।"
সহন বিস্ময় নিয়ে শুধালো তাহমিকে। তাহমি তাড়া দিলো।
" সেসব পরে আগে কেক কাটতে শুরু কর। "
" ওকে। "
সহন কেক কাটলো। প্রথমে তাহমিকে এক টুকরো কেক খাইয়ে দিয়ে তারপর নিজেও খেলো। তাহমিও খাইয়ে দিলো কেক সহনকে।
" সাড়ে বারোটা বাজল প্রায়। এখনও কি আমি তোমার সাথে বসে থাকবো? ঘুমুতে হবে না? "
অনিমা আয়ানের কোলে বসেই এতক্ষণ ধরে বকবক করে যাচ্ছে। বেচারার উরুতে ব্যথা হয়ে গেছে। ধমক দিতেও পারছে না আর বকলেও ঝামেলা। এখন অনিমা কাঁদা শুরু করলে আরেক বিপত্তি বাঁধবে। এতো ছোটো মেয়ের সাথে মানুষ কেমনে প্রেম করে সেসব ভাবতে গেলেও নিজেকে আসল বলদ মনে হচ্ছে আয়ানের। অনিমা ধীরে সুস্থে এবার কোল থেকে নেমে বিছানায় বসলো। ঘুম এসেছে মেয়েটার চোখে। চোখমুখ দেখেই সেটা বুঝতে পারছে আয়ান। বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আয়ানের এক হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে তার পাশেই শুইয়ে দিলো অনিমা।
" শোনো না, আমি একটু তোমাকে জড়িয়ে ঘুমাই তারপর তুমি যেও পরে।"
আহ্লাদী স্বরে বললো অনিমা। আয়ান গেলো তাতে চটে।
" তোমার যে মাথার স্ক্রু ঢিলা সেটা জানতাম কিন্তু ঢিলার বদলে যে সবগুলো যে ড্যামেজ সেটা আজকে বুঝতে পারছি এখন। একটা পুরুষ মানুষকে কোনো ভয়ডর নেই! আর না আছে কোনো বাবার ভয়।"
অনিমা আয়ানের কথায় পাত্তা দিলো না। আস্তে করে আয়ানের বুকের উপর মাথা রেখে আয়ানের বুকের উপর আবার হাত রাখল। আয়ান কিঞ্চিৎ নড়ে উঠলো তাতে। নিশুতি রাতে, ফাঁকা ঘরে একটা মেয়ে এত কাছাকাছি থাকলে নিজেকে কত কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেটা বুঝতে পারছে আয়ান। তার উপর যদি মেয়েটি ভালোবাসার মানুষ হয় তাহলে তো বেয়ারা মন কথাই শুনতে চায় না। এই মেয়ে কি তা বোঝে? শুধু তা থৈথৈ করতে জানে। যা-ও মাঝখানে ধমক খেয়ে শান্ত হয়ে গেছিল এখন তো পুরোদমে ক্ষেপেছে আবার।
" তুমি চুপ করো তো। কীসের ভয় তোমাকে? কেমন একটা লোক! কোথায় এখন নিজে থেকে দুষ্টমি করবা,দু'একটা রসাল চুম্মচাটি দিবা! তা না করে শাষণ করো কেন? জন্মের সময় কি মা মুখে মধু দেননি? "
অনিমা বুকে নাক ডুবিয়ে দিয়ে আয়ানের শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছে। তপ্ত নিঃশ্বাসে আয়ান এদিকে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই মেয়েকে সেসব বলতে গেলে আরও পেয়ে বসবে। আয়ান গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
" আমার মুখে মধু দেননি আসলেই। আর নিজের ভেতরের মধু এখন জমিয়ে রাখো। অনিমা এসব করার বয়স হয়নি তোমার। এইচএসসি পরীক্ষা যাক তারপর সব হবে। আর এখন থেকে তোমার সো কলড বান্ধবীদের সাথে চলাফেরা করবা না। কতগুলো অকালপক্ব! "
" চুপ করো বললাম আবারও হুহ্। এসব নরমাল বিষয়। প্রেম করলে করতেই পারে। যার যার পারসোনাল বিষয়। যদিও আমি ইন্টিমেট হওয়া সাপোর্ট করি না বাট আদর তো করাই যায় বলো?"
