শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৫১ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


সন্ধ্যার আজান পড়েছে মাত্রই। রাজশাহী হতে দু'দিনের ব্যবসায়ীক ভ্রমণ শেষ করে ফিরছে তন্ময়। গাড়িটা এখনো মাঝরাস্তায়। বাড়িতে পৌঁছাতে এখনো ত্রিশ মিনিটের পথ বাকি। তার ম্যানেজার সুমন নিস্তব্ধতা বজায় রেখে ড্রাইভ করছে। ওপরে বিদ্যমান কার-মিরোরে ক্ষণেক্ষণে আড়চোখে একপলক তন্ময়কে দেখে নিচ্ছে। গলাটা ভিজিয়ে নীরবতা ভেঙে সুমন থতমত কণ্ঠে আওড়ায়, 

 'স্যার, আমার কি যেতেই হবে আপনার সাথে? না গেলে হয় না? জানেনই তো বড়ো স্যার আমায় দু'চোখে দেখতে পারেন না। কটমট করে চেয়ে থাকেন। পারলে আমার গ লা কেঁটে তরল র ক্ত পান করতেন। আপনার জন্য আমি এখনো বেঁচে আছি।'

এতটুকু বলে থামে সে। বাকিটুকু মনের কথা মনের মধ্যেই আওড়ে বসে, 'আবার আপনার জন্যই আমার জান-টা কবজ হওয়ার রাস্তায় পড়ে আছে। কোন দুঃখী কপাল নিয়ে যে আপনাদের বিবাহদিনে ছিলাম! না থাকতাম– না আজ এই জ্বালা বয়ে বেড়াতাম।'

তন্ময় মৃদু হাসে। ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকায়। সুমনের ব্যস্ত মুখমণ্ডল দেখে একনজর। পুনরায় ল্যাপটপ স্ক্রিনে দৃষ্টি রাখে। কীবোর্ডে আঙুল চালাতে ব্যস্ত থেকেই বলে,

'আচ্ছা, যেও না। ইউ'ভ ওয়ার্কড হার্ড। থ্যাংকিউ। কাল ছুটি নাও।'

সুমনের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। চোখদুটোতে নক্ষত্র ঘুরেফিরে। গদগদ ভাব কণ্ঠে উপচে পড়ে,

'ধন্যবাদ, স্যার।'

ম্যাসেজ টুনের ধ্বনিতে সেলফোনটা হাতে তুলে নেয় তন্ময়। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সহস্র আনরিড ম্যাসেজেস। বন্ধুবান্ধবদের সিলেট ট্যুরের প্রতি আশ্চর্যজনক আগ্রহ জন্মেছে এবারে। ওদের মধ্যে এতটা আগ্রহ, উন্মাদনা–উত্তেজনা এই প্রথম দেখছে তন্ময়। পূর্বেও সবাই মিলে বিভিন্ন জায়গার ট্যুর দিয়েছে। প্রফুল্লহৃদয়ে উপভোগ করেছে একেকটি মুহূর্ত। তবে এমন আগ্রহবোধে ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলার মতন অবস্থা পূর্বে তো ঘটেনি। ইতোমধ্যে আবহাওয়ার আগাম হাবভাবে গবেষণা শুরু করেছে একেকজন। আবহাওয়ার গুঞ্জন উপলব্ধি করে দিন – তারিখ এবং সময় নির্ধারণ করতে শুরু করেছে। 

মাহিন সন্ধ্যার পরপর কল করেছে চার বার। তন্ময় ব্যস্ত থাকায় রিসিভ করতে পারিনি। এযাত্রায় কল ব্যাক করল। মাহিন ধরেছে ততক্ষণাৎ। ফোনের ওপাশ হতে বেশ কয়েকটি দুষ্টু কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। সবগুলো বদমায়েশ একসাথে নির্ঘাত! তন্ময়ের আন্দাজ সঠিক করে রিহান উচ্চ গলায় বলে ওঠল,

