শূন্য আশ্রম
অনু গল্প
আয্যাহ সূচনা
“আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি
আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি”
আলোকিত, শান্ত এবং প্রাকৃতিক বাতাসে ভরে উঠেছে বাতাবরণ। গাছ গাছালির মধ্যে আশ্রমের অভ্যন্তরীণ স্থানগুলি আরামদায়ক এবং আনন্দময়,খানিকটা বিষাদ ঘেরা। বাগানের সুন্দর ফুলের গন্ধ, গাছপালা এবং বৃক্ষের ছায়া বসবাসরত মানুষের মনে শান্তি দিচ্ছে।গাছ গাছালিরা আজও অপেক্ষায়, সেই আশ্রমের সৌন্দর্যের রচয়িতার।আজও গাছের শাখা-পাতা শুভ্র, পাখির স্বরলাপ এক ভিন্ন প্রেমের গান গেয়ে উঠে।পরিবেশের রমণীয়তা, তার শান্তি এবং মনোহরে কি যেনো এক অনুভুতি আছে।সেই সুদৃশ্য ছবি এক ভিন্ন গল্প বলে।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যে নামছে। লাইব্রেরী ঘরটা সচরাচর এর ন্যায় গুমোট।আজ দুজন ভিন্ন চরিত্রের অবস্থান আছে।তূর্য মাহবুব বলে উঠলেন সামনে বসে বই পড়া মানুষটির উদ্দেশ্যে,
“আচ্ছা রুদ্র দা?আপনি প্যারানর্মাল একটিভিটিতে বিশ্বাস করেন?”
রুদ্র শংকর চোখ তুলে চাইলো।বললো, “প্যারানরমাল একটিভিটি সম্পর্কে আমার আর বিজ্ঞানের ধারণা দুটোই ভিন্ন।তুমি কোনটা শুনতে চাও?”
তূর্য বললো, “আমি বিজ্ঞানের ধারণা জানি।বিজ্ঞান লজিকে বিশ্বাসী।কিছুটা যান্ত্রিক।আপনি আপনার ধারণাটাই বলুন।”
“বিশ্বাস অবিশ্বাসটা সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।তবে আমার ধারণা মতে প্রতিটি মানুষের অন্ধবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।গভীর চিন্তা করা উচিত কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করার পূর্বে।যেটা আমি করি।”
“যদি সরাসরি জানতে চাই আপনি ভৌতিক বিষয়ে বিশ্বাসী কিনা?”
রুদ্র হেঁসে উঠলো।বইটা বন্ধ করে টেবিলে দুহাত মুঠ করে তূর্যর উদ্দেশ্যে বললো,
“পরিস্থিতিভেদে যদি বলো?তাহলে হ্যাঁ করি।তবে হ্যাঁ পূর্ণ নিরীক্ষণের পর।”
তূর্যকে অন্যমনস্ক দেখালো।শূন্যে চোখ তুলে ভাবছে আশ্রমের মানুষগুলোর বলা কথা সম্পর্কে।মাত্র তিনমাস হলো এই আশ্রমে সে দায়িত্বরত।দেখেছে বাচ্চাদের একাকী কথা বলতে,হাসতে।রাতের আঁধারে গীটারের ধ্বনি শোনা যায়।এক সুন্দর ঘ্রাণ ভাসে সন্ধ্যায়। সবই দেখছে বুঝছে। কাকতালীয় নয় এসব।এখানে ঘটনা ভিন্ন।
রুদ্র তূর্যর মুখটা দেখলো ভালোভাবে।ফের মৃদু হেসে বলে, “আশ্রমের মানুষ লিয়ানাকে দেখতে পায়,অনুভব করে।এই বিষয়ে ভাবছো?”
কিছু সময়ের জন্য বিস্মিত হলো তূর্য।এক দৃষ্টিতে চাইলো।পরক্ষণেই মনে পড়লো সেতো ভারী বিচক্ষণ মানুষ।ধরে ফেলাটাই স্বাভাবিক। আগ্রহী গলায় বলে উঠলো,
“আপনার মনে হয় না অতৃপ্ত আত্মা?”
এবার শব্দ করে হাসে।যেনো ব্যঙ্গ করলো তূর্যকে। রুদ্র বললো,
“আমি লিয়ানার কেস স্টাডি করেছি।জেনেছি তার ব্যপারে।মেয়েটা সত্যিই নিষ্ঠুর মৃত্যু পেয়েছে।তার সাথে যা হয়েছে তা একদমই ঠিক না।থাকতে পারে তার কিছু অতৃপ্তি।”
“এই কারণেই কি দেখা দেয় আশ্রমের পুরোনো মানুষগুলোকে?”