আয়ান অনিমার কথায় লজ্জা পাবে নাকি রাগ করবে বুঝতে পারছে না। এতটুকু মেয়ে কীসব বলছে! এগুলো করাই যায়?
" এসব শেখো স্কুলে গিয়ে? যখন ছেলেগুলো সবকিছু লুটেপুটে খেয়ে চলে যাবে তখন তোমার বান্ধবীরা বুঝবে মজা। এরা মজা নিতে আসে দায়িত্ব নিতে না। ধুর! কাকে কী বোঝাচ্ছি আমি। সরো তো বাল আমি বাসায় যাবো। এরকম করলে কিন্তু আর কখনো ডাকলেও আসবো না অনিমা।"
আয়ানের নীরব হুমকিতে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো অনিমা। খানিকক্ষণ চুপ থেকে দূরে সরে শুয়ে বললো,
" ঠিক আছে যাও আর সাবধানে যেও। শুভ রাত্রি। "
আয়ান হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দ্রুত উঠে দাঁড়ালো সে। জানালার দিকে এগিয়ে গেলো কয়েক কদমে। কিন্তু আবারও পেছনে ফিরে তাকালো একবার। মেয়েটা এরমধ্যে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। আয়ান দ্রুত পা ফেলে অনিমার পাশে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আবারও জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অনিমা ইচ্ছে করে চোখ বন্ধ করে চুপ করে আছে। কারণ তাকিয়ে থাকলে এই ছোঁয়াটুকু তার জুটতো না।
" তৃষা আই এম সরি ডিয়ার। প্লিজ বইগুলো নাও। সামনে তোমার পরীক্ষা। না পড়লে কীভাবে হবে? "
পড়ার টেবিলে বসে তৃষা ফোনে পিডিএফ দেখে পড়ছে। বই ছিঁড়ে ফেলার পর বিভিন্নভাবে খোঁজাখুঁজি করে পিডিএফ যোগাড় করেছিল। রাতে বাসায় ফেরার সময় অনিক আবার বই কিনে নিয়ে এসেছে। তৃষাকে অনেকবার সাধার পরেও সে বইগুলো ছুঁয়ে অবধি দেখেনি।
" আপনাকে সেসব ভাবতে হবে না। রাত একটার বেশি বাজতে চললো,আপনি ঘুমাতে যান ডাক্তার সাহেব। আমার পড়া শেষ হলে আমি ঘুমাবো। আর যদি অন্য কিছু প্রয়োজন হয় তবে চলুন, আপনার প্রয়োজন মিটিয়ে তারপর আমি পড়তে বসবো আবারও। "
তৃষার ভাবলেশহীন কথাগুলো অনিকের বুকে তীরের মতো বিঁধল। অনিক নিজেও তো চায় না ওরকম করতে। কিন্তু হুটহাট পুরনো স্মৃতিগুলো এসে সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। মনে হয় তৃষাও হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা যাবে। আগে সমস্যাটা সামলে নিতে পারতো অনিক। কিন্তু বিয়ের পর তো তৃষা কাছে আসায় ভয়টা বেড়ে গেছে। তৃষা তো জানে তার অতীত। তবুও কেনো বোঝে না? এ পৃথিবীতে কি কেউ কাউকে বোঝে না? অনিক তৃষার পায়ের কাছে ফ্লোরে বসে পড়লো। বইগুলোও ফ্লোরে রাখা। তৃষা চমকাল খানিকটা। অনিকের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই ভীষণ মায়া লাগছে তৃষার। মানুষটা কি এরকমই? না-কি কোনো সমস্যা হচ্ছে তার?
" তৃষা এভাবে বলো কেনো? আমি কি শুধু শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি? বিশ্বাস করো তৃষা আমি চাই না তোমাকে কষ্ট দিতে। তবুও দিয়ে ফেলি!"
অনিকের অসহায়ত্ব তৃষাকে আঘাত করছে হৃদয়ে। তৃষাও চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।
.
.
.
চলবে...........................