'বিবাহিত ব্যাচেলর, শাহ্জাহান তন্ময় চাচা! আপনি কোথায়? আপনার মুখটা আমাদের একটু দর্শন করিয়ে যান, প্লিজ! আপনার চেহারা না দেখে একগ্লাস পানি গেলা সম্ভব হচ্ছে না! তৃষ্ণায় ধুকপুক করছে বুক, ইষৎ কাঁপছে—'

রিহানের বাক্যগুলোর পূর্ণতা মিলল না। মাহিন ঠাট্টার সুরে ওকে মাঝপথেই থামিয়ে শুধাল, 

'আপনার ইষৎ যা কাঁপছে সেটি সম্পর্কে জানতে আমরা আগ্রহবোধ করছি না।'

রিহানের মুখজুড়ে মেঘ ঘনিয়ে এলো। থেমে যাবার পাত্র সে নয়। মুহূর্তেই পাল্টা আক্রমণীয় গলায় জবাবে বলে বসল, 

'আমার কী কাঁপছে সেটি জানতে তুই আগ্রহবোধ করবি কেন, শালা? তুই কি গে?'
'গে নই বলেই শুনতে চাচ্ছি না।'

রিহানের জবাব শোনার মত মস্তিষ্ক তন্ময়ের আপাতত নেই। সে লং জার্নি করে ফিরছে কেবলই। প্রচণ্ড টায়ার্ড। শরীরের একেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ম্যাঁচম্যাঁচ করছে। বন্ধুদের ঝগড়া শোনার মেজাজ এখন নেই। সে ধীরেসুস্থে বিনা-বিনয়ী গলায় বলে,

'স্টপ ইট। কাজের কথা বল। কল কেঁটে দেব।'

ঝগড়া থামল বুঝি? ক্ষণিকের জন্য থেমেছিল সত্যি। পরমুহূর্তেই নিম্নস্বরে রসিকতা শুরু হলো। শুনশান নীরবতায় দুষ্টু গলায় মাহিন প্রশ্ন করল,

'বাসায় ফিরিসনি এখনো? এরজন্যই ফায়ার হয়ে আছিস। বউয়ের থোবড়া দেখা না অবদি তোর মুখে দিয়ে ভালো কথা আসবে না। রাতে কল দিব তাহলে। রাখি এখ । হে হে—'

ফোন পাশে রেখে পুনরায় ল্যাপটপে মনোযোগী হতে চাইল তন্ময়। পারল কই? বন্ধুর কথা মিথ্যে নয়। অরুকে দেখছে না চব্বিশঘণ্টা পেরুচ্ছে। এরজন্যেও বোধহয় তার হাঁসফাঁস লাগছে। অস্থির হয়ে আছে বুকের ভেতরটা। তৃষ্ণায় যেমন মানুষ ছটফট করে; ঠিক তেমন ভাবেই তার হৃদয় ছটফটিয়ে চলেছে। চোখজোড়া বুঁজে সিটে এলিয়ে দিলো মাথাটা। সে বাসায় বলেনি আজ ফিরছে। অরু আজ সন্ধ্যায়ও কল করে বারংবার শুধাচ্ছিল — কবে ফিরবে সে! আর কতদিন থাকবে! তন্ময় এড়িয়ে গিয়েছে প্রশ্নগুলো। ওকে সারপ্রাইজ করা যাবে বেশ।

–———

মোস্তফা সাহেব সংবাদপত্র পড়ছিলেন লিভিংরুমের সোফায় বসে। পাশেই আনোয়ার সাহেব বসে। টেলিভিশনে খবর দেখছেন। ওহী সাহেব ভাঙাচোরা রেডিয়োটা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখছেন। তন্ময় সেই মুহূর্তেই বাড়িতে প্রবেশ করল। ছেলেকে দেখে মোস্তফা সাহেব সংবাদপত্র ভাঁজ করে টি-টেবিলে রেখে দিলেন। গলা উঁচিয়ে ডাকেন স্ত্রীকে,

'এইযে তোমার রাজপুত্তর এসছে। খাবার বাড়ো।'