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে।পিঠ এলিয়ে দিলো চেয়ারের হাতলে।দুহাত বাঁধলো পেটের ঠিক উপরিভাগে।ডান দিকে চেয়ে বলতে লাগলো,
“কিছু মানুষ থাকে এমন।তাদের আমরা গুরুত্ব দেই না তেমন।কিন্তু তাদের বিয়োগ এমনভাবে আমাদের হৃদয়ে দাগ কাটে?মনে হয় গুরুত্ব না দিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছি। অপরাধবোধ কাজ করে।লিয়ানা জুড়ে ছিল এই আশ্রমের দেয়ালে দেয়ালে।কখনো লক্ষ্য করেছো কিনা জানি না কুকুর বিড়ালগুলো প্রায়শই ওর কাছে গিয়ে বসে থাকে।আমিও দেখেছি মানুষগুলোকে একাকী কথা বলতে।যদি একজন অথবা দুজন এমন পাগলামো করতো তাহলে ধরে নিতাম তারা হ্যালুসিনেট করছে।কিন্তু প্রায় অর্ধেক মানুষই এমন করছে?এটা ভাবনার বিষয়।প্রতিবার তাদের হেলথ ক্যাম্পে শারীরিক এর সাথে মানসিক অবস্থার দিকেও বিশেষ খেয়াল দেওয়া হয়।মানসিক রোগ তাদের মধ্যে কারোরই নেই।…..আর যদি বলে গীটারের আওয়াজ আর সুগন্ধের কথা।সেটা পনেরো দিন যাবত আমিও অনুভব করছি।”
মুখ ফুটে কথা বেরিয়ে জমিনে পড়ার পূর্বেই এক বাতাসে ঝাঁপটায় মাতোয়ারা ঘ্রাণ ভেসে এলো।ধাক্কা লাগলো তূর্যের ঘ্রণেন্দ্রিয়তে।বুকটা ধ্বক করে উঠলো।উত্তেজিত হয়ে তূর্য বলে উঠলো,
“দেখেছেন!দেখেছেন!”
রুদ্র হেঁসে জবাব দেয়, “সুঘ্রাণ দেখা যায় পাগল?তবে হ্যাঁ আমিও ঘ্রাণটা পাচ্ছি।”
“এবার?এবার বলুন?”
“কি বলবো?সুন্দর ঘ্রাণ। হেঁসে খেলে মানুষ এখানে জীবনযাপন করছে।কারো কোনো ক্ষতি হতে দেখেছো?”
তূর্য মাথা নাড়িয়ে বললো, “নাহ! তা অবশ্য কখনো দেখিনি।আশ্চর্যজনকভাবে কখনো ভয়ের অনুভূতিটাও হয়নি।”
রুদ্র খুব স্বাভাবিক।এমন নয় যে সে এসব কিছুই উপলব্ধি করেনি। গিয়েছিল লিয়ানার ঘরটাতে।কেমন যেনো শীতল নিস্তব্ধ।হালকা মনে হয় দেহ।হাওয়ায় মিশে মুগ্ধকারী ঘ্রাণ।কেমন অদ্ভুত একটা অনুভব হয় সেখানে। একি আসলেই কোনো ভৌতিক বিষয়?নাকি শুধুই অনুভূতি?অনুভূতি হবে কি করে?লিয়ানার সাথেতো ব্যক্তিগতভাবে তার কোনো পরিচয় ছিল না।আশ্রমের মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে তারা অনুভব করতে পারে ওই নারীটিকে।যে তাদের আগলে রেখেছিল।অনেকে খুব বিশ্বাস নিয়েই বলেছিলো ‘ সেকি আমাদের ছেড়ে গেছে?সে আছে এখনও।আপনাদের চোখ নষ্ট।তাই আপনারা দেখেন না’।কথা সত্য সে কখনও তাদের মতো করে দেখেনি লিয়ানাকে।তার কোনো ছবিও নেই।বড্ড অদ্ভুত! শুনেছিলো মুখে মুখে শেওলা পড়া সবুজ চোখের অধিকারিণী এক নারীর জীবন রহস্য।
ঘ্রাণটা এখনও বিরাজমান।লম্বা নিঃশ্বাস নেয় রুদ্র।তূর্য তার জবাবের অপেক্ষায় চেয়ে আছে।রুদ্র বললো,
“সবই খেলা অনুভূতির।কোনো অবাস্তবিক বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত ভাবলে সেটাকে সবকিছুর সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে মানুষ।….আর তারপরও যদি তোমার মনে হয় নাহ দিস অল আর প্যারানরমাল এক্টিভিটিস?দ্যান আমার কিছু বলার নেই।সেই ক্ষেত্রে তোমার মন রক্ষার জন্য বলবো।সে হয়তো শারীরিকভাবে নেই আত্মিকভাবে এখনও জুড়ে আছে এই আশ্রমের সাথে।অনুভব করো তাকে।তবে বাস্তব ভেবে বসে থেকো না। মস্তিষ্কে এই চিন্তাকে ভর করতে দেবে না।যদি সত্যিই এমন কিছু হয়ে থাকে?ভাবলেই সই না ভাবলে নেই!ব্যাস!আসি”
হাতের মুঠোয় একটা চিরকুট।সেখানে লাল কালিতে কিছু লেখা, “পৃথিবী আমাকে কি বলে আখ্যা দিবে?আমি হিংস্র ছিলাম?নাকি দরদী?.....আমিতো মানুষ খুন করেছি সাথে আমি মানুষকে বাঁচিয়েছি।আমার কোন গুণটা মনে রাখবে?”
আশ্রম থেকে বিদায় নেওয়ার পালা।রাতের আকাশে মেঘ জমেছে।ঝুম বৃষ্টি নামবে। অনুভুত হলো সে একা নয়।সঙ্গী আছে।টুংটাং গীটারের ধ্বনি আর এক মাতাল করা সুবাস।
“এখানেইতো সুখ ছিলো?
দেখো আজও দেয়ালে স্পর্শ মেখে আছে।
ভুলে যেতে চেয়েও পেরে উঠেনি।
অস্তিত্ব নেই,তবে অনুভব আছে।
প্রশ্ন ছিল, আমিও যদি কিছু পেতাম?
উত্তর আছে,স্বর্গসুখ আছে এই শূন্য আশ্রমে
আমি তৃপ্ত!”