অনিকের অসহায়ত্ব তৃষাকে আঘাত করছে হৃদয়ে। তৃষাও চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। হাতে হাত রাখল অনিক। তৃষা এগিয়ে গিয়ে দু'জনার মাথা ঠেকাল মাথায়।
" আমিও আপনাকে আঘাত করে কথা বলতে চাইনি। আমার মন মানসিকতা খারাপ থাকে। বিয়ের আগে যে আপনাকে পেয়েছিলাম,বিয়ের পরে সেই আপনাকে আমি পাচ্ছি না। সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ মনে হচ্ছে আমার। যেনো একের ভেতর দু'টি সত্তার বসবাস! "
অনিক চমকাল। মস্তিষ্কে একটা কথা বারবার আনাগোনা করতে লাগলো ❝ একের ভেতর দু'টি সত্তার বসবাস!❞ আসলেই কি তেমন কিছু? তার কি কোনো মানসিক রোগ হয়েছে? নিজেকে সামলে নিল লোকটা। আলতো করে নাকের ডগায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো তৃষার। তৃষার গাল বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। অনিক আলগোছে সেই পানিটুকু মুছে দিল।
" তৃষা আমি ডাক্তার দেখাবো। আমি সব রকমভাবে চেষ্টা করবো নিজেকে স্বাভাবিক রাখার। তুমি একটু ততদিন আমাকে সহ্য করে নাও লক্ষ্মী বউ আমার। "
" ঠিক আছে। আমিও চাই আমাদের একটা সুন্দর সংসার হোক। দু'জনের সুখের সংসার। তারজন্য আমি অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করবো।"
তৃষা নিজে থেকেই জড়িয়ে ধরলো অনিককে। অনিক তৃষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মাথার তালুতে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো।
সকালবেলা তড়িঘড়ি করে বাসার কাজকর্ম সব শেষ করে বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছে তাহমি। এমনিতে বাসে করে যায় তবে মাঝে মধ্যে আবার রিকশায় চড়েও যাওয়া হয়। আজকে অবশ্য বাসে উঠেছে। লোকাল বাসের হেলপার গুলোকে ভীষণ অসহ্য লাগে তাহমির। লাগার অবশ্য কারণ আছে। এই যে একটু আগে, ওভারব্রিজের নিচে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো তাহমি। বলার অপেক্ষা রাখে না বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। এরমধ্যে একসাথে দু'টো বাস থামলো। দু'জন হেলেপার সামনে এসে শুরু করলো প্যাসেঞ্জার নিয়ে কাড়াকাড়ি। একজন বলতেছে,
❝ আপা আমগো বাসে আহেন। এক্কেরে সামনে সিট আছে।❞
অন্য জন আবার বললো,
❝ আরে তোরা আর কী সিট দিবার পারবি? আফা এদিকে আইয়েন। একেবারে জানালার পাশে সিট দিয়ামনে। ফুরফুরা বাতাস খাইয়েন।❞
শেষমেশ বিরক্ত হয়ে তাহমি একটা বাসেও উঠেনি। পরের বাসে উঠে বসেছিল।
" আরে তাহমি না? কত বছর পরে দেখা হলো!"
হঠাৎ পুরুষালী আওয়াজে ভাবনার ছেদ ঘটলো তাহমির। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ তুলে তাকাল সেদিকে। এক পলকে চিনতে পারল লোকটাকে। তার কলেজের ক্লাসমেট ছিল অথবা বলা যায় তাহমির প্রথম প্রেম!
" হ্যাঁ। কেমন আছিস শ্রেয়ান?"
স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো তাহমি। শ্রেয়ান হাসলো একটু। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
" পাশের সিট তো খালি আগে না হয় বসি,তারপর কথা বলবো?"
তাহমি কিছুটা ইতস্ততভাবে বলে, " হ্যাঁ বস।"
শ্রেয়ান বসলো পাশের সিটে। তাহমি জানালার দিকের সিটে বসেছে।
" আছি আলহামদুলিল্লাহ। তোর খবর কী? বিয়েটিয়ে করেছিস নাকি?"
" আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কেন তুই কি বিয়ে না করে দেবদাস হয়ে বসে আছিস?"
" সেটা নয়। তবে বিয়ে করিনি এখনো। তোর তো বিয়ে করার কথা নয়। বিয়েশাদি তো বিশেষ পছন্দ ছিল না। "
চলন্ত বাস মাঝে মধ্যে থেমে আবারও চলছে। কখনো ঝাঁকি খাচ্ছে তো কখনো সমানভাবে চলছে। তাহমির অপ্রস্তুত লাগছে ভীষণ। কেনো লাগছে নিজে জানে না। যদিও সেরকম সিরিয়াস টাইপের রিলেশনশিপ ছিলো না শ্রেয়ানের সাথে। তবুও কিছু স্মৃতি তো আছেই। তবে সেসব নিছকই অতীত। অতীত বর্তমানে প্রভাব ফেলে।
" আমার বিয়ে হয়ে গেছে। সহনের সাথে। "
" কী!"
শ্রেয়ান ছোটখাটো একটা শক খেলো মনে হয়। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাহমির দিকে। তাহমি মৃদু হেসে বললো,
" হুম। শ্রেয়ান চলতি পথে অতীত আমাদের সামনে এসেই পড়ে। তাই বলে বর্তমানের সামনে অতীতকে প্রশ্রয় দিতে নেই। আমাদের সম্পর্ক এখন শুধু ক্লাসমেট ছিলাম। আমার সংসার আছে। তুইও বিয়ে করে নিবি আশা করি। "
" সত্যি বলতে আমি বিয়ে কেনো করিনি আমি নিজেও জানি না। ভেবেছিলাম হয়তো একদিন তোর সাথে দেখা হবে, আরেকবার সুযোগ চাইব। মিস হয়ে গেলো। শালা সহন মাঝখান থেকে গোল দিলো। যাগগে কংগ্রাচুলেশনস। "
" ধন্যবাদ দোস্ত। একদিন বাসায় আসিস তাহলে। আমার গন্তব্য এসে গেছে। "
বাস থামলো। হেলপার যাত্রীদের উদ্দেশ্য বারবার জায়গার নাম বলে যাচ্ছে, কেউ নামার থাকলে যেনো নেমে যায়।
" ঠিক আছে। বিয়ের কার্ড দিতে যাবো একেবারে। ভালো থাকিস।"
" সেইম টু ইউ। "
তাহমি বাস থেকে নামতেই জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টিপাত করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো শ্রেয়ান। সেদিন একটু সিরিয়াস হলে আজকে মানুষটা তার ঘরে থাকতো। এই আফসোস কখনো ঘুচবে না শ্রেয়ানের। তাহমি ছাড়া শ্রেয়ান ভালো নেই এমন না কিন্তু তাহমির শূণ্যতা আজীবন তার জীবনে থেকে যাবে। একজন গেলে একজন আসে ঠিক কিন্তু সেই চলে যাওয়া একজনের মতো আর হয় না দ্বিতীয় কেউ। প্রত্যেকটা মানুষের উপলব্ধি আলাদা।
আকাশে কালো মেঘ জমেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কালো রঙ করেছে কেউ। ঘনকাল মেঘেরা আর ঠান্ডা হাওয়া কালবৈশাখীর আভাস দিচ্ছে। এখন সময় দুপুরবেলা। রান্না ঘরের টুকটাক কাজ শেষ করে ফরিদা খান গোসল করতে ওয়াশরুমে ঢুকেছেন। আজকে শুক্রবার বলে তাহমি,সহনও আছে বাসায়। তাহমি দুপুরের খাবারগুলো ডাইনিং টেবিলে গুছিয়ে রেখে ছাদের দিকে এগোলো। বৃষ্টি হলে সব জামাকাপড় ভিজে একাকার হয়ে যাবে। ছাদের সিড়ি পর্যন্ত উঠতেই সহনের গলার আওয়াজ শুনতে পেলো সে। কারো সাথে ফোনে কথা বলছে সে। আবহাওয়া এমন তারমধ্য ছাদে বসে কেন থাকতে হবে? থাকবি যখন কাজ করে খাবি। তাহমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ছাদের উত্তর পাশের বেঞ্চির দিকে।
" ওকে মিস্টার শেখর আপনি আগামীকাল অফিসে আসুন। আমরা বাদবাকি কথা তখন না হ সেড়ে নিবো। "
সহনের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিল তাহমি। ফোন কাটতেই আলতো করে ঘাড়ে কামড়ে দিলো সে। সহন লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বড়ো বড়ো চোখ মেলে পেছনে তাকিয়ে দেখলো কীসো কামড়াল তাকে। তাহমির তো হেসে হেসে শেষ হওয়ার যোগাড় হয়েছে। লোকটা যে কতটা চমকে গেছে সেটা চোখের চাহনি দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পারছে তাহমি।
" তুই! এরকম কেউ করে? ধুর বেটা ভয় পেয়েছি।"
তাহমি সহনের দিকে এগিয়ে পায়ে পা রেখে গলা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
" কী ভেবেছিস ভ্যাম্পায়ার এসে কামড়ে দিলো? হাহাহা! "
সহন উত্তর দিলো না। দু'হাতে শক্ত করে তাহমির কোমর চেপে ধরলো। তাহমি শিহরিত হলো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো সহন। তাহমি সেদিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তাহমির ঠোঁটও নিজের জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে দিলো সহন। থেকে থেকে কেঁপে উঠল মেয়েটা। সহন থামল না তাতে। দীর্ঘদিনের দূরত্ব তাকে অধৈর্য করে তুলেছে। দু'জনের ভেজা ঠোঁট একত্র হলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। হঠাৎ মেঘের গর্জনে নড়েচড়ে উঠলো দু'জন। দু'জন দু'জনার দিকে তাকিয়ে দূরে সরে গেলো। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে।
" চল জামাকাপড় গুলো নিচে দিয়ে আসি। তারপর আবার আসবো ছাদে।"
কথাগুলো বলতে বলতেই দু'জন একসাথে সমস্ত জামাকাপড় হাতে নিতে শুরু করেছে। বৃষ্টি থেকে থেকে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিঁড়ির দিকে এগোলো দু'জন।
" আবার কেন?"
" ভিজবো দু'জন। "
তাহমি মুচকি হাসলো। সহনকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজেই সবগুলো জামাকাপড় ঘরে রেখো এলো চট করে। সহন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাহমি আসার অপেক্ষা করছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তাহমি এলো। সহন কিছু না বলে তাহমিকে কোলে তুলে নিয়ে ছাদের দিকে এগোচ্ছে। ছাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে দু'জনের গায়ে।
.
.
.
চলবে...........................