জবেদা বেগম রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ছেলেকে দেখেই চোখ ছোটোছোটো করে ফেলেন।
কণ্ঠে বিষাদ নিয়ে শুধান,

'দু'দিনে কেমন শুঁকিয়ে গেছিস, বাবা! ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করিসনি? ফ্রেশ হয়ে নিচে নাম। খাবার বাড়ছি আমি। আজ আসবি জানালে তোর পছন্দের কিছু রান্না করতাম।'

মোস্তফা সাহেব একমত হলেন। মাথা দোলালেন দু'বার ঘুরিয়েফিরিয়ে ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করে,

'সকালেও কল করলাম। জিজ্ঞেস করলাম– কবে ফিরবে! জবাব দিলো?'

তন্ময় দু'পাশে মাথা দুলিয়ে মৃদু হেসে সিঁড়ি ধরে। অরুটা কোথায়? কণ্ঠ শুনেও নিচে নামছে না যে? কী ব্যাপার? এই অবেলায় ঘুমাচ্ছে নাকি? ব্রিফক্যাস হাতেই দোতলায় ওঠে আসে। অরুর রুম বরাবর আসতেই এজমুহূর্তের জন্য থামে পাজোড়া। দরজা চাপানো। নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। এটা ঘুমানোর সময়? এখন ঘুমোবে পড়েপড়ে আর রাতে সজাগ থাকবে শেয়ালের মত। তন্ময় পদচারণের ধ্বনি তুলল বড়ো চালাকচতুর ভঙ্গিতে। তার পাশের রুমটির দরজাটাও শব্দ করেই খুলল। ততক্ষণাৎ অরুর রুমের চাপানো দরজাটা খুলে যায়। ফুলোফুলো ঘুম কাতুরে নয়নযুগল নিয়ে অরু হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসে। পায়ে জুতো নেই। এলোমেলো চুলগুলোর দুর্দশা হয়ে আছে। ওড়নার করুণ অবস্থা। তন্ময়কে দেখেই অবাক হয়ে চেয়ে রয়। পরপরই কী নিদারুণ আনন্দনীয় আশ্চর্যতা ঘিরে বসেছে ওর ওই চোখজোড়াতে! পাতলা ওষ্ঠেদ্বয়ে দীর্ঘ হাসির বিচরণ খেলে যায়,

'তখন প্রশ্ন করলাম—কখন ফিরবেন! উত্তর দিলেন না কেন?'
'আজই ফিরব তাই।'

অরু ঠোঁট ফোলাল। অভিমানী গলায় আওড়াল,

'আমি অপেক্ষায় ছিলাম তো।'

তন্ময় শুনল। কান শীতল অনুভব করল। অনুভূতির স্রোত বইল হৃদয় জুড়ে। শান্ত হলো বক্ষপিঞ্জরা। তৃষ্ণার্ত মন যেন জল পেলো মুহূর্তেই।
মরুভূমির মতন নিষ্প্রাণ, ছটফটিয়ে চলা হৃদয় বায়ুবাতাস পেয়ে শান্ত-স্থির হয়ে এলো। গভীর গলায় স্বতঃস্ফূর্ততা,

'অবসান ঘটালাম তো।'

অরু থামল না। চিন্তিত মুখে এগিয়ে এসে ক্লান্ত তন্ময়ের মুখমণ্ডল নিকট হতে দেখে প্রশ্ন করল,

'খুব টায়ার্ড লাগছে?'

তন্ময়ের কাঠখড়ি হৃদয় কথা বলতে জানলে এক্ষণ জবাব দিয়ে বসতো ঠিক এই বলে,

 'তোকে দেখতে পেয়েই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। একদম ম্যাজিকের মত। আচ্ছা, তুই কি ম্যাজিশিয়ান, অরু? আমার পার্সোনাল ম্যাজিশিয়ান। যাকে দেখলেই আমার সবরকম অসুখ দূর হয়ে যায়। যার কণ্ঠে সবরকম বিষাদ ভ্যানিশ হয়ে রয়। কী বিচিত্র আর আশ্চর্যজনক ব্যাপার তাই না?' 
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন